‘হয়তবা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবে না ॥ বড় বড় মানুষের ভিড়ে, জ্ঞানী আর গুণীদের আসরে, তোমাদের কথা কেউ কবে না।’ কালজয়ী এই গানের মর্মার্থ খুঁজে পাওয়া যায় ’৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী মুক্তিকামী অগণিত শহীদের কথা স্মরণ করে। স্বাধীনতা অর্জনের পরও এমন অনেক মুক্তিকামী মানুষ রয়ে গেছেন আড়ালে, যারা অনেকটা নীরবে-নিভৃতে দেশের স্বপক্ষে, দেশের উন্নয়নে জোরদার কাজ করে যাচ্ছেন। পরিবার-পরিজন, সুখ-শান্তি ফেলে জীবন উৎসর্গ করেছেন আপামর জনসাধারণের সেবায়। হয়ত সেভাবে পাননি কর্মের সম্মান ও স্বীকৃতি, কিন্তু থেমে থাকেননি। কাজ করে গেছেন অক্লান্তভাবে। তেমনই এক আত্মোৎসর্গকারী, বিদ্যোৎসাহী কালজয়ী পুরুষ ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির ফাউন্ডার ভিসি অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী।
অত্যুজ্জ্বল শিক্ষাগত যোগ্যতার অধিকারী ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী শুধু মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকই নন, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পিছনেও রয়েছে তাঁর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অবদান। শিক্ষার প্রতি তাঁর ভালোবাসা অতুলনীয়, ছাত্রদের প্রতি তাঁর অসীম স্নেহ লিখে বা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। আর তাইতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন ছাত্রদের রক্ষায় বীরোচিত ভূমিকা রাখার জন্য তিনিই ছিলেন তাদের ‘আসল উপাচার্য’। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে কথা বলায়, স্বাধীনতার পক্ষের হাত শক্তিশালী করায় তাঁর উপর একেকসময় নেমে এসেছে ক্ষমতাসীনের খড়গহস্ত। কিন্তু দমে যাননি তিনি, সাহসী মুক্তিযোদ্ধার মতই বুক চিতিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন। বারবার বুলেট মৃত্যুর বার্তা নিয়ে ছুটে এসেছে তাঁর দিকে। ’৬৬ এর ৬ দফা আন্দোলনে মরতে মরতে বেঁচেছেন পূর্ব পাকিস্তানের সুবেদার (গভর্ণর) মোনায়েম খানের পুলিশ এর বুলেট থেকে। ২৫ মার্চ কালোরাতে তাঁকে মনে করে সেনারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপর এক শিক্ষককে হত্যা করে। এরকম বেঁচে গিয়েছেন বারবার স্রষ্টার অপার কারিশমায়।
কিন্তু কালজয়ীকে বুলেটের আঘাতে শেষ করা যায়না, তাঁরা বেচে থাকেন যুগে যুগে। তাঁর ক্ষুরধার লেখনী লিখে যায় এখনো মুক্তিযুদ্ধের জয়গান। ছাত্রদের অত্যাধুনিক বিশ্বের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলাই যার দুচোখ ভরা স্বপ্ন।
আসুন জেনে নিই- বহুমুখী প্রতিভায় ভাস্বর, বর্ণিল গুণাবলির কর্মযোগী অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী সম্পর্কে।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসঃ কেমন চলছে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ?
অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরীঃ মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষার সহায়ক সার্বিক সুবিধাদি নিশ্চিত করার কারণে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ তার অগ্রযাত্রার কাঙ্খিত গতি শুধু ধরে রাখেনি, উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করতে পেরেছে। উত্তরায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ক্যাম্পাস কয়েক মাস আগে মাননীয় স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী উদ্বোধন করেছেন। চতুর্থ মেয়াদে বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টিই একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়, যা তার স্থায়ী ক্যাম্পাসে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হলো। তারপরও কেমন চলছে, তা অংশীজনরা নির্ধারণ করলে খুশি হবো।
বি ক্যাঃ ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির ফাউন্ডার-ভিসি হিসেবে আপনার অনুভূতি জানতে চাই।
ড. মান্নানঃ আমি প্রথমতঃ ফাউন্ডার, তবে ফাউন্ডার হিসাবে ভিসি নই। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের চ্যান্সেলর কর্তৃক নিয়োজিত উপাচার্য। আমি একজন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। জীবনে অনেক স্বপ্ন দেখেছি। উল্লেখযোগ্য স্বপ্ন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবো, পাকিস্তানি জিঞ্জির মুক্তিতে সক্রিয় অংশ নেব; মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবো এবং নিজের মনমত একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবো। বলতে গেলে সব স্বপ্নই বাস্তবায়িত হয়েছে। আমাকে একজন তৃপ্ত মানুষও বলতে পারেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে আরও গুরুত্বপূর্ণ অবদানের প্রত্যাশা এখনও ধারণ করছি।
বি ক্যাঃ অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ প্রতিষ্ঠার পিছনে আপনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা আছে বলে জানা যায়। কোন অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, জানাবেন কী ?
