কর্মজীবনের শুরুটা করেছিলেন একজন শিক্ষকরূপে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে। বিত্ত-ভৈববের পথে পা না বাড়িয়ে, পা বাড়িয়েছিলেন সৃজনশীল সৃষ্টির পথে, কল্যাণের পথে। শহুরে কোলাহলের মোহময় জৌলুসে দিকভ্রান্ত না হয়ে একখন্ড প্রকৃতির বুকে নীড় গড়ে নিরবে-নীভৃতে চালিয়ে গেছেন নিজ জ্ঞানসাধনা, অধ্যয়ন-গবেষণা ও শিক্ষাদান কার্যক্রম। মনে গভীর দেশপ্রেম লালন করে নিজ স্বপ্ন ও সাধনায় যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সামগ্রিক মুক্তির ছঁক তৈরি করে গেছেন সঙ্গোপনে; অপেক্ষা শুধু একটা সুযোগের।
অন্যদিকে একটি সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠন তথা দেশের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের পাশাপাশি একটি বৈষম্যহীন, সমতাভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরির মাধ্যমে সোনার বাংলা গড়ে তোলার অদম্য প্রয়াসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সৃষ্টি করেন বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম কালো অধ্যায়ের স্বীকার হয়ে বঙ্গবন্ধুর সে স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। ২০০৯ সালে জনগণের বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসেন জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসে প্রথমেই হাত দেন বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্ন পূরণে। শুরু হয় বাংলাদেশের পরিকল্পনা খাতের কাঠামোগত রূপান্তর। এ রূপান্তর প্রক্রিয়ায় কিছু দেশপ্রেমী, দূরদর্শী, দক্ষ এবং যোগ্য ব্যক্তিকে সম্পৃক্ত করতে উদ্যোগী হন প্রধানমন্ত্রী। নতুন অধ্যায়, নতুন ইতিহাস ও নতুন এক বাংলাদেশ গঠনে দলভ‚ক্ত হতে ডাক পান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুল আলম। মানুষ গড়ার কারিগর থেকে সরাসরি দেশ গড়ার কারিগরের ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হয়ে পঁয়ত্রিশ বছরের অধ্যাপনার অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০০৯ সালের ১ জুলাই প্রেষণে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগদান করেন উদ্যমী ও পরিশ্রমী নীতিনিষ্ঠ প্রফেসর ড. শামসুল আলম। অত্যন্ত বিনয়ী মৃদুভাষী, আদর্শিক দৃঢ়তা-বিচক্ষণতা ও সততার মূর্ত প্রতীক হিসেবে পরিচিত প্রফেসর শামসুল আলম এখানেই থেমে থাকেননি। তাঁর বহুমাত্রিক প্রতিভা, অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা, ও অদম্য কর্মস্পৃহার সফল সন্নিবেশ ঘটিয়ে জাতির আর্থসামাজিক রূপান্তরে অভাবনীয় অবদান রেখে তিনি আজ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের গর্বিত প্রতিমন্ত্রী।
একমাত্র ত্যাগের মাধ্যমেই মানবজীবনকে সার্থক করা সম্ভব। মানুষ যদি অন্যের কল্যাণে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে উজাড় করে দেয়, তাতেই তার চরিত্রে মহত্তে¡র প্রকাশ ঘটে। আর এমনই একজন সজ্জন ত্যাগী ব্যক্তি হলেন প্রফেসর ড. শামসুল আলম। তিনি সুদীর্ঘ সময় তাঁর প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে জ্ঞানের আলো বিতরণের পাশাপাশি কৃষি অর্থনীতিতে এক নয়া দিগন্তের সূচনা করেছেন; পরিকল্পনার সফলতাকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।
প্রফেসর ড. শামসুল আলম একজন পরিচ্ছন্ন বর্ণিল গুণাবলীর অধিকারী সজ্জন ব্যক্তি। একাধারে তিনি একজন শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, লেখক ও গবেষক এবং সে সঙ্গে একজন অত্যন্ত সফল পরিকল্পনাবিদ ও প্রশাসক। কর্মজীবনে তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ ৩৫ বছর (১৯৭৪-২০০৯) অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে অধ্যাপনা করেছেন। কর্মরত অবস্থায় ১৯৮৩ সালে ড. আলম সফলতার সঙ্গে ব্যাংককের থাম্মাসাট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ও ১৯৯১ সালে ইংল্যান্ডের নিউ ক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। অধ্যাপনা