॥ পূর্ব প্রকাশিতের পর -১৩ ॥
॥পর্ব ৫॥
সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রাণিজ
দুধে ব্যথানাশক প্রাকৃতিক এন্টিবায়োটিক
সুস্থ জীবনযাপন এবং দেহ-মন ও মস্তিষ্কের উপযুক্ত বিকাশের জন্য সুষম খাদ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। দুধ একটি সুষম খাদ্য। কারণ, দেহের প্রয়োজনীয় সব উপাদানই এর মধ্যে রয়েছে। শরীরের নানা ধরনের ঘাটতি মেটায় দুধ। এজন্য দুধকে বলা হয় আদর্শ খাবার। যারা ছোটবেলায় বেশি দুধ পান করেন,বৃদ্ধ বয়সে তারা অন্যদের চেয়ে বেশি সুস্থ থাকেন। তাদের হাড়ের গঠনও অন্যদের তুলনায় বেশি শক্ত থাকে।
কী আছে দুধে? এ নিয়ে নানা গবেষণা হয়েছে, নানা ব্যাখ্যা এসেছে। সম্প্রতি একদল বিজ্ঞানী জানিয়েছেন নতুন তথ্য। তাদের মতে দুধে রয়েছে ব্যথানাশক, জীবাণুনাশক এবং দেহের গঠন বৃদ্ধিতে সহায়ক হরমোনসহ ২০ ধরনের উপাদান।
স্পেন ও মরক্কোর গবেষকরা বিশ্লেষণের জন্য গাভীর দুধের পাশাপাশি ছাগলের দুধও সংগ্রহ করেন। এমনকি মানুষের দুধও নমুনা হিসেবে সংগ্রহ করা হয়। মানুষ ও প্রাণির অসুস্থতার চিকিৎসা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা দুধ নিয়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ঐ গবেষণা চালান। এতে দেখা গেছে, মানুষের দুধের মতোই গাভী ও ছাগলের দুধেও রয়েছে প্রয়োজনীয় অনেক উপাদান; যা রোগ-ব্যাধি প্রতিরোধ করে মানুষকে সুস্থ রাখে।
মেধা বিকাশে এবং ওজন কমাতে দুধ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুস্থ মস্তিষ্কের জন্য দুগ্ধজাত খাবার গ্রহণ জরুরি। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন হৃদরোগে আক্রান্ত বা মোটা হওয়ার ভয়ে অল্প বয়স থেকে অনেক ছেলেমেয়ে দুধ, পনির, ছানা বা দুধের তৈরি নানা খাবার গ্রহণে বিরত থাকছে; যা মোটেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। মস্তিষ্কের সুস্থ গঠন ও বিকাশের জন্য নিয়মিত দুধ এবং দুগ্ধজাত খাদ্যগ্রহণ অত্যন্ত আবশ্যক।
গবেষণায় দেখা গেছে যারা কম বয়স থেকে নিয়মিত দুধ, দই, পনির বা অন্যান্য দুধজাতীয় খাবার গ্রহণ করে, তাদের মানসিক স্বাস্থ্য অন্যদের তুলনায় অনেক ভালো। বিজ্ঞানীরা বলছেন মানব মস্তিষ্কের ৭৫ শতাংশ মাইয়েলিন চর্বি দ্বারা গঠিত, দুগ্ধজাত খাবারের উপাদান মস্তিষ্কের মাইয়েলিন চর্বির ঘাটতি পূরণে সাহায্য করে।
বিজ্ঞানীরা আরও জানান, দুগ্ধজাত খাবারের উপাদান মস্তিষ্কের কোষকে সবল ও নিরোগ রাখতে সাহায্য করে। তাই প্রত্যেক মানুষের মস্তিষ্কে মাইয়েলিন চর্বি সতেজ ও পুরোমাত্রায় থাকলে বুদ্ধিবৃত্তি বাড়ে। আধুনিক বিশ্বে হৃদরোগে আক্রান্ত বা মোটা হওয়ার ভয়ে সবাই লো-ফ্যাট বা কম চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণের দিকে ঝুঁকছে, যা মোটেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়; এর ফলে দীর্ঘমেয়াদে মস্তিষ্কের কোষ বৃদ্ধি বা এর সুস্থতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
যারা নিয়মিত দুধ পান করেন, তাদের জন্য সুখবর হচ্ছে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি প্রতিদিন ২ গ্লাস দুধ পান করলে ৬ মাসের মাথায় তার শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন ডি জমা হয়। এভাবে দুধ খাওয়া অব্যাহত রাখলে ২ বছর পর একজন মানুষের প্রায় ৬ কেজি ওজন কমে এমনটিই দাবি করেছেন ইসরায়েলের বেন গুরিওন ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক। গবেষক দলের নেতা দানিত শাহার বলেছেন দুধ ও দুধের তৈরি খাবারে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ডি থাকে, যা শরীরের ওজন কমাতে সহায়ক।