ড. মান্নানঃ ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ব্যতীত আরও তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার ব্যাপারে আমার ভূমিকা ছিল। এমনকি একটি মেডিক্যাল কলেজ ও সাধারণ কলেজসহ বেশ কিছু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছি ঠিকই, ধরে রাখতে পারিনি। বোধহয় মানুষের লোভ ও হীনমন্যতা তজ্জন্য দায়ী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায়ই স্কুল-কলেজে পড়িয়েছি। আমার এসব কর্মের পেছনে বিশেষতঃ স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমার চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। শুনলে হয়তো বিস্মিত হবেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার জন্য প্রথম আইনটির অন্যতম প্রণেতা আমি। কুমিল্লার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠার পেছনে আমি সেই ১৯৬৩ সাল থেকে যুক্ত ছিলাম। তারপর কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন কমিটির ছত্রছায়ায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করি। আমার অনুপ্রেরণার উৎসমুখ হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা, যাকে আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অংশ বলে মনে করি।
বি ক্যাঃ ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন কোন কোন বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করেছেন?
ড. মান্নানঃ ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এর প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এর লক্ষ্য হচ্ছে মানসম্মত ও চাহিদা ভিত্তিক শিক্ষা। উচ্চ শিক্ষার মানের ব্যাপারে আমি কখনও কমপ্রোমাইজ করিনি ও ভবিষ্যতেও করবো না। অবকাঠামো সৃষ্টি, বিশ্বজনীন কোর্স কারিকুলাম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুরূপ শিক্ষাদান, মূল্যায়ন ও জ্ঞানী- গুণী ও লক্ষ্যাভিমুখী শিক্ষক নিয়োগে নিবেদিত ছিলাম ও আছি। মেধাবী অথচ আর্থিক ভাবে অস্বচ্ছলসহ সমাজের পিছিয়ে পড়াদের জন্য আমরা আমাদের দ্বার উম্মুক্ত রেখেছি। আমি এমন কিছু বিষয় পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভূক্ত করেছি যা বাংলাদেশে তো বটেই, এই উপমহাদেশেও অনন্য। এমনকি বাংলাদেশে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ আমি করে দিয়েছি। মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং এর মত অভূতপূর্ব ও অশ্রুতপূর্ব কোর্সও প্রবর্তন করেছি যার চাহিদা বিশ্বব্যাপী। মাস্টার অব বিজনেস এডুকেশন কোর্সটিও অনন্য।
বি ক্যাঃ যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে বলে মনে করেন ?
ড. মান্নানঃ প্রথমেই আমি আমাদের রূপকল্প, মিশন ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য গুলো তুলে ধরছি।
রূপকল্পঃ
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এবং রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও উদ্দেশ্যকে সমুন্নত রেখে শিক্ষার্থীদেরকে এমন ভাবে তৈরি করা, যেন তারা তাদের মেধা ব্যবহার করে অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখতে পারে।
উদ্দেশ্যঃ
এ বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি অনন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে বাস্তবসম্মত শিক্ষাদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে উপযোগী করে গড়ে তোলা।
লক্ষ্যঃ
১। সহনীয় ব্যয়ে মানসম্মত উচ্চ শিক্ষা দান।
২। শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের দ্বারা সিলেবাস ও পাঠ্যক্রম আধুনিকায়নের মাধ্যমে উন্নতমানের শিক্ষা প্রদান।
৩। শিক্ষার্থী, অভিভাবক, কর্মচারীসহ সমাজের সকলের চাহিদার প্রতি দৃষ্টি রাখা।
আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করি, তখন থেকে শুরু করে মাথাপিছু আয় ও মধ্যবিত্তের অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটেছে। দারিদ্র্যসীমার নীচের মানুষের সংখ্যা কমেছে অনেক। আমরা ব্যক্তিক স্বচ্ছলতার পাশাপাশি পরিবার, সমাজ ও দেশের উন্নয়নের কথা ভেবেছি। এ যাবত আমরা প্রায় ১৫ হাজার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কৃতি শিক্ষার্থী সৃষ্টি করেছি। তারা দেশে বিদেশে অর্থপূর্ণ অবদান রেখেছে এবং ব্যক্তি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। অত্যাধুনিক কোর্স কারিকুলাম ও মানসম্পন্ন শিক্ষার কারণে আমাদের প্রায় সব গ্রাজুয়েটই লাভজনক কর্ম পেয়ে যাচ্ছে। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা অনেকেই আমাদের উপর ভর করে সামনে এগিয়ে গেছে। দেশে প্রয়োজনীয় মানবসম্পদ সৃষ্টিতেও আমরা নিষ্ঠাবান।
বি ক্যাঃ ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিকে ঘিরে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাই।
ড. মান্নানঃ আমি তো আমার স্বপ্নের কথা বলেছি। মানুষ জেগে স্বপ্ন দেখলে, চশমা পরে স্বপ্ন দেখলে এবং নিষ্ঠাবান কর্মযজ্ঞে লিপ্ত হলে তার স্বপ্ন ও অর্জন প্রায় সমান হয়ে যায়। আমার ক্ষেত্রে তা ঘটেছে। আমি এখন স্বপ্ন দেখছি, এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ১ম দশটির মধ্যে আমাদের স্থান করে নেয়া। আরও জীবনঘনিষ্ঠ ও কর্মমুখী বিষয়াদি প্রবর্তন করতে হবে। শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এদ্দিন যাবত সার্ভিস মানে সেবাই প্রদান করে গেছে। ভবিষ্যতে তাদের স্বাচ্ছন্দ্য ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিতে নজর দেব। ভাড়া বাড়ি থেকে নিজস্ব স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তর এই উদ্দেশ্য সফল করতে সহায়ক হবে।
বি ক্যাঃ আপনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং সম্মুখ সমরের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের এমন কোনো স্মৃতির কথা বলবেন কী, যা ভেবে এখনো আবেগে ছেয়ে যায় মন?
ড. মান্নানঃ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সম্বলিত আমার অনেকগুলো বই ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। এ সবের মধ্যে অনেক ব্যক্তিগত আবেগ ও উচ্ছ্বাসের কথা যুক্ত আছে। কোনো একটি বিশেষ স্মৃতির বর্ণনা করে অন্যগুলোর গুরুত্ব ম্লান করতে চাইনা। আমি শুধু মুক্তিযোদ্ধা নই, আমি মুক্তি সংগ্রামীও বটে। এই দুই বিষয়ে প্রণীত আমার নিম্নলিখিত বইগুলো পাঠককে অনুগ্রহ করে দেখার অনুরোধ জানাবো
প্রসঙ্গ ঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনী; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে কিছু ঘটনা ও রটনা; নেতা, নেত্রী ও নেতৃত্ব; মুক্তিযুদ্ধের প্রাসঙ্গিক কথা; বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে নিয়ে মিথ্ ও মিথ্যাচার; বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাপ্তাহিক ‘বাংলাদেশ’; মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ঘাতক দালাল প্রসঙ্গ; বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব স্মারক গ্রন্থ; মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিব বাহিনী; আমার মা ও অমরাবতীর কতিপয় সন্তান; দুই দেহ এক প্রাণ; অরাজনীতিকের রাজনীতি; শেখ মুজিব থেকে জাতির পিতা; মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ঘাতক দালাল প্রসঙ্গ ইত্যাদি।
বি ক্যাঃ ৬ দফা, ১১ দফা ও স্বৈরশাসন সময়েও বিভিন্ন আন্দোলনে ছিল আপনার সক্রিয় ভূমিকা। যে কারণে ও লক্ষ্য নিয়ে সেসময় এসব আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, তা ছাত্র-যুবকদের জানাবেন কী ?