জীবনে তিনি জার্মানির হুমবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয়, বেলজিয়ামের ঘেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় এবং নেদারল্যান্ডসের ভাগিনিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে ইকোনমিকস স্কুলে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি হিসেবে কৃষি অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষকতায় যুক্ত ছিলেন। এছাড়া ২০০২ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘসময় জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচিতে বাংলাদেশি কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করেন। তাছাড়া ইউএনডিপি, বাংলাদেশে সিনিয়র স্কেলে পূর্ণকালীন জাতীয় কনসালট্যান্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন চৌদ্দমাস।
পঁয়ত্রিশ বছরের অধ্যাপনার অভিজ্ঞতা নিয়ে ড. শামসুল আলম ২০০৯ সালের ১ জুলাই প্রেষণে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর কৃতিত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ মহামান্য রাষ্ট্রপতির ১০% কোটায় ২০১৪ সালের ফেব্রæয়ারি মাস থেকে ক্যাডার সার্ভিসের বাইরে থেকে তাঁকে সিনিয়র সচিব পদে নিয়োগ প্রদান করা হয়। তাঁর প্রতিভার সদ্ব্যবহার করার জন্য ২০১৮ সালে ১ জুলাই সরকার পঞ্চমবারের মতো পুনরায় তাঁকে তিন বছরের জন্য নিয়োগ প্রদান করে। ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল এ দীর্ঘ সময় (বার বছর) কর্মরত অবস্থায় বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনকে তিনি একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে যান। রূপকল্প ২০২১ এর আলোকে প্রণীত বাংলাদেশের প্রথম দীর্ঘমেয়াদি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০১০-২০২১), যষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১১-২০১৫), সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১৬-২০২০) প্রণীত ও বাস্তবায়িত হয় ড. আলমের হাত ধরে। স¤প্রতি অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাও (২০২০-২০২৫) তাঁর নেতৃত্বেই প্রণীত হয় এবং জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (একনেক) কর্তৃক অনুমোদিত হয়। তিনি একজন বিরল পরিকল্পনাবিদ, যাঁর নেতৃত্বে পরপর তিনটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণীত হয়ছে। তিনি ‘বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন কৌশলপত্র’ (২০১১-২০২১) ও ‘সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র’ (২০১৫-২০২৫) নীতিমালা প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাছাড়া বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি শতবর্ষী বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ তাঁর নেতৃত্বে সাড়ে চার বছরের কঠোর পরিশ্রমে প্রণীত হয়েছে (২০১৮), যা বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনে দীর্ঘ সময় রুটিন কাজের বাইরেও তাঁর তত্ত¡াবধানে ও সম্পাদনায় শতাধিক মূল্যায়ন প্রতিবেদন (মোট ১২৫টি) এবং বিশেষভাবে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জনবিষয়ক ২৫টি গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এছাড়া তিনি অর্থনীতিবিষয়ক ১৪টি গ্রন্থ রচনা করেন, যার মধ্যে গবেষণা ও পাঠ্যপুস্তক অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এছাড়া তিনি ৩৮টি গ্রন্থ সম্পাদনা করেন ও ৫১টি গবেষণা নিবন্ধ বিভিন্ন বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশ করেন।
