এবার শুরু হয়েছে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোর এমবিবিএস কোর্সে প্রথম বর্ষের ভর্তি কার্যক্রম। সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোর ৩ হাজার ৩১৮টি আসনে ইতোমধ্যে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। এবার ভর্তি পরীক্ষায় পাস নম্বর ৪০ বা তার বেশি পেয়ে ৪১ হাজার ১৩২ জন শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছে। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোর মোট ৬ হাজার ২৫টি আসনের জন্য লড়বেন ভর্তি পরীক্ষায় ন্যূনতম পাস নম্বরপ্রাপ্ত প্রায় ৩৮ হাজার শিক্ষার্থী। ভর্তি পরীক্ষায় ন্যূনতম পাস নম্বর পেয়ে কোন মেডিক্যাল কলেজেই ভর্তি হতে পারবেন প্রায় ৩২ হাজার শিক্ষার্থী। এবারও ভর্তি পরীক্ষায় ভাল ফল পেয়েও উচ্চ ভর্তি ফি’র কারণে অনেক দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থী কলেজে ভর্তি হতে পারবেন না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। সরকার নির্ধারিত ফি অনুযায়ী বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ থেকে একজন শিক্ষার্থীর এমবিবিএস ডিগ্রি সম্পন্ন করতে মোট খরচ হবে ১৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা। এই ফি যোগান দেয়াটাই অনেক শিক্ষার্থীর নাগালের বাইরে। তার মধ্যে সরকারি নির্ধারিত এই ফি মেনে চলে না অধিকাংশ বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ। একজন শিক্ষার্থীর এমবিবিএস কোর্স সম্পন্ন করতে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা লাগে বলে অভিযোগ করেছেন মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা। পাশাপাশি দেশের অধিকাংশ বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা ও জনশক্তি উন্নয়ন) অধ্যাপক ডাঃ মোঃ আব্দুর রশিদ জানান, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ভর্তি হতে আবেদনপত্র জমা দেয়ার শেষ তারিখ নির্ধারিত হয়েছে ১২ ডিসেম্বর। প্রাপ্ত সকল আবেদনের কোটাভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা হবে ১১ ডিসেম্বর। ছাত্রছাত্রী ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু ১৩ ডিসেম্বর এবং শেষ হবে ২০১৮ সালের ৭ জানুয়ারি । ক্লাস শুরু হবে ২০১৮ সালের ১০ জানুয়ারি। সরকারি ৩১ মেডিক্যাল কলেজে ৩ হাজার ৩১৮টি এবং বেসরকারি ৬৯ মেডিক্যাল কলেজে ৬ হাজার ২৫টি আসনে শিক্ষার্থীরা ভর্তির সুযোগ পাবেন। কঠোর নিরাপত্তা ও নজদারির মধ্য দিয়ে গত ৬ অক্টোবর মেডিক্যাল কলেজগুলোয় চলতি শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস কোর্সের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
সরকারিভাবে ফি নির্ধারণ
দীর্ঘ সমালোচনা ও আলোচনার পর বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ভর্তি ফি নির্ধারণ করে দেয় সরকার। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে এক প্রজ্ঞাপনও জারি করে। বেসরকারি মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজগুলোর নিজেদের ইচ্ছামতো বাড়তি অর্থগ্রহণ ঠেকাতেই এ উদ্যোগ নেয়া হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত ওই প্রজ্ঞাপনে জানা যায়, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলো ভর্তি ফি বাবদ ১৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা নিতে পারবে। ইন্টার্ন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এ ছাড়া পাঁচবছরে মোট টিউশন ফি বাবদ ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকার বেশি গ্রহণ করতে পারবে না। সরকারের পক্ষ থেকে ফি নির্ধারণ করে দেয়ার ফলে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ থেকে একজন শিক্ষার্থীর এমবিবিএস ডিগ্রি সম্পন্ন করতে মোট খরচ হবে ১৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা। তবে ইন্টার্ন ফি বাবদ কলেজ কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে যে টাকা গ্রহণ করবে পরবর্তীতে ইন্টার্নশিপ করার সময় তার লভ্যাংশসহ ফেরত দেবে। অথচ সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি ফি মাত্র ১২ হাজার টাকা (তিন মাসের টিউশন ফিসহ)।
