মানুষের জীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যার জন্য জীবনের গতিধারাই সম্পূর্ণ বদলে যায়; প্রেম-ভালোবাসা সেগুলোর মধ্যে শীর্ষে। এমনকি মানুষের জীবনে জন্ম-মৃত্যু এবং বিয়ের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে প্রেম।
প্রেম এক স্বর্গীয় সুখ, জীবনের আনন্দ, মহাজাগতিক অনুভবের মহানন্দ যা মানুষের আজন্ম লালিত কিংবা প্রত্যাশিত পরাক্রমশালী এক আত্মশক্তি। মানসিক সুখ ও ঐশ্বর্যের প্রত্যাশায় প্রেম-ভালোবাসার জন্য ব্যাকুল হয়ে ঘোরে মানব হৃদয়। তাইতো নারী-পুরুষ, ধনী-গরিব সবাই প্রেমের কাঙাল। এ কেবলই আমার কলমের লেখা নয়, শিল্পী কণ্ঠেরও আকুতি আমি চিরকাল, প্রেমেরও কাঙাল...।
প্রেমের মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য
এ মহাবিশ্বের প্রতিটি অণু-পরমাণুতে চলছে প্রেম-ভালোবাসার লীলা। আর সেই প্রেম-প্রীতি ও প্রণয়ের পরিচর্যাতেই বেঁচে আছে পৃথিবী। প্রণয়ের সুরভি যেন বিশ্বের আকাশ-বাতাস মাতিয়ে রেখেছে। বিকশিত হয়ে উঠেছে জীবন-সৌন্দর্য ও গতিময়তা। স্বর্গের সুবাসিত এই প্রেম বিনিময় থেকে যারা বঞ্চিত থেকে যায়, তারা আসলেই দুর্ভাগা।
প্রেম হতে মানুষ জন্মেছে বলে হয়ত মানব জীবনটা প্রেম-অপ্রেম, ভালোবাসা-ঘৃণার এক ট্র্যাজিক সময়কাল। প্রেম পবিত্র ও স্বর্গীয়; তন্মধ্যে যৌবনের প্রেমই জীবনের সর্বাধিক আরাধ্য ও সাধনার বিষয়। তাইতো Love is the best wreaths of pure heart. অর্থাৎ বিশুদ্ধ হৃদয়ের শ্রেষ্ঠ নির্মাল্যের নাম ভালোবাসা। প্রকৃতই প্রেম মানুষকে নীচ ও হীন জীবন হতে বহু ঊর্ধ্বে নিয়ে যায়। প্রেমের পাত্র-পাত্রীর দৃষ্টি হয় গভীর, হৃদয় হয় কত বড়, মায়া-মমতা হয় কত ব্যাপক!
যে প্রেমিক হয়েছে, তার হৃদয় যেমন উন্নত ও উদার হয়; যে প্রেমিক হবার পথে গিয়ে ব্যর্থ ও হতাশ হয়ে ফিরে এসেছে, তারও মন হওয়া উচিত অনেক বড়। প্রতিভা বসুর মতে প্রেম মানুষকে ধুয়েমুছে পবিত্র করে দেয়; যার হৃদয়ে সেই প্রেম জাগে সেও ধন্য, যার জন্য জাগে সেও ধন্য। চায় সবাই, পায় কয়জন? আরেক লেখক বলেছেন There is only one happiness in life is to love and to be loved.
