বিশেষ খবর



Upcoming Event

বর্ণিল প্রতিভায় ভাস্বর, সৎ ও নিষ্ঠাবান অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত এর বর্ণাঢ্য শিক্ষাজীবন-২

ক্যাম্পাস ডেস্ক প্রিয় মানুষের মুখোমুখি
img

বহুমুখী প্রতিভায় ভাস্বর, বর্ণিল গুণাবলির সৎ, ন্যায়নিষ্ট, কর্মযোগী ও স্পষ্টভাষী বিরল ব্যক্তিত্ব, বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিত। একদিকে তিনি সফল অর্থমন্ত্রী, খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ, সরকারের প্রজ্ঞাবান সচিবকুটনীতিবিদ, গবেষক, চিন্তাবিদ, লেখক ও সংগঠক; অন্যদিকে সহজ-সরল, ক্রীড়াপ্রেমী ও আমুদে মানুষ।  
কর্মযোগী মুহিত ছিলেন বরাবরই মেধাবী ছাত্র। তিনি যেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন, তেমনি আবার প্রাইমারি ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্যও হয়েছিলেন। তাঁর এ ধরনের সাফল্য ও ব্যর্থতার কথা অকপটে বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার সাথে প্রিয় মানুষের মুখোমুখিকলামে সাক্ষাৎকারে যা বর্তমান ছাত্র-সমাজের জন্য বিশেষ অনুকরণীয়। বরেণ্য এই ব্যক্তিত্বের শিক্ষা জীবনের বিচিত্র গল্প তাই তুলে ধরা হলো ছাত্র-যুবকদের প্রেরণার উদ্দেশ্যে।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবন
ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর সবাই ধরে নেয়, আমি ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হব। কিন্তু আমি সমস্যায় পড়ে যাই, বন্ধু-বান্ধব সবাই ইকোনোমিক্সে; আমিই কেবল ইংরেজিতে! ইকোনমিক্সের অধ্যাপক আবু নসর মাহমুদ বললেন সে ইকোনোমিক্সে ভালো মার্ক পেয়েছে, ইংরেজি নেবে কেন! কথাটা আমি বুঝলাম এবং চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমার বাল্যকাল থেকে পরিচিত অর্থনীতির অধ্যাপক আখলাকুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করে পরামর্শ চাইলাম। তিনি বললেন, মাহমুদ সাহেব তোমার কথা বলেছেন; ইতিহাসের ওয়াদুদুর রহমান সাহেবও বলেছেন তোমার বিষয়ে; তুমি ইতিহাসে ৮৮ নম্বর পেয়েছ, তিনিও তোমাকে চান। তিনি আমাকে বোঝালেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা আসলে কী। বিশ্ববিদ্যালয়ে মূলত শেখানো হয় কীভাবে পড়তে হয়, জ্ঞান আহরণ করতে হয়, গবেষণা করতে হয়; বাকিটা নিজের ওপর। কোন্্ বিষয় নিয়ে পড়া হলো সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। জ্ঞানার্জনের উপায় জানা থাকলে প্রয়োজনে ইকোনমিক্স আয়ত্ত্ব করে নিতে পারবে তুমি। এ কথা শুনে আমি বাড়ি গেলাম; মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, ইংরেজিতেই ভর্তি হব। তবে সাথে থাকলো ইকোনোমিক্স ও ফিলসফি।