প্রতি ১০০ বছর পর পর রুটিন করে বিশ্বব্যাপী মহামারী আক্রান্তদের প্রকোপের বিষয়টি কোনোক্রমেই কাকতালীয় নয়। এটি স্রষ্টার অমোঘ বিধান কিংবা স্রষ্টায় বিশ্বাসহীনদের জন্য প্রকৃতিরই প্রতিশোধ। এ বিশ্ব চরাচরের তাবত মানুষ যত অন্যায়-অবিচার করে যাচ্ছে, তাদের সেই সুদীর্ঘ অন্যায়ের কঠিন বদলা নিয়ে থাকে স্রষ্টা বা প্রকৃতি -যা বিগত কয়েক শতাব্দীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে অত্যন্ত স্বচ্ছ হবে।
তাই এই জমিন বা পৃথিবীর ওপর, একে অন্যের ওপর যে অন্যায়-অবিচার হয়েছে, তার বদলা নিতে এই করোনা মহামারীর আবির্ভাব। রাজত্ব এখন করোনার! বিশ্বজুড়ে করোনা আতঙ্ক !! অদৃশ্য, অস্পৃশ্য করোনা ভাইরাসের তান্ডবে জর্জরিত সমগ্র মানব জাতি। করোনা যেন ঈশ্বর হয়ে এসে মানব জাতিকে মনে করিয়ে দিচ্ছে- আর নয় মানুষের ওপর অমানবিক আচরণ; আর নয় পশুত্ব, প্রতারণা, অহঙ্কার, ঔদ্ধত্য, হিংসা-বিদ্বেষ, বিশ্বাসঘাতকতা..। সে দৃষ্টিকোণ থেকে মনে হয়- করোনা যেন ভাইরাস নয়, এ হলো Corona God। কারণ পৃথিবীর শীর্ষ শক্তিধর দেশকে নতজানু করেছে করোনা, স-ক-ল ক্ষমতাবানের হৃদয় কোমল করেছে করোনা, বৈধসাথী ও শিশুসন্তান ঘরে ফেলে বাইরে চড়ে বেড়ানো নিষ্ঠুর-উড়নচন্ডীদেরকে ঘরে ফিরিয়ে বন্দী করে আটকিয়ে রেখেছে করোনা।
সমাজে যারা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, বাকিরা যদি তাদের পক্ষ অবলম্বন না করে এবং জুলুমকারী ও অন্যায়কারীদেরকে চ্যালেঞ্জ না করে কিংবা নিদেনপক্ষে অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে- তাহলে যখন আযাব আসবে, সবার ওপরই আসবে। এজন্যই আল্লাহতা’য়ালা যখন আযাব দেন, তখন ভালো-মন্দ সবাই এর দ্বারা বিনষ্ট হয়ে যায়, ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পরবর্তীতে পুনরুদ্ধারের সময় যার যার ঈমান অনুযায়ী আল্লাহ তাকে সেই প্রাপ্য ঠিকই দিবেন।
তাই কোনো মহামারী বা আপদ বা আযাবকালীন সময়ে ‘আমি মুসলিম বা মুমিন, আমার কিছুই হবে না’ -এরূপ ভ্রান্ত বিশ্বাস রাখা বা গুজব রটানো কোনো কাজে আসবে না। প্রত্যেক মানুষের দায়িত্ব স্রষ্টার আনুকূল্যে সবকিছু করা এবং সবাই প্রকৃতির স্বার্থ সংরক্ষণ করা, অন্যায়-জুলুম-নিপীড়নের প্রতিবাদ করা। কারণ মানুষ এ প্রকৃতিরই অংশ, সৃষ্টির সেরা জীব। তাই সবার স-ব অন্যায়ের জন্য পরিবার-পরিজনসহ সবাই আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া এখন আর কোনো উপায় নেই। একমাত্র বিশুদ্ধ হৃদয়ে ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমেই করোনা-গড আমাদেরকে তার বদলা-গ্রাস থেকে ধীরে ধীরে মুক্তি দিতে পারে।
হযরত মূসা (আঃ) আল্লাহর কাছে প্রশ্ন করেছিলেন- হে আল্লাহ, আপনার কাছে জানতে চাই, আপনি যখন কোনো কওমের ওপর গজব নাজিল করেন, তখন ভালো এবং খারাপ সবাইকেই কেন এর ক্ষতির সম্মুখীন করে দেন? অন্যায়কারীদের ওপর সাজা মেনে নেয়া যায়; কিন্তু যারা অন্যায় করেনি, তাদেরকে কেন সাজা দেন?
