মানুষ হিসেবে জন্ম নেয়ার সার্থকতা তখনই আসে, যখন অন্যের মঙ্গলে কাজ করা সম্ভব হয়। কিন্তু অপরের মঙ্গল বা উন্নয়নে তিনিই কাজ করতে পারেন, যিনি নিজে উন্নত। নিজে উন্নত হতে হলে তথা আত্মোন্নয়ন করতে হলে যে জিনিসটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তা হলো আত্মবিশ্বাস। আত্মবিশ্বাস দৃঢ় হলে আত্মোন্নয়ন সহজ হয়। আবার এই আত্মবিশ্বাস তখনই দৃঢ় হয়, যখন মন স্বচ্ছ ও নির্মল হয়। অর্থাৎ সততা-সহজতা-সরলতা তথা ন্যাচারালিটি বা স্বাভাবিকতা থেকে মানুষের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। সেই সূত্রে আমরা বলতে পারি, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি ও আত্মোন্নয়নের প্রথম শর্ত নিজেকে জানা তথা নিজেকে পরিশুদ্ধ করা, সহজ-সরল বা Natural করা।
জীবন চলার পথে খেয়ালের বশে বা অচৈতন্যে, অনভিজ্ঞতা বা অজ্ঞানতায় মানুষ ভুল-ত্রুটি করবে, অন্যায় করবে এটি অপ্রত্যাশিত হলেও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আত্মসচেতনতার কোনো মুহূর্তে সেই অন্যায় বা ভুল-ত্রুটির বিষয়ে আত্মোপলব্ধি আসা জরুরি, যা মনুষ্যত্বের পরিচায়ক। ভুল-ত্রুটি বা অন্যায় ও অসুন্দর সম্পর্কে আত্মঅনুসন্ধান ও আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে নিজকে সর্বদাই পরিশীলিত, মার্জিত ও বিশুদ্ধ করা উন্নত বা মহৎ জীবনের পূর্বশর্ত। সুন্দর, মহৎ ও সুস্থ জীবন যাপনে এবং সম্মুখে চলার পথ কন্টকমুক্ত ও গতিশীল করতে প্রয়োজন আত্মঅনুসন্ধানের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে নিজের অবস্থান সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি। নিজেকে পরিচ্ছন্ন, স্বচ্ছ ও শুদ্ধ করে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি ও আত্মোন্নয়ন করতে হলে পাপ-পঙ্কিলতা ও ভুলত্রুটি কাটানো অত্যাবশ্যক এবং তা কাটানোর পূর্বশর্ত হচ্ছে এসবের সঠিক অস্তিত্ব নির্ণয় ও কার্যকারণ জানা।
ভুল-ক্রটি চিহ্নিত করে তা কাটানোর পাশাপাশি নিজের মধ্যেকার হতাশা-গ্লানি দূর করতে হবে; নতুন আশায় জীবন সাজাতে হবে, স্বপ্ন দেখতে হবে। নিজের মধ্যে এই বিশ্বাস আনতে হবে যে অতীতকে বাদ দিয়েছি, আমার সামনে এখন নতুন জীবন। এই মনোভাব আনার জন্য চিন্তার পরিবর্তন দরকার। চিন্তা পরিবর্তনে কার্যকর ভূমিকা রাখে মেডিটেশন ও অটোসাজেশন। হতাশাময় অতীত ঝেড়ে ফেলে নতুন ভবিষ্যৎ সাজাতে মেডিটেশনের ভূমিকা সর্বজনবিদিত।
আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি ও আত্মোন্নয়নের জন্য মেডিটেশনের পাশাপাশি নিজের বিশ্বাস প্রবণতা (Belief system) কার্যকর ভূমিকা পালন করে। নিজের মধ্যে সর্বদা এই বিশ্বাস রাখতে হবে যে আমি বদলাতে পারি, আমি অবশ্যই পারি, আমি পারি। Positive Belief system থেকে পজিটিভ চিন্তার উৎপত্তি হয়ে মস্তিষ্কে পজিটিভ প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে; যা পজিটিভ বাস্তবতা তৈরিতে ভূমিকা পালন করবে।
Positive Belief system লালন করতে প্রয়োজন নিজের ভেতরকার অসীম শক্তি সম্পর্কে জানা। মহান দার্শনিক সক্রেটিস সেই যুগে বলে গেছেন Knwo Thyself অর্থাৎ নিজেকে জানো। এই মহাবিশ্বের প্রত্যেক মানুষ এক একটি বিস্ময়; প্রত্যেকের ভেতরে রয়েছে অসীম শক্তি। সেই শক্তির ব্যবহারে মানুষ হয়ে উঠে সাধারণ থেকে উন্নততর বিশেষ মানুষে।