দুধ ও ডিমঃ হার্টের জন্যও ভালো
সুস্থতা ও দীর্ঘায়ুর জন্য প্রতিদিন অন্তত ১ গ্লাস দুধ এবং সপ্তাহে অন্তত ৫ দিন ডিম খাওয়া উচিত। দুধের মধ্যে ছাগলের দুধ অনেক রোগ প্রতিরোধে সহায়ক এবং ঔষধি গুণসম্পন্ন। তবে ছাগ-দুগ্ধ দুষ্প্রাপ্য বলে প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য প্রতিদিন ননীবিহীন গরুর দুধ ১ গ্লাস এবং সকালে ১ কাপ সাধারণ দই (Natural yogurt) খাওয়া উচিত।
ডিম-বিতর্কের অবসানঃ নিয়মিত ডিম খাওয়া নিয়ে বিতর্ক রয়েছে এবং পুষ্টিবিদ ও চিকিৎসকরাও একেকজন একেকরকম বলে যাচ্ছেন। দীর্ঘ এক বছর গবেষণা করে সম্প্রতি ডিম বিশেষজ্ঞরা বলছেন ডিম নিয়ে নিষেধের যে তর্জনী তোলা হয়, তার ন্যায্যতা নেই। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ট ফাউন্ডেশন বলছে সপ্তাহে ৬টি ডিম অবলীলায় খাওয়া যাবে, দুশ্চিন্তার কারণ নেই।
ডিম বিশেষজ্ঞ ডাঃ ডন ম্যাকনামারা বলছেন ডিমে যে কোলেস্টেরল থাকে, তা হৃদরোগে কোনো প্রভাব ফেলে না। ডিমে উন্নতমানের প্রোটিনসহ সব ধরনের ভিটামিন ও মিনারেল রয়েছে। সকালের নাস্তায় ডিম খেলে দুপুর পর্যন্ত যথেষ্ট এনার্জি পাওয়া যায়। স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের তালিকায় ডিম অপরিহার্য। যাদের দেহে উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল স্তর স্বাভাবিক পর্যায়ে রয়েছে, তারা দৈনিকও ডিম খেতে পারেন।
ডাঃ ম্যাকনামারা বলছেন, ডিমে কম পরিমাণে পরিনিষিক্ত চর্বি রয়েছে। গর্ভধারণকালে নারীদের গর্ভজাত শিশুর মস্তিষ্ক গঠনে এবং খাদ্য পরিপাকের জন্য ডিমের কোলাইন যৌগপদার্থ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এছাড়াও ডিমে লুটেইন রয়েছে, যা চোখের ছানি প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
ঘুম বা ক্লান্তি তাড়াতে এবং স্মরণশক্তি বাড়াতে ডিম
দিনভর কাজের ফাঁকে প্রায়ই চলে আসে ক্লান্তি। এই ক্লান্তি কাটানোর জন্য আমরা বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে থাকি। কেউ ঘন ঘন চা খাই, কেউবা কাজের ফাঁকে ছোট ছোট বিরতি নেই। অথচ দিনের শুরুতেই কেবল ডিম খেয়ে সেই সাধারণ ক্লান্তি কাটানো সম্ভব। এজন্যই সকালে একটি ডিম এবং রাতে এক গ্লাস দুধ নিয়মিত খাওয়া উচিত।
যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির একদল গবেষকের গবেষণায় জানা যায় ডিমের সাদা অংশে এমন এক ধরনের প্রোটিন আছে, যা আমাদেরকে দিনভর সতেজ রাখে এবং ক্লান্তি ও তন্দ্রা দূর করে। ডিমে থাকা কিছু প্রোটিন মানুষের মস্তিষ্ককে উদ্দীপ্ত রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। দিনভর শরীরকে সতেজ রাখার জন্য মস্তিষ্কে এক ধরনের সেল সর্বক্ষণ সক্রিয় থাকে; এই সেলের নাম ‘ওরেক্সিন সেল’।
বিভিন্ন খাদ্য নিয়ে গবেষণার পর বিজ্ঞানীরা দেখলেন সারাদিন আমরা যেসব খাদ্য খেয়ে থাকি, সেসব খাদ্যের গ্লুকোজ ওরেক্সিন সেলে এক ধরনের ব্লক তৈরি করে। কিন্তু এমিনো এসিড গ্রহণ করলে গ্লুকোজ আর ব্লক তৈরি করতে পারে না। তাই তন্দ্রা ও ক্লান্তি কাটাতে কাজ থেকে ঘন ঘন বিরতি না নিয়ে একেবারে দিনের শুরুতেই নাস্তায় ডিম খেয়ে নিতে গবেষকরা পরামর্শ দেন।
