প্রথমবারের মতো বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী বদলি ও পদোন্নতির বিধান রেখে তৈরি করা হচ্ছে ‘শিক্ষা আইন-২০১৬’। জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষা আইন প্রণয়নের সুপারিশ করা হলেও এতদিন বিষয়টি ঝুলেছিল। তবে এবার বেশকিছু নতুন ও যুগান্তকারী বিষয় যুক্ত করে শিক্ষা আইনের খসড়া প্রণয়ন করেছে সরকার। প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের খসড়া অনুসারে এক ব্যক্তি একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি বা গভর্নিং বডির প্রধান হতে পারবেন না। নোটবই-গাইডবই প্রকাশ ও পড়ানো এবং কোচিং সেন্টার পরিচালনা করলে অর্থদ-সহ ছয় মাসের কারাদ- হবে। একই সঙ্গে বাতিল হবে এমপিও। ইংরেজী মাধ্যমের প্রতিষ্ঠানেও বাংলা ও বাংলাদেশ স্টাডিজ বিষয় পড়ানো হবে বাধ্যতামূলক।
এদিকে, খসড়া আইনের বিষয়ে মতামত নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এটি তাদের ওয়েবসাইটে www.moedu.gov.bd প্রকাশ করেছে। তবে আইনে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাজার বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। যদিও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে দেশে একাধিক আইন সক্রিয় আছে। সেক্ষেত্রে নতুন আইনের প্রয়োজন পড়ে না। এর আগে সর্বশেষ গত বছরের অক্টোবরে শিক্ষা আইনের খসড়া প্রকাশ করে মতামত আহ্বান করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিছু বিষয় নিয়ে সমালোচনা, নানা প্রস্তাব বিবেচনা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবার নতুন করে খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে।
শিক্ষানীতির আলোকে শিক্ষা আইনের খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে জানিয়ে বলা হয়েছে, খসড়ায় শিক্ষার চারটি স্তর রাখা হয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক (৪ থেকে ৬ বছর), প্রাথমিক (প্রাক-প্রাথমিক থেকে অষ্টম), মাধ্যমিক (নবম থেকে দ্বাদশ) এবং উচ্চশিক্ষা (দ্বাদশ শ্রেণি থেকে স্নাতক ও তদুর্ধ) স্তরের মধ্যে প্রাক-প্রাথমিকসহ প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক এবং এই শিক্ষা শিশুর অধিকার হিসেবে গণ্য হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, ইংরেজী মাধ্যমসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বেতন ও অন্যান্য ফি সরকারের অনুমোদন ছাড়া নির্ধারণ করা যাবে না। আইন লঙ্ঘন করলে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা এক বছরের কারাদন্ড বা উভয়দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে আইনে। ইংরেজী মাধ্যমের প্রতিষ্ঠান হলেও বাংলা ও বাংলাদেশ স্টাডিজ বিষয় পড়ানো হবে বাধ্যতামূলক।
এ আইনের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো আসছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বদলি ও পদোন্নতির বিষয়। আইনে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বদলি ও পদোন্নতির সুযোগ রাখা হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি বদলিযোগ্য করার দাবি দীর্ঘদিনের। আইনের খসড়া অনুসারে এক ব্যক্তি একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির প্রধান হতে পারবেন না।
আইন অনুযায়ী প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিকে কিন্ডারগার্টেন, ইংরেজী মাধ্যম ও এবতেদায়ী মাদ্রাসাসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের কাছে বাধ্যতামূলকভাবে নিবন্ধন করতে হবে। নিবন্ধনের এ বিধান লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বন্ধসহ দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান জরিমানা বা ছয় মাসের কারাদণ্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে। মাধ্যমিক স্তরে সাধারণ, মাদ্রাসা, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও ইংরেজী মাধ্যম বা বিদেশী কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশী কোন শাখাসহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বাধ্যতামূলকভাবে নিবন্ধন নিতে হবে। এ নিয়ম লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বন্ধসহ দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা জরিমানা বা ছয় মাসের কারাদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে হবে।
জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচী প্রণয়ন করবে উল্লেখ করে খসড়া আইনে বলা হয়েছে, এনসিটিবির অনুমোদন ছাড়া এসব স্তরে শিক্ষাক্রমে অতিরিক্ত কোনো বিষয় বা বই অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। কেউ অতিরিক্ত বই অন্তর্ভুক্ত করলে জরিমানা ও ছয় মাসের কারাদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে। একই সঙ্গে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালী সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতির পরিপন্থী ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কার্যক্রম অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এজন্যও জরিমানা ও ছয় মাসের কারাদ- বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
