বিশেষ খবর



Upcoming Event

বিদেশ সফরের পূর্বাপর ॥ করণীয়, পালনীয় ও জানার বিষয়

ক্যাম্পাস ডেস্ক বিশেষ নিবন্ধ

একসময় বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেত বিলেত এবং সাধারণরাও বিদেশ ভ্রমণ বলতে বিলেতকেই বুঝত। এখন সে ধারণা পাল্টে গেছে। বিজ্ঞান ও যোগাযোগ-প্রযুক্তির ব্যাপক অগ্রগতির ফলে বিশ্ব আজ হাতের মুঠোয়। বাংলাদেশ-বিলেত সফর এখন সকাল-বিকালের ব্যাপার। আর জ্ঞানার্জনের জন্য যে সুদূর চীন পর্যন্ত যাওয়ার কথা বলা হতো, সেই সুদূর চীনযাওয়া এখন ব্রেকফাস্ট থেকে লাঞ্চ পর্যন্ত সময়ের ব্যবধান।

ইন্টারনেট, ই-লাইব্রেরি, টেলিমিডিয়ার কল্যাণে যেকোনো দেশ, শহর, বন্দর সম্পর্কে এখন ঘরে বসেই তাৎক্ষণিক জানা যায় অনেক কিছু। তবু নিজ চোখে বা কাছ থেকে কোনোকিছু দেখার অভিজ্ঞতা ও আনন্দের তুলনা হয় না। বিদেশ ভ্রমণ এখন অনেকের দৈনন্দিন বৈচিত্র্যহীন এমনকি আকর্ষণহীন রুটিনে দাঁড়িয়েছে। চিকিৎসা, পড়াশোনা, ব্যবসা বা পেশাগত প্রয়োজনে কিংবা নিছক ভ্রমণের ইচ্ছে থেকে শুরু করে বিয়ে বা ঈদের বাজার করতেও এখন বাঙালি হন্তদন্ত হয়ে ছুটছে বিদেশ-বিভূঁয়ে।

আমার বিদেশ সফরের শুরু ১৯৯৯ সালে, বিলেত গমনের মধ্য দিয়ে। সে থেকে এযাবৎ প্রয়োজনে অথবা শখে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের সুযোগ হয়েছে। ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, ইতালি, চীন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, সৌদিআরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেছি। তন্মধ্যে ইংল্যান্ড, ইতালি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া গিয়েছি কয়েকবার। এরূপ বিভিন্ন সফরে যেমনি প্রয়োজনীয় কাজ সেরেছি, তেমনি ভিনদেশ উপভোগসহ সিক্ত হয়েছি নানা অভিজ্ঞতায়।

বিশ্বের প্রতিটি দেশ ও প্রতিটি জাতির রয়েছে স্বকীয়তা বা স্বাতন্ত্র্য। আইন, নিয়ম-কানুন, রীতি-নীতি ও সংস্কৃতিতে রয়েছে কম-বেশি তফাত। এমনকি একই দেশের একেক প্রদেশ বা অঞ্চল কিংবা নগরীর সংস্কৃতিও ভিন্ন রকম। তাই বিদেশে না গেলে যেমনি ভিন্ন দেশের নিয়ম ও সংস্কৃতি বোঝা  মুশকিল, তেমনি দুএক দেশ ভ্রমণ করে নানা দেশ-মহাদেশের নিয়ম ও সংস্কৃতি বোঝা দুরূহ। তবুও সফরকালীন কিছু সাধারণ বিষয় জানা থাকলে বা মনে রাখলে বাকি ব্যতিক্রমী বিষয়গুলো নিয়ে অসুবিধায় কম পড়তে হয়।

বিদেশ সফরকালীন সদা-সর্বদা সতর্ক থাকা প্রয়োজন। তা নাহলে অজানা অচেনা বিদেশ-বিভূঁয়ে বিপদে পড়তে হতে পারে। প্রথম বিদেশ সফরের পূর্বে যেমনি অভিজ্ঞতার সুযোগ থাকে না, তেমনি দুএক দেশ সফরে অন্যসব দেশের নিয়ম-কানুনও বোঝা যায় না। এতদসত্ত্বেও কিছু বিষয়ে পূর্বধারণা থাকলে তা সফরকে সহজ, আনন্দময় ও উপভোগ্য করে তুলতে পারে।

