বিভিন্ন কারণেই দেশের শিক্ষার মান নিয়ে শিক্ষিত সমাজের চিন্তিত হওয়ার অনেক যুক্তি রয়েছে। যুগে যুগে সেøাগান উঠেছে ‘শিক্ষাব্যবস্থা পাল্টাতে হবে’, ‘শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে’। কিন্তু পাল্টাতে কিংবা ঢেলে সাজাতে চাইলেই তো সেটা করা যায় না। এর জন্য সমাজের সব স্তরের নাগরিকসহ শিক্ষা প্রশাসন ও সরকারের আগ্রহ, আন্তরিকতা ও সহযোগিতার কোনো বিকল্প নেই। কিভাবেই বা শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিশুদ্ধ করা যায় এবং এর জন্য আমরা কে কতটুকু কাজ করছি?
পরিশুদ্ধ করার লক্ষ্যে পরিবর্তন যে কেবল সম্ভব তা নয়, পরিবর্তনের পক্ষে বড় রকমের উদ্যোগের সময় এসেছে। কারণ দেশের সব স্তরের মানুষের মধ্যে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে, এর গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা হয়েছে এবং ইদানীং শিক্ষার মান নিয়েও মানুষ ভাবছে। এ খাতে সাধ্যানুযায়ী, এমনকি সাধ্যাতীত ব্যয়েও কুণ্ঠিত হচ্ছে না মানুষ। ফলে এখন এ খাতকে আরো গঠনমূলকভাবে সাজাতে শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের আরো অধিক আন্তরিকতার মাধ্যমে বাজেট বৃদ্ধির বিকল্প নেই।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে শিক্ষা খাতে বাজেটের ২১ শতাংশ বরাদ্দ থাকত। এখন তা কমিয়ে ১২ শতাংশে নামানো হয়েছে। ফলে শিক্ষা খাতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ সম্পন্ন হচ্ছে না। এতে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় তীব্র অবকাঠামো সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে এ সংকট অধিক লক্ষ্য করা যাচ্ছে প্রাথমিক স্তরে। অনেক স্কুলের ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার পরও সেখানে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হয়। শিক্ষার্থীদের বসার জন্য প্রয়োজনীয় বেঞ্চ নেই। বিশুদ্ধ পানির জন্য টিউবওয়েল নেই। বেশির ভাগ বিদ্যালয়ে সীমানাপ্রাচীর নেই। খেলার মাঠও ব্যবহার অনুপযোগী। প্রাথমিক শিক্ষায় প্রধান সমস্যা হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অভাব, বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষকের অপ্রতুলতা, আর্থিক বৈষম্য ও অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার অভাব। মূলত শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ কম থাকায় এ সমস্যাগুলো সৃষ্টি হয়েছে। ২০১৪-১৫ সালের বাজেটে মোট বাজেটের ১১.৬৬ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে শিক্ষা খাতে। এই বরাদ্দ শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়-এ দুই মন্ত্রণালয়ে বণ্টন করা হয়েছে, যদিও মোট পরিমাণের দিক থেকে শিক্ষা বাজেট বেড়েছে; কিন্তু শতাংশ হিসাবে শিক্ষা বাজেট বরাদ্দের হার গত পাঁচ অর্থবছরে ক্রমাগত কমেছে। ২৬ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে চট্টগ্রাম মহানগরে একটি স্কুল পরিদর্শনে গিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নিজেই বলেন, ‘আমি যখন দায়িত্ব নিই তখন শিক্ষায় বাজেট ছিল শতকরা ১৪ ভাগ। পরের বছর তা কমে হয় ১৩ ভাগ। এখন সেটা ১১ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘সারা বিশ্বে যখন শিক্ষায় বাজেট বাড়ছে আমাদের তখন ক্রমেই কমতে শুরু করেছে।’ অথচ যুক্তিসংগতভাবে শিক্ষাকেই সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেয়া উচিত ছিল। কারণ শিক্ষা একমাত্র দেশকে পশ্চাৎপদতা থেকে মুক্ত করতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার মান নিয়ে নানাবিধ প্রশ্ন ওঠে। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকের মান ও মর্যাদা নিয়েও প্রশ্ন আসে। কিন্তু শিক্ষার মান ও শিক্ষকের সম্মান-মর্যাদার সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে বাজেট বরাদ্দের। শিক্ষামন্ত্রী নিজেই প্রায়ই বলেন, ‘আমরা শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন দিতে পারি না। তাহলে প্রশ্ন আসাই স্বাভাবিক যে কিভাবে শিক্ষার গুণগত মান তৈরি হবে? যেসব শিক্ষকের পাঠদান ও যতেœর মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষা প্রস্তুত করা যায়, ওই শিক্ষকদেরই অনুপযুক্ত বেতন দিয়ে কি মান বজায় রাখা সম্ভব?’
