॥ পূর্ব প্রকাশিতের পর -৫৩ ॥
১০। নীতি-আদর্শ ও ধর্মকর্ম পালনের মাধ্যমে উন্নততর মানুষ হওয়ার উপায়
ন্যায়-নীতি ও আদর্শ রক্ষা এবং ধর্মকর্ম পালন উন্নততর মানুষের বৈশিষ্ট্য। ন্যায় ও বিজ্ঞানের দর্শনে নীতি ও আদর্শের চর্চা মানুষকে উৎকর্ষের দিকে নিয়ে যায়; যেকোনো ক্ষেত্রে সফল হওয়ার পথকে সুগম করে তোলে। তাছাড়া নৈতিক চরিত্র গঠনেও ধর্মকর্মের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেবল নৈতিকতার জন্যই নয়, দেহ-মনে স্বস্তি (ঐধৎসড়হু রহ নড়ফু ্ সরহফ), আত্মার প্রশান্তি, মনের পবিত্রতা, সৌন্দর্যচর্চা ও সুস্বাস্থ্য লালনে ধর্মকর্মের রয়েছে বিরাট ভূমিকা। প্রকৃতপক্ষে শরম ও ধরম ছাড়া মানুষের মধ্যে ভালোত্বের আশা করা বৃথা।
ধর্ম মানুষের কল্যাণে স্রষ্টার বিধি-বিধান। ধর্ম মানুষকে সত্য ও ন্যায়ের পথ দেখায়। ধর্ম মানুষের সেই পবিত্র বিশ্বাস, যে বিশ্বাস তাকে সর্বদা সত্য-সুন্দর, ন্যায় ও নৈতিকতার পথ ধরে স্রষ্টার নৈকট্য লাভের নির্দেশনা দেয়। সত্যিকার অর্থে ধর্মকে যিনি অন্তর দিয়ে ধারণ ও লালন করেন, তিনি বুঝতে পারেন ধর্ম আত্মাকে যে পবিত্রতা ও প্রশান্তি দান করে, তা জাগতিক ধনসম্পদ বা ঐশ্বর্য থেকে কখনো পাওয়া যায় না।
সকল ধর্মের নিয়মকানুন সাধারণত মানুষের শারীরিক ও আত্মিক সুস্থতার ক্ষেত্রে সহায়ক। অর্থাৎ ধর্ম যেমন মানুষের আত্মাকে পবিত্র করে তেমনি শরীরকেও সুস্থ রাখে। জীবনের সকল ক্ষেত্রে সমতা পালনের কথা বলা হয় ধর্মে। এ সমতা মানুষের দৈহিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য একান্ত প্রয়োজন।
ধর্মীয় নির্দেশাবলির পালন মানুষের হৃদয়কে নির্মল করে, মনকে সংযত ও শরীরকে সুস্থ রাখে; চিন্তাকে করে পবিত্র। ধর্ম মানুষকে লোভ, হিংসা, পরনিন্দা-পরচর্চা ইত্যাদি থেকে দূরে রাখে। শরীর ও মনের ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমে এমনই সুস্থ রাখে যা মানুষের জাগতিক ও পারলৌকিক উভয় জীবনের সুখ, সমৃদ্ধি ও সফলতার জন্য একান্ত প্রয়োজন।
ধর্ম কেবল আক্ষরিক ও দর্শনের অর্থেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, মানব জীবনে শৃঙ্খলা-সৌন্দর্য ও সুস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ধর্মের কারিশমা রয়েছে সরাসরি। যেমন ইসলাম ধর্মে নামাজ, রোযা, হজ, জেকেরসহ অন্যান্য ধর্মের বিভিন্ন কর্মেও নৈতিক উন্নতির পাশাপাশি দেহ-মনের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক বহুবিধ উপকার ও কল্যাণ নিহিত।