বিদেশ সফরে লক্ষণীয় বিষয়

১। সফরকালীন কী কী জিনিস লাগতে পারে, তার লিস্ট করবেন অথবা সে চিন্তা মাথায় রেখে জিনিসপত্র সাথে নেবেন। যে জিনিস লাগবে না বা লাগলেও তজ্জন্য অসুবিধায় পড়বেন না, সে জিনিস নেবেন না। কম জিনিস বহনের চেষ্টা করবেন।

২। যে দেশে যাবেন, সে দেশে ঠান্ডা বা গরম কেমন, তা ইন্টারনেটে দেখে এবং আপনার অবস্থান-সময়ের আবহাওয়া রিপোর্ট জেনে তদনুযায়ী কাপড়-চোপড় নেবেন।

৩। জুতো-স্যান্ডেল নেয়ার ক্ষেত্রে ফ্যাশনের চেয়ে আরামের বিষয়কে প্রাধান্য দেবেন।

৪। পাসপোর্টে লাগানো ভিসা ঠাহর করে দেখে নেবেন। ভিসার মেয়াদ, ভিসায় আপনার নাম, পেশা এবং অন্যান্য তথ্য ঠিকমতো লেখা হয়েছে কিনা পরীক্ষা করে নেয়া জরুরি।

৫। পাসপোর্ট ও টিকেটের ২টি ফটোকপি করিয়ে ১টি সর্বদা সাথে রাখবেন; অন্যটি সুটকেস বা লাগেজের পকেটে রেখে দিতে পারেন। পাসপোর্ট এবং টিকিট যেন না হারায়, সে ব্যাপারে সদা সতর্ক থাকবেন।

কয়েক কপি পিপি সাইজের ফটো, নোটবুক, কলম এসবও সাথে রাখবেন। অবশ্য অভিজাত প্লেনে এবং হোটেল রুমেও আপনার ব্যবহারের জন্য কাগজ-কলম থাকতে পারে।

৬। বিদেশ সফরকালীন কখনও পাসপোর্ট হারিয়ে গেলে দ্রুত নিকটস্থ বাংলাদেশ এম্বেসীতে যোগাযোগ করবেন। আর টিকিট হারিয়ে গেলে টিকিট-ইস্যুয়িং প্রতিষ্ঠান অথবা সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্সের ঐ সিটি-অফিসে বা এয়ারপোর্ট অফিসে যোগাযোগ করবেন।

৭। হ্যান্ড লাগেজে লিকুইড কসমেটিকস্, ছুরি, কাঁচি, সুঁই, পানি বা তরলজাতীয় কোনোকিছু নেবেন না। চেক-ইনকালীন এগুলো না আটকালেও বোর্ডিংপূর্ব নিরাপত্তা তল্লাসীতে আটকাতে পারে। তখন তা বিনে ফেলে দিয়েই প্লেনে উঠতে হবে।

৮। পাঁচ কেজির বেশি ওজনের হ্যান্ড লাগেজ বা কেবিন ব্যাগ নেবেন না।

৯। সিঁড়ি বা এসকেলেটরে উঠাতে-নামাতে অসুবিধা হয়, এমন বড় হ্যান্ড লাগেজ নেবেন না।

১০। লাগেজে কোনো ভঙ্গুর জিনিস থাকলে ঋৎধমরষব শব্দটি ব্যাগের গায়ে লিখে দেবেন।

১১। বুকিং লাগেজের ওজন টিকেটে উল্লেখিত ও অনুমোদিত পরিমাণের বেশি করবেন না। এক্ষেত্রে উদাসীন হলে তজ্জন্য চেক ইনকালীন হ্যাসেলে পড়তে হতে পারে। হয় অতিরিক্ত ওজনের জন্য ভাড়া গুণতে হবে, নতুবা আপনার প্রিয় জিনিস বিনে ফেলে যেতে হবে।

১২। কোনো লাগেজেই ম্যাগনেটিক, ফায়ার বা আগ্নেয়জাতীয় কোনো জিনিস বহন করবেন না। ম্যাগনেট বা আগ্নেয় জিনিস সন্ত্রাসী কর্মকা-ে ব্যবহৃত হয়; তাছাড়া এগুলো প্লেন চালনায় অসুবিধা সৃষ্টি করে। তাই নিরীহ ও সুবোধ যাত্রীর এসব বহন করার প্রয়োজন নেই।