প্রেম কত সুন্দর, কত পবিত্র, কত শক্তিশালী! মানব আত্মার জন্য মহাকল্যাণকর এ প্রেমের সঙ্গে সম্বন্ধ তৈরি না করে যারা বিপরীত লিঙ্গের সাথে মিলিত হয়, তারা কত বড় হতভাগ্য! ডি এইচ লরেন্স এর মতে প্রেম কামবৃত্তির চেয়েও বড়; এই বড়ত্বের রহস্যই প্রেম।
আবার বিশেষ মানুষের প্রতি বিশেষ মানুষের প্রেমের অনুভূতি কোনো অবস্থায়ই ক্ষতিকর নয়। এ অনুভূতি পরস্পরকে জীবনের অবসন্নতা থেকে বাঁচিয়ে দেয়, রোধ করে প্রতিমুহূর্তের তিল তিল ক্ষয়, বিলম্বিত করে জীবন সায়াহ্নের ঘন্টাধ্বনি। তাইতো আমেরিকান সংগীতশিল্পী জন হ্যারিসন বলেছেন, ঈশ্বর সন্ধানের ক্ষেত্রে এবং প্রেম-ভালোবাসার ক্ষেত্রে কোনো বিলম্ব ঘটানো উচিত নয়। ভারতের প্রখ্যাত মন নিয়ন্ত্রণ বিজ্ঞানী ও সাধক চন্দ্র শেখর বলেছেন, শরীরের রোগ নিরাময় তথা অটো হিলিং বজায় রাখার দু’টি ম্যাজিক ক্যাপসুল হলো ভালোবাসা ও হাসা।
অন্যদিকে এই প্রেম-ভালোবাসাই এক রহস্য নিকেতন। এর নানা মহল, অসংখ্য রং, বিভিন্ন রূপ; বিচিত্র কাহিনী সম্ভারে ভরা অনন্ত ভলিউমের সুবিশাল বিচিত্রা এই প্রেম।
প্রেমের পাঠ
আমরা সবাই প্রেম ও ভালোবাসা নিয়ে বলাবলি করতে কমবেশি পছন্দ করি। কিন্তু ভালোবাসার মর্মার্থ বুঝতে বা বোঝাতে কিংবা ভালোবাসার মতোই ভালোবাসতে পারি ক’জন?
প্রেম-ভালোবাসার মতো সহজ ও প্রাকৃতিক বিষয়ে অপ্রাকৃতিক নানা অঘটনের কারণ হচ্ছে সব মানুষ ভালোবাসা চায়; ভালোবাসা ভালোবাসা বা প্রেম প্রেম বলে মুখে ফেনা তোলে; অথচ ভালোবাসা বোঝে না, না বুঝেও বলাবলি করতে ভালোবাসে। ভালোবাসা দানের মাধ্যমেই প্রেম যে তৈরি করা যায়, তা তাদের বোধেই আসে না। দান করতে করতে নিজকে রিক্ত-নিঃস্ব করে ফেলতে পারলে তখন স্রষ্টার আশীর্বাদস্বরূপ তার জন্য স্বর্গীয় প্রেমের শুভাগমনের পথ সুগম হয়। তাইতো বলা হয় প্রেম মানুষের সৃষ্ট নয়, এটি স্রষ্টার দান বা আশীর্বাদ। কিন্তু স্রষ্টার এ দান পাওয়ার জন্য নিজেকে কত উজাড়-রিক্ত-নিঃস্ব করতে হয়, কতখানি উদার ও পবিত্র করে গড়ে তুলতে হয়, সেই পাঠে আমরা যাই ক’জন?
এজন্য বলা হয় সাধারণ মানুষ প্রেম সম্বন্ধে জানে, জ্ঞানীরা প্রেমকে শ্রদ্ধা করে, দেব-দেবীরা প্রেমকে সার্থক করে। তাইতো প্রেমের প্রকৃত মূল্যায়ন যে করতে জানে, সে সাধারণ মানুষ নয়, অসাধারণ; সে মানুষ নয়, দেবতুল্য।
আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রেম-ভালোবাসা-বিয়ে-পরিবার, স্রষ্টা-সৃষ্টি, মানবতা-নৈতিকতা ইত্যাকার মৌলিক বিষয়ের পাঠ নেই; পরিবারে বা সমাজে নেই এর অধ্যয়ন। তাই নানারূপ ভুল ধারণা, নিদারুণ আকাল ও কঠিন এ দুরবস্থা শুধু প্রেম-বিয়ের ক্ষেত্রেই নয়, বাজার ও বাণিজ্য ব্যবস্থাসহ আমাদের জাতীয় জীবনের সর্ব ব্যবস্থায় বিরাজমান।
প্রেম অন্বেষণ
