॥ পূর্ব প্রকাশিতের পর -৩ ॥
মা’র চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট জটিলতায় পড়ে আমি কত বিষয়ে যে ‘বিজ্ঞানী’ হবার সুযোগ পেয়েছি, তা লিখে শেষ করবার নয়। বিশেষত বাংলাদেশের চিকিৎসাজগতে সফিসটিকেটেড জিঞ্জিরা বাণিজ্যও যে চলে, তা মা’র দেখভালের দায়িত্বে না থাকলে ততটা বুঝতাম না; যেমনি বুঝতাম না থাইল্যান্ডের বামরুনগার্ড হাসপাতাল বা লন্ডনের রয়্যাল লন্ডন হাসপাতাল পরিদর্শনে না গেলে। শুধু ইউরোপ-আমেরিকা-সিঙ্গাপুর-থাইল্যান্ডই নয়, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের হাসপাতাল ও ডাক্তারদের মুখোমুখি হলেই বোঝা যায় তাদের সাথে বাংলাদেশের অধিকাংশ ডাক্তার মহাশয় ও হাসপাতালের কত বিস্তর ব্যবধান। সেসব দেশে চিকিৎসার বিল পরিশোধকালীন নির্ভরশীলতা ও কৃতজ্ঞতার এমনও অনুভূতি হয়, যেন তাদের নির্ধারিত বিলের অতিরিক্ত কিছু দিয়ে আসি। স্বল্পক্ষণের পরিচয়েই তারা ডাক্তার থেকে যে বন্ধুতে পরিণত হয়ে যায় এ শুধু আমারই কথা বা অনুভূতি নয়, এ অনুভূতি এমন সকলের, যারাই দেশের বাইরে চিকিৎসা বা স্বাস্থ্য পরীক্ষার সুযোগলাভ করেছে। সেসব দেশের জীবনযাত্রা ব্যয় বেশি বিধায় তাদের চিকিৎসার বিল আমাদের দেশের তুলনায় হয়ত বেশি; কিন্তু কখনই তাদেরকে পেট কাটা বা কসাই বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশে ইদানিংকালে কিছু অত্যাধুনিক হোটেল ও হাসপাতাল হয়েছে, যার অধিকাংশ যতটা না সেবামুখী, তার চেয়ে বেশি টোলমুখী। এদের কার্যক্রম গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করলে বোঝা যায়, বাণিজ্যিক ও সামাজিক চ্যানেল তৈরি ও বজায় রাখার উদ্দেশ্যকে মুখ্য করেই এগুলো প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত। স্বচ্ছতা-জবাবদিহি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে তথা ইন্সপেকশন ও মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার ও নিয়মিত হলে এসব হোটেল ও হাসপাতালের টিকে থাকাই দায় হতো। মানবসেবা, দেশপ্রেম কিংবা পেশাগত কোনো কমিটমেন্ট বা দায়-দায়িত্ব এদের ধাতে নেই। তাইতো বাংলাদেশের সর্বাধিক ব্যয়বহুল পাঁচতারকা হোটেলকে খাদ্য ও সেবা মানের ত্রুটির দায়ে সরকারের ভ্রাম্যমাণ আদালত কর্তৃক জরিমানা গুনতে হয়েছে।
ডাঃ সাখাওয়াত সাহেব দু’টো হোমিও ঔষধ লিখে দিলে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, এলোপ্যাথিক চিকিৎসার মাঝে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় অসুবিধা হবে কি? বললেন, না। জানতে চাইলাম, এলোপ্যাথি কবে বন্ধ করব? বললেন, আপনারাই বুঝতে পারবেন বন্ধ করতে হবে কিনা বা কবে বন্ধ করতে হবে। তাঁকে বললাম, আপনার চেম্বারে প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতির মূল্যবান ও সমৃদ্ধ বহু বই রয়েছে। এগুলো বাংলায় প্রকাশের ব্যবস্থা করা গেলে মানুষ চিকিৎসা জগতের অনেক বিভ্রান্তি থেকে নিষ্কৃতি পেত, উপকৃত হতো বহুলভাবে। এসবের ওপর ব্যাপক আলোচনাও হওয়া দরকার। এরূপ বিভিন্ন আলাপচারিতা ও রোগীর ভিড়ে অতঃপর বিদায়।