কৃষি অর্থনীতিতে অবদানের জন্য ২০২০ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোাচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘একুশে পদক’ প্রদান করে। ড. শামসুল আলম ২০১৮ সালে South Asian Network for Economic Modeling কর্তৃক বাংলাদেশে Economist of Influence Award অর্জন করেন। কৃষি অর্থনীতি বিষয়ে দক্ষতা ও অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত ১৬তম দ্বিবার্ষিক সম্মেলন স্বর্ণপদক, সরকার অনুমোদিত বাংলাদেশ শিক্ষা পর্যবেক্ষণ সোসাইটি ‘বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিপদক ২০১৮’ এবং শিক্ষকতা ও গবেষণায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই আ্যাসোসিয়েশন একই বছর তাঁকে সম্মাননা অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে। এছাড়া শিক্ষকতায় সাফল্য ও বিশেষ অবদানের জন্য বিশ্ব শিক্ষক দিবস জাতীয় উদযাপন কমিটি (২০১৮) ড. আলমকে ‘বিশেষ সম্মাননা স্মারক জিনিয়াস অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করেন। তিনি রিসোর্চ ডেভেলাপমেন্ট ফাউন্ডেশেন কর্তৃক অর্থ গ্রান্টসহ সম্মাননা এওয়ার্ড লাভ করেন ২০২০ সনে।
তিনি পরিকল্পনা কমিশনে জাতীয় পরিকল্পনা, গবেষণা ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত থাকা সত্তে¡ও তাঁর জীবনের মূল পেশা শিক্ষার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ড. আলম বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট (তৃতীয় মেয়াদে), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট (দ্বিতীয় মেয়াদে), সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট (চতুর্থ মেয়াদে), শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট (তৃতীয় মেয়াদে) এবং পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় রিজেন্টস বোর্ড (চতুর্থ মেয়াদে) দায়িত্ব পালনকালে বিশ্বিদ্যালয়ের শিক্ষা, গবেষণা ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের গভর্নিং বোর্ডের সদস্য হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ড. আলম অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত মাল্টি-ডাইমেনশনাল পোভার্টি-পিয়ার নেটওয়ার্ক (MPPN-OPHI) এর বাংলাদেশ হতে স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
একজন কর্মসফল ব্যক্তি প্রফেসর ড. আলমের জন্ম চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর উপজেলার এক সম্ভ্রান্ত শিক্ষানুরাগী মুসলিম পরিবারে ১৯৫১ সনের ১ জানুয়ারি। ড. আলমের প্রপিতামহের পিতা সিরাজুদ্দীন মিয়াজী উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে লুধুয়া পরগনায় জমিদারি প্রতিষ্ঠা করে লুধুয়া গ্রামে বসতি গড়ে ‘জমিদার বাড়ি’ প্রতিষ্ঠা করেন, যার আকর্ষণীয় ধ্বংসন্মোখ স্থাপনা এখনো দৃশ্যমান। ড. আলমের প্রপিতামহ সলিমউদ্দীন মিয়াজীসহ প্রপিতামহগণ একত্রে ১৯১৭ সনে স্বগ্রামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সাড়ে তিন একর জমি দান করেন, যেখানে আজকের লুধুয়া হাই স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠিত আছে। ড. শামসুল আলমের প্রপিতামহ সলিমউদ্দীন মিয়াজী মতলব দক্ষিণে প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত মতলব জে.বি. হাই স্কুলেও ৮৫ শতাংশ জমি দিয়েছেন স্কুলটি প্রতিষ্ঠায়।
সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও সরকারি দায়িত্ব পালনে ড. আলম বিশ্বের ৫০টি দেশ ভ্রমণ করেছেন। ড. শামসুল আলম সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় ২০১০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত দশ বার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি সফরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় যোগদান করেছেন। ৭-১১ মে ২০১১ ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সম্মেলনে এবং মে ২০১৬ এ জাপান সফরে ড. আলম মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী ছিলেন। ৩০ জুন ২০২১ এ সাধারণ অর্থনীতি বিভাগে সদস্য পদে পঞ্চমবারের মতো মেয়াদ শেষ হলে ১৮ জুলাই ২০২১ ড. আলম পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ড. আলমের পারিবারিক জীবনে স্ত্রী, দুই পুত্র সন্তান ও দুই নাতনী রয়েছে। তিনি অদ্যবধি জাতির আর্থসামাজিক রূপান্তরে অভাবনীয় অবদান রেখে চলেছেন।
