বিশেষ খবর



Upcoming Event

অভাবের তাড়নায় শিক্ষকের আত্মহত্যা

ক্যাম্পাস ডেস্ক মতামত

অভাবের কারণে ময়মনসিংহের ভালুকা থানার প্রাইমারি স্কুলের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত একজন শিক্ষকের আত্মহত্যার খবর দৈনিক আজকের পত্রিকাসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিদিনই দেশে বিদেশে স্বাভাবিক মৃত্যুর বাইরে অনেক অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা জানতে পারছি। এদের মধ্যে কিছু কিছু ঘটনা মনে বড় ধরনের দাগ কাটে। আর্থিক অভাবের কারণে একজন শিক্ষকের আত্মহত্যা, সে দিক থেকে বেদনার, সেই সাথে কষ্টের, বিষয়টি নিয়ে ভাবার তাগিদ সৃষ্টি করে। একটি স্বাধীন দেশের ৪৪ বছর সময় অতিক্রম করা, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটির ক্ষমতাসীন থাকা, দরিদ্রতম দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পর্যায়, সেই সাথে উন্নয়নের জোয়ারের গগনবিদারী প্রচার, সেই রকম একটি সময়ে একটি দেশে একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের আর্থিক অনটনের কারণে আত্মহত্যার ঘটনা বিচার বিবেচনার দাবি রাখে। শিক্ষক জাতি গড়ার কারিগর, জাতির বিবেক এবং শিক্ষার্থীদের জন্য দ্বিতীয় জন্মদাতা, এগুলি ইতিহাসের অংশ, তবে বর্তমান বাস্তবতায় এর অনেক ক্ষেত্রেই মিল পাওয়া কঠিন। ৩০ টাকা মাসিক বেতন ৪৪ বছরের ব্যবধানে ৩০০ গুণ বেড়েছে, তবে ঐ সময়ের বাজার ব্যবস্থায় ৩০ টাকা দ্বারা ঐ শিক্ষক যে সুবিধা ভোগ করেছে, আজকের শিক্ষক ৩০০গুণ বেশি বেতন পেয়েও আগেকার সেই সুবিধা পাচ্ছে না। না পাওয়ার পেছনে অনেক কারণ আছে, তার মধ্যে প্রধান রাষ্ট্রীয় নীতিও বাজার ব্যবস্থা।
সোমারসেট মমের গল্পে যেমন বলা হয়েছে, সর্বত্র পানি আছে কিন্তু খাওয়ার মত এক ফোঁটাও পানি নেই। ৪৪ বছরের ব্যবধানে অনেক উন্নয়ন হয়েছে, বাঁশ আর খড়কাঠির ঘরের স্থলে কংক্রিটের প্রাসাদপম বাড়ি, বাহারি গাড়ির হয়তো অভাব নেই। ১৮ বছর আন্দোলনের পর এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের ১০০টাকার বাড়ি ভাড়া ৫০০টাকা করে মিডিয়ার সামনে যেমন শিক্ষামন্ত্রী বারবার প্রতিধ্বনি করে বলেছিলেন, বাড়ি ভাড়া পাঁচগুণ, বাড়ি ভাড়া পাঁচগুণ, বাড়ি ভাড়া পাঁচগুণ বাড়ানো হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রীর এই ঘোষনায় মিডিয়া এবং দেশবাসী হয়তো হতবাক হয়েছিলেন বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীদের বাড়িভাড়া এতো বাড়ানো হলো। উনারা কিন্তু জানতে পারেননি পাঁচগুণ মানে কত টাকা? যদি উনারা জানতেন ১০০ টাকার পাঁচগুণ = ৫০০ টাকা, তাহলে হয়তো বুঝতেন। এমপিওভুক্ত একজন কলেজ অধ্যাপক (ডিগ্রি) যার বেতন স্কেল ডিসি পদ মর্যাদার কর্মকর্তার সমান তার বাড়িভাড়া মাসিক ৫০০ টাকা, বাংলাদেশের কোথাও এ টাকায় ১ দিন থাকা যায় কিনা সেটা বোধ সম্পন্ন সবারই বোঝার কথা।
স্নাতক পাঠদানকারী একজন শিক্ষক অথবা উপসচিব পদমর্যাদা সমান পদের একজন অধ্যক্ষকে মাসিক ৫০০টাকা বাড়ি ভাড়া দিয়ে যদি পালন করা সম্ভব হয় তবে বিশ্বায়নের এযুগে সেটা অবশ্যই ব্যতিক্রমী এবং শাসকের ক্ষমতার প্রশংসা না করে পারা যায় না। এমন অসম্ভব কাজ সমাধান করার জন্য সেই রাষ্ট্রের শাসকদের নোবেল পুরস্কারের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি বিবেচনা করা অবশ্যই কাল্পনিক হবে না। টাকায় ৮ মণ চাল পাওয়া যেত, সেই কারণে সেই সময়ের শাসক শায়েস্তা খান ইতিহাসের অংশ হয়ে আছেন, আমোদের শাসকরাও ইতিহাসের অংশ হবেন, তবে শায়েস্তা খানের মত নয়। পন্ডিত মশায়ের গল্পে লাট সাহেবের তিন ঠ্যাং (পা) ওয়ালা কুকুরের জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে মাসিক বরাদ্দ ৭৫ টাকা। আর পন্ডিত মশায়ের মাসিক বেতন ছিল ২৫। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে পন্ডিত মশায়ের প্রশ্ন ছিল পন্ডিত মশায়ের মাসিক বেতন লাট সাহেবের কুকুরের কয়টি ঠ্যাংয়ের সমান? পন্ডিত মশায়ের সেই গল্পের বড় বেশি পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না । ভালুকার অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষকের আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে সেটার প্রমাণ পাওয়া যায়। অবসরপ্রাপ্ত ঐ শিক্ষক বেসরকারি প্রাথমিক স্কুলে চাকরি করে অবসরে গিয়েছেন। ৫০০ টাকা মাসিক বেতনে তার চাকরির শুরু সর্বশেষ বেতন স্কেলের শতভাগ বেতন পেয়েছেন। সর্বসাকুল্যে টাকার অংকে ৫০০০ টাকার মত। ৫ সদস্যের পরিবার, মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছেন, অর্থের অভাবে বড় ছেলেটা লেখাপড়া বন্ধ করে গার্মেন্টসে চাকরি নিয়েছেন, বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করার কারণে না পেয়েছেন এককালীন অর্থ, না পাবেন পেনশন। অবসরের ১ মাস পরেই বেসরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলি সরকারি হয়েছে। ২৬০০০ স্কুলের সকল শিক্ষকই সুবিধা পাবেন কিন্তু ঐ শিক্ষকের কপালে সেটা হলো না। সব মিলে আর্থিক দৈন্যদশা থেকে মানসিক হতাশা, বয়স বৃদ্ধির কারণে শারীরিক শক্তি কমেছে কিন্তু আর্থিক দৈন্যদশায় মানসিক শক্তি বেড়েছে। সব মিলে হত্যাশায়, মৃত্যুকেই সে সব সমস্যার সমাধান ভেবেছেন। তবে তিনি মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে একটি মেসেজ রেখেছেন, আর তা হলো, সারা জীবনটাই তিনি অন্যের সন্তানদের পড়িয়েছেন, কিন্তু তার সন্তানটি আর্থিক অভাবের কারণে পড়াশোনা না করতে পেরে গার্মেন্টসে গিয়েছেন। নিশ্চয়ই এটা কম বেদনার নয়। শিক্ষা সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার, বিশেষ করে প্রাথমিক স্তরে এটির আরও বেশি বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সরকার সেই বিবেচনা থেকেই হয়তো সকল বেসরকারি প্রাইমারি শিক্ষাকে সরকারি করেছে। তবে প্রাইমারি স্কুলে কর্মরত শিক্ষকদের বেতন স্কেলের যে নিম্ন অবস্থান, তাতে বর্তমান বাস্তবতায় বিশেষ করে মুক্ত বাজার অর্থনীতির বাজারে টিকে থাকা কঠিন। বিএ পাস শিক্ষকের বেতন ৮ম শ্রেণি পাস ড্রাইভারের চেয়েও কম, বিষয়টি কেমন যে বেখাপ্পা।
শিক্ষা উন্নয়নের চাবিকাঠি। দেশ জাতি ও মানুষের উন্নয়নে শিক্ষার সংখ্যাগত উন্নয়ন সেই সাথে গুণগত উন্নয়নের বিকল্প নেই । শিক্ষা একটি দীঘ মেয়াদি বিনিয়োগ। দেশ জাতি ও মানুষের সঠিক উন্নয়নে শিক্ষাখাতে আর্থিক বরাদ্দ বৃদ্ধির বিকল্প নেই। সে জন্য ইউনেস্কো, ঘোষিত শিক্ষাখাতে জাতীয় বাজেটের এবং জিডিপি’র নির্ধারিত অংশ বরাদ্দ করা প্রয়োজন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে শিক্ষাখাতে আনুপাতিক হারে সেই বরাদ্দ কখনই দেয়া হয়নি বরং যেটি ছিল সেটিও কমেছে। অন্যদিকে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকল্প সাহায্য নিয়ে অপরিকল্পিত ব্যয়ের মাধ্যমে অস্বচ্ছতার নজির সৃষ্টি করা হয়েছে । প্রকল্পের অর্থে শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের দেশভ্রমণ আর গাড়ি বিলাস, অন্য দিকে শিক্ষাখাতে বাজেট হ্রাস নতুন এক সংকটের সৃষ্টি করেছে। ফলে বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা অবসরে যাওয়ার ৩ বছর পরও তাদের প্রাপ্য অর্থ পাচ্ছেন না। বিষয়টি শিক্ষামন্ত্রণালয় সেই সাথে রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারকদের ভাবার অবকাশ রয়েছে। শিক্ষক সমাজ আর কতকাল এইভাবে বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হবেন? মুক্তিযুদ্ধের আলোকে, ৭২এর সংবিধান এবং স্বাধীন দেশের প্রথম শিক্ষানীতি, বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই-খুদার সুপারিশকৃত শিক্ষানীতির আলোকে শিক্ষাক্ষেত্রে আর্থিক বরাদ্দসহ মর্যাদার বিষয়টি সুনিশ্চিত করার মধ্যেই রয়েছে শিক্ষা ক্ষেত্রে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের পথ। আশা করি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সরকার সে কাজটি করবেন। আর যেন শুনতে না হয়, আর্থিক সংকটের কারণে সারা জীবন ব্যাপী অন্যের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শেখানো শিক্ষকের ছেলে আর্থিক অভাবে লেখাপড়া করতে পারছে না, আর সেই দুঃখ ও গ্লানিতে শিক্ষক আত্মহত্যা করেছেন। এই ঘটনাই যেন শেষ ঘটনা হয়। সেই প্রত্যাশা আমাদের সকলের।
-লেখকঃ আকমল হোসেন
কলেজ অধ্যক্ষ,
সাংগঠনিক সম্পাদক
বাংলাদেশ কলেজ বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি


বিশ্ববিদ্যালয় কম্পাস পত্রিকার সংখ্যা সমূহ

আরো সংবাদ

শিশু ক্যাম্পাস

বিশেষ সংখ্যা

img img img