ড. মান্নানঃ আমি পড়াশুনার পাশাপাশি ৬ দফা ও ১১ দফা আন্দোলনে যাকে বলে একজন অগ্রবর্তী অপঃরারংঃ ছিলাম। ১৯৬১ সালের শেষ ভাগে কি ১৯৬২ সালের প্রথম ভাগে, আমি বঙ্গবন্ধুর ইবিএলএফ এর সদস্য হয়ে যাই। তাই স্বাধীনতার চেতনাবোধ তখন থেকেই আমার মাঝে অঙ্কুরিত হতে থাকে। সে সময়ের আন্দোলনগুলো ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচালিত হলেও শেখ মুজিবের লক্ষ্য ছিল এক দফা। আমরা আসলে এক দফার পথেই হাঁটছিলাম। কখনো কখনো দৌদুল্যমানতা থাকতো। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন থেকে আমাদের ধ্যান জ্ঞান-সাধনা হয়ে পড়ে স্বাধীনতা, স্বাধীনতা। ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন ৬ দফা দিবসে পিকেটিং করার সময় পুলিশের ডিএসপি আলম আমার মাথা লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছিল। গুলিটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল বলেই পরবর্তী সব ক’টি আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিতে পেরেছি। যতদিন বেঁচে থাকবো বাঙালিত্বের জন্য লড়ে যাবো। কোনো পুরস্কার পেলাম কি পেলাম না, তা বিবেচ্য নয়। এই সব আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে পড়াশুনারও ক্ষতি করেছি। তবে ভালো রেজাল্ট ছিল বলেই পাকিস্তান আমলে শত প্রতিকূলতার মাঝেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারারের পদে অধিষ্ঠিত হলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাবস্থায়ই আমি প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ, শিক্ষকদের স্বপক্ষে স্বাধীনতা প্রস্তাব ও ঘোষণা পাঠ করি, ছাত্রদের প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষকের ভূমিকা পালন করি। ৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে ভারতে চলে যাই এবং দেরাদুনে পুনঃপ্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেই। আমি অতি অল্প বয়সে সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক হয়েছি। সেকালে এসব পদে মূল্যায়নে বৃটেন বা আমেরিকার বহিরাগত প্রফেসরদের মতামত নেয়া হতো। সব বিচারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার প্রয়োজনের অতিরিক্ত যোগ্যতা আমার ছিল। আমার কপালে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এর ভিসি ছাড়া তেমন কিছু জুটেনি। তবুও আক্ষেপ নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধ্যান জ্ঞান ও সাধনাকে উপজীব্য করে আমরা আন্দোলন সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছি। কাজটা একান্তই অমরত্ব প্রাপ্তির প্রত্যাশায় করা হয়েছিল। ছাত্র-যুবকদের তাই অমরাবতীর সন্তান-সন্ততি হতে আহ্বান জানাচ্ছি।
বি ক্যাঃ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি খুব দূরে নয়। স্বাধীনতার এত বছর পর এসে দেশের প্রাপ্তি ও আপনার প্রত্যাশা জানতে চাই।
ড. মান্নানঃ আমি প্রায় বলে থাকি ‘আমি ছিলাম গোলাম, থাকতাম গোলাম, আর আমার শব-যাত্রা হতো গোলাম হিসাবে যদি না বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্ম ও উত্থান ঘটতো।’ তবে স্বাধীনতার পর বিশেষতঃ বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর সুদীর্ঘ সময় আমাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে বিরাট ফারাক ছিলো। এসব নিয়ে আমি লিখেছি, এখন মনে হচ্ছে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ব্যবধান কমে আসছে। আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সূচকগুলো অবলোকন করলে এবং সে সব ক’টি আমাদের প্রতিবেশী ও পাকিস্তানের সাথে তুলনা করলে বলতেই হবে স্বাধীনতা আমাদের শুধু মনস্তাত্ত্বিক প্রশান্তি দেয়নি, বৈষয়িক বা জাগতিক ব্যাপারে অকল্পনীয় অবদান রেখেছে। আমাদের মান মর্যাদা বৃদ্ধি হয়েছে। তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ কাটিয়ে আমরা উন্নয়নের রোল মডেল হয়েছি। আমাদের নব প্রত্যাশার জন্ম প্রতিনিয়ত ঘটছে। বহুদিন আগে বিশেষতঃ এরশাদ বিরোধী আন্দোলন ও ঘাতক যুদ্ধাপরাধীর বিচারের আন্দোলনে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালনের প্রত্যাশার কথা সাহিত্যিক শওকত ওসমানের সামনেই করেছিলাম। আশা করছি সে আশা পূর্ণ হবে; আরও স্বপ্নের জাল বুনতে পারব। তবে সমাজ থেকে দূর্নীতি, জঙ্গি, মাদক, সন্ত্রাসী প্রতিহত না করা গেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সংকটে পড়বে। প্রত্যাশা তাই এসবের নির্মূল।
বি ক্যাঃ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখেছেন একের পর এক অসংখ্য বই। বর্তমান প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর সঠিক ইতিহাস ও মূল্যবোধ সম্পর্কে কতটুকু অবগত বলে মনে করেন ?
