কখন আমরা পাগল-প্রায় থাকি!
মানুষের মনের অসীম ক্ষমতা বা চিন্তাশক্তির বিষয়ে আমার ইতিপূর্বেকার লেখা পড়ে কেউ কেউ বলেছেন, একটু বেশিই হয়ে গেছে...। তাদের প্রশ্ন, মানুষের ভেতর এ-ত ক্ষমতা থাকে কীভাবে? অর্থাৎ কিছু পাঠক আমার লেখায় অতিরঞ্জন রয়েছে বলে মনে করছেন। আর আমার লেখায় অতিরঞ্জনের আবিষ্কার মানে তাদের কাছে হয়ত আমি অপ্রকৃতিস্থ, যাকে ইংরেজিতে বলে Abnormal, আর খাস বাংলায় বলে পাগল।
হ্যাঁ, কারো কারো মতে আমি পাগল। তা না হলে এত বিষয় থাকতে বার বার কেন লিখতে বসি মানুষের অসীম ক্ষমতার বিষয় নিয়ে। তবে হলফ করে বলতে পারি এ পাগলামি ধ্বংসের নয়, সৃষ্টির; মানুষের মাঝে অনুভূতি ও চিন্তাশক্তি জাগরণের নেশা আমাকে পেয়ে বসেছে হয়ত। সে অর্থে হতে পারে আমি নেশাগ্রস্ত, পাগলের পূর্বাবস্থা; তবে পাগল নয়, এটি পেশার নেশা হয়ত। নেশায় না ধরলে পেশার লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় না। তাই মানব শক্তির জাগরণে আমার এ নেশা কারও কারও মতে পাগলামি, আবার কারও মতে হয়ত বাঁদরামি। যিনি যেরূপ গালই দিন না কেন, আসলে আমার মধ্যে এরূপ বিশ্বাস জেঁকে বসেছে
একটি মানুষ যার এক হাত নেই, তাকে ১০০ টাকা দিয়ে সাহায্য করলে তার উপকার হবে ঠিকই, কিন্তু তাতে অন্যের নিকট হাত পাততে পাততে সে এমন পরনির্ভরশীল হয়ে পড়বে যে, এক সময়ে ভিক্ষুকে পরিণত হয়ে যাবে। অথচ ঐ ব্যক্তির ভালো হাতের দিকে তার নিজের দৃষ্টি বা মনোযোগ আকর্ষণ করতে করতে এবং ঐ হাতকে কাজে লাগাতে লাগাতে এক সময়ে না-থাকা হাতের কথা ভুলে গিয়ে সে এমন আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠবে যে, তার এক হাত দিয়েই সে অন্যদের দু’হাতের চেয়ে বেশি Output create করতে পারবে।
মানুষের এরূপ নেতিবাচক ও ইতিবাচক চিন্তার তারতম্যের কারণে মানসিক ভারসাম্যের ব্যবধান যে কত বেশি হয়ে যায়, সে রহস্য উন্মোচনে এবং সে ভারসাম্য রক্ষার প্রয়াসে আমি হয়ত পাগল-প্রায়। অর্থাৎ অন্যের পাগলামি দূর করতেই আমি...।
এবার আমি যদি বলি আমার এ লেখা যিনি পড়ছেন, তিনি অর্থাৎ আপনিও একজন পাগল, তাহলে চটে যাবেন নাতো? যদি চটে যান, তাহলে বুঝব যে আপনি আসলেই পাগল। আর যদি তিল পরিমাণ বা সামান্যতমও চটে না গিয়ে লেখাটি একেবারে শেষ পর্যন্ত ধৈর্য স্বাভাবিক রেখে পড়তে পারেন, তাহলে বলব আপনি প্রকৃতিস্থ বা Balanced মানুষ তথা প্রোএকটিভ এটিচিউডের মানুষ।
আসলে অধিকাংশ মানুষেরই নিজের সম্পর্কে মূল্যায়ন নেই, অবজারভেশন নেই, কনক্লুশানতো নেই-ই; যেমনি নেই এরূপ কোনো ভাবনা আমাদের আলো ও তাপের উৎস কী? সূর্য কত বড়? পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব কত? এত বড় পৃথিবীর চেয়ে ১৩ লক্ষ গুণ বড় এই ম-হা ম-হা মহাশক্তি তথা সূর্য ১৫ কোটি কিলোমিটার দূরত্বে থেকে অনন্তকাল ধরে একই নিয়মে আমাদেরকে যে তাপ ও আলো দিয়ে যাচ্ছে, সে আলোর কত দীপ্তি, সে তাপের কত প্রখরতা!!!
এখন সূর্যটাকে ক্রমান্বয়ে আমাদের নিজ অবস্থানের আরো কাছাকাছি যেমন প্রথমে ১ কোটি তারপর ১ লক্ষ তারপর ১ হাজার তারপর ১ শত তারপর ১ কিলোমিটার দূরত্বে চিন্তা করলে উত্তাপ ও আলোর ঝলক কেমন হবে, চোখ বুঁজে তা কিছুক্ষণ ভাবুন, প্লিজ! ...কেমন লাগছে? আমি কি বলতে পারি যে, আপনি এরূপ অনুভবে কখনো অভিষিক্ত হননি?
