মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় ন্যূনতম পাস নম্বর ৪০ বহাল থাকছে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষেও। এর আগে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী সংকট কাটাতে এমবিবিএস ও বিডিএস কোর্সে ভর্তির জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে পাস নম্বর কমানোর আবেদন করেছে বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমসিএ)। গত বছরের মতো এবারও পাস নম্বর কমানোর দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে অন লাইনে ভর্তি পরীক্ষার আবেদন প্রক্রিয়া এবং জমা দেয়ার শেষ তারিখ ১ সেপ্টেম্বর। অন লাইনে টাকা জমার শেষ তারিখ ২ সেপ্টেম্বর। প্রবেশপত্র বিতরণ করা হবে ১৪ সেপ্টেম্বর। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ মালিকপক্ষের নানা চাপ সত্ত্বেও যথাযথ শিক্ষার মান বজায় রাখতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ৪০ নম্বর বহালের পক্ষে সিদ্ধান্ত দেয় বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (চিকিৎসা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন) অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আবদুল হান্নান জানান, ২০১৫-২০১৬ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস ও বিডিএস ভর্তি পরীক্ষা ১৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। এবারও ন্যূনতম পাস নম্বর ৪০ বহাল থাকছে। আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত দেশের সব পাবলিক ও প্রাইভেট মেডিক্যাল এবং ডেন্টাল কলেজে একযোগে পরীক্ষা হবে। এবার সারাদেশে ২২টি কেন্দ্রে এই পরীক্ষা নেয়া হবে বলে জানান অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আবদুল হান্নান। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, দেশে বর্তমানে ২৯টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস কোর্সে ৩১৬২টি আসন এবং ৬৪টি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে ৫৩২৫টি আসন রয়েছে। এ ছাড়া ন’টি সরকারি ডেন্টাল কলেজ ও মেডিক্যাল কলেজগুলোর ডেন্টাল ইউনিট মিলিয়ে বিডিএস কোর্সে মোট ৫৩২টি ও ২৪টি বেসরকারি ডেন্টাল কলেজে ১২৮০টি আসন রয়েছে।
গত দু’ বছর ধরে ন্যূনতম পাস নম্বর ৪০ থেকে ২০ এ নামিয়ে আনার দাবি জানিয়ে আসছিল বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ এ্যাসোসিয়েশন। নম্বর কমানোর দাবিতে এ্যাসোসিয়েশনের ব্যানারে গত বছর থেকে সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়ে আসছে। এবারও ভর্তি পরীক্ষার আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বরাবর ১০০ নম্বরের ভর্তি পরীক্ষায় ৪০ নম্বর পাওয়ার বাধ্যবাধকতা শিথিলের দাবি করেছিলেন তারা। ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিলেই ডাক্তার হওয়া যায়! শিক্ষার্থীদের এমন সুযোগ করে দিতে তদ্বিরে নেমেছিলেন বেসরকারি মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজগুলোর মালিকরা। ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিলেই শিক্ষার্থীদের এমবিবিএস বা বিডিএসে ভর্তি করানোর সুযোগ চান তারা। এ লক্ষ্যে কয়েকটি বৈঠকও করেছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে। প্রত্যেকবারই স্বাস্থ্যমন্ত্রী কলেজ মালিকদের দাবি এড়িয়ে যান। এর পেছনে মন্ত্রীর যুক্তি ছিল, ভর্তি পরীক্ষার ন্যূনতম মেধাস্কোর কমানো হলে মেডিক্যাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মেধাশূন্য হয়ে পড়বে। আর দেশবাসী পাবে না দক্ষ চিকিৎসক।