ড. মান্নানঃ আগেই বলেছি মুক্তি সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেন্দ্রিক আমার বেশ কিছু বই রয়েছে। এগুলো কেউ পড়েছে কিনা জানিনা। স্বাধীনতার পর ও বঙ্গবন্ধু হত্যা পর ২০ বছরে যে প্রজন্মের আর্বিভাব ঘটেছে তাদেরকে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অন্ধকারে রাখা হয়েছিল। স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে তারা ছিল বিভ্রান্ত। ছোটখাট বিষয় যেমন ইকবাল হলের পরিবর্তে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল নামকরণ নিয়ে তারা ছিল অগভীর জলের মাছ। একদিন এক ছাত্র ইকবাল হলের জায়গায় জহুরুল হক হলের উদ্ভব নিয়ে মজার গল্প শোনায়। সে বলেছিল জহুর শেখ মুজিবের প্রাণ বাঁচিয়েছিল বলে কৃতজ্ঞতার চিহ্নস্বরূপ শেখ মুজিব তার নামে একটি হলের নামকরণ করেছিল।
এখন এই অবস্থা বহু পরিবর্তিত হয়েছে। ঘাতক যুদ্ধপরাধীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সফল পরিণতিতে এবং শেখ হাসিনার ক্ষমতারোহণ ও দীর্ঘসময় অধিষ্ঠানের কারণে বর্তমান প্রজন্ম বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা, মুক্তি সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালি নিয়ে অনেক পরিচ্ছন্ন ধারণা পোষণ করছে।
বি ক্যাঃ বর্তমান তারুণ্যোজ্জ্বল ডিজিটাল সরকারের দেশের উন্নয়নে করণীয় কী হতে পারে এবং এ নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কী ?
ড. মান্নানঃ আমি বঙ্গবন্ধুর বাকশাল ব্যবস্থা ও শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশের মধ্যে একটা সাদৃশ্য দেখি। সত্তর দশকের আবহ ও পারিপাশির্^কতায় ত্বরিৎ উন্নয়নের কৌশল হিসাবে বঙ্গবন্ধু বাকশালকে বেছে নিয়েছিলেন। বর্তমান বাস্তবতায় ডিজিটাল বাংলাদেশ ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে মোক্ষম হাতিয়ার বলে বিবেচিত হতে পারে। শেখ হাসিনা তাঁর বর্তমান মন্ত্রীসভায় করিৎকর্মা ও নিবেদিতদের স্থান করে দিয়েছেন। তারা প্রতিশ্রুতিবান ও শেখ হাসিনার লালিত স্বপ্নে বিভোর। দেশের উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু শিক্ষিত বেকারদের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। কর্মজীবী মানুষের বিশেষতঃ সরকারি খাতে বেতন ও সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে মনে হচ্ছে দুর্নীতি বাড়ছে। দেশে মাদক, জুয়া-ক্যাসিনোর সংখ্যা বেড়েছে, আয় বৈষম্য তীব্রতর হচ্ছে। আমি কামনা করছি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার জিরো টলারেন্স শত প্রতিকূলতার মাঝেও অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাবে, মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত থাকবে। নিবেদিত সমাজকর্মী, রাজনৈতিককর্মী, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবিরা তাদের প্রাপ্য মর্যাদায় আসীন হবেন। এই সময়ে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতির পূর্ণ সুযোগ গ্রহণের লক্ষ্যে শিক্ষা ব্যবস্থাকে মানসম্মত ও বাজার চাহিদার উপযোগী করতে হবে। সমাজে এক শ্রেণির পরগাছা জন্মেছে যারা শুধু টাকার স্বপ্নে বিভোর, ক্ষমতার দম্ভে ধরাকে সরাজ্ঞান করে, মানি-গুণীদের তাচ্ছিল্য করছে, শোষণ করছে, নির্যাতন করছে। তাদের গজানো পাখা ভেঙ্গে দিতে হবে। দলমত নির্বিশেষে শেখ হাসিনা যে জিহাদ সূচনা করেছেন, তার সফল যবনিকাপাত তাঁকে তাঁর মহান পিতার ন্যায় জাতিস্মর করে রাখবে।
বি ক্যাঃ দেশে শিক্ষার মান আশানুরুপ নয় বলে অনেকে মনে করেন। শিক্ষার কারিকুলামও উন্নত বিশে^র উপযোগী নয় বলে মনে করেন অনেকে। এ ব্যাপারে আপনার সুচিন্তিত মতামত জানতে চাই।
ড. মান্নানঃ শিক্ষার মান বাড়েনি তা হলফ করে বলা কঠিন। কিন্তু শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাটা দেখলে তাজ্জব বনে যেতে হয়। মনে হচ্ছে আমরা অন্ততঃ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অপ্রাসঙ্গিক শিক্ষা দিচ্ছি এবং প্রাসঙ্গিক হলেও আমরা মানসম্পন্ন শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছি। শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে শিক্ষাদান পদ্ধতির ও মূল্যায়নে আগাগোড়া সংস্কার প্রয়োজন রয়েছে। শিক্ষার কারিকুলামের দৈন্যতা কাগজে কলামে নিরসন করছি। আজকাল প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স কারিকুলাম ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে আমাদের সিলেবাসে গেঁথে দেয়া সহজ কাজ। কিন্তু সেসবের বাস্তবায়নের জন্য যে অবকাঠামোগত সুবিধা, তার ব্যাপক পরিবর্তন হলেও সত্যিকার শিক্ষিত, নিবেদিত ও স্বতঃপ্রণোদিত শিক্ষকের অভাব দিনে দিনে তীব্রতর হচ্ছে। শিক্ষকের নিয়োগ-পদোন্নতি ও প্রণোদনা এমনভাবে হচ্ছে যে, আমাদের আশেপাশে অঢেল জলরাশি থাকলেও সুপেয় জলের বড্ড অভাব। আমি মনে করছি শিক্ষাঙ্গনে স্বায়ত্ত্বশাসন প্রয়োজন; কিন্তু দায়বদ্ধতা যেভাবে বিসর্জিত হচ্ছে এবং যেভাবে শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি হচ্ছে, তাতে তেমন ভরসা পাচ্ছি না।
বি ক্যাঃ অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখনো স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে পারেনি। এ ব্যাপারে ইউজিসি’র করণীয় কি হতে পারে বলে করেন? আপনার কোন সুপারিশ রয়েছে কী?