মূসা (আঃ) এর প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন আল্লাহ, এমনি সময়ে একটি বিষাক্ত পিঁপড়া মূসার পায়ে কামড় দেয়। তিনি প্রচন্ড ব্যাথা পান এবং পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখেন একঝাঁক পিঁপড়া সেখানে কিলবিল করছে। তিনি পা দিয়ে ঘষে সবগুলো পিঁপড়া মেরে ফেলেন। তা দেখে আল্লাহ বললেন- হে মূসা, তোমাকে কয়টি পিঁপড়া কামড় দিয়েছে? নবী বললেন, একটি পিঁপড়া। আল্লাহ বললেন- তুমি কয়জনকে হত্যা করেছো? তিনি বললেন- আমিতো পুরো পালের ওপর পা চাপিয়ে দিয়েছি।
তখন আল্লাহ বললেন- একটি পিপঁড়ার কামড় খেয়ে তুমি এত পিঁপড়া মেরে ফেলেছো! এটি কেন করেছো? মূসা (আঃ) এর কোনো উত্তর নাই। আল্লাহ বললেন, তাহলে বুঝতে পারছো- যে ব্যক্তি অন্যায় করছে, অন্যদের উচিত তাকে সে অন্যায় থেকে বিরত রাখা। অন্যায় করা যেমন অপরাধ, অন্যায় করতে দেখে চুপচাপ বসে থাকাও তেমন অপরাধ।
অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।
করোনার আশীর্বাদে এখন অবশ্য অনেক কিছু এ বিশ্বে পজিটিভলি বদলে গিয়েছে, যা অভূতপূর্ব অনন্য। কোল থেকে, বুক থেকে দূরে ঠেলে রাখা নিজ পেটের সন্তানকে কাছে ফিরিয়ে নেয়ার কঠিন ট্রেনিং চলছে এখন...; পরপুরুষে আবেগ ছেড়ে ঘর-পুরুষে আবেগী হবার সূক্ষ্ম ও অদৃশ্য ট্রেনিং চলছে এখন...; কপালে লাল টিপ পরে পিঠ-দেখানো ব্লাউজে মুসলিম নারীর টকশো কিংবা ফেসবুক-পোস্ট প্রায় বন্ধ এখন...; পুরো মানবজাতি মিতব্যয়ী, সাশ্রয়ী, ধর্মভীরু, নীতিনিষ্ঠ, সভ্য ও পুতপবিত্র হয়ে উঠছে এখন...। কুৎসা-হিংসা-বিদ্বেষ-যুদ্ধবিগ্রহ-হানাহানি ছেড়ে পরস্পরের উপকার ও সহযোগিতায় এক হয়ে সমচিন্তা ও সমমনায় শুধু অদৃশ্য করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে পুরো পৃথিবী।
লক্ষ মানুষের মৃত্যু-ক্ষতির কারণ বাদ দিলে আর বাকি হাজার কোটি মানুষের চিন্তা ও মননের পরিবর্তনে এ অস্পৃশ্য করোনা-শক্তি আবির্ভাবের যে দরকার ছিল, তা বিজ্ঞানীরাও মনে করছেন। বিশ্ব-দৃশ্যের ও মনুষ্য-চরিত্রের চেহারা পাল্টানোয় করোনা-গডের আবির্ভাব ও পরিবর্তন এবং এরূপ জরুরি অবস্থা ছিল অত্যাবশ্যকীয় ও একান্ত কাঙ্খিত।