আত্মোন্নয়নের আরেকটি ধাপ পজিটিভ ও প্রোএকটিভ এটিচিউড। সর্ববিষয়ে নিজের সাথে এবং অপরের সাথেও ভালো ভালো কথা তথা পজিটিভ ও প্রোএকটিভ কথা আওড়াতে থাকলে সমাজ-সংসারের নানা প্রতিকূলতা ও নেতিবাচকতা নিজের মধ্যে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। ফলে আত্মোন্নয়ন অব্যাহত থাকে।
আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আত্মোন্নয়নের পথে উপরোক্ত অনুশীলনের পাশাপাশি নিজের মাঝে যে গুণগুলো রপ্ত করা উচিত তা হলো সর্বদা যুক্তিভিত্তিক ও ন্যায়ভিত্তিক আচার-আচরণ করতে হবে। অন্যের নিকট অযৌক্তিক মনে হয় এমন আচরণ করা যাবে না। নিজের দেনা ও দায়িত্বের প্রতি সচেতন থাকতে হবে; সবার ব্যাপারে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। সর্বদা ন্যাচারাল থাকতে হবে তথা সহজ-সরল ও স্বাভাবিক আচরণ করতে হবে; কোনো বিষয়ে কারো সাথে মেকি বা আর্টিফিশিয়ালিটি না করে বরং প্রকৃত ও প্রাকৃত আচরণ করাই উত্তম। ন্যাচারিলিটির ফলে সৃজনশীলতাও বাড়ে। ক্ষমাশীল ও ধৈর্যশীল হতে হবে। নিজের অন্যায় বা ভুলের জন্য সর্বদা অনুশোচনা ও ক্ষমাপ্রার্থনা করতে হবে। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতার চর্চা করতে হবে অর্থাৎ কেউ উপকার করলে তাকে ধন্যবাদ দিতে হবে এবং তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে। সময়, সুযোগ ও স্থানের সদ্ব্যবহার করতে হবে। সততার লালন ও চর্চা করতে হবে। অন্যের অধিকারের প্রতি সচেতন থাকতে হবে। নীতি ও আদর্শবোধ থাকতে হবে। নিজ ধর্মের অনুসারী হতে হবে এবং অন্যের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা থাকতে হবে। অন্যের উপকারে সচেষ্ট থাকতে হবে; এর মধ্য দিয়ে অপরের বিশ্বাস, আস্থা ও নির্ভরতা অর্জন করতে হবে। সর্বক্ষেত্রে ভালোকে হ্যাঁ ও মন্দকে না বলতে হবে। অর্থাৎ ভালো কাজে সমর্থন ও মন্দ কাজে প্রতিবাদ জানাতে হবে।
এসবের পাশাপাশি সাধ্য অনুযায়ী ভালো পরিবেশে থাকার চেষ্টা করতে হবে; ভালো কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার চেষ্টা করতে হবে। অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে ন্যায়-নীতিবোধ শিক্ষা দেয়া হয় কিংবা ক্রিয়েটিভ কাজের সুযোগ আছে; সম্ভব হলে ছাত্রজীবন থেকেই এগুলোর সাথে সম্পৃক্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে; শিক্ষানবিশ হিসেবে এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করা যেতে পারে। এ গুণগুলো রপ্ত করা কিন্তু মোটেই কঠিন নয়। আত্মোন্নয়নের সুকঠিন সদিচ্ছা, সুদৃঢ় আকাক্সক্ষা ও সুনিবিড় সাধনা থাকলে এ অভিযানে সাফল্য অর্জন সহজেই সম্ভব। এরূপ অভিযানে সফল ব্যক্তি নিজের চর্চায় নিজেই হয়ে ওঠে সুস্থ-সুন্দর-মহৎ ও অপরের অনুকরণীয়। এরূপ বিশেষ মানুষ দেশ ও জাতির অহংকার।
পশুপাখি খুব সহজেই পশুপাখি, কিন্তু মানুষ বহু সাধনার পর মানুষ। অর্থাৎ পশুপাখি হতে হলে খুব সহজেই তা হওয়া যায়, কিন্তু মানুষ হতে হলে বহু সাধনার পর তা হওয়া যায়। সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে আমাদের পরিচিত হতে হলে তথা উন্নততর মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে হলে উপরোল্লিখিত উৎকর্ষতার নিরন্তর চর্চা ও অনুশীলন একান্ত প্রয়োজন। নিজ জীবনকে সুখময়, সার্থক, সুস্থ ও সুন্দর করতে হলেও আত্মোন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই।