লেবু খায় না এমন মানুষ পৃথিবীতে খুব কমই আছে। আমরা প্রাত্যহিক জীবনে সকলেই কমবেশি লেবু খেয়ে থাকি। সাধারণত খাবারের স্বাদ বাড়ানোর ক্ষেত্রে এটি ব্যবহার করা হয়। আবার করোনা মহামারির এই সময়ে লেবু একটি কার্যকরী মহৌষধ বলে প্রমাণিত। লেবু আকারে ছোট ফল হলেও এর উপকারিতা বিস্ময়কর! প্রচুর পুষ্টিগুণে ভরপুর একটি মাত্র লেবুর রয়েছে কোটি টাকার বিস্ময়কর উপকারিতা!!
লেবুপানি পান স্বাস্থ্যের জন্য আশ্চর্য উপকারী
পিপাসা মেটাতে লেবুপানি খুব চমৎকার একটি পানীয়। এতে রয়েছে প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং মিনারেল, যা শরীরকে আদ্র রাখে। একে শক্তিবর্ধক এবং বিপাকক্ষমতা বাড়ানোর অন্যতম পানীয় হিসেবে ধরা হয়। আমরা যখন সকালে ঘুম থেকে উঠি, আমাদের শরীর পানিশূন্য থাকে, যা পূর্ণ করার প্রয়োজন পড়ে। কুসুম-গরম পানিতে লেবুর শরবত শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ দূর করে, কিডনি ভালো রাখে এবং হজমে সাহায্য করে।
লেবুকে বলা হয় ‘সুপার ফুড’। ভিটামিন সি, এ, বি১, বি৬, ম্যাগনেসিয়াম, বায়োফ্লাভোনয়েড, প্যাকটিন, ফলিক এসিড, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম ও পটাসিয়াম -কী নেই লেবুতে!! পাকস্থলী, হৃদপিণ্ডের বিভিন্ন রোগসহ ইনফ্লুয়েঞ্জা, ল্যারিঞ্জাইটিস, ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ ও হাইপারটেশনে ভালো উপকার করে লেবু। স্বাস্থ্যের জন্যতো বটেই আরও অনেক কিছুর জন্যই লেবুর ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি। লেবুর রস করে প্রতিদিন খেলে শরীর তাজা থাকে। মেদ জমে না। আরও অনেক কিছুর জন্যও লেবু উপকারে লাগে। আসুন জেনে নিই লেবুর কিছু সুনির্দিষ্ট-বিশেষ উপকারিতা।
লেবুর স্বাস্থ্য উপকারিতা
১. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়ঃ লেবুতে থাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি ও লৌহ, যা ঠান্ডা ও ঠান্ডাজ্বর জাতীয় রোগের বিরুদ্ধে ভীষণ কার্যকর। এতে আরও আছে পটাসিয়াম, যা মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুকে সক্রিয় রাখে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। এতে থাকা অ্যাসকরবিক এসিড প্রদাহ দূর করে এবং অ্যাজমা বা এ জাতীয় শ্বাসকষ্টের সমস্যা কমায়। এছাড়াও কফ কমাতে সাহায্য করে লেবু।
২. গলা ব্যথা ও সর্দি থেকে মুক্তিঃ একটি লেবু মাঝামাঝি কেটে নিয়ে চুলার ওপরে ধরুন। যখন লেবুর কাটা অংশের রঙ বাদামী হয়ে যাবে, তখন লেবুটি চিপে ১ চা চামচ মধুর সাথে মিশিয়ে পান করে নিন। অথবা ৪ চা চামচ লেবুর রস, ১ কাপ মধু ও আধা কাপ অলিভ অয়েল মিশিয়ে ৫ মিনিট চুলায় রেখে গরম করে নিন। এই মিশ্রণটি ঠা-া হলে প্রতি ২ ঘণ্টায় ১ চা চামচ পান করুন। সমস্যার দ্রুত সমাধান পাবেন।
৩. দৃষ্টিশক্তি বাড়ায়ঃ আমাদের প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু চোখের সমস্যা থাকে। অনেকেই মাঝে মাঝে চোখে ঝাপসা দেখেন। চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। এই সকল ছোটোখাটো চোখের সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে নিয়ম করে প্রতিদিন লেবুর রস খান, লেবুর শরবত করেও খেতে পারেন। লেবুর রস চোখের দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে বেশ উপকারী।