নামাজে রুকু-সেজদা-সালামসহ প্রত্যেকটি মুভমেন্টে শারীরিক নানা উপকার রয়েছে এবং অজু করার মধ্যে বাধ্যগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিরাট সুযোগ রয়েছে। তাই যারা দৈনিক ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন, তারা বাধ্যগতভাবে পরিচ্ছন্ন থাকেন এবং শরীরের এমনসব নিয়মিত চর্চায় অভ্যস্ত থাকেন, যার ফলে অনেক অসুখ-বিসুখ তাদের হয়ই না এবং তারা ঈমান, শৃঙ্খলা ও সুস্বাস্থ্যে মজবুত থাকেন।
যারা বুদ্ধি-বিবেক কাজে লাগান, জ্ঞানের গভীরতা রাখেন, তারা জানেন যে স্রষ্টার লীলাখেলার এ পৃথিবীতে তাঁর অনুমোদন ব্যতিরেকে কিছুই হয় না। তিনি আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করে ভূমি ভিজিয়ে শস্য অঙ্কুুুুরিত করেন। আবার ক্ষেতে ফসলের শোভা দেখে মালিক যদি আত্মদম্ভে মেতে ওঠেন অথবা কোনো অহমিকার আশ্রয় নেন, তখন স্রষ্টা এমন দুর্যোগ বইয়ে বা গজব নাজিল করে সেই ফসল নিশ্চিহ্ন করে দেন; যেন গতকালও এর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এতে ধৈর্যহারাদের এখানেই শেষ। আর অনুশোচনাকারী ও ক্ষমাপ্রার্থীরা ধৈর্যের পরিচয় দিতে সক্ষম হলে স্রষ্টা আরেক সময়ে কয়েকগুণ বেশি ফসল দান করে তাকে পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেন এবং ক্ষতি পুষিয়ে দেন। এভাবেই নদীর একূল ভাঙা আর ওকূল গড়ার মতোই স্রষ্টা মানুষের পাপ ও পুণ্যের বিচার ও ব্যালেন্স করে থাকেন।
ধর্মকর্ম অতীব ভালো, কিন্তু সুবিধাবাদী স্টাইলের ধর্মকর্মে সুফল নেই। বিপদ বা অসুস্থতা থেকে উদ্ধারের জন্য অথবা পরীক্ষায় পাসের জন্য আল্লাহকে স্মরণ করা শুরু করলাম সিরিয়াসলি; কিন্তু সেই বৈতরণী পার হওয়ার পর ধর্মকর্ম ছেড়ে দিলাম! এতে কোনো ক্ষতি হয়েছে কিনা, বুঝতে না পারলেও ফাইনাল পরীক্ষার পূর্বে দেখা দিতে পারে অসুখ বা অন্য কোনো বিপর্যয়। এমনকি ইবাদত-বন্দেগী করে এবং সবার দোয়া-দাওয়া নিয়ে পরীক্ষা ভালো দিলাম, কিন্তু ফল ভালো হলো না; ফল ভালো হলেও ভালো চাকরি জুটল না; চাকরি পেলেও সাফল্য এল না অথবা স্বস্তি-শান্তি-সমৃদ্ধি এল না। এবারে চিন্তা করুন যদি ফাইনাল পরীক্ষা ভালো না-ই হলো, যদি সফল কর্মজীবন না-ই পেলাম, তাহলে পরীক্ষার পূর্বে সাময়িকভাবে যে ধর্মকর্ম করলাম, তাতে কী ফল হলো?
