১৯৮৪ সালের জুলাই মাসে ফ্রান্সে অশ্ববিহীন শকটের উদীয়মান প্রযুক্তির গাড়ির এক প্রতিযোগিতা হয়েছিল। প্যারিস থেকে রুয়েন পর্যন্ত ৭৯ মাইল দূরত্ব পাড়ি দেয়ার এই প্রতিযোগিতায় ২১ ধরনের গাড়ি অংশ নিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত টিকেছিল ১৭টি এবং গোতলিয়ের ডেইমলারের উদ্ভাবিত কমবাস্টন ইঞ্জিনচালিত গাড়িটি প্রথম হয়েছিল। সেই থেকে অটোমোবাইল যুগের যাত্রা শুরু হয়। পেট্রলচালিত মোটরগাড়ি বিংশ শতাব্দীতে যানবাহনের মধ্যে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে।
এখন এক নতুন ধরনের গাড়ি রাস্তায় নেমেছে। তাহলো কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত স্বয়ংচালিত গাড়ি। লোকে নিশ্চিত হতে পারছে না এ নিয়ে কি করবে। রাস্তার অন্যান্য যানবাহনের সঙ্গেই বা এটা চলবে কি করে। এটা কি আমাদের যাতায়াতের ধারাকে পাল্টে দেবে? স্বয়ংচালিত গাড়ি বা এভিএস নিয়ে এই প্রশ্নগুলো উঠছে। প্রথম যখন মোটরগাড়ি রাস্তায় নেমেছিল তখনও এই প্রশ্নগুলো উঠেছিল।
স্বয়ংচালিত গাড়িগুলো এখনও মানুষের তত্ত্বাবধান ছাড়া চলবার জন্য ঠিক প্রস্তুত নয়। কিন্তু তারপরও সাম্প্রতিককালে এ ব্যাপারে দ্রুত অগ্রগতি হয়েছে। এখন এগুলোকে আমেরিকার বেশ কিছু নগরীর রাস্তায় দেখতে পাওয়া যায়। ছাদের ওপর বসানো এক গুচ্ছ সেন্সর দেখে এগুলো সহজে চিনতে পারা যায়। উবারের রোবোট্যাক্সি পিটসবার্গ ও ফিনিক্সে যাত্রীদের আনা-নেয়া করে। গুগলের স্বয়ংচালিত কার ইউনিট এখন এলফাবেট পরিবারের পৃথক ইউনিট। এটি চালকের আসনে সেফটি ইঞ্জিনিয়ার ছাড়াই ফিনিক্সের একটি শহরতলীতে স্বচালিত মিনিভ্যান চালাচ্ছে। এ বছর থেকে এই কোম্পানি বাণিজ্যিকভাবে উবারের মতো ‘রাইড হেইলিং’ সার্ভিস চালু করবে। আমেরিকার সর্ববৃহৎ গাড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানি জেনারেল মোটরস ২০১৯ সালে রোবোট্যাক্সি সার্ভিস চালু করবে। এতে স্টিয়ারিং হুইল বা প্যাডেল কিছুই থাকবে না। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও চালকহীন স্বচালিত গাড়ি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, ব্যবসায় কেন্দ্রে কিংবা বিশেষ বাস লেন দিয়ে যাত্রী আনা-নেয়া করছে। সহসাই যেন সবাইকে চালকহীন গাড়ির হুজুগে পেয়ে বসেছে। কম্পিউটার ভিশন এবং অন্যান্য মেশিন লার্নিং ব্যবস্থার অগ্রগতি তার একটা কারণ। চিপ প্রস্তুতকারক থেকে শুরু করে সফটওয়্যার ফার্ম পর্যন্ত টেক জগতের সবাই যেন স্বয়ংচালিত গাড়িকে (এভিএস) তাদের পণ্যের জন্য এক আকর্ষণীয় নতুন বাজার হিসাবে পেয়ে গেছে। স্বচালিত গাড়ি বেশ কিছু সেন্সরের সমন্বয়ে গোটা পরিপার্শ্বকে দেখতে পায়। এগুলোর মধ্যে আছে ক্যামেরা, রাডার ও লাইডার। শেষেরটি হলো রাডারের মতো একটি কৌশল যা আলোর অদৃশ্য স্পন্দনকে কাজে লাগিয়ে চারপাশের এলাকার এক হাই-রিজোলিউশন থ্রি-ডি ম্যাপ তৈরি করে। এই তিনটি একে অপরের পরিপূরক হিসেবেও কাজ করে। ক্যামেরাগুলো সস্তা এবং সেগুলো রাস্তার মার্কিংগুলো দেখতে পায় কিন্তু দূরত্ব পরিমাপ করতে পারে না। রাডার দূরত্ব ও গতি পরিমাপ করতে পারে কিন্তু সূক্ষ্ম খুঁটিনাটি বিষয় দেখতে পারে না। লাইডার সূক্ষ্ম খুঁটিনাটি বিষয় দেখতে পায় তবে তা খুব ব্যয়বহুল এবং তুষারে সবকিছু গুলিয়ে ফেলে। স্বচালিত গাড়ির নিরাপত্তা ও নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করার জন্য সেন্সরগুলোর সমন্বয় থাকা প্রয়োজন।