১৩। বিদেশ সফরের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ইমিগ্রেশন এবং সিকিউরিটি সিস্টেম। টুইন টাওয়ার হামলার পর নিরাপত্তা ঝুঁকি বৃদ্ধিহেতু  বন্দরগুলোর নিরাপত্তা কঠোর করা হয়। সেজন্য ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়ককেও নিরাপত্তা তল্লাশিতে পড়তে হয়েছে। বন্দর নিরাপত্তারক্ষীদের ক্ষমতা ও দায়িত্ব বেড়ে যাওয়ায় এখন তারা যদি বলে অমুক জিনিস আপনি বহন করতে পারবেন না বা তমুক জিনিস নিতে পারবেন না, তাহলে বিনা বাক্যে তা মেনে নিতে হবে এবং অনেক সাধ ও সাধ্যের জিনিস বিনা প্রতিবাদে বিনে ফেলে দিয়ে আসতে হবে। এ ব্যাপারে গোয়ার্তুমির কোনো সুযোগ নেই।

১৪। নিজের ব্যাগ বা জিনিসপত্র কোথাও কখনো নজরের বাইরে বা Unattended রাখবেন না।

১৫। এয়ারপোর্টে চলাচলের সময় এসকেলেটর বা এলিভেটরে এক পাশ ঘেঁষে দাঁড়াবেন, যাতে দ্রুত ধাবমান কেউ অন্য পাশ দিয়ে চলে যেতে পারে। এ অভ্যাসটি দেশে-বিদেশে সর্বত্রই পালন করা উচিত।

গতিশীল জাতির সদস্যরা এসকেলেটরে উঠে থেমে থাকে না বরং এসকেলেটরের ওপরেও হাঁটতে বা দৌড়াতে থাকে। এতে তারা আমাদের চেয়ে সর্বদাই কয়েক ধাপ এগিয়ে থাকে। অর্থাৎ

They are always ahead,
And we are always behind.

১৬।প্লেনে বসে বাইরের দৃশ্য উপভোগ করতে চাইলে চেকইন ডেস্কে বলবেন Window side seat please. না পেলে আইল সিট বা যেকোনো একপাশের সিট দিতে বলবেন; এতে প্লেন চলাকালীন সিট থেকে ওঠানামা করতে বা টয়লেটে যেতে সুবিধা হবে।

১৭। টিকেটের সাথে থাকা লাগেজ বুকিংয়ের ট্যাগ বা সিøপ কিন্তু হারাবেন না। কারণ গন্তব্যে পৌঁছার পর বেল্টে লাগেজ খুঁজে না পেলে Baggage Claim Desk এ তা দেখাতেই হবে।

১৮। চেক ইনের পর কখনো ফাইট বাতিল বা বিলম্ব হলে সেক্ষেত্রে এভিয়েশন রুল অনুযায়ী এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ আপনাকে খাবার-দাবার দেবে এবং হোটেলে রাখা ও পোর্টে আনা-নেয়ার ব্যবস্থা করবে। ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটের যাত্রীদের সাধারণত ফাইভ স্টার হোটেলে রাখা হয়।

এসব ক্ষেত্রে আপনার খরচাপাতি নেই। তবে সংশ্লিষ্ট প্লেনের সার্ভিস ডেস্ক বা  ট্রান্সফার ডেস্কে আপনার চাওয়া-পাওয়ার কথা জানাতে হবে।

১৯। এয়ারপোর্টে ঢোকার আগে টার্মিনাল নাম্বার জেনে নিন। এরপর সিকিউরিটি পর্ব সেরে চেক ইন ডেস্ক বা কাউন্টারের সিরিয়াল জেনে নিয়ে সেখানে পৌঁছে একটি ডেস্কের অভিমুখে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে যান। চেক-ইনকালীন পাসপোর্ট ও টিকিট দেখাতে হয়। চেক-ইন শেষে বোর্ডিং পাস ও লাগেজ ট্যাগসহ পাসপোর্ট ও টিকিট ফেরত নিন।

২০। চেক-ইন হবার পর ইমিগ্রেশন পর্ব। আপনি কোথায়, কেন যাচ্ছেন তা ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা জানতে চাইতে পারে এবং ইনভাইটেশন লেটার বা ভ্রমণ সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখতে চাইতে পারে। সরকারি কর্মকর্তা হলে নিজ দেশের গভর্নমেন্ট অর্ডার (GO) কপি চাইতে পারে।