এটি নিছক স্বার্থপরতা; আর স্বার্থপর প্রেমিকের দুরবস্থা অবধারিত। সরল ও সুনিবিড় ভালোবাসা ছাড়া বিশেষ কোনো আকর্ষণ বা খেয়ালের বশে এ কি প্রেম প্রেম খেলা? সেই প্রেমতো টেকেই না বরং পরিণতি হয় ভয়াবহ। স্রষ্টার সহজ-সরল প্রাকৃতিক শক্তির সাথে চাই সরল-সহজ প্রেম; পুঁতির মালার মতো। ২০০ পুঁতির মালার মধ্য হতে একটি পুঁতি পড়ে গেলে বা ছিঁড়ে গেলে তা আর মালা থাকে না, পুঁতিগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে বা পড়ে গিয়ে অবস্থা জটিলতর হয়ে যায়। তেমনি পাঞ্জেগানা নামাজের ১ ওয়াক্ত না পড়লে বাকি ৪ ওয়াক্তের চেইন নষ্ট হয়ে যায়, স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসার সম্পর্ক ব্যাহত হয়; প্রমাণিত হয় প্রেমিকের প্রতি অবহেলা। সেই ব্যর্থতা ও অবহেলার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অবশ্যই রয়েছে, যা স্থূল মন বা সংকীর্ণ চিন্তার মানুষদের বোধেই আসে না। ভালোর চর্চার মাধ্যমে তাদের এন্টেনায় তথা নূর বা জ্যোতি বা অঁৎধ ষবাবষ এ শান দেয়া থাকে না বলে সে এন্টেনায় এসব সূক্ষ্ম ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সিগন্যাল ধরা পড়ে না। ফলে চালাক-বোকার দলভুক্ত এসব মানুষ ধর্মকর্ম এবং স্রষ্টা, সৃষ্টি ও প্রকৃতির প্রতিশোধ সম্পর্কে থাকে উদাসীন। এদের মধ্যে অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ‘অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী’ এর বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে নিজকে বঞ্চিত করে রাখে সেই সম্ভাবনা ও সাফল্য থেকে।
আবার অনেকেই ধর্মকর্ম নিয়মিত করেন, কিন্তু হেলাফেলায়। যেমন দিনশেষে ঘরে ফিরে খাওয়া, বিশ্রাম, টিভি, পড়াশোনার পর রাত ১২টা বা ১টায় ঘুমানোর পূর্বে নামাজ! এতে হয়ত ফরজ আদায় বা দায়পালন হয়, কিন্তু শয়তানের প্রভাবমুক্তি নিশ্চিত নাও হতে পারে। ফলে বরকত-রহমত ও শান্তি-স্বস্তি লাভে সমস্যা হতে পারে। কারণ ধর্মকর্ম বা নামাজের পূর্বে বড়জোর করণীয় হচ্ছে ক্ষুধা থাকলে তা মেটানো, পীড়িত বা বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করা অথবা বহুজনের যৌথ অসুবিধা বা অস্বাভাবিকতা ফেস করা। এরূপ অতীব জরুরি বিষয় ছাড়া স্বাভাবিক ক্ষেত্রে যদি নামাজ বা ধর্মকর্ম বিলম্বিত বা প্রলম্বিত হয়, তাহলে ততক্ষণ পর্যন্ত তার সাথে ইবলিস বা শয়তানের আছর থাকা স্বাভাবিক। এর ফলে যা যা ঘটার, তা-ই ঘটে এবং দেখা দেয় অনাকাক্সিক্ষত কর্মফল।
একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে নামাজ না পড়া পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এদের যত ফোন আসে, তন্মধ্যে অধিকাংশই থাকে নেগেটিভ বা খারাপ সংবাদের। অন্যদিকে এরা যদি ঘরে ফিরেই নামাজ পড়ে নিত, তাহলে ভালো খবরের ফোনই আসত বেশি। তবে এর মধ্যে বিবেচনার আরও অনেক বিষয় আছে। আসলে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই বলে এরা শয়তানের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়; ফলে সবকিছুতেই বিলম্ব হয়, আলসেমী আসে। এ আলসেমী মানেই শয়তানের প্রভাব।
অনেককে দেখেছি, শুয়ে-বসে রেস্ট করে তারপর নামাজ পড়েন। অর্থাৎ নামাজ পড়ার পূর্বে বিশ্রাম দরকার হয়। অথচ আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে নামাজেই বরং শ্রান্তি-ক্লান্তি দূর হয়, শান্তি আসে। তাই দেহ বা মনে কোনো ক্লান্তি এলে আমি ফরজ নামাজের সাথে নফল নামাজ পড়তে থাকি। এতে ধর্মকর্মের পাশাপাশি মেডিটেশন ও ইয়োগার পূর্ণ উপকারিতা পেয়ে যাই; দেহ-মন স্বচ্ছ ও ফুরফুরে হয়ে অনাবিল শান্তি আসে, অনেক অসুখ ও অসুবিধা কেটে যায়। তবে অসুখ-বিসুখ-বিপদ কাটানোর জন্য নফল নামাজ বিশেষভাবে পড়লে আরও ভালো।
সত্য-ন্যায়-ধর্ম-প্রকৃতি ও সুন্দরের প্রতি নিরবচ্ছিন্নভাবে (ঈড়হঃরহঁড়ঁংষু) আমরা যত বেশি মোহ বা প্রণয় বোধ করতে থাকব, তত বেশি সুখ-সুস্বাস্থ্য-প্রশান্তি, সাফল্য ও সমৃদ্ধি পেতে থাকব। এ সরল অংকের ভুল নেই। বরং এ অংকে কূটকৌশল বা জটিল চিন্তায় প্রকৃতির প্রতিশোধের আশঙ্কা রয়েছে।
ধর্মকর্ম পালনে শয়তান যাকে অনুরূপভাবে প্রভাবিত করতে পারে, তাকে অন্যান্য কর্মেও প্রভাবিত করে, যা ঐ ব্যক্তি বুঝতে পারে না বলে শয়তান তার কাঁধে স্থায়ীভাবে ভর করে। তার নূর বা অঁৎধ ষবাবষ এ মরিচা ধরে বলে ঈড়হহবপঃরারঃু ব্যাহত হয় এবং তিনি হতে থাকেন ভারসাম্যহীন ও বিভ্রান্ত। সরল অংকের জীবনে কষেন কঠিন অংক; কন্টকপূর্ণ জীবনের চোরাবালিতে হাবুডুবু খেতে খেতে পৌঁছে যান জীবন সায়াহ্নে।
মহাপবিত্র কোরআনের সুরা ইউনুস এর ব্যাখ্যায় বলা হয়, অবাধ্যরা তাদের প্রবৃত্তি ও অহমিকার কারণেই ঈমান আনতে পারবে না। যুগে যুগে অবাধ্য মানুষরা সত্যকে গ্রহণ করতে দ্বিধা করেছে, তারপরও সত্যেরই জয় হয়েছে।
অর্থাৎ অবাধ্য মানুষদের প্রবৃত্তি ও অহমিকার কারণে সত্য প্রতিষ্ঠায় বিলম্ব হলেও শেষতক সত্যেরই জয় হয়েছে, হচ্ছে এবং চিরকালই হবে। সুরা ইউনুস এর ব্যাখ্যায় আরও বলা হয় যারা সত্য ও ন্যায়কে বুঝতে চায় না, তাদের দায়-দায়িত্ব তারা নিজেরাই বহন করুক। পথভ্রষ্ট বা বিপথের এ মানুষদের কারণে পথের মানুষদেরকে দুঃখ-ভারাক্রান্ত না হওয়ার জন্য সান্ত¡না দেয়া হয়েছে। এ সুরায় আল্লাহর রসুলকেও বলা হয়েছে আপনিতো সঠিক পথে আনতে পারবেন কেবল তাকেই, যার অন্তরে সত্য ও ন্যায়কে গ্রহণ করার আগ্রহ আছে; আর যাদের অন্তরে এ আগ্রহ নেই তারাতো প্রকৃত অর্থে অন্ধ ও বধির, তারা তর্কে ও অহমিকায় থাকবে বিভোর। শত চেষ্টা করেও তাদেরকে কোনো কথা শোনানো যাবে না, কোনো পথও দেখানো সম্ভব নয়। শোনানো ও দেখানোর দায়িত্ব এবং শোনা ও দেখার দায়িত্ব এক নয়। শোনানোর দায়িত্বের জন্য রয়েছে পুরস্কার, আর না শোনার পরিণতিতো একসময়ে ভয়াবহ হবেই।
