শিক্ষা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে জোর আলোচনা চলছে। ঠিক এ মুহূর্তে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা, পদোন্নতি, আর্থিক সুবিধাদি নিয়ে আন্দোলন। তাঁদের ন্যায়সংগত দাবির প্রতি জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনের কারণে শেষ পর্যন্ত গোঁফ নামাতে রাজি হয়েছেন স্বয়ং অর্থমন্ত্রী। তাঁর এই শুভবুদ্ধির উদয়কে সাধুবাদ জানাতে হবে। শিক্ষকদের এসব দাবির পাশাপাশি তাঁদের দায়িত্ব, কর্তব্য নিয়েও কথা উঠেছে। সে কথায় অভিযোগের সুর, আর সে তীর শিক্ষকদের দিকেই। জনগণের পক্ষ থেকে ওঠা এসব কথা বেমালুম অস্বীকার করা একেবারেই অনুচিত হবে।
জনগণের প্রত্যাশাগুলো কী কী? তাঁরা চান সন্তানেরা যেন উপযুক্ত শিক্ষা পায়, তারা যেন প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠে, প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারে, যেন তারা উপযুক্ত পেশায় নিয়োজিত হতে পারে। শিক্ষকদের কাছ থেকে এই হলো তাঁদের প্রত্যাশা। কিন্তু অভিযোগ, কোনো কোনো শিক্ষক সে দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করেন না। এ অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করাও যাবে না। তবে সমাজকেও বুঝতে হবে, শিক্ষক কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা নন। সমাজ যখন দুর্বৃত্তায়িত, শিক্ষকও তখন তার শিকার। তাকে আলাদাভাবে দোষারোপ করা অনুচিত।
বাংলাদেশে মূলধারার শিক্ষার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের মোটা দাগে চার ভাগে ভাগ করা যায়, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষক পদে যোগদানে যাঁরা ইচ্ছুক, তাঁদের এই পেশায় প্রবেশের আগেই (প্রি-সার্ভিস) শিক্ষকতা-বিষয়ক পড়াশোনা বাধ্যতামূলক নয়, বা দেশে তেমন ব্যবস্থাও গড়ে তোলা হয়নি। ব্রিটিশ যুগে আজকের বাংলাদেশে ৪৪টা গুরু ট্রেনিং স্কুল ছিল। পরবর্তী সময়ে সেগুলোকে করা হয়েছে প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (পিটিআই)। ঠিক এই মুহূর্তে দেশে ৫৯টি পিটিআই আছে। সেখানে চাকরিতে যোগদানের পর এক বছর মেয়াদি (ইন-সার্ভিস) সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন কোর্স করানো হয়। এখন তার অবসান ঘটিয়ে ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন নামে দেড় বছরের একটি কোর্স সেখানে চালু করা হচ্ছে, যা দেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের পেশাগত মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষকতার জন্য শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ একজন স্নাতক আবেদন করতে পারেন। সেই সঙ্গে ব্যাচেলর অব এডুকেশন ডিগ্রি থাকলে ভালো হয়। অন্যথায়, চাকরিতে প্রবেশের পর তিনি এই ডিগ্রি অর্জন করে নিজেকে একজন যোগ্য শিক্ষক হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন। কলেজ পর্যায়ে শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা নির্ধারণ করা আছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতকসহ (সম্মান) মাস্টার্স ডিগ্রি। সেখানে প্রার্থীকে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়। সব পর্যায়ে দ্বিতীয় শ্রেণি/সমমানের গ্রেড থাকতে হবে। একটির বেশি তৃতীয় বিভাগ/শ্রেণি/সমমান থাকলে চলবে না। তিনি একজন বিষয় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। বেসরকারি কলেজের জন্য শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু কোনো উচ্চতর ডিগ্রি, যেমন এমএস/এমফিল বা পিএইচডি তাঁকে তেমন কোনো অগ্রাধিকারী হিসেবে বিবেচিত হতে সাহায্য করে না।
সবচেয়ে অবাক বিষয়, শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে যাঁরা গ্রহণ করবেন, কলেজ পর্যায়ে হলে তাঁদের শিক্ষা বিষয়ে কোনো ডিগ্রি ব্যাচেলর অব এডুকেশন (বিএড), মাস্টার অব এডুকেশন (এমএড) প্রয়োজন হয় না। চাকরিতে প্রবেশের পরও শিক্ষা বিষয়ে কোনো ডিগ্রিই বাংলাদেশের কলেজ শিক্ষকদের জন্য আবশ্যকীয় নয়। এমনকি, কারও যদি শিক্ষা বিষয়ে কোনো ডিগ্রি থাকেও, তার কোনো মূল্য নেই কলেজশিক্ষায়। বর্তমান দুনিয়ায় শিক্ষায় ডিগ্রি (ডিগ্রি ইন এডুকেশন) ছাড়া শিক্ষকতা করা বোধ হয় কেবল বাংলাদেশেই সম্ভব! বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের সারা জীবনে মাত্র একবার পদোন্নতি পাওয়ার সুযোগ আছে, প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক হওয়ার। এরপর তিনি উপাধ্যক্ষ/অধ্যক্ষ হতে পারেন। কিন্তু আর কোনো সোপান তাঁদের নেই। আর সরকারি কলেজ শিক্ষকদের পদোন্নতির শর্ত হচ্ছে চার মাসের বুনিয়াদি ট্রেনিং আর বিভাগীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া। পদ শূন্য সাপেক্ষে পদোন্নতি পাওয়া যায় কোনো বিষয়ভিত্তিক নতুন জ্ঞান যাচাই বা পেশাগত ট্রেনিং বা গবেষণাপত্র প্রকাশ ছাড়াই। পদোন্নতির কোনো স্তরেই এসবের প্রয়োজন হয় না। তাহলে একজন পেশাজীবী শিক্ষক হিসেবে তিনি কীভাবে তাঁর সঠিক দায়িত্ব পালন করবেন? কীভাবে তিনি নিজেকে আরও যোগ্য শিক্ষক হিসেবে গড়ে তুলবেন?