ড. মান্নানঃ বলতে পারেন, আমরা আমাদের একনিষ্ঠতার কারণেই স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তর প্রায় দু’বছর আগেই সম্ভব করেছি। ১৯৯২, ১৯৯৮ ও এমনকি ২০১০ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুসারে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তরের সময় এসে গেছে। এ ব্যাপারে নির্ভেজাল ও অখন্ড জমির স্বল্পতা আছে, আছে অর্থায়নের প্রতিবন্ধকতা। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে যাওয়াতে শিক্ষার্থী উপকৃত হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যাচ্ছে বা যাবে। সে কারণে অনেকেই স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে পারছেন না। কিন্তু এগুলোর কারণ হিসাবে (অজুহাত হিসাবে নয়) ধরে নিষ্ঠাবান প্রয়াস অব্যাহত রাখলে ঢাকার বাইরে স্থায়ী ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা অসম্ভব নয়। অর্থায়নের ক্ষেত্রে কিছু আইনগত সংস্কার প্রয়োজন, নতুন কোর্স প্রবর্তনের ব্যাপারে প্রত্যেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরূপ প্রক্রিয়া অনুসরণের সুযোগ দেয়া হোক।
শেষোক্ত কথাগুলো ইউজিসিকে ঘিরেই বলছি। ইউজিসি সরকারি জমি প্রাপ্তির ব্যাপারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে সাহায্য করতে পারে। অর্থায়নের ব্যাপারে শিথিলতা আনতে পারে। ট্রাস্টি বোর্ডের সমান্তরাল বা পাশাপাশি লাভজনকভাবে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালিত হতে পারে। ক্যাম্পাস নির্মানের পরও কতিপয় প্রতিবন্ধকতা রয়ে যায়। তন্মধ্যে শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস পরিবর্তনে জড়তা, শিক্ষকদের তদ্রুপ আচরণ, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, যানবাহনের ঘাটতি, সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদি রয়েছে। এসব উর্ত্তীণের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ও সহায়তা ইউজিসিকে প্রদান করতে হবে। ইউজিসিতে আইন সংস্কার ও বিধি সংশোধন এমনভাবে করতে হবে, যেন সেটা ব্যবহারকারি বান্ধব হয়। শিক্ষার্থীদের ফিসের উচ্চ ও নিম্ন সীমা বেঁধে দেয়া প্রয়োজন। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে যাতে শিক্ষা বাণিজ্য নিরুৎসাহিত হয়।
-আমি আরও মনে করি নীতি-নির্ধারণীর ক্ষেত্রে ইউজিসি, এক্রিডিটেশন কাউন্সিলসহ অন্যত্র বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। ক্যাম্পাস নির্মাণ সামগ্রীর উপর আরোপিত কর ও ভ্যাট রহিত করতে হবে। স্থায়ী আমানত ভূমি ক্রয় ও ক্যাম্পাস নির্মাণে ব্যবহারের সুযোগ থাকতে হবে।
-স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের পূর্ব পর্যন্ত শ্রেণিকক্ষ, পাঠাগার, বিজ্ঞানাগার পরিচালনার জন্য ভাড়াকৃত বাড়ির উপর সকল কর প্রত্যাহার করা উচিত।
-ক্যাম্পাস নির্মাণের ঋণ গ্রহণ ও অর্থায়নের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করতে হবে।
-শিক্ষার্থীদের জন্য পরিবহনের জন্য ক্রয়কৃত যানবাহনের উপর সব ধরনের ভ্যাট ও কর রেয়াত দিতে হবে।
-হোস্টেল নির্মাণে সামগ্রিক সহযোগিতা প্রয়োজন।
-ট্রাস্টি বোর্ড পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আয়কর আওতার বাইরে রাখতে হবে। বিকল্প অর্থায়নে লভ্যাংশ প্রদান ও করারোপ করা যেতে পারে।
বি ক্যাঃ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ শিক্ষিত তরুণরা জড়িয়ে পড়ছে জঙ্গিবাদে। এর কারণ কী এবং প্রতিকার কী হতে পারে বলে মনে করেন?
