গরম খাবার বলতে আমরা বুঝি মাংস, মাছ, ডিম ইত্যাদি খাদ্যকে। কখনই গরম চা, কফি, বা গরম ভাতকে গরম খাবার বলি না। অর্থাৎ গরম খাবার বলতে যে খাবার সহজে হজম হয় না, বিশেষত গরমকালে, তাকেই বলি গরম খাবার। এসব খাবার খেলে শরীর গরম হয়, পেট গরম হয়, অর্থাৎ বদহজম হয়। শরীর গরম হয় মানে, শরীরের তাপমাত্রা বাড়ে, তা কিন্তু নয়, আবার ঠান্ডা খাবার মানে যে খাবার শরীর ঠান্ডা রাখে, তাও কিন্তু নয়। বরং বলা যেতে পারে যে সব খাবার নিজে সহজে হজম হয়, অপর খাদ্যকেও হজমে সাহায্য করে সেগুলোই ঠান্ডা খাবার। এই নিরিখে এবার বিচার করে দেখি ডিম কতটা গরম খাবার?
কারণ গরম খাবারের তালিকায় এক নম্বরে তো ডিমেরই স্থান। দেখা যাক কী থাকে একটা ডিমে? ডিমের গড় ওজন প্রায় ৬০ গ্রাম। এতে প্রোটিন ও ফ্যাট থাকে মাত্র ৬ গ্রাম করে। কাজেই এদের হজম করা কোনও ব্যাপার নয়। এ ছাড়া থাকে ৩০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ১.৫ মিলিগ্রাম লোহা, অন্যান্য খনিজ পদার্থ ৮ গ্রাম এবং অধাতব পদার্থ ৩ গ্রাম, যার মধ্যে ভিটামিন সি বাদে অন্য সব ভিটামিনই থাকে। জল থাকে প্রায় ৩৫ গ্রাম। কোলেস্টেরল থাকে প্রায় ৭০০ মিলিগ্রাম এবং শক্তি পাওয়া যায় ৭০ ক্যালরির মতো। আমাদের দেহ গঠনের জন্য প্রোটিনের অন্যতম উপাদান যে ৮টি অ্যামাইনো অ্যাসিড, ডিমে তার সব কটিই থাকে। সেই অর্থে ডিম অবশ্যই পুষ্টিকর খাদ্য এবং সহজপাচ্যও বটে। অর্থাৎ ডিম গরম খাদ্য নয়। যে জন্য রোগীদের খাদ্য তালিকায় ডিমের স্থানটি বরাবরের জন্য বাঁধা। অনেক বাড়িতে বসন্ত, হামসহ নানা ভাইরাসঘটিত রোগ দেখা দিলে ডিমের প্রবেশ বন্ধ হয়। অথচ এ সময় শরীরের বাড়তি পুষ্টির জন্য ডিম অবশ্যই প্রয়োজন।
ডিমের নানা গুণপনা থাকা সত্ত্বেও তার কপালে নানা নিন্দেমন্দ জোটে কেন? কারণ ভাল ডিম সব সময় বাজারে পাওয়া মুশকিল। ৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের ওপরে ১২ ঘণ্টার বেশি ডিম রাখলে তার পুষ্টিমূল্য কমে যায়। অথচ আমাদের মতো গ্রীষ্মপ্রধান দেশে গড় তাপমাত্রা সব সময়ই ৩০ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থাকে। রাস্তাঘাটে বা হোটেল রেস্টুরেন্টে পচা ডিমের ছড়াছড়ি। রান্নার গুণে তাদের পচনত্ব চাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। যে জন্য বাইরের ডিম এ সময় বিষতুল্য। যদি খেতেই হয় বাড়িতে এনে ভাল করে ধুয়ে সেদ্ধ করতে হবে। কাঁচা বা অর্ধসেদ্ধ ডিম হজম হয় না নানা কারণে। হাঁসের ডিমে ‘ট্রিপসিন ইনহিবিটর’ নামক একটি পদার্থ থাকে যা আমাদের অগ্ন্যাশয় গ্রন্থি থেকে ক্ষরিত পাচকরসের ট্রিপসিন নামক একটি পদার্থের কাজে বাধার সৃষ্টি করে। এই ট্রিপসিন আবার আমাদের প্রোটিন পরিপাকে সাহায্য করে। কাজেই হজমে গন্ডগোল অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু ৮/১০ মিনিট ফুটিয়ে নিলে ট্রিপসিন ইনহিবিটর নষ্ট হয়ে যায়। কাজেই ডিম সবসময় সেদ্ধ করেই খাওয়া উচিত। এ ছাড়া কাঁচা ডিম সালোমোনেলা, সিগেলা ইত্যাদি কিছু জীবাণু সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে, গরমকালে এই আশঙ্কা আরও বাড়ে। বেশি ডিম উৎপাদনের জন্য এবং পোলট্রিকে জীবাণুমুক্ত রাখার জন্য নানা জীবাণুনাশক রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগ করা হয়। এর ফলে ক্ষতি হতে পারে। তবে শুধু ডিম নয়, যে কোনও খাদ্য উপাদানের ক্ষেত্রেই একথা সত্যি।