প্রেমের সুধা আহরণের পূর্বশর্ত হচ্ছে মনকে আলোকিত, অলঙ্কৃত, অহংকৃত করা; যে আলোর ঝর্ণাধারায় বিমোহিত ও বিগলিত হবে অন্য হৃদয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখেছি প্রেমের পাত্র বা পাত্রী নিজে কক্ষচ্যুত, অথচ সঙ্গীকে খোঁজ করতে থাকে কক্ষপথে। নিজে কক্ষচ্যুত হয়ে অন্যকে কক্ষপথে খোঁজ করলে কি তার সন্ধান মিলবে? Before looking outer world, look into your inner world. তাই নিজেকে আগে সামলাতে হবে; ব্যালেন্সড হতে হবে; নিজেকে লাইনে রেখে অন্যকে লাইনে আসতে ও থাকতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে; কম্প্রোমাইজ করতে হবে; কনসিডারেট হতে হবে; ধৈর্যশীল ও ক্ষমাশীল হতে হবে। নিজেকে গুণগতভাবে স্মার্ট, আকর্ষণীয়, যৌক্তিক ও কল্যাণ চিন্তায় সৌন্দর্যমন্ডিত করে গড়ে তুলে অন্যের কাছে উপস্থাপন করতে হবে; তারপরইতো অপর পক্ষের কাছে ভালোবাসার প্রত্যাশা, তারপরই প্রেমের মহামিলন।
নিজে ব্যালেন্সড হওয়া ছাড়া অন্যের প্রেমলাভ অথবা প্রেমে মিলন অসম্ভব। এক্ষেত্রে ব্যালেন্স যত বেশি, প্রেম লাভের সম্ভাবনাও তত বেশি; অন্যদিকে যত বেশি ইমব্যালেন্সড, তত বেশি অপ্রেম-অমিল-অশান্তি। ব্যালেন্সড বা ভারসাম্যের প্রধান উপকরণ হচ্ছে ধৈর্য। প্রেম-ভালোবাসার ক্ষেত্রে ধৈর্য খুবই ফলদায়ক টনিক। কেবল প্রেম-চর্চার ক্ষেত্রেই নয়, যেকোনো অধৈর্যের ক্ষেত্রেও এ কথা স্মর্তব্য যে দুঃসময়ের কাল দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, কিন্তু চিরস্থায়ী নয়।
ধরুন, নিজকে ভারসাম্য এবং অপরকে ভারসাম্যহীন বলে মনে হয় এক্ষেত্রে কী করণীয়? সেক্ষেত্রেও নিজেরই ধৈর্য বাড়িয়ে দিতে হবে। অন্যের অস্থিরতা বা ভারসাম্যহীনতায় নিজে অধৈর্য হয়ে পড়লে তখন মিলনতো দূরের কথা, সংঘর্ষ বেঁধে গিয়ে দু’জনার পথ দু’দিকে চলে যেতে পারে। তাছাড়া অন্যের ভারসাম্যহীনতা বা ভুল-ত্রুটিতে নিজকে হতে হবে অধিক ক্ষমাশীল ও উদার।
ক্ষমা মহৎ গুণ ছোটবেলায় এ পাঠের পরবর্তী সময়ে নিজকে জানতে গিয়ে তথা আত্মআবিষ্কারে আমি উপলব্ধি করেছি যে, বহু অশান্তি ও রোগ থেকে মুক্তির একক উপায় বা সমাধান হচ্ছে ক্ষমা। অন্যকে ক্ষমা করে দেয়ার শক্তি অর্জন করতে পারলে নিজের মানসিক মুক্তি, সুস্থতা ও সিদ্ধি লাভের পথ সুগম হয়ে যায়।
আমার মতে, ক্ষমার সাধারণ সূত্র হচ্ছে You have to avoid something and you have to accept something. অর্থাৎ অন্যের ভুল-ত্রুটির অনেক কিছু আপনি এড়িয়ে যাবেন এবং অনেক কিছু ক্ষমা করে দেবেন; কেবল সিরিয়াস কিছু বিষয়ে নিতে পারেন Action, তাও কোনোরূপ রিএকটিভ না হয়ে বরং অনেকটা প্রোএকটিভ এটিচিউডে। কিন্তু প্রেমের ক্ষেত্রে প্রায় সবকিছুতেই ক্ষমা করার ঔদার্য এবং ১০০% প্রোএকটিভ এটিচিউড আপনার থাকতেই হবে; তবেই প্রেমে সিদ্ধিলাভ।