অনেকেই তাৎক্ষণিক শক্তির জন্য প্রোটিনযুক্ত চকলেট, বিস্কুট এবং চা-কফি খেয়ে থাকেন। অথচ এগুলোতে থাকা চিনি ঐ প্রোটিনকে সঠিকভাবে কাজ করতে দেয় না। তাছাড়া চিনি স্বাস্থ্যের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর।
ক্লান্তি তাড়াতে উক্ত প্রোটিনযুক্ত খাবার নিয়মিত গ্রহণের কারণে হৃদরোগও হতে পারে। সুতরাং ক্লান্ত বা অবসন্নবোধ করলে একটি ডিম খেয়ে নেয়াই হবে সবচেয়ে কার্যকর পন্থা। তবে যাদের উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল বা অনুরূপ সমস্যা রয়েছে, তারা ডিমের হলুদ অংশ বাদ দিয়ে কেবল সাদা অংশ খেতে পারেন।
তবে অনেকেই কিন্তু আমার সাথে অলিখিত চুক্তিতে আছেন যে আমরা কোনো খাবারই ফেলে দেব না। তাই ঐ চুক্তি রক্ষার্থে ডিমের হলুদ অংশ কোনোক্রমেই ফেলে দেব না; বরং শিশু-কিশোরসহ অনেকের জন্য তা সবিশেষ প্রয়োজন বিধায় তাদের খাবারে কাজে লাগাব।
বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের স্মরণশক্তি কমে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। কোলাইনসমৃদ্ধ খাবার মস্তিষ্ককে ক্ষতির হাত থেকে তথা স্মরণশক্তি হ্রাস থেকে রক্ষা করে। যেমন মুরগির ডিম, মাংস, সামুদ্রিক মাছ ও শিমসহ বিভিন্ন কোলাইনসমৃদ্ধ খাদ্যে ভিটামিন ডি ঘরানার পুষ্টি থাকে। তাছাড়া মাছ, সব্জি ও জলপাই থেকে উৎপাদিত তেল (অলিভ অয়েল) স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য বিশেষ প্রয়োজন।
উল্লেখ্য, নাস্তায় একটি ডিম আপনার ওজন বৃদ্ধিতেও ব্যাঘাত ঘটায়। কারণ ডিম ক্ষুধা উদ্রেককারী হরমোনের কার্যকারিতা কমায়। তাই ওজন কমাতে নাস্তায় ডিম রাখুন নিয়মিত।
হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় সামুদ্রিক মাছ
পৃথিবীজুড়ে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে হৃদরোগ। মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার যেমন পরিবর্তন হচ্ছে, তেমনি হৃদরোগেরও বিস্তার ঘটছে। বিজ্ঞানীরা একাধিক গবেষণায় প্রমাণ পেয়েছেন, জীবনযাপনে পরিবর্তন এনে হার্টবান্ধব খাবার খেয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের একদল গবেষক হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সি-ফুড বা সামুদ্রিক খাবার যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে, তার প্রমাণ পেয়েছেন। তারা বলছেন সাপ্তাহিক খাদ্য তালিকায় সামুদ্রিক খাবার যোগ করলে হৃদরোগের আশঙ্কা প্রায় অর্ধেক কমে যায়। কারণ চিংড়ি, কাঁকড়া, শামুক, অক্টোপাসসহ সামুদ্রিক বিভিন্ন মাছে ভিটামিন, খনিজ পদার্থ ও প্রচুর পরিমাণে তেল রয়েছে। এছাড়া এগুলোতে আছে ওমেগা-৩ নামের ফ্যাটি এসিড, যা হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া সামুদ্রিক খাবার রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রার ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব রাখে।
চলবে।
সুস্থতা ও শতায়ুলাভে
প্রাকৃতিক চর্চা ও চিকিৎসা Be your own Doctor -এ বইটির
পৃষ্ঠা সংখ্যা ঃ ৩৪৬, মূল্যঃ ৩৫০ টাকা
প্রাপ্তিস্থানঃ ক্যাম্পাস পত্রিকা অফিস
৩৩ তোপখানা রোড, ১৩ তলা, ঢাকা।
ফোনঃ ৯৫৫০০৫৫, ৯৫৬০২২৫