ক্ষণিকের আনন্দে বিভোর আর স্বার্থের নেশায় অন্ধ হয়ে করোনা-গ্রাসের আগ পর্যন্ত মানুষ ভুলে গিয়েছিলো- এ অন্ধ নেশার পথে কোথাও না কোথাও থামতে হবে; অর্থাৎ পূণ্যের সাথে পাপের পরিমাণেরও ব্যালেন্স থাকতে হবে। পূণ্যের চেয়ে পাপের প্রাচুর্য্যতার ভারে ভূ-প্রকৃতি ব্যালেন্স হারিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে তার আগ্রাসী থাবায় আঘাত হানে মনুষ্য সমাজের ওপর। তাই এখন এ অন্ধ-পাগল গ্রুপকে থামাতে গিয়ে পুরো পৃথিবীকেই থামিয়ে দিয়েছে করোনা-গড। এরূপ মানুষরা বিশ্বময় মানবতা ও প্রকৃতির ফুসফুস জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করার পর এখন মানুষের ফুসফুসই গ্রাস করতে এসেছে ঔষধবিহীন-অপ্রতিরোধ্য করোনা।
করোনা ভাইরাস আছে এখন সবার আশপাশে, সর্বত্রই ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবাই করোনার করাল গ্রাসের জালে আবদ্ধ। হয়ত কিছুদিন পর স্রষ্টা এখনকার মানবমনে করোনার পরীক্ষা-ফলাফল দেখার জন্য আপাতত এর ছোবল একটু প্রশমিত করতে পারেন। তবে কেয়ামত আকারে যেকোনো সময় সমগ্র মানবসমাজকে পর্যুদস্ত করতে এ করোনা-গড তার Character change করে অন্যরূপেও আসতে পারে আবার, যদি এ অহংকারী-অহংধারী-অত্যাচারীরা বর্তমান করোনা লকডাউনের এ বিরাট শিক্ষার সুযোগ নিতে সক্ষম না হয়।
এটিকে চায়নার রাজনীতি বলে উড়িয়ে দিতে চাইলেও এরূপ মহামারী পৃথিবী থেকে একেবারে উবে যাবে না কিন্তু। পৃথিবী সৃষ্টির আদিম সময়ের শক্তিশালী জীবাশ্ময় সাইবেরিয়া কিংবা চায়নার উহান কিংবা যেখানেই এসে পড়–ক না কেন-
করোনা এখন বংশবিস্তার করে ফেলেছে বিশ্বময়,
তারই নাগালে সবাই, নিশ্বাস তাই করোনা-সুবাশে পুতিগন্ধময়।
কারণ- করোনার এ আগ্রাসন শেষ নাও হতে পারে, হলেও তা সুদীর্ঘ সময় নেবে। মানুষের পাপ মোচন হয়ে বা মানুষ সংশোধিত হয়ে পৃথিবীতে ভালো-মন্দের তথা পাপ-পুণ্যের ব্যালেন্স হওয়ার পর তখনই কেবল হয়ত করোনা উঠিয়ে নিতে পারেন স্রষ্টা। এর মধ্যে কি হতভাগা ধূরন্ধর ইবলিশরা নিজকে বুঝবে? সুপথে তথা আল্লাহর নির্দেশিত পথে আসবে? নিজকে সংশোধন করবে? তারা সেখানে আসতে আসতে আরও লক্ষ কোটি প্রাণ ঝরবে হয়ত! এবং তারাও...।
চারদিকে আজ মহাশক্তিশালী করোনার অশরীরী করাল গ্রাস। মৃত্যুর হাতছানি আজ ক-ত জোরালো। পুরো বিশ্বে ওৎ পেতে অপেক্ষা করছে মৃত্যু, মৃত্যু আর মৃত্যু। এবারে শত-সহস্র-লক্ষ নয়, কোটি মৃত্যু হাতছানি দিচ্ছে তার অবিরাম প্রচন্ডতম ব্যস্ততায়। এ প্রিয় পৃথিবীর বিশ্বস্ত নিঃশ্বাসগুলো আজ কত ভয়ঙ্কর; আশপাশে মৃত্যুর সারি সারি লাশ। করোনার মুখেই কবির ভাষায় শোনা যাক...
আমি করোনা-গড বলছি
হে বিশ্বাসঘাতক নিষ্ঠুর ইতর মানুষ,
আমি কোভিড-১৯ ওরফে করোনা ভাইরাস।
আমি তোমাদের প্রতিরূপ!
