বেতন বৈষম্য নিরসনের দাবি পূরণ না হওয়ায় ১১ জানুয়ারি থেকে লাগাতার কর্মবিরতির কর্মসূচি দিয়েছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এ সময় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকালীন কোর্স পরিচালনা বন্ধসহ সব ক্লাস, পরীক্ষা ও দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকার ঘোষণা দেন তারা। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের মোজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী মিলনায়তনে প্রতিনিধিদের নিয়ে দীর্ঘ তিন ঘণ্টার বৈঠকের পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিগুলোর সম্মিলিত মোর্চা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন এক সংবাদ সম্মেলনে এই কর্মসূচি ঘোষণা করে। এ সময় ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির প্রতিনিধিরাও ছিলেন। কর্মসূচির বিস্তারিত তুলে ধরে ফেডারেশনের মহাসচিব অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কর্মবিরতি চলবে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আলোচনার আহ্বান এলে শিক্ষক নেতারা আলোচনায় বসবেন। কিন্তু প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে যতদিন না দাবি মেনে নেয়া হবে, ততদিন কর্মবিরতি প্রত্যাহার করা হবে না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি খুবই আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করছেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও কথাবার্তা হচ্ছে। খুব শিগগিরই সমস্যার সম্মানজনক সমাধান হবে বলে তিনি আশা করছেন। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরা আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার দ্রুত সমাধান চেয়েছেন। এর আগে শিক্ষকদের বিরোধিতার মধ্যেই সরকার গত ১৫ ডিসেম্বর অষ্টম বেতন কাঠামোর গেজেট প্রকাশ করে। পরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন দাবি আদায়ে ২৭ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলনে কমপ্লিট শাটডাউনের হুমকি দিয়েছিল। ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ জানান, তারা প্রতারিত হয়েছেন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত শিক্ষকদের দাবি মেনে নেয়ার সুস্পষ্ট অঙ্গীকার করেছিলেন, কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। অষ্টম বেতন কাঠামো ঘোষণার পর থেকেই গ্রেডে মর্যাদার অবনমন এবং টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিলের প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষকরা। এরপর সরকার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এসব দাবি পর্যালোচনায় কমিটি করে। গত ৬ ডিসেম্বর কমিটির সভাপতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে শিক্ষকদের বৈঠকে তিনটি দাবি নিয়ে মতৈক্য হয়। শিক্ষকদের তিনটি দাবির মধ্যে ছিল- অষ্টম বেতন কাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সপ্তম জাতীয় বেতন কাঠামোর অনুরূপ সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বহাল এবং এ ক্ষেত্রে সপ্তম বেতন স্কেলে বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা না কমানো; জ্যেষ্ঠ সচিবদের জন্য সৃষ্টি করা সুপার গ্রেডে সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত অধ্যাপকদের একটি অংশকে শতকরা হারে উন্নীত করার বিধান চালু এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রারম্ভিক বেতন সপ্তম গ্রেডে সম্ভব না হলেও অন্তত অষ্টম গ্রেড থেকে শুরু করা। কিন্তু প্রজ্ঞাপনে প্রথম দুটি দাবির প্রতিফলন না ঘটায় সব প্রতিশ্রুতি পূরণ করে অষ্টম বেতন কাঠামো সংশোধনের পর আবার গেজেট প্রকাশের দাবি জানিয়ে অর্থমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়েছিল শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। এ পরিস্থিতিতে তারা গতকাল তাদের ভাষায় কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হলেন। জানা যায়, বেতন স্কেলের গেজেট জারির পর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য অর্থ বিভাগ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে একটি পরিপত্র পাঠান। ওই পরিপত্রটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে জারি করা হয়। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় দাবি করছে, ১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত বেতন-বৈষম্য দূরীকরণ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভার গৃহীত সুপারিশ হিসেবে ওই পরিপত্র জারি করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওই পরিপত্রে বলা হয়, বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা তৃতীয় গ্রেডভুক্ত। পরবর্তী সময়ে নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করলে তারা সিলেকশন গ্রেড পেয়ে গ্রেড-১-এর বেতন পান। জাতীয় বেতন স্কেল-২০১৫-এর সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বিলুপ্ত হওয়ায় নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে গ্রেড-৩ ভুক্ত অধ্যাপকরা গ্রেড-২ ও পরে গ্রেড-১-এর বেতন পাবেন। গ্রেড-১ ভুক্ত অধ্যাপকের সংখ্যা গ্রেড-২ ভুক্ত যত অধ্যাপক আছেন তার ২৫ শতাংশের বেশি হতে পারবে না। আর যেহেতু গ্রেড-২ ও গ্রেড-১-এর বেতনের বিষয়ের সঙ্গে সরকারের উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আর্থিক সংশ্লেষ জড়িত, সে জন্য এই দুই গ্রেডে বেতন পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটি কমিটির পূর্বানুমোদনক্রমে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় তা কার্যকর করতে পারবে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক মাকসুদ কামাল জানান, তারা আইনমন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রীর মাধ্যমে জানতে পারেন যে, এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে হয়নি। এমনকি অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীও পরিপত্রে উল্লেখিত সিদ্ধান্ত সভায় নেয়া হয়নি বলে তাদের নিশ্চিত করেছেন। অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বলেন, ওই পরিপত্রে জাতীয় অধ্যাপকদের সিনিয়র সচিবদের সঙ্গে সুপার গ্রেডে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অথচ জাতীয় অধ্যাপকদের বিশ্ববিদ্যালয় মনোনয়ন দেয় না বা তারা সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদানের সঙ্গেও যুক্ত নন। বেতন কাঠামোর স্কেলে তাদের সম্মান নির্ণয় করা শোভন ও সমীচীন নয়। সিনিয়র সচিবের সমমর্যাদায় আনার প্রয়াসের মধ্য দিয়ে এই বরেণ্য ব্যক্তিদের অপমান করা হয়েছে। শিক্ষকদের নতুন কর্মসূচি সম্পর্কে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মুহম্মদ মিজানউদ্দিন বলেন, উপাচার্য হিসেবে আমরা সরকার ও শিক্ষক উভয়েরই প্রতিনিধি। তাই আমরা চাই একটি সম্মানজনক সমাধান। দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চলছে। যদিও কোনো সম্মানজনক সমাধান এখনও হয়নি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম বলেন, এ আন্দোলন শিক্ষকদের সম্মান রক্ষার আন্দোলন। ছাত্রদের ক্ষতির বিষয়ে তিনি বলেন, শিক্ষকদের সম্মান রক্ষায় ছাত্রদের একটু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ফরিদউদ্দিন আহমেদ জানান, বারবার অনুরোধ করার পরও দাবি মানা হয়নি। তারা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ব্যাঘাত না ঘটিয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছিলেন। এখন তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। নিজেদের মর্যাদার প্রশ্নে এখান থেকে ফিরে যাওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই। সংগঠনের মহাসচিব অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল জানান, গত প্রায় আট মাস অব্যাহতভাবে তারা অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অবনমনের প্রতিকার ও মর্যাদা রক্ষার জন্য আন্দোলন করে আসছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম সচল রেখেই তাদের দাবির পক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি ও পদক্ষেপ নিয়েছেন। সর্বশেষ গত ৬ ডিসেম্বর তারা অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে চূড়ান্ত পর্যায়ের আলোচনা সম্পন্ন করেছেন। অর্থমন্ত্রী তাদের সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কথা রাখেননি।