মাদ্রাসা শিক্ষায় সাধারণ ধারার মতো চার বছর মেয়াদী ফাজিল অনার্স এবং এক বছর মেয়াদী কামিল কোর্স ক্রমান্বয়ে চালু করা হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক এবং মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিতে স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ ও উপযুক্ত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি ‘শিক্ষা কমিশন’ গঠনের কথাও বলা হয়েছে খসড়ায়। খসড়া আইনে বলা হয়েছে, বিদেশী কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আওতায় ‘ও’ লেভেল এবং ‘এ’ লেভেল বা সমপর্যায়ে শিক্ষাদান কার্যক্রম উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমোদনসাপেক্ষে পরিচালনা করা যাবে। কোনো এলাকায় কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা না থাকলে সরকার প্রয়োজনে একীভূত/স্থানান্তর/বিলুপ্ত করতে পারবে।
অষ্টম শ্রেণি শেষে একটি পাবলিক পরীক্ষার বিধান রেখে শিক্ষা আইনের নতুন খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে। তবে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা থাকবে কি-না নির্বাহী আদেশ দিয়ে সরকার তা নির্ধারণ করবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী ২০১৮ সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীতকরণে কাজ করছে সরকার। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা উন্নীত করার প্রাথমিক সমাপনী এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা থাকবে কি-না তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
শিক্ষার মানোন্নয়নে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে খসড়ায় বলা হয়েছে, সরকার প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং বন্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এই ধারা লঙ্ঘন করলে তিনি অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদন্ড বা ছয় মাসের জেল বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তির বিষয়ে বলা আছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবস্থানকালীন মানসিক বা শারীরিক শাস্তি দেয়া যাবে না। এটি লঙ্ঘন করলে শিক্ষক অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা তিন মাসের কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে নির্ধারিত পাঠ্যবই না পড়িয়ে বাইরের বই পড়ালে দুই লাখ টাকা জরিমানা বা ছয় মাসের জেল বা উভয় দন্ড রাখা হয়েছে খসড়ায়।
খসড়ার উচ্চশিক্ষার অংশে বলা হয়েছে, কলেজ পর্যায়ে প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনার জন্য অনুমতি নিতে হবে। অন্যথায় ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা পাঁচ বছর জেল বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে। অনুমতি ছাড়া বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় চালালে বা শাখা ক্যাম্পাস, স্ট্যাডি সেন্টার বা টিউটোরিয়াল কেন্দ্র স্থাপন করলে পাঁচ বছর কারাদন্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড ভোগ করতে হবে।
উচ্চশিক্ষা স্তরে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী বিধি দ্বারা নিয়োগ করতে হবে। এছাড়া উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা, ডিপ্লোমা, জীবনব্যাপী শিক্ষা, বয়স্ক শিক্ষা, নৈতিক শিক্ষা, বিশেষ চাহিদামূলক শিক্ষার (প্রতিবন্ধী বা অটিস্টিক এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য) ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আইনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হচ্ছে, যার আইনগত কোন ভিত্তি নেই। এ কারণে কেউ কোর্টে মামলা করলে আমরা হারি। এজন্য আমরা আইনটি করতে যাচ্ছি যেখানে সমন্বিতভাবে শিক্ষার বিভিন্ন খাতকে আইনের আওতায় নিয়ে আসব, যাতে সরকার, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, প্রতিষ্ঠান সবাই এটা মেনে চলতে বাধ্য হবে।
খসড়া আইনে প্রশ্ন ফাঁসের জন্য শাস্তির বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, পরীক্ষায় নকলের বিষয়ে আলাদা একটি আইন আছে। এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি আইন অনুযায়ী তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রশ্ন ফাঁস বা বিভ্রান্তি ছড়ালে ১৪ বছরের জেল বা এক কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হতে পারে। যেহেতু আলাদা আইন আছে তাই শিক্ষা আইনের খসড়ায় বিষয়টি রাখা হয়নি।