৪. হজমে সহযোগিতাঃ যাদের হজমে সমস্যা, তাঁরা প্রতিদিন লেবুর শরবত খেতে পারেন। কারণ লেবুর রস হজমে সাহায্য করে ও পিত্তরসের উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করে। সেই সঙ্গে পরিপাক নালী থেকে বর্জ্য পদার্থ বের করে দেয়। লেবুর শরবত কোষ্ঠকাঠিন্যও দূর করে।
৫. ক্লান্তি দূরঃ দীর্ঘ পরিশ্রমের পর শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়লে এক গ্লাস লেবুর শরবত বানিয়ে খেয়ে নিন। কারণ লেবুর রস শরীরে লবণের ভারসাম্য আনতে সাহায্য করে।
৬. বুক জ্বালাপোড়া দূর করেঃ হৃদপিন্ডের জ্বালাপোড়ায় ক্যালসিয়াম ও অক্সিজেনের ভারসাম্য রক্ষা করে। এ সময় এক গ্লাস লেবুর রস আপনাকে আরাম দিতে পারে। যাদের এই সমস্যা আছে, রোজ আধাকাপ পানির মাঝে ১ চা চামচ লেবুর রস মিশিয়ে পান করুন।
৭. ত্বকের সুস্থতায়ঃ লেবুতে উপস্থিত ভিটামিন ‘সি’ ত্বকের কোষের ক্ষয় প্রতিরোধে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। শুধু তাই নয়, এই উপাদান শরীরে কোলাজেন তৈরি করে। যা মুখের অবাঞ্ছিত দাগ দূর করে ঔজ্জ্বলতা ফিরিয়ে আনে। লেবুর রস ত্বক ভাল রাখে। বলিরেখা ও ব্রণ প্রতিরোধে বেশ কার্যকরী।
৮. ওজন হ্রাসেঃ লেবুতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার বা আঁশ রয়েছে, যা ক্ষুধার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। এক গবেষণায় দেখা গেছে- যারা খালি পেটে লেবুর রস খান, তাদের ওজন দ্রুত হ্রাস পায়। সুতরাং ওজন বৃদ্ধি নিয়ে চিন্তা না করে প্রতিদিন সকালে লেবুর রস খান।
৯. মূত্রনালীর সংক্রমণ দূরঃ যদি মূত্রনালীতে সংক্রমণ ঘটে, তাহলে প্রচুর পরিমাণে লেবুর রস পান করুন। এটি আরোগ্য লাভে সাহায্য করবে।
১০. গর্ভবতী নারী ও গর্ভের সন্তানের জন্য ভীষণ উপকারিঃ গর্ভবতী নারীদের জন্য খুবই ভালো লেবুর শরবত। এটা শুধু নারীর শরীরই ভালো রাখে না। বরং গর্ভের শিশুর অনেক বেশী উপকার করে। লেবুর ভিটামিন সি ও পটাশিয়াম শিশুর হাড়, মস্তিষ্ক ও দেহের কোষ গঠনে সহায়তা করে। মাকেও গর্ভকালে রোগবালাই থেকে দূরে রাখে।
১১. লিভার পরিষ্কার রাখেঃ লেবুতে বিদ্যমান সাইট্রিক অ্যাসিড কোলন, পিত্তথলি ও লিভার থেকে বর্জ্য পদার্থ বের করতে সাহায্য করে।
লেবুর রসের আরও আশ্চর্য উপকারিতা
১. ত্বক ফর্সা করেঃ একটি লেবুর অর্ধেক অংশ কেটে তার রস বের করে নিন। এবার লেবুর রসের সঙ্গে ২ টেবিলচামচ মধু মিশিয়ে মিশ্রণটি ত্বকে ১৫ মিনিট লাগিয়ে রাখুন। শুকিয়ে গেলে ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। মধু ত্বক উজ্জল করবে এবং লেবুর প্রাকৃতিক উপাদান ত্বককে আরও ফর্সা করে তুলবে।
২. ত্বকের তৈলাক্ত ভাব কমাতেঃ ত্বকের তৈলাক্ত ভাব দূর করতে একই পরিমাণ শসার রস ও লেবুর রস মিশিয়ে মুখে লাগিয়ে নিন। এতে ত্বকের তৈলাক্ত ভাব দূর করে ত্বক সতেজ হবে।
৩. মুখের উজ্জ্বলতায়ঃ একটি লেবুর অর্ধেক অংশ কেটে তার রস বের করে নিন। এবার তার সঙ্গে ১০ টেবিল চামচ দুধ মিশিয়ে নিন। এবার মিশ্রণটি মুখে ধীরে ধীরে ম্যাসাজ করুন। এরপর ১৫ থেকে ২ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন।
৪. ত্বকের উজ্জলতায়ঃ ডিমের সাদা অংশের সঙ্গে অর্ধেক লেবুর রস ও এক টেবিল চামচ কমলা লেবুর রস উষ্ণ গরম পানিতে মিশিয়ে ত্বকে লাগান। ২০ মিনিট রেখে ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এটি ত্বকের তৈলাক্ত ভাব কম করার পাশপাশি উজ্জ্বলতা বাড়ায়।