ড. আলম একজন অত্যন্ত উদ্যমী ও পরিশ্রমী নীতিনিষ্ঠ মানুষ। দেশ ও নিজ কাজের প্রতি কতটা ভালোবাসা এবং মমত্ববোধ থাকলে একজন মানুষ এই করোনাকালীন দুঃসময়ে নিঃস্বার্থ ও বিরামহীনভাবে কাজ করা যায়, তা তাঁকে না দেখলে বুঝা যায়না। একজন প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ক্ষণজন্মা এই মানুষটি ভালোবাসেন মানুষের সঙ্গে মিশতে, বিশেষ করে তরুণদের সঙ্গে। তাঁদের মাধ্যমে জাগিয়ে রাখতে চান নিজের স্বপ্নের কথা। তিনি বিশ্বাস করেন, ‘স্বপ্ন ও স্বপ্নবাজরা সবসময় সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে’। কারণ, স্বপ্ন না দেখলে তো তা বাস্তবে সত্যি করা যাবে না। তাঁর মতে, ‘স্বপ্ন দেখতে হবে’। কারণ, স্বপ্নটা চিন্তায় পরিণত হয়। আর চিন্তা মানুষকে কর্মে অনুপ্রাণিত করে। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য ব্যক্তি হিসেবে ড. শামসুল আলমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সরকারের পাশাপাশি একজন মানুষ কীভাবে আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারে তা তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। নিবেদিতপ্রাণ এই মানুষটি আর্থসামাজিক কাজের স্বীকৃতি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অনেক জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
সততার মূর্ত প্রতীক এই ব্যক্তিটি ক্ষমতার খুব কাছাকাছি থেকেও কখনো ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি। দম্ভ কখনো তাঁকে সামান্যতম আচ্ছন্ন করেননি। এমনকি কর্মজীবনের দীর্ঘ এ পথচলায় দুর্নীতির বিন্দুমাত্র আঁচড় লাগেনি তাঁর গায়ে। এত সমৃদ্ধময় জীবনগল্প তবুও তাতে আত্মঅহমিকার লেশমাত্র নেই। বিনয়ী মৃদুভাষী, সততা, আদর্শিক দৃঢ়তা আর বিচক্ষণতার মধ্য দিয়েই তিনি সকলের সততার মূর্ত প্রতীক হিসেবে পরিচিত। তিনি প্রকৃত অর্থেই নবীনদের কাছে রোল মডেল।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থায় প্রায় সাড়ে তিন বছর এবং ইউএনডিপি বাংলাদেশে ১৪ মাস সিনিয়র স্কেলে পূর্ণকালীন জাতীয় কনসালট্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন ড. শামসুল আলমের বর্ণাঢ্য একাডেমিক ক্যারিয়ারে যোগ করে নতুন মাত্রা। অভিজ্ঞ ড. শামসুল আলম তাই সরকারের কাছে পরিণত হন এমন এক অপরিহার্য ব্যক্তিত্বে, যাকে জাতীয় দুইটি রূপকল্প প্রণয়নের দায়িত্ব প্রদানে সরকার কুণ্ঠাবোধ করেনি। বাংলাদেশের পরিকল্পনা জগতে শুরু হয় ড. শামসুল আলমের নতুন এক অধ্যায়। ড. আলমের সাংগঠনিক নেতৃত্বের কথা বলতে হলে প্রথমেই বলতে হয় তিনি পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগকে (জিইডি) একেবারে শূন্য থেকে সরকারের শীর্ষস্থানীয় নীতি/পরিকল্পনা তৈরির কেন্দ্রে পরিণত করেছেন। জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়নে সরকারের আস্থার প্রতীক হিসেবে জিইডিকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একটি ব্র্যান্ড হিসেবে। এসব তিনি করেছেন একটি শক্তিশালী কর্মী বাহিনী গড়ে তালার মাধ্যমে। দায়িত্ব গ্রহণের সাথে সাথে তিনি বিভিন্ন মন্ত্রণলয়/বিভাগ থেকে পরিকল্পনার সাথে প্রাসঙ্গিক ও একাডেমিকভাবে দক্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে এসেছেন জিইডিতে। একজন শিল্পী যেমন তার সৃষ্টিকে সুনিপুণ করার জন্য বারবার ঘষামাজা করেন, প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলমও তেমনি তাঁর নিজস্ব পদ্ধতি প্রয়োগে জিইডির কর্মীদের সর্বোচ্চটা বের করে নিয়ে আসেন।
ডায়নামিক ও দেশপ্রেমী এ পরিকল্পনাবিদের সাথে ‘প্রিয় মানুষের মুখোমুখি’ কলামে উপস্থাপনের নিমিত্তে সাক্ষাৎকারে মিলিত হন ক্যাম্পাস পত্রিকার প্রতিনিধিদল। সেই সাক্ষাৎকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসঃ বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালনে আপনার অনুভ‚তি জানাবেন কি?