আমি তোমাদের শিক্ষা!!
আমি তোমাদের কর্মফল!!!
আমিতো অতি ক্ষুদ্র একটি সত্তা।
কিন্তু সৃষ্টিকর্তা আমায় দিয়েছেন অপরিসীম ক্ষমতা!
আজ আমার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ মরছে।
স্ত্রী স্বামীর সাথে, সন্তান মায়ের সাথে আলাদা হয়ে যাচ্ছে।
আমার জন্য স-ব মানুষ ঘরবন্দী, পরাধীন...
এখন কে যাবে কোডেগো, যাবে কোডে?
শিশুদের ঘরে রেখে যাবে বাইরে আবারও?
হে পাপিষ্ঠ মানুষ, তোমাদের মধ্যেতো অনেক বৈষম্য-
অকৃতজ্ঞ স্ত্রী স্বামীকে লুটেপুটে খেয়ে ঘর থেকে বের করে দেয়;
শ্রেষ্ঠ সন্তানরূপে গড়ে তোলা ছেলেও বাবাবিরোধী হয়ে যায়;
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া মেয়ে জন্মদাতার খোঁজ রাখে না।
সুদীর্ঘ লকডাউনেও উদ্বাস্তু বাবার কেহই খোঁজ নেয় না;
দস্যি মাও সন্তানকে দেয় না সে নির্দেশ কিংবা অনুরূপ আদর্শ শিক্ষা।
তোমাদের মধ্যে এরূপ অনেক গোলমাল;
তোমরা বেজাত-বেলাজাত-বেসামাল।
তোমরা মানুষরা যে নিজেরাই নিজেদের মহামারী!
তার কী হবে? সেটা শেষ হবে কবে?
আজ পশু-পাখি রাস্তায় নেমেছে-
হোম কোয়ারেন্টাইন নামক মানুষের চিড়িয়াখানা দেখতে!
পশু-পাখি আর দানবের দাপটে
মানুষের ভেতরে জাগ্রত হয়েছে-
আজ প্রকৃত বন্ধু, প্রকৃত মানুষ, প্রকৃত আত্মীয়।
তোমাদের শিক্ষার এ পর্ব শেষ করো,
ঠিক হয়ে যাও, তারপরই আমি ফিরে যাবো।
এরপর আর কক্ষণো ওসব কোরো না কিন্তু!
তাহলে আমি আবার আসবো অন্যনামে,
অন্যরূপে নতুন শক্তিতে।
ইতি,
তোমাদের করোনা-গড
ভাইরাস দেখালো নিজের পরিবার আর আপনজনকে আমরা কত বেশি অবহেলা করি। আমরা পরিবারে/ঘরে জন্ম নিয়েছি, বড় হয়ে ঘর করার প্রতিশ্রুতিতে সঙ্গী নিয়েছি। আবার ধীরে ধীরে সেই ঘর প্রায় ছেড়েও দিয়েছি এবং অবশেষে এমনকি নিজ থেকে ঘরেও ফিরিনি, আপনজনদের সময় দেইনি। এমনও নজির রয়েছে যে- কর্মজীবী নারী তার ছুটির দিনেও নিজ পেটের শিশু-সন্তানকে নাস্তা না খাইয়ে লেকের পাড়ে সকালের গান শোনার কথা বলে বাইরে চলে গিয়েছে , তারপর রেডলাইট ডিস্ট্রিক্ট সেরে ঘরে ফিরে দেখেছে ঐ শিশু ঘুম হতে উঠে প্রায় দুপুর অবধি নাস্তা না খেয়ে শুধুই খেলছে। তাই বুঝি ভাইরাস জোর করেই আমাদেরকে শিশু-সন্তানদের কাছে, প্রিয়জনদের কাছে ফেরালো। প্রিয়জনদের সাথে নতুন করে দৃঢ় সম্পর্ক তৈরি করার বাধ্যগত সুযোগ তৈরি করে দিলো। বিপথগামী ও বিভ্রান্ত মা’দেরকেও বাইরে থেকে ঘরে ঢুকিয়ে একেবারে বন্দী করে রেখে মাসের পর মাস স্বামী-সন্তানদের কাছে থাকতে বাধ্য করেছে এ ভাইরাস।