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সমাজসেবাও করেছি আমি। যেমন ১৯৫৪ সালে একটা বড় বন্যা হলো। আমার অনার্স পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আমার শিক্ষক মি. টারনার বললেন তুমি কি বাড়ি যাচ্ছ? বন্যা-দুর্গতদের মাঝে একটু রিলিফের কাজ করে যেতে পারতে। আমি রাজি হলাম। বাড়ি যাওয়া স্থগিত হলো। ৫০/৬০ জনের একটা ভলান্টিয়ার গ্রুপ হলো। ঢাকা মহানগরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দুর্গতদের মাঝে ত্রাণ কাজ পরিচালনা করলাম প্রায় ৩ মাস। আমাদের কিছু টাকা ছিল সেগুলো নিয়ে গেলাম ঢাকা জেলার দুর্গম অঞ্চলে, যেখানে ত্রাণ কর্মীরা সাধারণত যায় না। এসময় ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে ত্রাণ কাজে অংশগ্রহণের সূচনা হলো। কিছু সামাজিক বাধা কিংবা অসুবিধার জন্য মেয়েরা এরূপ মানব-কল্যাণমূলক কাজে অংশ নিতে আগে দ্বিধা বোধ করতো। এবারে মেয়েরাও আমাদের সাথে যুক্ত হয়ে কাজ করলো এবং তারা ছিল দৃঢ়চিত্ত।
তবে মেয়েদের সম্পৃক্ত করার জন্য আমাদের কিছু পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল। ছেলে-মেয়েরা যাতে একসাথে মিলে ত্রাণ বা সমাজ সেবামূলক কাজ করতে পারে, সেজন্য খুব সাবধানে দলগুলো গঠন করতে হতো। যেসব মেয়ে সাহস করে ত্রাণকাজে সম্পৃক্ত হন তারাও ছিলেন ব্যক্তিত্বশালী মহিলা। তাই নির্বিবাদে একসাথে ছেলে-মেয়েরা ত্রাণ কাজ করতে সক্ষম হই।
আমাদের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে মেলামেশার সুযোগ ছিল সীমিত। মেয়েদের সঙ্গে আড্ডা দেয়াতো দূরের কথা, কথা বলাও ছিল নিষিদ্ধ। শুধু শিক্ষকের উপস্থিতিতে সরাসরি কথা বলা যেত। তবে ১৯৫৩ সালে আমরা এক যুগান্তকারী পরিবর্তন করি। প্রথমবারের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক অভিনয়ে ছেলে ও মেয়েরা একসঙ্গে অভিনয় করে। এর আগে ছেলেরা মেয়ে সেজে অভিনয় করতো।  সেসময় আমি এস এম হল ইউনিয়নের জয়েন্ট সেক্রেটারী। আমরা ঠিক করলাম যে, সহ-অভিনয় চালু করব। উদ্যোগী ছাত্রী পেতেও অসুবিধা হলো না। তখন হলের প্রভোস্ট ড. এম ও গণি। আমরা তাঁকে আমাদের উদ্দেশ্য বললাম ও তাঁর অনুমতি চাইলাম।
ড. এম ও গণি বললেন যদি গার্জিয়ানরা আপত্তি না করেন, তাহলে তিনি সাহায্য করতে পারেন। প্রমাণস্বরূপ দুজন গার্জিয়ানের চিঠি সংগ্রহ করলাম আমরা। মালিক আবদুল বারি একটি চিঠি দিলেন। তিনি লিখলেন মেয়েরা ছেলেদের সাথে সহ-অভিনয় করবে, সেটাইতো স্বাভাবিক। আমার মেয়ে সহ-অভিনয়ে অংশ নেবে। তাঁর মেয়ে ছিলেন নামকরা গায়িকা ফরিদা বারি মালিক।
আরেকজন ছিলেন মুনিনুন নেসার আব্বা খান বাহাদুর শামসুদ দাহার, কলকাতার পুলিশ কমিশনার। তিনিও তাঁর মেয়েকে সহ-অভিনয়ে ছেলেদের সাথে অংশ নেয়ার সম্মতি দিলেন। ড. গণিও সানন্দে রাজি হলেন। আমাদের পথের বাধা অপসারিত হলো।
এসবের মধ্য দিয়েই ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ অনার্স পরীক্ষায় ১ম শ্রেণিতে ১ম এবং ১৯৫৫ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করি আমি।
এক্সট্রা কারিকুলার একটিভিটিজ
পড়ালেখার বাইরেও এক্সট্রা একাডেমিক কাজের প্রতি আমার আকর্ষণ ছিল বেশি, সবরকম খেলাধুলায় আমি অংশ নিতাম। কবিতা আবৃত্তি, নাটক, হাতে লেখা পত্রিকা, দেয়াল পত্রিকা ইত্যাদি প্রকাশে উৎসাহের সাথে কাজ করতাম।