ড. শামসুল আলমঃ ধন্যবাদ আপনাকে। গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আগেও পালন করেছি। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ছাড়াও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছি। ৩৫ বছর অধ্যাপনা শেষে পরিকল্পনা কমিশনে সদস্য হিসেবে যোগদান করি জুলাই ২০০৯ সনে। শিক্ষকতা পেশার বাইরে এটি অবশ্যই ভিন্ন এক জগত, প্রায়োগিক জগৎ। এখানে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা প্রয়োগের একটি সুষ্ঠ ও সুন্দর অবস্থান আমি পেয়েছি। সেজন্য আমি অবশ্যই আমাদের দুরদর্শী নেত্রী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাই এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি এবং আজীবন করবো। কারণ তিনি আমাকে সুযোগ দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা ছেড়ে এই প্রায়োগিক জগতে যোগদান করার।
আমার যাত্রা শুরু হয়েছে রূপকল্প ২০১০-২০২১ প্রেক্ষিত পরিকল্পনা তৈরি করার মধ্য দিয়ে। সেই প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় আমরা স্বপ্ন দেখেছি যে, বাংলাদেশ যখন তার ৫০ তম জন্মজয়ন্তী পালন করবে, তখন বাংলাদেশ কোথায় থাকবে বা কোথায় থাকতে পারে। আমরা সেই প্রক্ষেপণগুলো নির্ধারণ করেছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এবং প্রধানমন্ত্রীর চিন্তা-চেতনাকে ধারণ করে।
প্রথম প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় আমরা ২০১০ সালেই লিখেছিলাম যে, রূপকল্প ২০২০-২০২১ এ বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হবে। ইতোমধ্যে সেটি হয়েছে, যা আপনারা অবগত আছেন। আমরা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছি। ২০২৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সেটা ঘোষণা করা হবে। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রথম বাংলাদেশের রূপকল্প দলিল, প্রথম প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০১০-২০২১ প্রণয়নের সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আমরা যে অভীষ্ঠ লক্ষ্যগুলো নির্ধারণ করেছিলাম সেগুলো সফলভাবে অর্জন করেছি। আমি কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি, যেমন আমরা লিখেছিলাম ২০১৫ এর মধ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে উন্নীত হবে। ইতিপূর্বে আমাদের জিডিপি ৫-৬ শতাংশ অর্জিত হয়েছিল। সেটাকে ভিত্তি ধরেই আমরা ২০১৫ এর মধ্যে সেটিকে পেরিয়ে ৭ শতাংশে উন্নীত হওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম। ২০১৫ সালের মধ্যেই আমরা সেটি করতে পেরেছি। দেশ খাদ্যে তথা চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে সেটাও আমরা বলেছিলাম। ২০১৩-২০১৪ সালে চালে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করি। আমরা বলেছিলাম ২০২১ এর মধ্যে আমাদের মাথাপিছু আয় হবে ২০০০ ডলার। ২০২১ এর মধ্যে আমাদের মাথাপিছু আয় হয়েছে ২৫৯১ ডলার। আমরা মাতৃমৃত্যু হার কমিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলাম, দারিদ্র্য কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলাম, শিশু মৃত্যু হার কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলাম। আমরা বলেছিলাম, প্রাইমারী এবং সেকেন্ডারী স্কুলে জেন্ডার সমতা নিশ্চিত হবে। এগুলো সবই কিন্তু আমাদের প্রেক্ষিত পরিকল্পনাকালে অর্জিত হয়েছে। রূপকল্প ২০২১-এ আমরা যে প্রক্ষেপণগুলো নির্ধারণ করেছিলাম সেগুলো অর্জিত হয়েছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশিও হয়েছে। যেমন বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমরা বলেছিলাম- ২০ হাজার মেগাওয়াটের কথা, সেখানে অর্জিত হয়েছে ২৫ হাজার মেগাওয়াট।