অদক্ষ চিকিৎসক দিয়ে চিকিৎসার নামে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা যাবে না। তাই মেডিক্যাল শিক্ষার মান বজায় রাখতেই ভর্তি পরীক্ষায় ন্যূনতম পাস নম্বর ৪০ কমানো হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। সর্বশেষ এ সংক্রান্ত আরেকটি সভাতেও বেসরকারি মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তির ন্যূনতম পাস নম্বর না কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। অর্থাৎ একজন পরীক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় ন্যূনতম ৪০ নম্বর পেলেই ভর্তিযোগ্য শিক্ষার্থী হিসেবে বিবেচিত হবেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজ এবং ইউনিটসমূহে ছাত্রছাত্রী ভর্তিসংক্রান্ত সভায় বেসরকারি মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজ, বিএমএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি ন্যূনতম পাস নম্বর ৪০ রাখার পক্ষে জোরালো অবস্থান নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিল এবং বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত বছর থেকে নতুন আরোপিত শর্ত হিসেবে, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় প্রাপ্ত জিপিএ এবং লিখিত পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর মিলে অর্জিত স্কোর কমপক্ষে ১২০ হতে হবে। অন্যথায় কোনো শিক্ষার্থী এমবিবিএস ও বিডিএস কোর্সে ভর্তির যোগ্য হবেন না। গত ২০১৩ সালে সব মিলে ১১০ স্কোরধারী বেশকিছু শিক্ষার্থী বেসরকারি মেডিক্যালে ভর্তি হয়েছিলেন। এ নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। কেউ কেউ এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার উভয়টিতে জিপিএ-৫ পেয়ে ১০০ স্কোর নিয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়। ভর্তি পরীক্ষায় তারা পেয়েছিলেন মাত্র ১০। বেসরকারি কলেজগুলোতে আসনসংখ্যা খালি পড়ে থাকার সুযোগে তারাও চিকিৎসক হওয়ার সুযোগ পেয়ে গিয়েছেন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এমবিবিএস এবং বিডিএস কোর্সে সর্বোচ্চ মানের শিক্ষার্থীরা ভর্তির সুযোগ পায়। এমনি একটি সাধারণ ধারণা দেশে প্রচলিত আছে।
জানা যায়, প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় মানের সঙ্গে আপোশ করতে হচ্ছিল। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ সুযোগ সংকুচিত করতে চায়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, চিকিৎসাশিক্ষা খাতকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে পর্যায়ক্রমে আরও কিছু পদক্ষেপ আসবে। প্রথম ধাপ হিসেবে সম্মিলিত মেধাস্কোর কমপক্ষে ১২০ নির্ধারণ করা হলো। অর্থাৎ দুটি পাবলিক পরীক্ষার জিপিএ অনুযায়ী যার স্কোর ৮০, তাকে ভর্তি হতে হলে লিখিত পরীক্ষায় ৪০ পেতে হবে। যার উভয়টি জিপিএ-৫, অর্থাৎ ১০০ স্কোর রয়েছে, তাকে কমপক্ষে ২০ পেতে হবে। এভাবে পদ্ধতিটি গতবারের পরীক্ষা থেকে কার্যকর করা হচ্ছে। ২০১৩ সালে কোচিং ব্যবসা ও প্রশ্ন ফাঁস বন্ধে মেধাক্রম অনুযায়ী মেডিক্যালে ভর্তির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এতে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে সঙ্কট দেখা দেয়। ঝামেলা এড়াতে সরকার সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে যায়। গত বছর ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে সরকার নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বরাবর ১০০ নম্বরের ভর্তি পরীক্ষায় ৪০ নম্বর পাওয়ার বাধ্যবাধকতা শিথিলের দাবি করেছে কয়েকটি চিকিৎসক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। তবে ভর্তি পরীক্ষার ন্যূনতম পাস নম্বর কমানোর বিরোধিতা করেছেন অধিকাংশ চিকিৎসক নেতা ও বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, মেডিক্যাল শিক্ষার সঙ্গে মানুষের জীবন-মরণের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। মেডিক্যালের মতো প্রায়োগিক ও স্পর্শকাতর সেক্টরকে পুরোপুরি বাণিজ্যিক সেন্টার হিসেবে গড়ে তোলা ঠিক হবে না। টাকা দিয়ে ডিগ্রি অর্জন করলেই হবে না, রোগীকে যথাযথ চিকিৎসা দেয়ার দক্ষতা থাকতে হবে। মুখস্থ করে, বানিয়ে লেখার সেক্টর মেডিক্যাল শিক্ষা নয়। দক্ষ চিকিৎসক তৈরি না হলে দেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেক্টরে