অধিকাংশ মানুষ সত্য ও ন্যায়ের কথা দৃশ্যত শোনে, কিন্তু অন্তরে অনুধাবন বা উপলব্ধি করতে চায় না কিংবা পারে না বলে সেই দেখা বা শোনায় কোনো ফল হয় না। এজন্যই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মানুষের অন্তর ও বিবেক। বিবেকই বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ আদালত। তাই আমাদেরকে নিজের বিবেক ও বুদ্ধি দিয়ে সত্য ও ন্যায়কে অনুভব ও উপলব্ধি করতে হবে; সত্য ও কল্যাণের পথে আত্মোৎসর্গ করতে হবে, যে কল্যাণ-কর্মের প্রতিদান স্রষ্টা নিজ হাতেই দিয়ে থাকেন। সুরা ইউনুস এ রয়েছে কল্যাণ কাজের ফল বাড়তে থাকে বহুগুণে, আর পাপের পরিণাম নির্ধারিতই থাকে।
শান্তি, সমৃদ্ধি ও সৌহার্দ্যরে পথই হচ্ছে আল্লাহর পথ। শান্তি মানেই সত্য ও ন্যায়ের পথে অর্জিত চিরন্তন শান্তি; ক্ষণিকের আনন্দ উল্লাস নয়। আমরা ক্ষণিকের আনন্দ-উল্লাসে মোহাবিষ্ট হব না; কারণ ক্ষণিকের এ আনন্দ স্থায়ী সুখ ও সমৃদ্ধি অর্জনে বর্তমানের সময়কে নস্যাৎ করে দেয়। যারা তাদের ইচ্ছা ও কর্মকে শান্তি ও সমৃদ্ধিতে তথা আল্লাহর নিকট সমর্পিত করেন, তাদেরকেই কেবল সরল-সঠিক পথ দেখান স্রষ্টা। তাই সত্যের অনুসন্ধানের জন্য সরল-সঠিক পথের সন্ধান পাবে তারা, যারা আল্লাহর পথে তথা প্রকৃতির শক্তির পথে সাধনা করে থাকেন।
হিন্দু ধর্মেও স্রষ্টার সান্নিধ্যলাভ বা উপাসনার পূর্বশর্ত হলো ভক্তি ও সরলতা। স্রষ্টার কাছে কপটতা বা জটিলতার কোনো স্থান নেই। সরল হৃদয় ও নির্মল ভক্তির মাধ্যমে স্রষ্টার নৈকট্যলাভ সম্ভব।
আসুন ধর্মের আহ্বানে আমরা সত্য ও ন্যায়ের পথে আত্মত্যাগ, সাধনা ও আত্মনিয়োগের জিহাদে অবতীর্ণ হই এবং যৌক্তিক ও গঠনমূলক জিহাদের মাধ্যমে নিজকে, নিজের পরিবার-সমাজ ও মানব সভ্যতাকে পরিশীলিত, পাপমুক্ত ও শান্তিময় করে তোলার কর্মকান্ডে ঝাঁপিয়ে পড়ি।
ধর্ম মানে বিশ্বাসের বৈশিষ্ট্য কিংবা অনুষঙ্গ। তাই আপনার বিশ্বাস যেমনি আপনার নিকট মূল্যবান, তেমনি অন্যের বিশ্বাসও তার নিকট মূল্যবান বিধায় অন্যের ধর্মকর্মের প্রতি সম্মানবোধ থাকা সভ্যতার পরিচায়ক।