আমি কবিতা আবৃত্তি, বিতর্ক, বক্তৃতা বা রচনা প্রতিযোগিতা, বাংলা ও ইংরেজি নাটকে অভিনয় করে বেশ কিছু পুরস্কারও অর্জন করেছি। তখনকার সিলেটের নামকরা প্রতিষ্ঠান মুসলিম সাহিত্য সংসদে সদস্য হই ১৯৪৫ সালে। ওখানে সাহিত্য সভা করতাম; এ প্রতিষ্ঠান থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি, পুরস্কারও পেয়েছি। সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি আমি ভলিবল, ফুটবল, বাস্কেটবল, ক্রিকেট খেলতাম।
স্কুলে থাকতেই বড় বড় সব বই পড়ে ফেলেছিলাম আমি। প্রচুর বই পড়তাম আর খেলাধুলা করতাম। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসও বাদ পড়েনি। বঙ্কিমচন্দ্র পড়ার একটা কারণ ছিল আমার এক শিক্ষক দ্বিজেন্দ্র বাবু, উনি কংগ্রেস পার্টির সাথে জড়িত ছিলেন, আমাকে খুব স্নেহ করতেন। একদিন আমাকে ডেকে বললেন মুহিত, তুমিতো বঙ্কিমকে পছন্দ করো না; আমার একটা উপদেশ আছে তুমি প্রথমে বঙ্কিম পড়ো; যদি ভালো না লাগে, তাহলে তোমার মতামত জানাবে। আমি শিক্ষকের উপদেশে বঙ্কিমের বই পড়া শুরু করলাম এবং তাঁর অনবদ্য সৃষ্টির প্রায় সবই পড়ে ফেললাম। কেননা এর মধ্যে আমি বুঝে ফেলেছিলাম, বঙ্কিমচন্দ্রই বাংলা সাহিত্যে আধুনিক ধারার প্রবর্তক। আমি রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের বইও পড়েছি, তাছাড়া ইতিহাস ছিল আমার খুব প্রিয় বিষয়।
সিলেটে মিলাদ উপলক্ষ করে কয়েকটি স্কুলে প্রতিবছরই স্বরচিত প্রবন্ধ, কবিতা ও রচনা প্রতিযোগিতা হতো। ১৯৪৪ সালে ক্লাস ফোরে পড়ার সময় প্রতিযোগিতা উপলক্ষে লেখা প্রবন্ধ এখনও আমার কাছে আছে। মিলাদ উপলক্ষে লেখার পুরস্কার নিয়েছিলাম জেলা জজ বেলায়েত হোসেন মোল্লার হাত থেকে। আরেকবার একটা প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশনে এসেছিলেন আসামের প্রধানমন্ত্রী স্যার মোঃ সাদুল্লাহ। সেটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরের ঘটনা, সম্ভবত ১৯৪৫ সালের। সাথে শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন মিজ মুভিস ডান খাসিয়া উপজাতির লোক।
আমি এসএম হলে থাকাকালীন ঢাকায় একটি প্রতিযোগিতা হয়েছিল রোটারীর গোল্ডেন জুবিলী উপলক্ষে, রচনা প্রতিযোগিতা। কলকাতা, ঢাকা, মুম্বাই থেকে প্রতিযোগীরা অংশগ্রহণ করেছিল।  এসএম হলে আমার কামরা তখন অন্য একজন পরীক্ষার্থীকে একমাসের জন্য দিয়েছিলাম, তার প্রিপারেশনের সুবিধার্থে। রচনা প্রতিযোগিতার কথা শুনে আমি তাকে গিয়ে বললাম যে, রচনা প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার জন্য আমার কয়েকদিন কামরায় থাকা প্রয়োজন। এরপর আমি রচনা লিখলাম এবং পুরস্কারও পেলাম।
এ রচনার জন্য আমি ৭৫ টাকা পেয়েছিলাম, যা আমার আত্মবিশ্বাস আরও দৃঢ় করে তোলে। বিশ্ববিদ্যালয় চ্যান্সেলর গোল্ড মেডেল রচনা প্রতিযোগিতায়ও আমি অংশগ্রহণ করেছিলাম, কিন্তু এটাতে পুরস্কার পাইনি। এই একটিমাত্র রচনা প্রতিযোগিতায় আমি ব্যর্থ হয়েছিলাম। আর যা চেয়েছি, তা-ই পেয়েছি। আমি সব খেলা খেলতাম। খুব যে গুড প্লেয়ার ছিলাম, তা নয়; খেলতাম মনের সুখে।
চলবে



বিশ্ববিদ্যালয় কম্পাস পত্রিকার সংখ্যা সমূহ

আরো সংবাদ

শিশু ক্যাম্পাস

বিশেষ সংখ্যা

img img img