২১।ইমিগ্রেশন শেষ করে প্লেন কোন্্ গেটে থাকবে, তা কম্পিউটারে বা ডিসপ্লে বোর্ডে দেখে নিয়ে ঐ গেটে ফরোয়ার্ড হোন এবং বোর্ডিং গেটে অপেক্ষা করুন। এখানেও সিকিউরিটি চেক বা তল্লাশি হয়ে থাকে। এখানকার তল্লাসি চেকিং হয় এয়ারলাইন্সের পক্ষ থেকে, ফ্লাইটের নিরাপত্তার নিমিত্তে; আর পোর্টে ঢোকার পর সিকিউরিটি চেকিং হয় বন্দর কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে।

২২। প্লেনে উঠে বোর্ডিং পাস অনুযায়ী নির্দিষ্ট সিটে বসবেন। এক্ষেত্রে কেবিন ক্রুরা আপনাকে সাহায্য করবে। প্লেন ওঠা এবং নামার সময়ে অবশ্যই সিট বেল্ট আটকিয়ে রাখবেন। তবে সর্বক্ষণ বেল্ট লাগিয়ে রাখা ভালো।

২৩। যতক্ষণ আকাশে থাকবেন, ততক্ষণ প্রচুর জুস ও পানি পান করবেন; নইলে ডিহাইড্রেশন হতে পারে। তাছাড়া কিছুক্ষণ পর পর হাত-পা স্ট্রেচ করবেন। লম্বা জার্নি হলে প্লেনের ভেতর একটু হাঁটাহাঁটি করতে পারেন।

২৪। প্লেনে ভ্রমণকালীন কান বন্ধ হয়ে যেতে পারে, এটি মামুলি ব্যাপার। নাক চেপে ধরে জোরে প্রশ্বাস ছাড়লে কান দিয়ে বাতাস বের হয়ে যাবে এবং কান খুলে যাবে।

২৫। গন্তব্যে পৌঁছে স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন। তারপর পরনের কাপড় বিশেষত মোজা, রুমাল এবং অনুরূপ পরিধেয় ধুয়ে দেবেন; অর্থাৎ পুনরায় পরার ব্যবস্থা করে রাখবেন।

২৬। যে শহরে গেলেন এবং যে হোটেলে বা বাসায় উঠলেন, তার সম্পূর্ণ ঠিকানা ইংরেজিতে এবং সম্ভব হলে স্থানীয় ভাষায় লিখে তা অবশ্যই সর্বক্ষণ সাথে রাখবেন। প্যারিস, বেইজিং, সাংহাইসহ এমন বহু বড় নগরী রয়েছে যেখানকার সাধারণ মানুষ তাদের স্থানীয় ভাষা ছাড়া অন্য ভাষা বুঝতে ও বোঝাতে পারে না। এমনকি আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজিতে বোঝা বা বোঝানোর ক্ষেত্রেও কঠিন বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।  অনেক সময়ে মনে হবে যে, আপনি সব চেনেন বা চিনবেন। কিন্তু পরিপাটি শহরগুলোর রাস্তা বা বাড়িঘর প্রায় একই রকম। তাই ঠিকানাহীন অবস্থায় বাড়ি চিনতে মারাত্মক ভুল হয়ে বিপদ বা বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে পারেন।

২৭। কাউকে ভাষা দিয়ে বোঝানো না গেলে ইশারা-ইংগিতে বোঝানোর কৌশল অবলম্বন করবেন।

২৮। কারো সাথে দেখা হলে হাসিমুখে হ্যালোবলে সম্বোধন করে কথা শুরু করবেন।

২৯। বিদেশের রাস্তায় চলার পথে কেউ আপনার ব্যাগ বা লাগেজ বহনে হেল্প করতে চাইলে তাতে রাজি হবেন না। এটি ছিনতাইয়ের কৌশলও হতে পারে। এক্ষেত্রে No, Thanks বলে এড়িয়ে যাবেন।