ঠিক এভাবেই আপনার মনোরাজ্যের এমনকি আপনার শরীরের বহু বিষয়েই আপনি এখনো ভেবে দেখেননি। নিজের সম্পর্কে এত উদাসীন আপনি! আর আপনার সে উদাসীনতা ও হেলা-ফেলাভাব (Calasness) দিয়েই আপনি ভাবছেন, আমি বেশি লিখে পাগলামি করেছি অর্থাৎ আমাকে পাগল বলতে চাচ্ছেন।
ব্রেন-ফ্রিকোয়েন্সির পরিমাপ
ও পাগলামির অবস্থান
মানুষের ব্রেন-ফ্রিকোয়েন্সি প্রতি সেকেন্ডে ০.৫০ থেকে ৩.৯০ সাইকেলে থাকলে তাকে ডেল্টা লেভেল, ৩.৯১ থেকে ৬.৯০ পর্যন্ত থাকলে তাকে থিটা লেভেল, ৬.৯১ থেকে ১৩.৯০ পর্যন্ত থাকলে তাকে আলফা লেভেল এবং ১৩.৯১ থেকে উপরের দিকে থাকলে তাকে বিটা লেভেল বলে।
বিটা লেভেলে ফ্রিকোয়েন্সি ৩৫/৪০ পর্যন্ত থাকলে তাকে যৌক্তিক আচরণের সহনীয় মানুষ হিসেবে অনেকটা গ্রহণ করা যায়। কিন্তু ৪১ এর উপর হলে সে মানুষের আচার-আচরণ অস্বাভাবিক বা Imbalanced হয়ে যায়। আবার তা যদি ৬০ অতিক্রম করে, তাহলে সে মানুষ বদ্ধ উন্মাদের ন্যায় আচরণ করতে থাকে। এরূপ উচ্চ ব্রেন-ফ্রিকোয়েন্সির মানুষ নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না বলে ক্ষেত্রবিশেষে তাকে আটকে রেখে চিকিৎসা করাতে হয়। আর এ ফ্রিকোয়েন্সিতে দীর্ঘদিনের অবস্থান ঘটলে অনেকক্ষেত্রে তাকে পুনরায় স্বাভাবিকতায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
কীভাবে পাগলামি কমানো যায়
ব্রেন-ফ্রিকোয়েন্সির ১৩/১৪ থেকে ৩৫/৪০ পর্যন্ত অর্থাৎ বিটা লেভেল বা জাগরণের লেভেলেই মানুষ স্বাভাবিক কাজকর্ম করে থাকে। কিন্তু এ লেভেলে অবস্থান করে বিশেষ সৃজনশীল কাজ করা দুরূহ। কারণ এ লেভেলে মনের ছোটাছুটি থাকে বেশি। ফলে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে বেশিক্ষণ Concentration ধরে রাখা যায় না। সৃজনশীল কর্মের ক্ষেত্রে তাই তাকে ঈৎবধঃরাব ষবাবষ তথা অষভধ ষবাবষ (ব্রেন ফ্রিকোয়েন্সি ৬.৯১ থেকে ১৩.৯০) এ থাকতে হয়। পীর, আউলিয়া, মুনী-ঋষি, বিজ্ঞানী, গবেষক, লেখক বা এরূপ মানুষরা অধিকাংশ সময়েই অনুরূপ লেভেলে অবস্থান করেন। এটি ঘুমের কাছাকাছি অবস্থান, তবে ঘুম নয়; তন্দ্রাচ্ছন্ন বা তন্দ্রা ভাবের অবস্থা, যে অবস্থায় জাগতিক চেতনা থাকে তথা অন্যের কথাবার্তা বা শব্দ শোনা গেলেও মনের একাগ্রতা বা Concentration এত বেশি থাকে, যা সৃজনশীল ও আধ্যাত্মিক কাজের জন্য খুবই সহায়ক।
আলফা লেভেলে মনের ছোটাছুটি কমে গিয়ে স্থিরতা বজায় থাকে বলে সবকিছু নিখুঁতভাবে অনুভব ও পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা থাকে এবং সে কারণে সৃজনশীলতাও কাজ করে। ব্রেনের এ লেভেলে মনের স্থিরতা থাকায় মন ও মস্তিষ্কের সংযোগ সহজ হয়। ফলে যেকোনো বিষয়ের উপলব্ধি স্বচ্ছ-পরিচ্ছন্ন ও সুনির্দিষ্ট হয়।
যাদের ব্রেন-ফ্রিকোয়েন্সি প্রায়ই উচ্চমাত্রায় ওঠে এবং যারা প্রায়ই অস্বাভাবিক আচরণ করে, তাদেরকে ব্রেনের আলফা লেভেলে থাকার চর্চা তথা ধ্যান বা মেডিটেশন করাতে পারলে তাদের অস্বাভাবিকতা বা পাগলামি থাকবে না। প্রথম প্রথম এদের এরূপ বশীভূত করা কঠিন হতে পারে। তবে Counseling, sharing, accompany বা সঙ্গ দিতে দিতে এবং কৌশল অবলম্বনে এক সময়ে এক্ষেত্রে সাফল্য আসবেই।