৫. হাত ও পায়ের রুক্ষভাব দূর করতেঃ লেবুর রসের সঙ্গে একই পরিমাণ চালের গুড়া মিশিয়ে ভালভাবে হাতে-পায়ে লাগিয়ে নিন। এতে ত্বক আগের চেয়ে অনেক বেশী কোমল হবে।
৬. ব্রণের সমস্যা দূর করতেঃ ব্রণের সমস্যা দূর করতে লেবুর জুড়ি নেই। সমস্যায় আক্রান্ত ত্বকের উপর এক টুকরা লেবু ঘষে নিলে তা ব্রণ শুকিয়ে যেতে সাহায্য করে। লেবুর ভিটামিন সি’তে রয়েছে অ্যান্টিমাইক্রোবাইয়াল এবং হিলিং প্রোপার্টিজ, যা ত্বক সুস্থ করতে সাহায্য করে। ত্বকে লেবুর রস লাগিয়ে পাঁচ থেকে ১০ মিনিট অপেক্ষা করে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।
লেবুর গন্ধের অনুপম কিছু উপকারিতা
১. মানসিক প্রশান্তিঃ অনেকেই জানেন না, লেবু শুধু খেলেই নয়। ঘরের মধ্যে এক টুকরো লেবু রাখলে আপনার ঘর-বাড়ির পরিবেশই পাল্টে যাবে। লেবু অনেকটা অ্যারোমার কাজ করে। তাই ঘরে লেবু রাখলে মানসিক শান্তি মেলে, স্ট্রেস কমে যায়। মন শান্ত ও তরতাজা রাখতে লেবুর গুণ অসাধারণ।
২. ঘুমের শান্তিঃ শোয়ার ঘরে বা বেডের মধ্যে লেবু রাখলে খুব ভালো ঘুম হয়। লেবু যেহেতু অ্যারোমার কাজ করে, তাই মানসিক জোর ও লক্ষ্য স্থির রাখতেও সাহায্য করে। বুদ্ধির বিকাশ ঘটে দ্রুত। শুধু শোয়ার সময়ই নয়- কর্মক্ষেত্রে স্ট্রেস কমাতে ও মনোঃসংযোগ বাড়াতে আপনি যদি লেবুর গন্ধ নেন, দেখবেন এক নিমেষের মধ্যে সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে। কাজের প্রতি মনোসংযোগও বাড়বে।
৩. মন ভালো করে দেয়ঃ মুড চেঞ্জ করতেও লেবুর গুণ রয়েছে। লেমন ওয়েল ডিপ্রেসন কমাতে সাহায্য করে। শুধু মানসিক অবসাদ ঘোচাতেই নয়, আপনি মাঝে মাঝেই লেবুর গন্ধ নিতে পারেন; তাতে মন শান্ত থাকবে।
৪. বাতাস বিশুদ্ধ করেঃ লেবুর গন্ধ যেহেতু অ্যারোমার কাজ করে, তাই ঘরের পরিবেশকে বদলাতে এর সময় লাগে মাত্র কয়েক সেকেন্ড। ঘরের বাতাসে ভেসে থাকা ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলতেও লেবুর গুণ অপরিহার্য। ঘরে ক্লিনজারের কাজ করতে দরকার একটিমাত্র লেবুই!
৫. হাইপারটেনশনঃ কারোর যদি হাইপারটেনশন থাকে, তাহলে লেবুর গন্ধ নিতে পারেন। ব্লাড প্রেসার কন্ট্রোলে রাখতেও লেবুর জুড়ি নেই।
৬. পোকামাকড় তাড়ানোঃ লেবু ও লবঙ্গ একসঙ্গে রেখে দিলে, ঘরের মধ্যে পোকামাকড়, মশা-মাছি ধারেকাছে ঘেঁষবে না। বাড়িতে যদি শিশু ও বয়স্করা থাকেন, তাহলে এই প্রাকৃতিক উপায়টি একবার ট্রাই করে দেখতে পারেন।
লেবুর রসের আরও চমৎকার কিছু ব্যবহার
১. কাপড় থেকে কালির দাগ তুলতেঃ কাপড় থেকে কালির দাগ তুলতে দাগের ওপরে লেবুর খ- ভালো করে ঘষে নিন। লেবুর সাইট্রিক অ্যাসিড দাগ দূর করে দেবে নিমেষেই। এরপর ভালো করে কাপড় ঠাণ্ডা জলে ধুয়ে নিন। ব্যস, সমস্যার সমাধান!
২. সাদা কাপড়ের হারানো উজ্জ্বলতা ফিরিয়ে আনতেঃ সাদা কাপড় বেশ কয়েকবার ধোয়া হলেই হলদে ভাব চলে আসে। এই সমস্যার সমাধান পেতে ২ মগ পানিতে আধা কাপ লেবুর রস মিশিয়ে কাপড় কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখুন। এরপর ভালো করে ধুয়ে নিন। দেখবেন সাদা কাপড়ের হারানো উজ্জ্বলতা ফিরে এসেছে।
লেবুর এতো আশ্চর্য গুণের কারণেই বলা হয়, এক টাকার একটি লেবুর রয়েছে কোটি টাকার বিস্ময়কর উপকার!!