ড. মান্নানঃ জঙ্গিবাদে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম সমাধিক উচ্চারিত হলেও অন্যত্রও তা পরিব্যাপ্ত হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষার গন্ডী ছাড়িয়ে তা ইংরেজি শিক্ষাঙ্গনেও বিস্তৃত হচ্ছে। অন্যতম কারণ পরিচিতি সংকট ও বঞ্চনা বোধ। বিশে^র বিভিন্ন জায়গায় মুসলমানদের উপর অন্যায় হচ্ছে; যার কারণে ধর্ম ব্যবসায়ীদের সুবিধা হচ্ছে; তারা তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ পাচ্ছে। বর্তমানে সন্তান ও পিতা-মাতার অদৃশ্যমান দুরত্ব দুস্কৃতদের অনুপ্রবেশ সহজ করে দিচ্ছে। তারা বৃহত্তর সমাজ ও ব্যক্তি সত্ত্বার মধ্যে দেয়াল তুলে দিচ্ছে যার কারণে জঙ্গিবাদ শেকড় গেড়ে বসছে। জঙ্গিবাদের আরেক কারণ শিক্ষিত বেকার। ইহলোক ও পরলোকের বিভ্রান্ত ব্যাখ্যা ও ধর্মগ্রন্থের অনাকাঙ্খিত বিশ্লেষণও কারণ হিসাবে দেখা যায়। প্রতিকার হিসাবে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের বিকাশ ঘটাতে হবে, পিতা-মাতা ও সন্তানের দুরত্ব ঘোচাতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষাকে জীবন ধারা উপযোগী করাও বাঞ্চনীয়। বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর শোষণ-নির্যাতন উৎখাত করতে হবে, ধর্মের প্রকৃত ব্যাখ্যা ও প্রচারণার জন্যে আমাদের বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় আদর্শের সমাজ গড়ে তুলতে হবে। মাদকের প্রসার প্রতিহত করতে হবে, বেকারত্ব নির্মূলের প্রয়াস নিতে হবে; আরও সম্পদ বৈষম্য কমানোর উপায় বের করতে হবে।
বি ক্যাঃ প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলোকে ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ে নিয়ে আসার জন্য সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের করণীয় কী ?
ড. মান্নানঃ র্যাংকিং এর বিষয়টি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দেশে-বিদেশে চাকরি প্রাপ্তির ব্যাপারে এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। র্যাংকিং এ উপরে থাকা শিক্ষাঙ্গন অধিক হারে ও অধিক ফিসে শিক্ষার্থী আকর্ষণ করতে পারে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় পর্যাপ্ত অবকাঠামো সুবিধা এবং দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ দিতে পারে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষিতরা বিদেশে উচ্চ-শিক্ষাও সহজে পেয়ে যায়।
র্যাংকিং এ উর্ধ্বস্থান পেতে হলে শিক্ষা ও গবেষণার মান বাড়াতে হবে। একই সময়ে অবকাঠামোগত সুবিধা, ছাত্র-শিক্ষক অনুকূল অনুপাত, সৃষ্ট জ্ঞানের ব্যবহার ইত্যাদি বিষয় র্যাংকিং এ ধর্তব্য। র্যাংকিং করে থাকে বিশ্বের খ্যাতনামা সংগঠন বা সংগঠনসমূহ। তাদের সাথে সংশ্লিষ্টতার জন্য অনেকের আর্থিক সঙ্গতি নেই, অনেকে র্যাংকে ওঠার তথ্যই পরিবেশন করে না। আমাদের দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান বিতরণে ব্যস্ত। জ্ঞান সৃষ্টি তাদের গৌণ লক্ষ্য, আবার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য শিক্ষকের প্রচন্ড অভাব রয়েছে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক বিবেচনা ও পদোন্নতিতে শিথিল মানদন্ড দক্ষ ও নিবেদিত শিক্ষক সৃষ্টির প্রতিবন্ধক। শিক্ষা প্রশাসন নিয়ে রয়েছে বহু কথা। তাই শিক্ষা প্রশাসনে আমূল সংস্কার আবশ্যক। শিক্ষকের পাশাপাশি দক্ষ ও নিবেদিত প্রশাসন গড়ে না তুললে মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠবে না।