প্রথম প্রেক্ষিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আমরা দু’টি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করি এবং সেগুলো প্রণয়নে নেতৃত্ব দেই আমি। একটি হলো ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এবং অপরটি সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ছিল ২০১১-২০১৫ সাল পর্যন্ত এবং সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ছিল ২০১৬-২০২০ সাল পর্যন্ত। এই দু’টি পরিকল্পনা সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। কারণ এই দু’টি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছিল দেশের যে রূপকল্প দলিল-২০২১, সেটিকে সামনে রেখে। আমাদের এগুলো প্রণয়নে ঋণদানকারী সংস্থার কোনো পরামর্শ বা সুপারিশ ছিলনা। যেমনটি অতীতে ছিল আশির দশকে কাঠামোগত সমন্বয়, নব্বইয়ের দশকে ওয়াশিংটন কনসেনসাসের মতো দাতাগোষ্ঠির উন্নয়ন প্রেসক্রিপশন, ২০০২- ২০০৯/২০১০ পর্যন্ত পিআরএসপি। কিন্তু এবারে এজাতীয় কোনো আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা কর্তৃক প্রণীত কোনো দলিল আমাদের সামনে ছিলনা। আমরা দেশজ চিন্তা-চেতনাকে পুঁজি করে ২০২১ এর স্বপ্ন দেখেছিলাম বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ করবো, উন্নয়নশীল দেশ করবো, মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা এক নাম্বার দেশ হবো; এগুলো আমরা অর্জন করেছি। এরই ধারাবাহিকতায় অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার নেতৃত্বও আমি দিয়েছি, সেটি হলো ২০২১-২০২৫ পর্যন্ত।
এখানে উল্লেখ্য যে, অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আগেই দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা রূপকল্প ২০২১-২০৪১ আমরা তৈরি করেছি। সেখানেও আমরা ২০৪১ সালে কী কী অর্জন করতে চাই সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা চিহ্নিত করেছি। আমরা লক্ষ্য স্থির করেছি ২০৪১ সালে বাংলাদেশ সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশ হবে, উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ হবে। ২০৪১ এ দারিদ্র্য শূণ্যে নেমে আসবে, শিক্ষার হার হবে শতভাগ। আমাদের মাথাপিছু আয় হবে ১৬৪০০ মার্কিন ডলার। এরকম সুনির্দিষ্ট বেশ কিছু লক্ষ্যমাত্র নিয়ে আমরা আমাদের পথযাত্রা শুরু করেছি।
দ্বিতীয় এ রূপকল্পে ডিজিটালাইজেশনের উপর আমরা বিশেষ জোর দিয়েছি। আমাদের দেশ হবে প্রযুক্তি নির্ভর। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে ধারণ করে যে অবকাঠামো তৈরি করা উচিৎ, আইসিটি খাতে যে ধরণের উন্নয়ন ঘটানো দরকার, সেগুলো সুন্দরভাবে আমরা রূপকল্পে চিহ্নিত করেছি। এই পরিকল্পনাগুলো উল্লেখ করে আমি বলতে চাই, আমার যে অনুভ‚তি জানতে চাওয়া হয়েছে, আমি বলবো তা অভ‚তপূর্ব। জাতীয় ফ্ল্যাগশীপ এতগুলো কাজের সাথে জড়িত থাকতে পারবো এটা আমি পূর্বে ভাবিনি। যখন যাত্রা শুরু করেছি, ক্রমান্বয়ে একের পর এক জাতীয় পরিকল্পনাগুলো প্রণয়ন করছি, এসব ক্ষেত্রে বলবো আমি সফল হয়েছি। আমি বিনয়ের সাথে উল্লেখ করতে চাই, এ পরিকল্পনাগুলো নিয়ে কোনো বিতর্ক হয়নি। তাই বলা যায়, আমার অনুভ‚তি খুবই আনন্দদায়ক। এক্ষেত্রে আমার সফলতা সরকারও স্বীকার করেছেন, দেশবাসীও স্বীকার করেছেন। সে কারণে আমি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরকি পুরস্কার একুশে পদক-২০২০ পেয়েছি। আমার এ অনুভ‚তি বলে শেষ করবার নয়। দায়িত্ব পালনে দেশকে সরাসরি সেবা দিতে পারছি, নিষ্ঠার সাথে দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার দলিল তৈরি করতে পেরেছি এবং তা বাস্তবায়িত হচ্ছে খুব সফলভাবে; এটি আমার মহাআনন্দের। আমার জীবনে আর এর থেকে বেশী পাওয়ার কিছু নেই, এর থেকে মহাআনন্দের কিছু নেই; এখন শুধু দেশকে দেয়ার পালা।
বি ক্যাঃ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে আজ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রি; এ সাফল্যের পেছনের গল্প পাঠকের উদ্দেশ্যে যদি জানাতেন?