বিপর্যয় নেমে আসবে। ভুল চিকিৎসায় বিপন্ন হবে রোগীদের চিকিৎসা। গত বছরও পরীক্ষার ন্যূনতম পাস নম্বর কমানোর দাবি উঠলে তা প্রত্যাখ্যান করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা ও জনশক্তি উন্নয়ন) অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আবদুল হান্নান জানান, বিপিএমসিএ সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আসন্ন ভর্তি পরীক্ষায় মেডিক্যালে ১২০ ও ডেন্টাল কলেজে ১১০ পাস নম্বর করার অনুরোধ জানিয়ে স্বাস্থ্য মহাপরিচালকের কাছে চিঠি দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত গতবারের মতোই ভর্তি পরীক্ষায় ন্যূনতম পাস নম্বর ৪০ বহাল রাখা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হুশিয়ারি
ভর্তির যোগ্যতা নিয়ে অনেক আগেই নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধীভুক্ত বেসরকারি মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তির জন্য ভর্তি পরীক্ষায় ন্যূনতম ১২০ নম্বর পেতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তিচ্ছুদের সতর্ক করে বলা হয়, এর কম নম্বর নিয়ে ভর্তি হলে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রেজিস্ট্রেশন প্রদান করা হবে না। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজে এমবিবিএস ও বিডিএস কোর্সে ভর্তির জন্য আগ্রহী ছাত্রছাত্রীদের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে গৃহীত ভর্তি পরীক্ষায় ২০০ নম্বরের মধ্যে সর্বনিম্ন ১২০ নম্বর পেতে হবে। এখন পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হয়নি।
নম্বর কমানোর বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন
জাতীয় স্বাস্থ্য আন্দোলনের সভাপতি ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ রশিদ-ই মাহবুব জানান, ন্যূনতম পাস নম্বর কমিয়ে মেডিক্যালে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো সুষ্ঠু লক্ষণ হতে পারে না। একজন ভাল চিকিৎসক হতে হলে মেধাবী হতেই হবে। মানসম্মত মেডিক্যাল শিক্ষার অন্যতম একটি প্রধান শর্ত হলো ‘ন্যূনতম পাস নম্বর’। তবে একটি মেডিক্যাল কলেজের সার্বিক মানই একজন দক্ষ চিকিৎসক গড়ে তোলার পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে। দেশের প্রথম শ্রেণির মেডিক্যাল কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীর অভাব হচ্ছে না। যেসব কলেজের মান কিছুটা পেছনে পড়ে রয়েছে, সেই সব কলেজেই শিক্ষার্থীর অভাব দেখা দিয়েছে। ন্যূনতম পাস নম্বরপ্রাপ্ত অনেক শিক্ষার্থী রয়ে গেছে। কিন্তু তারা উচ্চ ভর্তি ফি দিয়ে ওই সব কলেজে ভর্তি হতে চায় না। আবার সরকারও ওই সব তুলনামূলক কম মানের কলেজগুলোর ওপর শক্তিশালী মনিটরিং বসিয়ে প্রথম শ্রেণির মেডিক্যাল কলেজ বানানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে না। এর সমাধান না হলে মেডিক্যাল কলেজের ভর্তির চলমান সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না বলে মনে করেন ডাঃ রশিদ-ই মাহবুব।
বাংলাদেশ চিকিৎসক সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বিএমএ’র বর্তমান কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য ডাঃ মুস্তাক হোসেন জানান, ভর্তির ন্যূনতম পাস নম্বর ৪০ করার কারণে ভর্তিযোগ্য শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না- বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ এ্যাসোসিয়েশনের এমন অভিযোগ গ্রহণযোগ্য নয়। নম্বর নয়, ভর্তি ও অন্যান্য ফি কমালেই ছাত্রছাত্রীর অভাব হবে না। জীবন বাঁচানোর কারিগর গড়ার জায়গাটাকে পুরোপুরি ব্যবসায়িক করে তোলা হচ্ছে। বেশি টাকার লোভ করতে গিয়েই নিজেদের সাজানো জালে নিজেরাই ধরা খেয়েছে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলো। নির্ধারিত যোগ্যতার ভিত্তিতেই মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজগুলোতে ভর্তির সুযোগ বহাল রাখা দরকার।