আমরা যেহেতু সৃষ্টির সেরা জীব (তবে সবাই নই), আর স্রষ্টা যেহেতু প্রেমের সাগর, আনন্দের সাগর, দয়ার সাগর, ক্ষমার সাগর, ধৈর্যের সাগর তাই প্রেম অর্জন করতে হলে আমাদেরকে স্রষ্টার গুণগুলো অনুসরণ করতে হবে। এতে একদিকে স্রষ্টা সন্তুষ্ট হবেন, অন্যদিকে আমাদের জীবনেও আসবে প্রেম-ভালোবাসার শান্তি-স্বস্তি-সুস্থতা ও সমৃদ্ধি।
প্রেম-ভালোবাসার ক্ষেত্রে স্বস্তি ও শান্তি হচ্ছে নিঃশর্তভাবে দিয়ে যাওয়া, দান করে যাওয়া; তাতে প্রেম সার্থক-সমার্থক ও সমৃদ্ধ হয়। প্রেমের প্রকৃত সুখ পাওয়াতে নয়, দেয়াতে। পরার্থে সর্ববিসর্জন দিয়েই প্রেম-ভালোবাসার অমিয় সুধা আহরণ করতে হয়। কোথায় যেন ইংরেজিতে একটি কথা পড়েছিলাম The greatest satisfaction in a life lies in giving satisfaction to others. শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের বাণী দিতে যে পারে না, পাওয়া তার ঘটে না।
আমি মনে করি প্রেমের ক্ষেত্রেতো বটেই, জীবনের সর্বক্ষেত্রেই দান করতে হবে আগে, তারপর অন্যের কাছে প্রত্যাশা। অনেকটা ব্যবসায়ে বিনিয়োগের মতো। পুঁজি জোগাড় করবেন, খাটাবেন বা লগ্নি করবেন, ব্যাংক একাউন্ট-লাইসেন্স-ট্যাক্সসহ বিভিন্ন কর্ম সম্পাদন ও দায়-দেনা পরিশোধ করে সকল পক্ষকে তুষ্ট করতে পারলে তারপরইতো লাভের প্রত্যাশা। প্রেমের ক্ষেত্রেও তাই। আগে স-ব দেবেন, তারপর পাবেন। অর্থাৎ প্রথমে নিজ থেকে দিতে থাকবেন কম্প্রোমাইজ, কনসিডারেশন, স্মার্টনেস, ধৈর্য, ক্ষমা, যৌক্তিক ও কল্যাণ চিন্তার আকর্ষণীয় আচার-আচরণ। কেবল তারপরই অন্যের কাছ থেকে ভালোবাসার প্রত্যাশা করতে পারবেন নিজের ভেতরে।
এককথায় অন্যের মনোরাজ্যে আপনার প্রতি এমনই কৃতজ্ঞতাবোধ, এমন এক আকর্ষণ তৈরি করবেন যাতে তার অজান্তেই সে গাইতে শুরু করে
আমি ধন্য হয়েছি ওগো ধন্য
তোমারি প্রেমের জন্য...।
ব্যক্তিত্বহীন ব্যক্তির যুক্তিহীন কথাবার্তা প্রেমের পথে বিরাট অন্তরায়। তাছাড়া স্বার্থপরতাও প্রেমে অন্তরায়। স্বার্থপরতার মধ্যে আর যাই থাকুক, প্রেম থাকে না। সে কারণে নিজে ‘আনিস’ হয়ে অন্যকে ‘দেনিস’ আশা করলে তথা সর্বক্ষণ হাত পেতে রাখলে প্রেম-ভালোবাসা পাওয়া যায় না। প্রথমে হাত উপুড় করতে হবে, উজাড় করতে হবে; প্রথমে ভালোবাসতে হবে, ভালোবেসে যেতে হবে; ভালোবাসার স্বভাব তৈরি করতে হবে। ভালোবাসা দেখানোর স্বভাবে না গিয়ে বরং প্রকৃত ও প্রাকৃত ভালোবাসার স্বভাব অর্জন করতে হবে। তারপরই কেবল পাওয়া যাবে অপরের ভালোবাসা। তখন দেখা যাবে অন্যের ভালোবাসার জোয়ার। এভাবে অন্যের মধ্যে নিজের প্রতি ভালোবাসা উৎপাদন না করে যদি ভালোবাসা চাওয়া হয়, তাহলে তা পাওয়া যাবে কোত্থেকে!