প্রশ্ন হচ্ছে এই দায় কার? রাষ্ট্রেরই এই দায় বলে আমি মনে করি। কেন শিক্ষকতায় শিক্ষাবিজ্ঞান জানা আবশ্যকীয় করা হবে না? এ প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। আমি মনে করি, কলেজ শিক্ষকদের পেডাগজি বাধ্যতামূলক করা উচিত। চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে বিএড/এমএড ডিগ্রিকে অগ্রাধিকার দেয়া, বিশেষ ইনক্রিমেন্ট প্রদান করা, পদোন্নতির ক্ষেত্রে তা বিবেচনা করা উচিত। এবং অন্যদের প্রথম দুই বছরের মধ্যে বিএড ডিগ্রি অর্জন করা বাধ্যতামূলক করা জরুরি।
কিন্তু প্রশ্ন হলো এ জন্য বাংলাদেশে কতটুকু সুবিধা গড়ে তোলা হয়েছে? সত্যি কথা বলতে কি, এ ক্ষেত্রে আমাদের কোনো প্রস্তুতিই নেই। ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট ছাড়া দেশে মাত্র ১৪টি সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে এই ডিগ্রি প্রদানের মানসম্মত ব্যবস্থা আছে। দেশে বেসরকারি শ’ দেড়েক প্রতিষ্ঠান বিএড কোর্স করালেও তার মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটা প্রতিষ্ঠান ছাড়া সবাই ডিগ্রি বিক্রির বাণিজ্যে মেতেছে বলে অভিযোগ আছে।
এটা খুবই আশ্চর্যের বিষয় যে, দেশে কোনো পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়নি। এমনকি এমন কোনো দাবিও শিক্ষকদের তরফ থেকে কখনো করা হয়েছে বলে আমার অন্তত জানা নেই। কলেজশিক্ষকদের শতকরা ৯০ ভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনের পর শিক্ষাবিজ্ঞানে ডিগ্রি একান্তই অপ্রয়োজনীয় মনে করেন।
এই অবস্থার অবশ্যই অবসান হওয়া জরুরি। আজ যখন সর্বস্তরের শিক্ষক তাঁদের মর্যাদা রক্ষায় রাস্তায় যৌক্তিক আন্দোলন করছেন, তখন তাঁদের এ দাবিও তোলা জরুরি যে তাঁদের পেশাগত মান উন্নয়নের জন্য বিএডসহ উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ দিতে হবে। এ জন্য দেশে একটি স্বতন্ত্র শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। দেশ-বিদেশে তাঁদের শিক্ষা-বিষয়ক উচ্চতর শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, শিক্ষাভ্রমণ, গবেষণা করার সুযোগ দিতে হবে। তাঁদের জন্য অবশ্যই মানসম্মত জার্নাল প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশবিদেশে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে।
শিক্ষকতায় যোগদানে, আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবীরা সুযোগ পেতেন। এখন সেখানে দলবাজদের প্রাধান্য। মেধা নাকি সেখানে মূল্যহীন। বঞ্চনা এখন তার নতুন উপসর্গ। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দেশবিদেশে নানা সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে। নানা গবেষণায় নিয়োজিত থাকেন তাঁরা। পদোন্নতির জন্য গবেষণা এবং পাবলিকেশন বাধ্যতামূলক। তারপরও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নানা সমস্যায় জর্জরিত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আগের সুনাম ধরে রাখতে পারছে না। শুধু ডিগ্রি প্রদান নয়, বিশ্ববিদ্যালয়কে অবশ্যই গবেষণা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে।
আমরা জানি, এসব কাজ রাতারাতি হবে না। কিন্তু সরকার এবং শিক্ষক সমাজকে এসব বিষয়ে এখনই উদ্যোগী হয়ে আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন সাধন করতে হবে। অন্যথায় আজকের দিনে দ্রুত বিকাশমান পৃথিবীর সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে আমরা পিছিয়ে পড়ব। একটি শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন এখন সময়ের দাবি। সেখানে শিক্ষা-বিষয়ক গবেষণা হবে, ভালো শিক্ষক তৈরির জন্য শিক্ষা দেয়া হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে সম্প্রতি থাইল্যান্ড নতুন উদ্যোগ নিয়ে প্রমাণ করতে চাইছে, শিক্ষায় বিনিয়োগের চেয়ে লাভজনক বিনিয়োগ দ্বিতীয়টি নেই। আমাদেরও তা উপলব্ধি করতে হবে।
লেখকঃ আমিরুল আলম খান, শিক্ষাবিদ
amirulkhan7@gmail.com