৩০। স্ট্রীট, পার্ক ও শপিং সেন্টারে চলার সময়ে একদিকে অন্যের মধুর প্রলোভন এড়িয়ে চলবেন; অন্যদিকে এটিও মনে রাখবেন যে, বহু দেশের মানুষ আমাদের চেয়ে সৎ ও সিনসিয়ার। তাই চোখ-কান খোলা রেখে সচেতনতা বজায় রেখে বুদ্ধি খাটিয়ে চলুন। অন্যকে অযথা সন্দেহ করে আপনার মঙ্গলজনক সুযোগগুলো নষ্ট করবেন না।

৩১। জায়গা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সর্বত্র সর্বক্ষণ অত্যন্ত সতর্ক থাকবেন এভাবে আপনার মালামাল বিশেষত পাসপোর্ট, টিকিট, কারেন্সী, কাগজপত্র সব সাথে আছেতো?

৩২। সাধারণ কারেন্সী বা স্থানীয় কারেন্সীর পাশাপাশি সর্বক্ষণ পকেটে অন্ততঃ ৫০ পাউন্ড বা ইউরো অথবা ১০০ আমেরিকান ডলার রাখার চেষ্টা করবেন। কারণ পৃথিবীর সব বন্দরে এবং আন্তর্জাতিক শহরগুলোতে এসব কারেন্সী গ্রহণযোগ্য।

৩৩। সফরকালে টাইম মেইনটেইন করবেন কঠোরভাবে। ঘড়ির কাঁটা ৫/৭ মিনিট ফাস্ট করে রাখতে পারেন। বিদেশ-বিভূঁয়ে সেকেন্ডের ব্যবধানেও ফ্লাইট, ট্রেন, বাস মিস হয়ে বিপদে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।

৩৪। দৃষ্টিনন্দন খাবারের লোভ করবেন না। কন্টিনেন্টাল সিটিতে শুকর বা সাপজাতীয় বহু খাবার থাকে, যেগুলো একেবারে নিষিদ্ধ হলেও দেখতে অত্যন্ত লোভনীয় বলে মনে হতে পারে।

নিজ দেশে নিয়মিত যে খাবার খান, বিদেশে গিয়ে তা না খেয়ে সেখানকার স্থানীয় খাবার খেলে আপনার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় এবং ব্রেইন প্রোগ্রামিংও হতে পারে। থাইল্যান্ড গিয়ে দৈনন্দিন ভাত-মাংস না খেয়ে সেখানকার নানাজাতের ফলমূল খেতে পারেন। আবার হল্যান্ড, ডেনমার্ক, ফ্রান্স গিয়ে দুজাতীয় বিভিন্ন খাবার বিশেষত Natural yogurt, রকমারী ব্রেড ও স্থানীয় খাবার খেতে পারেন।

৩৫। খাবারের বিষয়ে বিশেষত লাঞ্চের বিষয়ে সিরিয়াস হবেন না। সকালে পেট ভরে নাস্তা খেয়ে নেবেন। বাইরে ঘুরতে যাওয়ার সময়ে লাঞ্চের বিকল্প হিসেবে পানির বোতল, কিছু ফল, বিস্কিট বা অনুরূপ খাবার সাথে নিতে পারেন। যাতে সন্ধ্যার পূর্বে খাবারের পিছুটান না থাকে।

এককথায় সকালেই দিনের ৬০% খাবার সেরে ফেলবেন। কারণ লাঞ্চ ও ডিনার নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকলে দেখার ও শেখার সময় নষ্ট হতে পারে। খাওয়ার আনুষ্ঠানিকতায় পড়ে বাঙালি ট্যুরিস্টদের ট্যুর বিড়ম্বনার স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে আমার  রচিত ন্যায়ভিত্তিক সমাজ এবং আলোকিত জাতির সন্ধানেঃ বাংলাদেশ ও বিশ্ব অধ্যয়নগ্রন্থে।

৩৬। কোনো দেশে বা শহরে যাবার আগে ইন্টারনেটে সে শহরের Important places তথা দর্শনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ জায়গাসমূহ জেনে নেবেন এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি প্রিন্ট দিয়ে নিতে পারেন। প্লেনে বসে তা স্টাডি করে নিলে পরে পরিদর্শনকালীন সবকিছু সহজতর ও স্বচ্ছ মনে হবে। যেকোনো দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, গুরুত্বপূর্ণ ও দর্শনীয় স্থান বা বিষয়াদি সম্পর্কে যাত্রাকালীনই পড়াশোনা করে নিলে সফর অধিকতর স্বচ্ছন্দ ও ফলপ্রসূ হয়।

