॥ পূর্ব প্রকাশিতের পর -৩৫ ॥
॥পর্ব ২॥
সৌন্দর্যের নেশায় স্বাস্থ্য নাশ
এ পর্বে থাকছে মেয়েদের জন্য সতর্কতামূলক কিছু বিষয়। খাবার ও ব্যায়াম সম্পর্কিত বিষয়াদিতে বিধি-নিষেধ নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য প্রায় একই। তবে কিছু বিষয় আছে যেগুলো নারীর একান্ত এবং যা অজান্তেই ধীরে ধীরে ক্ষতি করে চলেছে নারীর শরীর ও মন।
অধিকাংশ নারীই স্বাস্থ্য সচেতনতার চেয়ে সৌন্দর্য সচেতনতায় অধিক মনোনিবেশ করে থাকেন। নারীর এই সৌন্দর্য সচেতনতা কীভাবে তার স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হয় এবার সেই আলোচনা।
সুন্দর শরীরের নেশায়
নিজেকে শারীরিকভাবে অন্যের কাছে সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন হিসেবে উপস্থাপন করার ইচ্ছা সকলেরই থাকে। তবে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এ প্রবণতা প্রবল। কিশোরীদের অর্ধেক এবং কিশোরদের এক-তৃতীয়াংশ তাদের দেহের আকার-প্রকার নিয়ে ব্যাপক চিন্তা করে, ভাবনায় আচ্ছন্ন থাকে। সামাজিক জরিপে এ তথ্য জানা গেছে। এ গবেষণায় শারীরিক সৌন্দর্যবোধ সম্পর্কে ৮১০ কিশোর-কিশোরীর মতামত যাচাই-বাছাই করা হয়, যাদের বয়স ১১ থেকে ১৬ বছর।
গবেষণায় দেখা গেছে, বালকদের ১০ জনের ১ জন তার শরীরকে মেদহীন ও পেশিবহুল করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। এটি তাদের কাছে নেশার মতো হয়ে যায়। অন্যদিকে বালিকাদের ৮ জনে ১ জন শরীরকে সিøম এবং আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য নানা ঔষধ ও পথ্য গ্রহণ করে থাকে। শরীর নিয়ে চিন্তায় আচ্ছন্ন এ বালক-বালিকারা খাদ্যভীতিতে আক্রান্ত হচ্ছে।
গবেষণায় আরও জানা গেছে, কিশোর-কিশোরীদের শতকরা ৫০ ভাগেরও বেশি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে মডেল ও নায়ক-নায়িকাদের শরীর দেখে মুগ্ধ হয়। এরপর তারা নিজ শরীরকে পছন্দের সেলিব্রেটির মতো করার চেষ্টা চালাতে থাকে। এ চেষ্টার মধ্যে রয়েছে ডায়েটিং, ব্যায়াম, হেলথ ক্লাবের সদস্য হওয়া, নিয়মিত জিমে যাওয়া প্রভৃতি। তাদের ৪ ভাগের ১ ভাগ কাক্সিক্ষত দেহ-বৈশিষ্ট্য অর্জনের জন্য শরীরে কসমেটিক সার্জারি করায়।
লন্ডনে ওয়াইএমসিএ’র প্রধান নির্বাহী রোজি প্রেসকট এ ব্যাপারে বলেন কারো শরীরের গড়ন ও আকার-প্রকার অন্যকারো মতো হয় না। কিন্তু কিশোর-কিশোরীরা তাদের আইকন বা রোল মডেলের মতো শারীরিক অবয়ব অর্জনের জন্য যেভাবে পাগলের মতো উঠেপড়ে লাগে, এতে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে; পড়ালেখাসহ দৈনন্দিন ও স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয় এবং বিভ্রান্তি ও হতাশার রাহুগ্রস্তে নিক্ষিপ্ত হয়ে জীবন চলার পথও হয় কন্টকিত।