ধর্মকর্মে চিন্তার দারিদ্র্যের বা অন্ধ বিশ্বাসের সুযোগ নেই। তাই ধর্মের জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়ার অন্ধবিশ্বাসও অতিরঞ্জন, অনাকাক্সিক্ষত। ধর্মের ক্ষেত্রে উৎসবমুখর হওয়ার চেয়ে যৌক্তিক আবেগী হওয়া দরকার। যেমন শবেবরাতকে খাদ্যোৎসবের দিন হিসেবে না নিয়ে এবাদত-বন্দেগীর দিন হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। তাছাড়া ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কখনো শান্তি দিতে পারে না। ধর্মকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে নিয়ে এর মূল দর্শনকে অনুভবে নিতে হবে। ধর্মের নামে হত্যা, নিপীড়ন, বোমাবাজি, সন্ত্রাস কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়।
পশু কুরবানির পূর্বে কুঅভ্যাসের কুরবানি দিন, চিন্তার দারিদ্র্য দূর করুন
যেকোনো পেশাগত সাফল্য ও মনোদৈহিক সুস্থতার জন্য চিন্তার সুস্থতা ও উৎকর্ষ অতীব জরুরি। চিন্তার দারিদ্র্য ও মানসিক বিকারগ্রস্ততা দূর করতে পারলে দেহ-মনের ভারসাম্য বা ঐধৎসড়হু বজায় থাকে; শারীরিক রোগমুক্তি ও রোগ প্রতিরোধ সহজ হয়ে যায়। সেজন্য আমাদের কুঅভ্যাসকে ত্যাগ বা কোরবান করা পশু কুরবানির চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই পশু কুরবানির পূর্বে নিজের ভেতরের কুঅভ্যাস বা পশুপ্রবৃত্তি যেমন লোভ, আত্মকেন্দ্রিকতা, অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ, ক্রোধ, পরচর্চা, পরনিন্দা প্রভৃতির কুরবানি দেয়া জরুরি। এসব নিন্দনীয় কুঅভ্যাস ত্যাগ না করে যত শত গরু-ছাগল জবাই দেয়া হোক না কেন, তাতে কুরবানির দর্শন বাস্তবায়ন হওয়ার কথা নয়।
এক বন্ধু গল্পচ্ছলে বলল আচ্ছা, আমাদের মধ্যে যারা নিজের ভেতরের পশুত্ব বা কুঅভ্যাস ত্যাগ না করে প্রতিবছর শুধু পশু কুরবানি দিয়েই যাচ্ছি, তাদের কুরবানি কবুল হবে কি? তার মতে, অনেকেইতো কুরবানির আসল উদ্দেশ্য তথা উৎসর্গের উদ্দেশ্যে কুরবানি না দিয়ে জাগতিক বিভিন্ন উদ্দেশ্য হাসিলে কুরবানি দেয়। খবরের কাগজের এক রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে সে বলে, ঢাকার দু’সাবেক এমপি নাকি ফি বছর শতাধিক গরু কুরবানি দেন। তাকে বললাম তাতে ক্ষতি কী? সেটাওতো কুরবানি। কারণ এমপি সাহেব নিজেতো সব মাংস খান না, অন্যদের বিশেষত তার নির্বাচনী এলাকার জনগণের মধ্যে বিলিয়ে দেন। উত্তরে সে ঐ নেতার বিভিন্ন কর্মকান্ডের ফিরিস্তি দিয়ে বলল এত কুরবানি দিয়েও যেহেতু তাঁর মন ও চিন্তা পবিত্র হচ্ছে না, তাহলে এমন উদ্যোগ নিলে কেমন হয়, যাতে ঐ এলাকার দারিদ্র্য লোপ পায়। যেমন ঐ গরু এমন দরিদ্রদের দিয়ে দেবেন, যারা গরুগুলো লালন-পালন করে দুধ ও বাছুর দিয়ে নিজেদের অভাব-অনটন মেটাতে পারে। এতে একদিকে দুধ ও মাংসের সরবরাহ বাড়বে, অন্যদিকে দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে মুক্তি পাবে বহু মানুষ। তাকে প্রশ্ন করলাম দারিদ্র্যের উপশমে এটি চমৎকার চিন্তা হলেও ধর্মমতে কুরবানি হলো কি?