ফিরতি পথে ভাবলাম মানুষের জীবন নিয়ে কিছু মানুষের যত মঙ্গল চিন্তা, তার চেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের ততোধিক অমঙ্গল যে চিন্তা, তা শুধুই বাণিজ্যবৃত্তির জন্য। অর্থাৎ এ সমাজে কিছু মানুষ থাকে জীবনের সন্ধানে, আর কিছু মানুষ থাকে জীবন বিধ্বংসে। মানুষে মানুষে জীবন-মৃত্যুর এই হোলিখেলার একটি সমীকরণ হওয়া দরকার। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে সংশয় থাকলেও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার দায় এড়ানোর সুযোগ নেই নিশ্চয়ই।
হাসপাতাল থেকে মা’র ফেরতের ২২ দিনের মাথায় তারাবি নামাজের পর সেলফোন হাতে নিয়ে দেখি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকপতœী এবং প্রাকৃতিক চিকিৎসায় নিবেদিতপ্রাণ মিসেস তাজকেরা খায়েরের মিসড কল। তাকে কলব্যাক করতেই প্রশ্ন, কেমন আছেন? বললাম, ভালো আছি। জানতে চাইলেন, আপনার আম্মা কেমন আছেন? উত্তর না দিয়ে প্রশ্ন করলাম, মা’র কথা কোথা থেকে শুনেছেন? বললেন তাঁকে নিয়ে দৌড়াদৌড়িতে আছেন শুনেছি, তাই ফোন করলাম। বললাম, বিভিন্ন সিসিইউ ও আইসিইউ ফেরত হয়ে She is now better than before and is getting better & better. বললেন আলহামদুলিল্লাহ, মায়ের এরূপ সংকট অবস্থায়ও আপনার মুখ থেকে ‘ভালো আছি’ শুনে খুশি হলাম। এরপর বললেন থাইল্যান্ড থেকে Reflexology এবং Metaphysical Meditation এ ব্যুৎপত্তিলাভ করে এসেছেন এ কে এম আনোয়ারুল হক। তিনি আমার এখানে অর্থাৎ মাইন্ড এন্ড বডি হারমনি সেন্টারে বসেন। আপনি বললে তাঁকে নিয়ে আপনার আম্মাকে দেখতে আসব। বললাম, এটিতো আরেক রহমত!
মাকে দেখে চোখ বুঁজে ৫ মিনিটের মধ্যেই আনোয়ার সাহেব বলে দিলেন মা’র শিশুবেলা ও মধ্য বয়সের দু’টি ঘটনার কথা, সেই সাথে বর্তমান স্বাস্থ্যগত ক্রাইসিসের স্বরূপ। মাও তাঁকে এবং তাজকেরা খায়েরকে পেয়ে অধিক প্রাণবন্ত হয়ে বললেন হ্যাঁ, শিশুবেলায় এরূপ হয়েছিল। এরপর আনোয়ার সাহেব বললেন কোনো ঔষধ বা চিকিৎসা চলতে থাকলে আমি তা বন্ধ করতে বলব না, তবে Reflexology এবং Metaphysical Meditation এর কয়েকটি টেকনিক আমি দেখিয়ে দেব, যেগুলো করলে আপনি দ্রুত আরোগ্যলাভ করবেন এবং কিছুদিনের মধ্যেই একেবারে ভালো হয়ে যাবেন। এসবে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই, জ্বালা-যন্ত্রণা বা ব্যথা-বেদনা নেই, নেই কোনো ক্ষতি বা ক্ষতিকর কোনোই প্রভাব। এরপর শরীরের কয়েকটি রিফ্লেক্স পয়েন্ট এবং মেরিডিয়ান চ্যানেল ও গ্ল্যান্ডের বিভিন্ন পয়েন্টে বিশেষ কৌশলে চাপ দিয়ে ১০ সেকেন্ডের মধ্যে ছেড়ে দেয়া এবং দু’হাতে মুখ চেপে কিছুক্ষণ থাকা শিখিয়ে দিতে দিতেই মা বললেন, আমি ভালো বোধ করছি।
এভাবে প্রতিদিনই ভালোত্ব লক্ষ্য করতে করতে ২/৪ দিনের মধ্যে মায়ের রুম থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার, নেবুলাইজার, ইনহেলার, পালস অক্সিমিটারসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি এবং ঔষধের বাক্স সরিয়ে নিয়েছি; তার পরিবর্তে শয়নপাশে বসিয়ে দিয়েছি মানিপ্ল্যান্টের টব ও সুদৃশ্য অর্কিড ফুলসহ জীবন্ত গাছ। শরীরে অক্সিজেন দেয়া এবং শরীর থেকে কার্বন বের করে নেবার কৃত্রিম যন্ত্র বাইপাপ’র পরিবর্তে অক্সি-কার্বনের প্রাকৃতিক কারখানারূপী গাছের সাথে ভোর থেকে সন্ধ্যার পূর্ব পর্যন্ত চলে মা’র সখ্যতা।