তাই শারীরিক তথা বাহ্যিকভাবে স্রষ্টা যাকে যেভাবেই তৈরি করুন না কেন, বিধাতার সেই বিধিতে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। স্রষ্টার উদার দানকে হেলাফেলা ও নেতিবাচকতায় না নিয়ে সেসবকে স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক ও প্রকৃত রেখে বরং তাঁর দেয়া মস্তিষ্ক ও মননের উৎকর্ষ চর্চায় সর্বক্ষণ লেগে থাকলে পছন্দের সেলিব্রেটিদের চেয়েও বহুগুণে গুণান্বিত তথা উন্নততর সফল মানুষ হবার সৌভাগ্যলাভ কঠিন কিছু নয়।
লিপস্টিকে বুদ্ধি নাশ
সৌন্দর্য সচেতন নারীরা নিজেদের আকর্ষণীয় করে তুলতে কত কিছুই না করে। পরিমিত খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত রূপচর্চা, এমনকি ব্যায়ামও করে কেউ কেউ। কিন্তু সাজগোজের অপরিহার্য উপাদান যে লিপস্টিক, সেটির মান নিয়ে খেয়াল করে না তেমন।
এরূপ নারীদের জন্য এবার সতর্কবাণী জানাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্ডাররাইটারস ল্যাবরেটরিজ। ২২টি ব্র্যান্ডের লিপস্টিকের মান পরীক্ষা করে তারা জানায় বেশিরভাগ লিপস্টিকেই সীসা ব্যবহার করা হয়; যা মানুষের বুদ্ধিমত্তা, নতুন কিছু শেখার ক্ষমতা ও আচরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাছাড়া সীসা মানুষের শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ।
চুলের রংয়ের রাসায়নিকে ক্যান্সার
চুলে বাহারী রং করানো মানুষের সংখ্যা কম নয়। তবে পুরুষের চেয়ে নারীরা এক্ষেত্রেও এগিয়ে। অথচ যারা চুলে রং করায় তারা জানে না যে এতে ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা কত বেশি। কেননা, হেয়ার ডাই বা চুল রং করার উপকরণে ব্যবহৃত রাসায়নিকের সঙ্গে ক্যান্সারের যোগসূত্র রয়েছে।
যুক্তরাজ্যের লিডস শহরে গ্রিন কেমিক্যালস নামক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে এ তথ্য পেয়েছেন। তারা বলছেন, হেয়ার ডাইয়ের রাসায়নিকের কারণে নারীরা সমূহ স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে থাকে। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেন হেয়ার ডাইয়ের রাসায়নিক মানুষের চামড়া বা চুলে কয়েক সপ্তাহ, মাস, এমনকি বছর পর্যন্ত থাকতে পারে। এছাড়া যাদের ধূমপানের অভ্যাস আছে, তাদের জন্যও এই রাসায়নিক বিপদের কারণ হতে পারে। তাদের শরীরে এন-নাইট্রোস্যামিনস নামে এক ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিকের সৃষ্টি হতে পারে, যা দূরারোগ্য ক্যান্সারে রূপ নেয়।
নকল পাপড়ি থেকে সাবধান
চোখ যে মনের কথা বলে...; সেই চোখের শোভাবর্ধনে এখন শুরু হয়েছে আসল পাপড়ির ওপর আরেক সারিতে নকল পাপড়ি পরা। তাও আবার লাল-নীল নানাবর্ণে চিত্রিত। কিন্তু সাবধান, সাময়িক সৌন্দর্য বাড়ালেও নকল পাপড়ি গিলে খেতে পারে আপনার আসল পাপড়িকে এমনই বলছেন চুল ও ত্বক বিশেষজ্ঞরা।
ইংলিশ পপ সিঙ্গার শেরিল কোল এর মতো সেলিব্রেটিদের দেখে অনেক নারীই ইদানীং নকল পাপড়ির দিকে ঝুঁকছেন। যুক্তরাজ্যের চুল পুনঃস্থাপন সার্জন ডাঃ বিসাম ফারজো বলেন এমন অনেক রোগীর চিকিৎসা তিনি করেছেন, যারা নকল পাপড়ি পরে আসলটিকে ধ্বংস করে ফেলেছে। তিনি বলেন কেউ যদি দীর্ঘক্ষণ নকল পাপড়ি পরে থাকে বা সঠিকভাবে সেগুলো না তুলে ফেলে, তবে ক্ষতির আশঙ্কা বেশি। অনেক সময় নকল পাপড়ি তুলতে গিয়ে আসল পাপড়িও উঠে যায়। তাছাড়া নকল পাপড়ি লাগানোর আঠা আপনার চোখের পাতায় জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করতে পারে।