নির্ধারিত ফি’র দ্বিগুণ খরচ
এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই প্রতি বছরের মতো এবারও ভর্তি ফি’র বিষয়টি আলোচনায় চলে এসেছে। গত বছর প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে শুধু ভর্তি ফি ১৪ লাখ ২০ লাখ টাকা নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। আর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির অনেক কলেজে ভর্তির সুযোগ পেতে অনানুষ্ঠানিকভাবে অনেক শিক্ষার্থীকে দিতে হয়েছে বাড়তি টাকা। যা কাগজে-কলমে লিখিত থাকে না। প্রথম শ্রেণির মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেতে অনেক শিক্ষার্থী গোপনে মোটা অঙ্কের টাকা দেয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। ভর্তি পরীক্ষার পাশাপাশি ভর্তি ফি নিয়ে এবারও আতঙ্ক প্রকাশ করেছেন অনেক মেডিক্যাল ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবক। গত সেশনের অভিজ্ঞতা তাদের বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোর নিজেদের মতো করে বাড়তি ভর্তি ও কোর্স ফি আদায় করে আসছে । দীর্ঘদিন ধরে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোর বিরুদ্ধে শিক্ষার নামে বাণিজ্য বসানোর অভিযোগ উঠে আসছে । বিগত শিক্ষাবর্ষে ভর্তি ফি, উন্নয়ন ব্যয়, বিধিসহ নামী-বেনামী অনেক খাতের অজুহাত দেখিয়ে চড়া ফি আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। ওই সব প্রতিষ্ঠানের ভর্তি বাণিজ্যসহ নানা নিয়মের বিষয়টি দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মেধাবী শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বেশ ভাবিয়ে তুলেছে।
এ বিষয়ে বিএমএ’র সাবেক সভাপতি এবং ডক্টরস ফর হেলথ এ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট এর সভাপতি রশিদী-ই মাহবুব। তিনি জানান, সদিচ্ছা থাকলেই সহনশীল ভর্তি ফি নির্ধারণ করতে পারে সরকার। যত তাড়াতাড়ি বৈষম্য দূরীকরণে সরকারি হস্তক্ষেপ দরকার। আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়টি সুরাহা হতে পারে বলে মনে করেন তিনি। বাংলাদেশে এখনও ভর্তি ফি কম নেয়া হয় বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিক্যাল প্র্যাকটিশনারস এ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডাঃ জামাল উদ্দিন চৌধুরী। তিনি বলেন, মেডিক্যাল কলেজ পরিচালনা করা কোনভাবেই লাভজনক নয় বলে এ সেক্টরে বড় বড় ব্যবসায়ীর মুখ দেখা যায় না। জনকল্যাণমূলক উদ্দেশ্যেই মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়ে থাকে। তাই ব্যবসায়িক কারণে নয়, প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্যই তা করতে হয়। প্রতিষ্ঠান চালানোর চাহিদা ছাড়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোন বাড়তি টাকা নেয়া হয় না বলে জানিয়েছে বেসরকারি কলেজের কর্তৃপক্ষরা। পার্শবর্তী দেশ ভারতে ভর্তি ফি হিসেবে ৩০ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়ে থাকে বলে জানান মহাসচিব ডাঃ জামাল উদ্দিন চৌধুরী।
তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত জানান, একটি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করা খুবই ব্যয়বহুল। ভারতে প্রথম শ্রেণির কয়েকটি কলেজে ভর্তি ফি হিসেবে শিক্ষার্থী প্রতি এক কোটি টাকাও নেয়া হয়ে থাকে বলে তিনি দাবি করেন।