সেন্সরগুলোর কাছ থেকে প্রাপ্ত ডেটা একত্র করে গাড়িকে তার চারপাশের জিনিসগুলো শনাক্ত করতে হয় যেমন অন্যান্য যানবাহন, পথচারী, সাইকেল আরোহী, রাস্তার মার্কিং, রোড সাইন ইত্যাদি। এ কাজে মানুষ অবশ্য মেশিনের চেয়ে অনেক ভাল। মেশিনের সযতেœ লেবেল আটা অসংখ্য দৃষ্টান্ত দিয়ে ট্রেনিং দিতে হয়। শনাক্ত করার কঠিনতম জিনিসগুলো হচ্ছে সেগুলো যা কদাচিৎ দেখা যায়। যেমন রাস্তায় আবর্জনা কিংবা হাইওয়ে থেকে উড়ে আসা প্লাস্টিকের ব্যাগ। বিভিন্ন সেন্সর থেকে প্রাপ্ত ডেটা একত্রিত ও বিশ্লেষণ করে স্বচালিত গাড়ি নামতে পারে রাস্তার বস্তুটি কঠিন কোনো বস্তুও বাধা কি না। একই রাস্তায় চলা অন্যান্য গাড়ির ইতোপূর্বে সংগৃহীত সেন্সর রিডিং তুলনা করেও গাড়িগুলো পরস্পরের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে পারে সেটাকে বলা হয় ফ্লিট লার্নিং।
চারপাশের সবকিছু শনাক্ত করা হয়ে গেলে গাড়ির প্রয়োজন আগামী কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কি ঘটতে যাচ্ছে তার পূর্বাভাস দেয়া এবং তাতে কিভাবে সাড়া দিতে হবে সেই সিদ্ধান্ত নেয়া। মানব চালক রাস্তার স্বাভাবিক ট্রাফিকের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটনাগুলো যেমন রাস্তায় কাজ হচ্ছে, কোনো গাড়ি ভেঙে গেছে। ডেলিভারী ট্রাক অথবা জরুরি বাহন যাচ্ছে, গাছ পড়ে আছে কিংবা খারাপ আবহাওয়া চলছে এই বিষয়গুলো মোকাবেলায় অভ্যস্ত। কিন্তু এভিএস এর পক্ষে এখনও এগুলোর মোকাবেলা অসুবিধাজনক। প্রযুক্তি আরও উন্নত হলে অবশ্য এগুলো মোকাবেলায় সমস্যা হবে না।
কোন স্বচালিত যান বিভ্রান্ত হয়ে গেলে এবং কি করতে হবে জানতে বা বুঝতে না পারলে অথবা ভুল সিদ্ধান্ত নিলে ড্রাইভিং সিটে বসা সেফটি ইঞ্জিনিয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করে। স্বচালিত গাড়ি এখন পরীক্ষামূলকভাবে কিংবা সীমিত পরিসরে চলছে। তবে যখন আরও ব্যাপক পরিসরে চালু করা হবে তখনও সম্ভবত সেগুলোর কিছু সময়ের জন্য মানুষের সাহায্য চাওয়ার প্রয়োজন হবে। যেমন ধরুন, এমন একটি গাড়ি দুই লেনের রাস্তায় একটি বিকল হয়ে থাকা ট্রাকের পিছনে আটকে গেল। যেহেতু গাড়িটি রোড মার্কিং মেনে চলার জন্য প্রোগ্রাম করা তাই ওটি পেছনেই আটকা পড়ে থাকবে। মানব চালক হলে কি করবে? সে রাস্তা ফাঁকা থাকলে সে সোজা নিয়ম ভেঙ্গে গাড়িটি ট্রাকের পাস দিয়ে কাটিয়ে নিয়ে চলে যাবে। খরচ অত্যধিক থাকায় এই গাড়িগুলো প্রথমে রোবোট্যাক্সি হিসেবে কাজ করবে। এগুলোকে রাইড-হেইলিং এ্যাপ ব্যবহার করে ডাকা হবে। এভাবে সেগুলো অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। তাদের খরচের পরিমাণও কমবে। নিজের গাড়ি থাকলে প্রতি মাইল যেতে যে খরচ পড়বে এই ব্যবস্থায় খরচ পড়বে তার চেয়েও কম। এতে করে অন্তত শহরবাসীর জন্য নিজেদের গাড়ি রাখার প্রয়োজন কমে আসবে। ইউএসবি নামে একটি ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০৫০ সাল নাগাদ নগরবাসীর গাড়ির মালিকানা ৭০ শতাংশ হ্রাস পাবে। আজকের গাড়িগুলো ৯৫ শতাংশ সময় অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকে। তাই নিজেদের গাড়ি বাদ দিয়ে রোবোট্যাক্সির ব্যাপক ব্যবহার হলে শহরের যে জমি পার্কিংয়ের কাজে অপচয় হয় সেগুলো অন্য কাজে ব্যবহার করা যাবে।
স্বচালিত গাড়িতে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমে আসবে। বৈদ্যুতিক গাড়ি বলেই এগুলো থেকে কার্বন ডাই অক্সাইডের নির্গমন হবে খুবই কম এবং এদিক দিয়ে এগুলো হবে পরিবেশবান্ধব।