আমরা জানি, বর্তমানে প্রাথমিকে শতভাগ ভর্তি, বছরের প্রথম দিনে সবার জন্য বিনা মূল্যে বই, চমকপ্রদ ফল হচ্ছে। কিন্তু এসব কিছু কি শিক্ষার চূড়ান্ত ভিত্তি? এগুলো থাকলেই যে শিক্ষার্থী ঠিকমতো শিখবে কিংবা শিক্ষক ঠিকমতো পাঠদান করবেন, সেটি চিন্তা করা যুক্তিসংগত নয়। শিক্ষাকে একটি অবকাঠামোগত উন্নয়ন হিসেবে ধরতে বিভিন্ন ধারার শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দে এবং শিক্ষা প্রশাসনের ভূমিকায় ব্যাপক তারতম্যের প্রভাবে শিক্ষার একাডেমিক ও সামাজিক উভয় ক্ষেত্রেই ব্যাপকভাবে বৈষম্য সৃষ্টি হয়, যা শিক্ষার নিম্ন স্তরগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলছে। সরকারি শিক্ষা প্রশাসন থেকে শুরু করে স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকাগত নানাবিধ পার্থক্য রয়েছে। যেমন ঃ দেশের অভ্যন্তরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো একযোগে একই সময়ে ছুটি হয় না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় (প্রাথমিক ও মাধ্যমিক) সপ্তাহে এক দিন ছুটি থাকলেও শিক্ষা প্রশাসনিক স্তরে সপ্তাহে দুই দিন ছুটি ভোগ করে থাকে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্তরে ইতোমধ্যেই গ্রীষ্মকালীন ছুটি শুরু এবং কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে ইতোমধ্যেই শেষ হয়ে গেলেও প্রাথমিক স্তরের কোমলমতি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা এখনো ছুটি ভোগ করতে পারেননি। ২৩ থেকে ২৭ মে পর্যন্ত পূর্বনির্ধারিত গ্রীষ্মকালীন ছুটি থাকলেও তা হঠাৎ এক দিন আগে অর্থাৎ ২১ তারিখের মন্ত্রণালয়ের আদেশে বাতিল করে রমজানের ছুটির সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। একজন শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং শিক্ষকের পূর্বনির্ধারিত ছুটির সময় অনুযায়ী কিছু পরিকল্পনা থাকে। বিষয়টি শিক্ষক-শিক্ষার্থীর বিনোদনের সঙ্গেও সম্পৃক্ত। কিন্তু হঠাৎ ছুটি বাতিল করলে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মানসিক চাপ সৃষ্টি হতে পারে, যা শিক্ষাব্যবস্থাকে মানসম্মত কোটায় নিতে বাধা সৃষ্টি করে।
ইদানীং পেশা হিসেবে স্কুল শিক্ষকতার মর্যাদা ও আকর্ষণ কমে যাওয়ার নানাবিধ কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম কারণ শিক্ষা প্রশাসনের অসহযোগিতা এবং অসংলগ্ন ভূমিকা। এর প্রভাবে লক্ষ্য করা যায় যে মেধাবী, মননশীল, ব্রতী তরুণরা এ পেশায় আসছেন না। মেধাবী তরুণদের শিক্ষকতায় আগ্রহী করে তোলার জন্য মূলত দুটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে। এক. শিক্ষকের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি এবং দুই শিক্ষা প্রশাসন ও শিক্ষা বিভাগের বিভিন্ন দপ্তরের বহুমুখী অধস্তনতা থেকে মুক্তি। কম বেতন ও অতিরিক্ত অধীনতা শিক্ষকের মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গে কর্মক্ষমতাও নষ্ট করে দেয়। সম্প্রতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিলকেও শিক্ষার্থীর মানসিক ক্ষতি, শিক্ষকের মর্যাদাহানি এবং কর্মক্ষমতা নষ্টের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। একদিকে বেতন-ভাতা অপ্রতুল, অন্যদিকে শিক্ষকের মানসিক চাপ সৃষ্টি কোনোটিই শিক্ষা তথা শিক্ষার সামগ্রিক ব্যবস্থাকে মানসম্মত করতে পারে না।
কাজেই এসব পরিপ্রেক্ষিতে আসছে বাজেটে শিক্ষা খাত নিয়ে ভিন্নতরভাবে ভাবতে অর্থমন্ত্রীকে আহ্বান জানাই। বর্তমান জাতীয় শিক্ষানীতিতে বেশ কয়েকটি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষার পরিসর বাড়ানো, প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার, নারীশিক্ষার প্রসার, বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ ইত্যাদি। সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে সব কিছু যে একসঙ্গে বাস্তবায়ন করা যাবে না, তা আমরা সবাই উপলব্ধি করি। কিন্তু প্রতিবছর একটি একটি করে বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়নের দিকনির্দেশনা প্রদান করা যায়। তাতে সরকারের ওপর শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের চাপ একসঙ্গে না পড়ে কাজ কিছুটা কমে যায়। এসব উন্নয়নের লক্ষ্যে আগামী বাজেটে একই সঙ্গে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ ও দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্যে আশাবাদী হওয়ার মতো উপাদান থাকা জরুরি।
শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দের পাশাপাশি শিক্ষকদের মান-মর্যাদা ও বেতন-ভাতা বৃদ্ধির বিষয়টি বারবার জোর দেওয়ার কারণ হচ্ছে যে, শিক্ষকদের বাদ দিয়ে প্রত্যাশিত শিক্ষার মান বৃদ্ধি সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে মত-পথ যা-ই থাকুক না কেন, পেশাগত অধিকার ও মর্যাদার প্রশ্নে তাঁদের মধ্যে একটি সহজাত ও স্বতঃস্ফূর্ত ঐক্য চেতনা সব সময় ক্রিয়াশীল থাকে। এ ক্ষেত্রে আদর্শিক অবস্থান নয়, পেশাগত স্বার্থই প্রধান বিবেচ্য হয়ে থাকে। তাঁদের যৌক্তিক প্রত্যাশাগুলো পূরণে মন্ত্রী বা সরকারের আন্তরিকতার মূল্য রয়েছে। তবে সে ক্ষেত্রে আন্তরিকতার পাশাপাশি প্রদানের সক্ষমতা, প্রতিশ্রুতি পূরণের যোগসূত্রই বিশেষ নির্ধারক ভূমিকা পালন করতে পারে।
লেখক ঃ
ড. সুলতান মাহমুদ রানা
সহকারী অধ্যাপক,
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ,
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়,
sultanmahmud.rana@gmail.com