বেশি ডিম খেলে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে গিয়ে রক্তনালি ও হৃদযন্ত্রের অসুখ হতে পারে, অ্যাসিডিটি বাড়তে পারে, ফ্যাটি লিভার হতে পারে। কাজেই বেশি ডিম খাওয়ার হ্যাপা কিন্তু আছেই। কিন্তু তাই বলে সপ্তাহে ৩/৪টি সুসেদ্ধ ডিম খেলে মহাভারত অশুদ্ধ হয় না, শরীরও গরম হয় না। শুধু দেখতে হবে ডিমটা যেন ভাল হয়। হাঁস, মুরগি বাছ-বিচারের দরকার নেই। ভাল করে সেদ্ধ করে খেলে দুটো থেকে প্রায় সমান পুষ্টিই পাওয়া যায়।
ডিম নিয়ে আমাদের মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন জাগে, এবার সেই প্রশ্নগুলির একটু বিজ্ঞানসম্মত উত্তর খোঁজা যাক। অনেকের ধারণা ডিম খেলে অ্যালার্জি হয়। হয়, তবে সবার নয়, কারও কারও। যার হয়, তিনি ডিম খাবেন না। অ্যালার্জির প্রকাশ নানাভাবে হতে পারে। কখনও সারা গা চুলকোয়, লাল চাকা চাকা হয়ে ওঠে। মুখ ফুলে যায়, বেশি ঘাম হয়, শ্বাসকষ্টও হতে পারে।
ডিম খেলে বাত হয় বলে অনেকে মনে করেন। বাতের অন্যতম কারণ রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বৃদ্ধি। ডিমের সাদা অংশে ইউরিক অ্যাসিড থাকে, তবে তা এত সামান্য যে কোনও ক্ষতি হয় না। ডিম খেলে সব সময় রক্তচাপ বাড়ে, তাও ঠিক নয়। ডিমের সাদা অংশে থাকে সোডিয়াম সল্ট অফ অ্যালবুমিন খুবই অল্প পরিমাণে। তবে অতিরিক্ত ডিম, বিশেষ করে ডিমের কুসুম খেলে রক্তে কোলেস্টেরল বাড়তে পারে, সে কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এই কোলেস্টেরলের স্তর রক্তনালিতে জমে গিয়ে তাকে শীর্ণ করে তোলে, অবরোধ সৃষ্টি করে। রক্তচাপ বাড়তে পারে। কাজেই হাই প্রেসারের রোগীদের ডিম কম খাওয়াই ভাল। বয়স্ক লোকেরা কোলেস্টেরলের বিপত্তি এড়াতে ডিমের সাদা অংশটিই শুধু খাবেন, শিশুদের খাওয়াবেন ডিমের কুসুম। কুসুমে প্রোটিন বেশি থাকে, হজম করাও সহজ। তবে সুস্থ মানুষদের এত বাছবিচার না করলেও চলে।
ডিম দেশি ভাল না পোলট্রির, এ তর্কও অনেকে তোলেন। পোলট্রির ডিমের কুসুম একটু সাদাটে বলে অনেকে খেতে চান না। অপর দিকে দেশি ডিমের কুসুম ঘন হলুদ রঙের। অথচ পুষ্টি কিন্তু পোলট্রির ডিমেরই বেশি। দেশি মুরগি যে সব শাকসবজি খায়, তা থেকে ‘ক্যারোটিন’ পায়। এই ক্যারোটিন হল ভিটামিন এ-র প্রাক্ অবস্থা। যে জন্য দেশি ডিমের কুসুম লাল। অপর দিকে পোলট্রির মুরগিকে সুষম পুষ্টিকর খাদ্য দেওয়া হয়, যা থেকে সরাসরি ভিটামিন ‘এ’ পায়। এ জন্য তাদের ডিম ফ্যাকাসে বা সাদাটে। সঠিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে রক্ষণাবেক্ষণ হয় বলে পোলট্রির ডিম অবশ্যই বেশি পুষ্টিকর।শেষ কথা হল, ডিম খেলে শরীর গরম হয় না, বরং অনেক পুষ্টি মেলে।