সৃজনশীলতা বাড়ানোর উপায়
বিভিন্ন টেকনিক অবলম্বনে ব্রেনের আলফা লেভেলে যাওয়া সহজ। যেমন ডীপ ব্রেদিং বা শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে, কাউন্ট ডাউন করে (থ্রি টু ওয়ান মেথড বা টেন টু ওয়ান মেথড), মনের আইডিয়াল প্লেস অব রিলাক্সেশনে গিয়ে। এভাবে নিয়মিত চর্চার মাধ্যমে ব্রেনের আলফা লেভেলে বারংবার যেতে থাকলে এবং দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করতে থাকলে মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ চলে আসে। একবার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে তারপর প্রতিদিন অন্তত ১৫ মিনিট বা মাঝে মধ্যে ব্রেন ও মনের এ লেভেলে বিচরণ-চর্চা অব্যাহত রাখলে মানুষ দুশ্চিন্তামুক্ত, হতাশামুক্ত, সুস্থ ও উদ্যমী থাকে। তাদের দৃষ্টিশক্তি হয় প্রখর, চিন্তাশক্তি হয় গভীর, বৃদ্ধি পায় স্মরণশক্তি এবং বজায় থাকে ধৈর্য ও মানসিক সুস্থতা, জীবন হয় চিরসবুজ। এরা দীর্ঘায়ু লাভ করে এবং হয়ে ওঠে অন্যের নিকট আকর্ষণীয়, অনুকরণীয় ও বরণীয় ব্যক্তিত্ব। নিয়মিত ধ্যানচর্চায় এরা এক সময় প্রোএকটিভ বা বিশেষ মানুষ তথা উন্নততর মানুষ (ঝঁঢ়বৎরড়ৎ যঁসধহ নবরহম) এ পরিণত হয়। তাদের নিকট তখন কোনো কিছুই অসম্ভব বলে মনে হয় না। প্রথমে নিজের ওপর, তারপর অন্য মানুষের ওপর এবং অতঃপর অন্য প্রাণীর ওপর, উদ্ভিদের ওপর, শেষতক জড় পদার্থের ওপর তারা প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে সহজেই কাক্সিক্ষত সাফল্যলাভে সক্ষম হয়। এরূপ মানুষ কারো কোনো ক্ষতি করে না, করতে পারেও না। ব্রেনকে পজিটিভ চিন্তা ও ধারণা সম্পর্কে কমান্ড দিতে দিতে ভালোমানুষী এমনিভাবে লালিত হয়ে যায় যে, এদের মনে অন্যের ক্ষতির চিন্তাই আসে না। মনের এ লেভেলে কারো ক্ষতির চিন্তা করলে তখন তার নিজের ক্রিয়েটিভ লেভেল তথা ক্রিয়েটিভিটি নষ্ট হয়ে যায়।
উন্নত দেশের ততোধিক সুউন্নত মানুষরা মন ও মস্তিষ্কের এ চর্চায় ক্রমান্বয়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তাই হিলারী ক্লিনটনের মতো প্রচন্ড কর্মব্যস্ত ব্যক্তিত্বরাও প্রতিদিন অন্ততঃ ১৫ মিনিট ধ্যানচর্চা করেন। দুঃশ্চিন্তামুক্ত, মানসিক চাপমুক্ত-ভারমুক্ত, সুখময়-আনন্দময়, সৃজনশীল-সমৃদ্ধ জীবন গঠন ও লালনে আপনিও করতে পারেন ধ্যানচর্চা।
ধ্যান বা মেডিটেশন, ইয়োগা, রেইকি প্রভৃতি প্রাকৃতিক ও সৃজনশীল চর্চায় আগ্রহী হলে প্রতি শনিবার ক্যাম্পাস অডিটোরিয়ামে আসুন। হতাশামুক্ত, উদ্যমী, কর্মযোগী, উজ্জ্বল-উচ্ছল, আলোকিত জাতি গড়ার লক্ষ্যে ক্যাম্পাস বিনামূল্যে এ সার্ভিস প্রদান করছে দীর্ঘদিন থেকে। অতীতের দুঃখ-হতাশা ঝেড়ে ফেলে নব উদ্যমে জীবন রাঙাতে, জীবনকে ভেঙে নতুন করে গড়তে, আপনার নিজের ভেতরের আপনাকে নিত্য নবরূপে আবিষ্কারের ক্ষেত্রে সহযোগিতা দানে সদা প্রস্তুত ক্যাম্পাস সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্র।
এ আলোর ভুবনে, এ আনন্দালোকে সবাইকে স্বাগত।