ভাইরাস বুঝিয়ে দিয়েছে, জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত। যেকোনো সময়েই জীবনের ইতি হয়ে যেতে পারে। এই সংক্ষিপ্ত জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষ মানুষের জন্য, বিশেষত বয়স্ক আর শিশুর বেশি করে যতœ নেয়া। এদের মধ্যে শিশুরা পৃথিবী দেখার জন্য এবং বয়স্করা পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। তাই, এদেরকে বেশি বেশি করে সময় ও মনোযোগ দিতে হবে। এদেরকে খুব বেশি বিবেচনায় আনতে হবে; সহানুভূতি, মায়া ও ক্ষমা করতে হবে।
আমাদের ইচ্ছাশক্তির পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। আমরা ভালো হবো না মন্দ হবো, স্বার্থপর হবো না পরার্থপর হবো, ভালোবাসবো না ঘৃণা করবো, সাহায্য করবো না ছিনিয়ে নেবো, দান করবো না গ্রহণ করবো, সাহায্য করবো না নিপীড়ন করবো -এসব কিছু করার পূর্ণ স্বাধীনতা সবারই আছে। কিন্তু ক্ষমতা, খ্যাতি, বিত্তের দম্ভ -এসব কিছু নিমিষেই যেকোনো সময়ে চুপসে যেতে পারে। কেবল বড় কোনো শক্তির কাছেই নয়; এমনকি অতি ক্ষুদ্র এক আণুবীক্ষণিক ভাইরাসের কাছে। পুরো দুনিয়াটাকে অচলাবস্থায় নিয়ে যেতে পারে খালি চোখে অদেখা এক ভাইরাস। তাই আমাদের সব রকমের দম্ভ ও অহংকারকে যেন আমরা সবসময় নিয়ন্ত্রণের মাঝেই রাখি।
ভাইরাস স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে- কিছু মানুষ কত স্বার্থপর এবং এরা উচ্চকিত উচ্চারণে জড়বাদী, ভোগবাদী আর বিলাসী সমাজেরই কথা বলে বেড়াচ্ছে, নেতৃত্ব দিচ্ছে। তারা সর্বক্ষণ নিজের ব্যক্তিগত আনন্দ ভোগের পিছনেই ছুটছে, কিন্তু তার এই আনন্দের পেছনে যে আরেকজনের এমনকি বহুজনের অবদান, কষ্ট কিংবা অন্যকে দুঃখ-কষ্টে নিক্ষিপ্ত করার মতো ব্যাপার রয়েছে, সেসব তাদের বোধেই আসছে না।
পরিবারে ও সমাজে চরম সংকট তৈরি করে প্রাকৃতিক মহাদুর্যোগরূপে করোনা এসে বুঝিয়ে দিয়েছে, জীবনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো হচ্ছে- খাদ্য, পানি, ঔষধ। দামি বাড়ি, গাড়ি, লেটেস্ট ফোন-ট্যাব, ধনাঢ্য বন্ধু আর লাক্সারিয়াস রিসোর্টে ঘর-সংসার ফেলে একা চড়ে বেড়ানো নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি বাড়ি, গাড়ি আর ধনী বন্ধুও একজন মানুষকে বাঁচাতে পারে না; যেমন পারে- ঔষধ, খাবার আর পানি।
করোনা কেবল ভাইরাস নয়, এটি কেবল গ্রেট-ডিজাস্টারও নয়, এটি হচ্ছে গ্রেট-ক্যারেক্টর; প্রকৃতির প্রতিশোধ! তাই প্রকৃতি ও স্রষ্টার কাছে কিছু চাওয়ার পূর্বে এবং প্রকৃতি-বিরুদ্ধ কোনো অন্যায় করার পূর্বে প্রকৃতির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়টি আমাদেরকে বারংবার যথেষ্ট বিবেচনা করা উচিত। কারণ প্রকৃতির রুদ্ররোষ বড়ই নিমর্ম। সেই অবশ্যম্ভাবী ক্ষ্যাপা পাগলার রুদ্ররোষ থেকে কেহই রেহাই পাবে না। ১০ জনের ১০ অন্যায়ের ১০ দিন, আর প্রকৃতির প্রতিশোধ যেহেতু ১ দিন -তাহলে তার প্রলয়-প্রকম্পনের বিপর্যয় কত ভয়ঙ্কর হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। এরূপ রুষ্ঠ প্রকৃতিরই এক মহাপ্রলয় হচ্ছে এখনকার চলমান এই নির্মম করোনা মহামারী।
