দুদকে অভিযোগ জমার হার প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। মে মাসে দুর্নীতি, জালিয়াতি, প্রতারণা, অনিয়ম, অর্থ আত্মসাৎ ও পাচার-সম্পর্কিত এক হাজার ১০১টি অভিযোগ জমা পড়েছিল আর এপ্রিলে জমা পড়েছিল ৭৭৮টি অভিযোগ।
কমিশনের সচিব আবু মোঃ মোস্তফা কামাল বলেন, দুদক’র প্রতি মানুষের আস্থা বেড়েছে বলেই বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ আগের চেয়ে বেশি অভিযোগ পেশ করছে। প্রতিটি অভিযোগ যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে যাচাই-বাছাই করছে সংশ্লিষ্ট কমিটি। কমিশন অভিযোগগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়।
সূত্র জানায়, গত ১৪ এপ্রিল সরকারের সাবেক সিনিয়র সচিব ইকবাল মাহমুদ দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দুদক’র কাজের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়তে শুরু করেছে। দায়িত্ব গ্রহণের দিন থেকে দুদকের ভেতরে শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়। পাশাপাশি চলে দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধের কাজ। শুরু হয় দুর্নীতি মামলার আসামিদের গ্রেফতার অভিযান। এরই মধ্যে দুই শতাধিক আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তি যে-ই হোক না কেন, তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের নীতি অনুসরণ করে কাজ করছে কমিশন। অনুসন্ধান ও তদন্তের সঙ্গে যুক্ত সব কর্মকর্তাকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে
জানা গেছে, মে মাসে পাওয়া এক হাজার ১০১টির মধ্যে যাচাই-বাছাই করে ৯৫টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য তালিকাভুক্ত করে যাচাই-বাছাই কমিটি। এর মধ্যে কমিশন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ৭২টি অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর, অধিদপ্তরের কাছে পাঠানো হয় ৬১টি অভিযোগ। দুদক আইন অনুযায়ী আমলযোগ্য না হওয়ায় অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করা হয়নি ৯৪৫টি অভিযোগ। অভিযোগগুলোর মধ্যে দুদক চেয়ারম্যান, কমিশনারের কাছে পাঠানো ও সরাসরি বাক্সে ফেলা অভিযোগের সংখ্যা এক হাজার ৬৯টি। এ ছাড়া সংবাদপত্র থেকে নয়টি ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জাতীয় সংসদ, গোয়েন্দা সংস্থা ও বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তর থেকে পাওয়া গেছে ছয়টি অভিযোগ।
এছাড়া, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কমিশন পুনর্গঠন হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটিতে চলছে অভ্যন্তরীণ শুদ্ধি অভিযান। এমন খবরে সাধারণ জনগণ শাস্তি ও আশা প্রকাশ করলেও প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরে আতঙ্ক বিরাজ করছে। শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে নানা অনিয়ম ও দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে গত এক মাসে বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেয়া হয়েছে ৮৭৩টি কারণ দর্শানোর নোটিশ। ফলে দুদকে ডেপুটেশনে (প্রেষণ) আশা কর্মকর্তা কিংবা নিজস্ব কর্মকর্তা কারো মনেই শাস্তি নেই। যারা ডেপুটেশনে দুদকে কমর্রত রয়েছেন তাদের মধ্যে বদলি আতঙ্ক বিরাজ করছে। অন্যদিকে যারা নিজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন তারাও দুদক’র বাইরে বদলি ও বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়ার আতঙ্কে রয়েছেন।
জানা যায়, দুদক’র বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আর্থিক সুবিধা গ্রহণের বিনিময়ে তদন্তে প্রকৃত অপরাধীকে ছেড়ে দেয়া, মূল অপরাধীকে বাঁচাতে নিরীহ ব্যক্তির বিরুদ্ধে চার্জশিট প্রদান, মূল ঘটনা এড়িয়ে ভিন্ন খাতে অনুসন্ধান তদন্ত পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে দায়ীদের ৩ মাসের বেতন দিয়ে চূড়ান্তভাবে বরখাস্ত, সাময়িক বরখাস্ত, তাদের সম্পদ অনুসন্ধান, পদোন্নতি স্থগিত, পদাবনতি, বেতন-ভাতাদি কর্তন, বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর সিন্ধান্ত নিচ্ছে কমিশন।