শিক্ষকের বদলে যদি ভোটার নিয়োগ দেয়া হয়, দিন গুণে যদি প্রমোশন দেয়া হয়, প্রকাশনার মূল্যায়নে যদি উন্নত মানের জার্নাল বা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব দেয়া না হয়, তাহলে প্রফেসর হবার রেইসটা শেষ হলে পর রাজনীতি ছাড়া একজন শিক্ষকের কি করণীয় থাকে? মোট কথা র্যাংকিং এ উঠতে আমাদের যা যা করণীয়, সেসবের অনুপস্থিতি আমাদেরকে ক্রমশঃ বহু দূরে ঠেলে দিচ্ছে। গবেষণার অনুপস্থিতিতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সত্যেন সেনের মতো মানুষ জন্ম দিয়েছে। আমরা বিস্মিত হই বর্তমানে সত্যেন সেনের যুগ অপেক্ষা বহু সুযোগ-সুবিধা থাকতেও আমরা আগাতে পারছিনা। শিক্ষাঙ্গনে অপরাজনীতিকে সযতেœ শিক্ষক ও শিক্ষার্থী পর্যায়ে বর্জন করতে হবে।
বি ক্যাঃ ছাত্র-যুবকদের উদ্দেশ্যে আপনার মূল্যবান পরামর্শ জানতে চাচ্ছি।
ড. মান্নানঃ ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম বলতেন স্বপ্ন দেখো। আমি বলছি স্বপ্ন দেখবে, তবে জেগে ও চশমা পড়ে স্বপ্ন দেখবে, স্বপ্ন পূরণ উপযোগী কার্যাবলী নিষ্ঠার সাথে পালন করবে। তোমার স্বপ্নটা অন্যের সাথে ভাগাভাগি করবে, তাহলে অন্যরা তোমাকে সামনে এগিয়ে দিতে যতœবান হবে। দেশটাকে ভালোবাসবে। মাদক ও জঙ্গিবাদ থেকে দূরে থাকবে। পিতা-মাতা ও অভিভাবকদের সাথে সহজ সম্পর্ক বজায় রাখবে। যেকোনো ধরনের হতাশা এড়াতে খেলাধূলা, সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কাজের পাশাপাশি নব আবিষ্কারের দিকে নজর দেবে যা গরীব ও দুস্থ মানুষের অধিক উপকারে আসবে।
বি ক্যাঃ জ্ঞানভিত্তিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ এবং আলোকিত জাতি গঠনে নিবেদিত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকা ৩ যুগপূর্তি উৎসব পালন করছে। ক্যাম্পাস পত্রিকা ও ক্যাম্পাস সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্রের অগ্রযাত্রায় আপনার পরামর্শ জানাবেন কী ?
ড. মান্নানঃ ক্যাম্পাস পত্রিকা ৩ যুগপূর্তি উৎসব পালন করছে এটি অত্যন্ত আনন্দের কথা। শিক্ষা ও যুব উন্নয়নের ব্যতিক্রমী পত্রিকা হিসেবে নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে ৩ যুগ পর্যন্ত পৌঁছতে পারা অবশ্যই বিশাল ব্যাপার যা অনেক বড় মূল্যায়নের দাবি রাখে। ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক ড. এম হেলালকে আমরা শুরু থেকে দেখছি কীভাবে তার একনিষ্ঠতা, একাগ্রতা ও নিবেদিত সত্ত্বার মাধ্যমে এরূপ অসম্ভবকে তিনি সম্ভব করেছেন।
ক্যাম্পাস’র স্টাফ ও শুভার্থী সকলে মিলে এক বিশাল পরিবার। এই পরিবারের সাহচর্যেই সব বাধা পেরিয়ে ক্যাম্পাস সুদূর অগ্রযাত্রার সারথী হয়েছে, প্রসারিত হয়েছে এর বহুমুখী কর্মপ্রয়াস। দেশ ও জাতির উন্নয়নে সেবামূলক কার্যক্রমকে ড. হেলাল ও তার ক্যাম্পাস পরিবার ব্রত হিসেবে নিয়েছে। তারা সামনে দেখছে এবং অফুরন্ত সম্ভাবনাময় বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে সহায়তা দিচ্ছে। আজকে ক্যাম্পাস এতটা উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে সৈকতে সৈকতে উঠি উঠি করছে।
ক্যাম্পাস’র এ মহান লক্ষ্য পূরণে তাদের অধিকতর সমৃদ্ধ অবকাঠামোগত সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে; পাশাপাশি সমাজের বিজ্ঞজনদেরও ক্যাম্পাস’র সাথে অধিক পরিমাণে সম্পৃক্ত হতে হবে। এভাবেই সকলে মিলে সুস্থ, সুন্দর ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন সম্ভব।