৩৭। যেকোনো শহরে ঢুকে প্রথমেই সিটি ট্যুর ম্যাপ সংগ্রহ করবেন।  র (আই) লেখা দেখলে বুঝবেন, এটি ইনফরমেশন সেন্টার। আপনার যেসব তথ্য জানার বা জিজ্ঞাসার সবই ইনফরমেশন সেন্টার বা ডেস্ক থেকে জেনে নেবেন। সেখান থেকে ম্যাপ সংগ্রহ করে আপনি ঐ মুহূর্তে কোন্্ অবস্থানে আছেন, সে স্থানে চিহ্ন দিয়ে নিতে পারেন। আগামী কদিনে আপনার যেসব তথ্য লাগতে পারে, সেসব তথ্যও জেনে নিতে পারেন।

এয়ারপোর্টেও ইনফরমেশন ডেস্ক থাকে। তবে এয়ারপোর্টে জিনিসপত্রের দাম বেশি থাকে বলে ম্যাপের দাম কয়েকগুণ বেশি নিতে পারে। আবার অনেক এয়ারপোর্টে এবং শহরের ট্যুরিস্ট গাইড সেন্টারে ম্যাপের জন্য কোনো পয়সাই দিতে হয় না।

৩৮। যে শহর বা যে দেশে গেলেন, তা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করবেন। তাৎক্ষণিক মনে হতে পারে যে, এ শহরটি অনেক সুন্দর ও ব্যতিক্রম। আমি আবারও এ শহরে আসব। কিন্তু মনে রাখবেন যে অনুরূপ দেশ একটি নয়, শতটি এবং অনুরূপ শহরের সংখ্যা শত নয়, হাজার হাজার। তাই আপনার সীমিত জীবনে পৃথিবীর সব শহর বারেবারে দেখা সম্ভব না হওয়াই স্বাভাবিক এবং যদি একই শহর বার বার দেখতে চান, তাহলে বহু শহর দেখার সুযোগ হারাবেন। তাই প্রথমবারেই ভালো করে দেখুন।

৩৯। কোনো শহর দেখতে হলে দ্রুতগামী যানবাহনে না গিয়ে ধীর গতির গাড়িতে এবং যথাসম্ভব হেঁটে দেখবেন; দেখার সময়ে নোটও মেইনটেইন করতে পারেন।

৪০। কোনো শহরে ঢুকে সে শহরের যানবাহনের সিস্টেম জেনে নেবেন। পদ্ধতি জানার অভাবে যেমনি এক ট্যুরিস্ট পুরো শহর দেখা শেষ করতে পারে না বা পারলেও প্রচুর পয়সা ব্যয় করতে হয়; তেমনি আবার পদ্ধতি জানা থাকার ফলে আরেক ট্যুরিস্ট অল্প পয়সায় ও আয়েশে এবং স্বল্প সময়ে সম্পূর্ণ শহর চষে বেড়াতে পারে।

পৃথিবীর ব্যস্ততম ও বিশাল শহরের অন্যতম বেইজিংয়ের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ঘুরে বেড়াতে বাসে লাগে ১ ইয়েন বা ১১ টাকা, সাবওয়ে বা ট্রেনে গেলে লাগে ২ ইয়েন, অথচ ট্যাক্সিতে উঠলেই গুণতে হবে ন্যূনতম ৩০ ইয়েন! এয়ারপোর্টে যাতায়াতে আরামদায়ক সাটল ট্রেন বা লাক্সারিয়াস সাটল বাসে গেলে লাগবে সর্বোচ্চ ৫ ইয়েন, যেখানে ট্যাক্সিতে গেলে লাগবে ন্যূনতম ১০০ ইয়েন। তবে লাগেজ অত্যধিক হলে সেক্ষেত্রে ট্যাক্সিরই প্রয়োজন বেশি।

৪১। শিক্ষণীয় বিদেশ সফরের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে Tour in countryside village অর্থাৎ বড় শহর দেখার পাশাপাশি গ্রাম-গঞ্জ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন। এতে সেই দেশ বা জাতির প্রকৃত সংস্কৃতিও জানা যায়।