লক্ষ্য করে দেখুন, করোনার সঠিক ও নির্ভরশীল চিকিৎসা তথা ভ্যাকসিন কেন এখনো আবিষ্কার করা সম্ভব হয়ে উঠছে না এবং সে অসম্ভবকে সম্ভব করতে তথা আনুবীক্ষণিক একটি ক্ষুদ্র শক্তিকে বশীভূত করতে বিশ্বভান্ডারের সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বশক্তি বিনিয়োজিত করেও বছরের পর বছর সময় লেগে যাচ্ছে। তাইতো বিশ্বশীর্ষ ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্টও বাংকার-প্রকোষ্ঠে নিজের মৃত্যুর মহড়া বা কসরত করছেন। এ পৃথিবীর একজন মানুষও জানে না- অদৃশ্য করোনা আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে।
তাই এখনো সময় থাকতেই আমাদের প্রত্যেকের প্রবল আত্ম-উপলব্ধির সতর্কতা খুবই জরুরি। আমাদের মধ্যে যারা অন্যায়-অবিচারের সাথে জড়িত নন, তাদের ভালোত্ব ও মানুষ হিসেবে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে ও বজায় রাখতে সমাজে ও পরিবারে যেকোনো অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে যার যার সাধ্যমতো প্রতিবাদ করা এখনই জরুরি এবং তা এখন এ মহাদুর্যোগ সময়ের মৌলিক দাবি।
করোনা যুগে এখন সময় এসেছে স-ক-ল পারিবারিক ও সামাজিক নিষ্ঠুর নিবর্তন অপরাধের শাস্তি বিধানের। সময় এসেছে এসব অমনুষ্যোচিত আচরণের কারণে প্রকৃতির রুদ্ররোষ সৃষ্টিকারীদেরকে আইনের আওতায় এনে ক্ষতিগ্রস্থ অসহায়দের উদ্ধার ও তাদের পক্ষে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার। আমাদের মনে রাখতে হবে, এরূপ কিছু অন্যায়কারীর অনাচারে বিকলাঙ্গ ও পর্যুদস্ত মনুষ্য সমাজকে প্রকৃতি ও স্রষ্টা কেহই সহ্য করবেন না এবং তা করলেতো বিশ্বচরাচর সুশৃঙ্খলভাবে টিকে থাকবে না। আরও মনে রাখতে হবে, Injustice anywhere is a threat to justice everywhere; অর্থাৎ পাপের একটি বীজ যেখানে পড়ে, সেখানে দেখতে দেখতে সমগ্র মানব সমাজ কেমন করে অরণ্যে পরিণত হয়ে যায়, তা কেউ টেরও পায় না।
আসলে অন্যকে ঠকিয়ে কেউ লাভবান হতে পারে না, অন্যকে ঠকালে নিজকেই ঠকে যেতে হয়; আর ঠক-খাওয়া ব্যক্তি পেয়ে যায় স্রষ্টার কৃপা তথা প্রকৃতির আশীর্বাদ। কিন্তু প্রকৃতির সেই ইঞ্জিনিয়ারিং আমরা বুঝতে পারি না বলেই যত বিপত্তি। তাই ব্যক্তির একান্ত ভোগ বিলাসে লোলুপতা করে বেড়ানো এবং সমাজকে নীরব ঘাতকে কলুষিত করে ফেলা এরূপ ক্ষমতাবান পরাক্রমশালী অত্যাচারী ব্যভিচারীদেরকে রুখতে না পারলে আমাদের কারুরই রক্ষা নাই করোনার আগ্রাসনের থাবা থেকে। হে আল্লাহ, আপনি আমাদের সহায় হোন। আমীন!