চোখ মানুষের মহামূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। প্রাকৃতিকতার সাথে কৃত্রিমতার সমন্বয়-সম্পর্ক হয়ই না, যেমনি জল ও তেল একত্রে মেশে না। তাই চোখে কৃত্রিম পাপড়ি লাগানো বা তোলার মতো এরূপ বা অনুরূপ সকল কৃত্রিমতার চর্চা বাদ দিয়ে সর্বক্ষেত্রে প্রাকৃতিক হোন, সুস্থ-সবল ও দীর্ঘায়ুলাভ করুন।
মেকআপ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর
মেকআপ নিয়ে দীর্ঘদিন তারুণ্য ধরে রাখার চেষ্টা কমবেশি সব নারীই করে। নিজেকে সুন্দর ও আকর্ষণীয় করতে মেকআপের বিকল্প নেই। কিন্তু এটি অনেকেরই অজানা যে, মেকআপ সাময়িক সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি নারীদেহে ক্ষতিকর প্রভাবও ফেলে। মেকআপে ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থ দেহে অনেক রোগ তৈরি করে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, অনেক মেকআপ-সামগ্রী বিতর্কিত সিনথেটিক বা কৃত্রিম উপাদান দিয়ে তৈরি। নিয়মিত এসব সামগ্রী ব্যবহার করলে স্তন ক্যান্সার, হরমোনে সমস্যা, গর্ভধারণে জটিলতা, এজমা, এলার্জি, ডায়াবেটিস এমনকি মেকআপকারীর সন্তান নানা ধরনের সমস্যা নিয়ে জন্ম নিতে পারে।
ব্রিটিশ লেখক ও গবেষক ডন মেলোশীপ বলেন আমাদের ত্বকে অভেদ্য দেয়াল নেই। ফলে আমরা যা গায়ে মাখি, সেটি শোষণ করে নেয় ত্বক। এর একটি বিশাল অংশ দেহে প্রবেশ করে এবং ক্ষতির কারণ হয়।
ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির গবেষকরা জানিয়েছেন মেকআপে রয়েছে এমন রাসায়নিক উপাদান, যা মেয়েদের প্রজনন স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। থ্যালেটস নামের এই রাসায়নিক পদার্থের কারণে নির্ধারিত সময়ের প্রায় দুই-আড়াই বছর আগে নারীর মেনোপজ বা ঋতুস্রাব বন্ধ হতে পারে। তাছাড়া থ্যালেটস উপাদানের কারণে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস ও স্থুলতার ঝুঁকিও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গবেষকরা জানান আপাতদৃষ্টিতে আগাম মেনোপজকে তেমন কোনো রোগ মনে না হলেও এর কারণে নারীদের স্ট্রোক, হৃদরোগ, হাড়ের সমস্যা ও ব্রেন-হেমারেজের মতো মারাত্মক সব রোগের ঝুঁকি ভয়াবহ হারে বেড়ে যায়। তাই সুস্থভাবে বাঁচতে হলে মেকআপকে অবশ্যই না বলতে হবে।
শাড়িতেও হতে পারে ক্যান্সার
যারা নিয়মিত কিংবা প্রায়ই শাড়ি পরেন, তাদের জন্য পরামর্শ হচ্ছে প্রতিবার শাড়ি পরার সময় পেটিকোটের ফিতা নতুন স্থানে রেখে গিঁট বাঁধুন। আগেরবার যে স্থানে বেঁধেছিলেন, সেখানে পরবেন না। কারণ এর মাধ্যমে এক ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি থেকে বাঁচতে পারেন। ভারতের চিকিৎসকরা তেমনটিই বলছেন। তারা বলছেন, বছরের পর বছর একই স্থানে শাড়ির গিঁট বাঁধা নারী স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি নিয়ে আসছে। তারা এ সমস্যার নাম দিয়েছেন শাড়ি ক্যান্সার।