ঢাকা বা চট্টগ্রাম শহর দেখে যেমনি বাংলাদেশের গ্রামীণ সাধারণ জীবন বোঝা যায় না, তেমনি অন্যদেশের বড় বড় শহর ভ্রমণ করে সে দেশের মূলধারার সংস্কৃতি জানা মুশকিল। এজন্য গ্রামীণ কোনো পরিবারে কটা দিন থাকার সুযোগ তৈরি করে নিতে পারলে সোনায় সোহাগা।

বিদেশি স্টুডেন্টদের জন্য এরূপ হোস্ট প্রোগ্রাম থাকে বহু দেশে। অর্থাৎ সে দেশের কোনো কোনো শৌখিন পরিবার হোস্ট হয়ে বিদেশি স্টুডেন্টদেরকে আমন্ত্রণ জানায় তাদের সাথে ২/১ দিন কাটাতে। এতে হোস্ট ও গেস্ট উভয়েই পরস্পরের জীবনাচার ও সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে জানার সুযোগলাভ করে। উন্নত দেশের অনুরূপ হোস্টরা সে দেশের নামকরা ইউনিভার্সিটিতে হোস্ট-অফার দিয়ে রাখে এবং বিদেশি ছাত্ররা ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টস্্ কাউন্সিলে খোঁজ নিয়ে এরূপ প্রোগ্রামে যোগ দিতে পারে।

যুক্তরাজ্যের ওয়েল্্স অঞ্চলের রিমোট এলাকার স্থানীয় এক পরিবারের সাথে দুদিন থাকার সুযোগে ঐ এলাকার বহু বাড়িতে যাতায়াত করে মূল ব্রিটিশদের পারিবারিক-সামাজিক কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার বিরল সুযোগ পেয়েছিলাম; যার বিশদ বর্ণনা রয়েছে আমার  রচিত ন্যায়ভিত্তিক সমাজ এবং আলোকিত জাতির সন্ধানেঃ বাংলাদেশ ও বিশ্ব অধ্যয়নগ্রন্থে।

৪২। ভ্রমণশেষে দেশে ফেরতকালীন বা ডিপারচার সময়ে ইমিগ্রেশন ডেস্ক থেকে আপনার পাসপোর্টে সিল মেরে দিয়েছে কিনা, তা লক্ষ্য করবেন। এই সিলই প্রমাণ করবে যে, আপনি ভিসা মেয়াদের মধ্যে ঐ দেশ ছেড়ে এসেছেন। অর্থাৎ আপনি একজন সাধু-সুবোধ মানুষ।

শেষ হয়েও হইল না শেষ...

৪৩।বিদেশ ভ্রমণে যা দেখলেন, যা বুঝলেন তা থেকে নিজ জন্মভূমের মঙ্গল ও কল্যাণার্থে কিছু অবদান রাখার চিন্তা ও প্রচেষ্টা করুন। বিদেশের ভালো ও অনুকরণীয় বিষয়গুলো পরিবারে ও প্রতিষ্ঠানে এবং সুযোগ থাকলে জাতীয় পর্যায়ে চর্চা করা ও করানোয় লেগে থাকুন; দুঃখী জননীর দুর্গতি লাঘবে প্রয়াসী থেকে তার প্রতি আপনার ঋণ শোধ করুন।

৪৪।বিদেশ ভ্রমণকালীন প্রতিদিনের ডায়েরি লিখতে চেষ্টা করবেন। দেশে ফিরে আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লিখে পত্রিকায় পাঠাতে পারেন। আমাকেও এক কপি পাঠালে প্রীত হব। আর আমার সংশ্লিষ্ট ক্যাম্পাস পত্রিকায় আপনার ভ্রমণকাহিনী বা অভিজ্ঞতার কথা ছাপাতে চাইলে মেইল করুন info@campus.org.bd এ।

আপনার বিদেশ ভ্রমণ সার্থক ও সমৃদ্ধ হোক, চলার পথ হোক কন্টকমুক্ত। Be international, be a global personality. And thus come forward to remove all darkness with the light of knowledge.

 

লেখকঃ                        

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক

ফোনঃ ৯৫৫০০৫৫, ৯৫৬০২২৫

web: www.helal.net.bd               
e-mail: m7helal@yahoo.com

 


বিশ্ববিদ্যালয় কম্পাস পত্রিকার সংখ্যা সমূহ

আরো সংবাদ

শিশু ক্যাম্পাস

বিশেষ সংখ্যা

img img img