এ চিন্তা ঐ বন্ধুর একান্ত, তাই এর সারবত্তায় আমরা নাইবা গেলাম। তবে ধর্মীয় নির্দেশনা অনুযায়ী ফরজ পালনে একটি বা দু’টি গরু কুরবানি দিয়ে বাকিগুলো অনুরূপ কল্যাণ কাজে ব্যবহার করা যায় কিনা, তা ধর্মগুরুগণ ভালো বলতে পারবেন। যেরূপ রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি গরু জবাই করে প্রতীকী কুরবানি দেয়া হয় রোমানিয়ায়।
দেবী বিসর্জনের পূর্বে দানবের বিসর্জন দিন
হিন্দুদের ক্ষেত্রে দেবী বিসর্জন দেয়া হয় বাস্তবে তথা ফিজিক্যাল ডায়মেনশনে তৈরি করা দেবীকে জলে ফেলে দিয়ে। কিন্তু সেতো আনুষ্ঠানিকতা হলো, দানব বিসর্জন হলো কি? দানবসহ দেবী বিসর্জন দিতে হলে দেবীকে জলে ফেলার পূর্বে নিজের সাথে নিজেকে কথা বলে এমন গভীর অনুভূতি তৈরি করতে হবে এই দেবী বিসর্জনের মধ্য দিয়ে আমি অন্তরের সকল দানবীয় আচার-আচরণ, সকল কুটিল-জটিল-অমঙ্গল-অমানবিক চিন্তা-চেতনা বের করে এই অতল জলে ফেলে দিলাম। এ জল থেকে আর এসব কালিমা কস্মিনকালেও উঠে আসবে না বা খুঁজে পাওয়া যাবে না। দেবী বিসর্জনের পর অনুভব করা উচিত, আমি এখন সহজ-সরল-মানবিক গুণসম্পন্ন উন্নততর মানুষ। এ অনুভূতি তৈরির পর মনোরাজ্যে পুণ্য ও স্বচ্ছতার নব উদ্যম নিয়ে পূজা সমাপ্ত করলে তাতে পূজার সার্থকতা বেশি হতে পারে।
ধর্মকর্মের উপরোক্ত আখ্যানের উপসংহারে সবিনয়ে আহ্বান আসুন, আমাদের সামাজিক অবক্ষয় রোধ কিংবা মানসিক স্বাস্থ্যের দ্রুত উন্নতির জন্য এখন থেকে কুরবানি হোক বনের পশু নয় বরং মনের পশু; দেবী বিসর্জনের সাথে বিসর্জন হোক অন্তরের দানব। তাতে আমাদের মানসিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার উন্নতি হবে; ভেজালের জাল ও বিষের বাণিজ্য থেকে মুক্তি পেয়ে আমরা সুস্থ, নিরোগ, সুখী-সমৃদ্ধ ও সফল হতে পারব। মানুষের ওপর পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ কিংবা গণঅগ্নিদগ্ধের ঘটনা দৈনন্দিন হবে না; বরং ব্যক্তি, সমাজ ও জাতিতে মানবিক মূল্যবোধ এবং আত্মিক অনুভবের অনুরণন বৃদ্ধি পেয়ে আমরা সবাই মান-হুঁশ হয়ে উঠব।
সর্বক্ষেত্রে অবিরাম সাফল্যের বিশেষ মানুষ হতে ক্যাম্পাস’র ১০টি দিগ্দর্শনের আলোচনা আপাতত এখানে শেষ। সুস্থতা ও শতায়ুলাভসহ জীবনকে জ্যোতির্ময় সমৃদ্ধির সোপানে নিয়ে যেতে এ দিগ্দর্শনগুলো পাঠকের উপকারে এলে এ লেখা সার্থক হবে। -চলবে।