শাড়ি ক্যান্সার নিয়ে গবেষণা করছেন মুম্বাইয়ের গ্র্যান্ড মেডিক্যাল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক জি ডি বকশী। তিনি জানান, শাড়ি পরা হয় পেটিকোটের ওপর। পেটিকোট সাধারণত সরু ফিতা দিয়ে বাঁধা হয়। এর ওপর পড়ে শাড়ির গিঁট। দীর্ঘদিন ধরে একইভাবে পরার ফলে কোমরের ছোট একটি জায়গার ওপর ব্যাপক চাপ পড়ে এবং ত্বক স্বাভাবিক রং হারাতে থাকে। এভাবেই একসময় দেখা দেয় শাড়ি ক্যান্সার।
শাড়ির ক্ষেত্রে এ ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিলেও প্যান্ট কিংবা বেল্ট পরলে তা হয় না কেন, জানতে চাইলে বকশী বলেন প্যান্টের ক্ষেত্রে বেল্টের প্রস্থ বেশি থাকে বলে কোমরের বড় অংশজুড়ে চাপ ভাগ হয়ে যায়।
শাড়ি পরুয়াদের তাই গিঁট খুব টাইট না করতে এবং রশির প্রস্থ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। তারা বলছেন অভ্যাস বদলালেই যেহেতু ঝুঁকি এড়ানো যায়, তাই সহজেই এ ধরনের স্বাস্থ্যসমস্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
সুগন্ধিতে ক্যান্সারের ঝুঁকি
যানবাহন ও কলকারখানার ধোঁয়া বা দূষণ থেকে ক্যান্সারসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয় মানুষ। কিন্তু প্রিয় সুগন্ধির মধ্যেও যে ঐ ঝুঁকি রয়েছে, তা অনেকেরই অজানা।
যারা শুকনো জামাকাপড়ে নিয়মিত পারফিউম বা সুগন্ধি ব্যবহার করেন, তাদের জন্য দুঃসংবাদ হলো এসব পণ্য ব্যবহারের ফলে মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্তের ঝুঁকি রয়েছে। এমনকি জামাকাপড় ধোয়ার ক্ষেত্রে সুগন্ধি তরল ডিটারজেন্ট ব্যবহারের ক্ষেত্রেও রয়েছে এই ঝুঁকি।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির গবেষকগণ বলেছেন জামাকাপড়ে ব্যবহৃত সুগন্ধিতে এমন কিছু রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে, যেগুলো ক্যান্সার তৈরির ক্ষেত্রে সহায়ক। সুগন্ধি যখন জামাকাপড়ে ব্যবহার করা হয়, তখন সেখানকার বাতাসে বিভিন্ন রাসায়নিকের চক্র ছড়ায়। আর ঐ বাতাস দেহে ঢুকে ক্যান্সার, মাথাব্যথা, হাঁপানিসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ সংক্রমণের আশঙ্কা তৈরি করে। বাতাসে পাওয়া ঐ রাসায়নিক মিশ্রণের চক্র পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এতে ২৫ ধরনের ভলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ড রয়েছে; যার সঙ্গে রয়েছে ৭ ধরনের বায়ু দূষণের উপাদান। এছাড়া ঐ বাতাসে এসিটালডিহাইড ও বেনজিন নামক দু’ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিকের উপস্থিতি নির্ণয় করেছে ক্যান্সারের কারণ অনুসন্ধানী যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সংরণ সংস্থা।
চলবে।