মাকে বলেছি, এ গাছের সাথেও আপনার বন্ধুত্ব করতে হবে। গাছকে বলবেন আমি তোমাকে কার্বন দিচ্ছি আর তোমার থেকে নিচ্ছি অক্সিজেন, আমাদের লেনদেন সমানে সমান; আমাদের পরস্পরের কাছে কোনো দায় নেই; আমরা পরোপকারী, আমরা দায়িত্বশীল, আমরা কৃতজ্ঞ, আমরা সার্থক-সফল-কামিয়াব।
এভাবে বিভিন্ন কৌশলে নিজের সাথে নিজে কথা বলে আমার মা তাঁর শরীরে ভারসাম্য ও ছন্দ (Balance & Harmony) ফিরিয়ে আনছেন। নিজকে দায়মুক্ত ও ভারমুক্ত করে আত্মা ও চেতনাকে স্বচ্ছ ও পবিত্র করছেন। নিদেনপক্ষে গাছকে কার্বন দিয়ে হলেও প্রকৃতির কল্যাণ বা অন্যের উপকারার্থে বেঁচে থাকার সার্থকতা খুঁজে পাচ্ছেন। আত্মবিশ্বাস, আত্মশক্তি ও আত্মার নির্বাণের সুখ জাগ্রত করে চলেছেন। আত্মশক্তি জাগানোয় সহযোগিতার প্রতীক হিসেবে তথা নির্ভরতার জন্য Physical dymension এ গাছ রাখা হয়েছে তাঁর রুমে। আসলে মুখ্য বিষয় ও উদ্দেশ্য হচ্ছে, তাঁর নিজের সাথে নিজেই বিভিন্ন পজিটিভ কথা বলার সুযোগ তৈরি। আত্মশক্তি জাগানোর এ সুযোগ তৈরিতে আমি বা আমরা তাঁকে সাহায্য করছি মাত্র। প্রকৃতপক্ষে মা’র চিন্তা-চেতনা ও আত্মা তাঁর দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত ...She is the captain of her soul, so she is bossing on her mind. তিনি যেভাবে কমান্ড দেন, সেভাবেই তাঁর অন্তর্জগৎ নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়।
দেহের বিভিন্ন Function বা ক্রিয়া সচল রাখতে, শরীরের ব্যালেন্স ও ছন্দ ঠিক রাখতে এবং শরীরে জমে যাওয়া নেগেটিভ সাবস্টেন্স (টক্সিন, অক্সিডেন্ট) ক্লিন করতে এরূপ মন নিয়ন্ত্রণ খুবই প্রয়োজন। শরীরের কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যদি ব্রেনের কমান্ড নিতে না পারে, তাহলে সেই অঙ্গের ঋঁহপঃরড়হ বন্ধ হয়ে যায়। যেমন আমার মা’র ফুসফুস ব্রেনের কমান্ড নিতে পারছিল না বলেই তাঁর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে মারাত্মক অসুবিধা হচ্ছিল। তাই প্রাথমিকভাবে ঔষধ খাওয়া, তারপর অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং শেষতক বাইপাপ যন্ত্রের দরকার হয়ে পড়েছিল। সাধারণত ঔষধ ও যন্ত্রে সাময়িক স্বস্তি হলেও মূল অসুখের নিরাময় হয় না বরং সময়ান্তরে সেই অসুখ বেড়ে যায় অথবা প্রতিক্রিয়া হিসেবে অন্য অসুখ দেখা দেয়। তাই আমি বা আমরা তাঁর ফুসফুসের ওপর ব্রেনের কমান্ড প্রতিষ্ঠায় কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে তাঁকে সহযোগিতা করছিলাম এবং তিনি ফুসফুসের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন, আলহামদুলিল্লাহ।
ধৈর্যশীল পাঠক, এভাবেই প্রকৃতি চর্চা ও প্রাকৃতিক চিকিৎসার বদৌলতে আমার মাকে এখন আর হুইল চেয়ারে বসতে হয় না। অক্সিজেন সিলিন্ডারকে টা-টা দিয়ে তিনি নিজে নিজেই ডাইনিং টেবিলে বা টয়লেটে যাওয়া-আসা করতে পারছেন। স্রষ্টার কৃপার কৃতজ্ঞ মাকে ধন্যবাদ, আপনারাও সুস্বাগত এরূপ প্রাকৃতিক চিকিৎসার জগতে, ধন্যবাদ সবাইকে।
(চলবে)
সুস্থতা ও শতায়ুলাভে প্রাকৃতিক চর্চা ও চিকিৎসা
Be Your Own Doctor -এ বইটির
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৩৪৬, মূল্যঃ ৩৫০ টাকা
প্রাপ্তিস্থানঃ ক্যাম্পাস পত্রিকা অফিস
৩৩ তোপখানা রোড, ১৩ তলা, ঢাকা।
ফোনঃ ৯৫৫০০৫৫, ৯৫৬০২২৫