জানা যায়, শুদ্ধি অভিযান প্রক্রিয়ায় কমিশন প্রাথমিকভাবে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম তালিকাভুক্ত করেছে তাদের পার্সোনাল ডাটাশিট, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরির পারফরম্যান্স, কার্যক্রম, অনুসন্ধান-তদন্তের সংখ্যা, কাজের গুণগত মান, পেশাদারিত্ব, কর্মদক্ষতা, কর্মকর্তাদের নৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে। সন্দেহভাজন সকল কর্মকর্তাদের টেলিফোনে আড়িপাতা হচ্ছে বিটিআরসি’র সহযোগিতায়।
এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, দুদক বিচ্ছিন্ন কোন দ্বীপ নয়, এখানেও দুর্নীতি রয়েছে। আমি মনে করি সত্য বলাই দুর্নীতি দমনের প্রধান শর্ত। অনুসন্ধানের সময় সীমা ৩০ দিন হলেও আমার জানামতে একটি মামলাও ৩০ দিনে নিস্পত্তি হয়নি। আমার কাছে ১০ বছর আগেরও নথি এসেছে। এ সকল কার্যক্রম দেখে আমি বিস্মিত। তাই বর্তমান কমিশন ঘর থেকেই শুদ্ধি শুরু করেছে। আমরা ইতোমধ্যেই ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছি।
প্রসঙ্গত অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ সচিব ইকবাল মাহমুদ গত ১৪ মার্চ দুদক চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, দুদক’র কোনো কর্মকর্তা যদি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর ভুল সংশোধনের জন্য মাত্র একবার সুযোগ দেয়া হবে।
অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ সচিব ইকবাল মাহমুদ। বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের ১৯৮১ ব্যাচের এ কর্মকর্তার রয়েছে সততা, দৃঢ়তা এবং নিষ্ঠার খ্যাতি। চাকরিজীবনে তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সিনিয়র সচিবসহ দেশ-বিদেশে ২৪টি দফতরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ ২০১৫ সালে তিনি বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালকের পদ থেকে অবসরোত্তর ছুটিতে যান। ১৩ মার্চ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পান ইকবাল মাহমুদ। চলতি বছরের ১৪ মার্চ এ পদে যোগ দিয়েই বেশকিছু কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছেন, যাতে দুদক সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারে।
বিভিন্ন পত্রিকার সাথে সাক্ষাকারে তিনি বলেন, যোগদানের পর প্রথমেই যে বিষয়টি আমার নজরে পড়েছে সেটি হচ্ছে, অনুসন্ধানের সময়সীমা। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, অনুসন্ধানের একটি টাইম ফ্রেম রয়েছে। বিধিতে বলা আছে, ৩০ কার্য দিবসের মধ্যে এটি শেষ করতে হবে। এ বিষয়টি অনুসৃত হচ্ছে না। এক-দুই বছর লেগে যাচ্ছে অথচ প্রতিবেদন দাখিল হয় না। এ বিষয়টিতে আমার খুব দুঃখ লেগেছে। ধরুন, যে লোকটি নিরপরাধ, নির্দোষ কিংবা ধরুন অপরাধই করেছেন- তিনি নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে জানতে পারছেন না তার অনুসন্ধান কিংবা তদন্তটির কি হল। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন না হওয়ায় যাদের ভোগান্তি হয়েছে, তাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি।
তিনি আরো বলেন, দুদক’র কোনো কৌশলপত্র ছিল না। এটি প্রণয়নের চিন্তা আমাদের রয়েছে। আশা করছি কৌশলপত্র প্রণয়নের পর দুদক কাগুজে বাঘ থেকে সুন্দরবনের প্রকৃত বাঘে রূপান্তর হবে। যদিও আমি ‘বাঘ’ বলতে রাজি নই। কারণ, দুদক মানুষের জন্য ভীতিকর কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। যারা দুর্নীতি করে শুধু তাদের জন্য আতংকের। বলা চলে দুদক মানুষের আস্থাভাজন প্রতিষ্ঠানে উন্নীত হবে।
দুদক চেয়ারম্যন বলেন, দুদক কর্মকর্তাদের মধ্যে দুর্নীতিবাজ থাকতে পারেন। তারাও তো এ সমাজেরই মানুষ। তবে আমার তো দু’মাস হল। এর মধ্যে দুর্নীতিবাজ কোনো কর্মকর্তাকে দেখিনি। আমি তো এসেই বলেছি, আগের কোনোকিছু নিয়ে কাউকে কিছু জিজ্ঞাস করব না। তবে নতুন করে কেউ দুর্নীতি করবেন না। যদি করেন তাহলে একবারই শুধু সুযোগ পাবেন- দ্বিতীয়বার নয়। তারা এখন পর্যন্ত কথা রেখেছেন। কোনো কোনো অফিসারের বিরুদ্ধে আগে থেকেই কিছু অভিযোগ ছিল। আমরা সেটি আমলে নিয়ে কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। আরও উদ্যোগ অচিরেই দেখবেন। সত্যি বলতে, আমরা পরিবর্তন দেখতে চাই।