ড. আলমঃ নিজ কর্মক্ষেত্রে নিষ্ঠার সঙ্গে, দক্ষতার সঙ্গে, দেশপ্রেমের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেই একটা ভিত্তি তৈরি করতে হয়। শিক্ষক হিসেবে আমি বলব, আমি একজন সফল শিক্ষক ছিলাম এবং নিষ্ঠার সাথে, আদর্শ, দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার চেতনাকে বুকে ধারণ করে আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি সারাজীবন; প্রথম দিন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিন পর্যন্ত। একথার প্রমাণও রয়েছে; যারা আমার উপর বিভিন্ন লিখা লিখেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন, মূল্যায়ন করেছেন, তাঁদের সে লিখাতেই এর প্রতিফলন রয়েছে। সে কাজেরই স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছি পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হওয়ার আমন্ত্রণ। সুতরাং আমি বলতে চাই, আমার সাফল্যের পেছনে মূল বিষয়টি হলো একাগ্রতা, সকল কিছুর ঊর্ধ্বে দেশকে রাখা, নিজকে খন্ডিতভাবে না দেখা, অঞ্চলভিত্তিতে বা ভাষার ভিত্তিতে বা ধর্মের ভিত্তিতে খন্ডিতভাবে না দেখে দেশটাকে সামনে রাখা, দেশটাকেই একক সত্তা ভাবা। এগুলোর মাঝে আমি কখনও কোনো বিভাজন টানিনি। সর্বদা দেশকে সামনে রেখেছি। কে কোন ধর্মের তা কখনও ভাবিনি, কে কোন ভাষার তা ভাবিনি। আমি বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কালচারকে এবং জনগণকে সামনে রেখে আমার সকল দায়িত্ব পালন করে গেছি। সফলতার গল্পের মূল ভিত্তিটাই হচ্ছে নিষ্ঠার সঙ্গে, সততার সঙ্গে, সরলতার সঙ্গে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ হয়ে দেশসেবা করা এবং এর যথাযথ প্রতিদান আমি পেয়েছি বলে মনে করি।
বি ক্যাঃ কেমন আছে আমাদের প্রিয় মাতৃভ‚মি? একজন শিক্ষক, সরকারের একজন চৌকস, সুদক্ষ ও প্রতিথযশা আমলা, একজন প্রতিমন্ত্রী এবং সর্বোপরি দেশের সূর্যসন্তান একজন সুনাগরিক হিসেবে কেমন দেখছেন আজকের বাংলাদেশকে?
ড. আলমঃ আজকের বাংলাদেশে নজিরবিহীনভাবে রূপান্তর ঘটছে। ২০০৯ থেকে অব্যাহতভাবে আমাদের যে উন্নয়ন-যাত্রা শুরু হলো তা এখনো চলমান আছে। দ্রæত আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়ছে। ২০০৯ সালে যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে, তখন মাথাপিছু আয় ছিল ৯০০ মার্কিন ডলার। সেই মাথাপিছু আয় এখন ২৫৯১ মার্কিন ডলার (২০২১ এ)। ১ যুগের মধ্যে আমরা প্রায় ৩ গুণের মতো মাথাপিছু আয় বাড়াতে সক্ষম হয়েছি। এর পূর্ববর্তী সময়ে মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ করতে সময় লেগেছিল ২৪ বছর। আর মাত্র ১২ বছরে আমরা দেশে মাথাপিছু আয় প্রায় ৩ গুণ বৃদ্ধিতে সক্ষম হয়েছি। এই একটি সংখ্যা দিয়েই বুঝা যায় আমাদের উন্নয়ন কতটা হয়েছে। বাংলাদেশ এখন মাথাপিছু আয়ে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ১ নাম্বার দেশ। দ্বিতীয় ভারত, পরে অন্যান্য দেশ।
স্বাধীনতাকালে যে বাংলাদেশর মাথাপিছু আয় পশ্চিম পাকিস্তানের থেকে ৭০ শতাংশ কম ছিল আর এখন আমাদের সেই বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৪৫ শতাংশ বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আমাদের প্রত্যাশিত গড় আয়ুষ্কাল এখন সবথেকে বেশি, তারপর ভারত ও অন্যান্য দেশ। সেদিক থেকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ১ নাম্বার দেশ। আমরা মাতৃমৃত্যু কমাতে পেরেছি বিপুলভাবে। প্রতি ১ লক্ষে ১৬৫ জন মারা যায়। এটিও দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। আমাদের প্রাইমারী ও মাধ্যমিক স্কুলে ছাত্রী সংখ্যা বেশি; এটা আমাদের বিরাট একটা সাফল্য। চরাঞ্চল ও পার্বত্য অঞ্চলের কিছু অংশ ছাড়া প্রায় প্রত্যেকটা গ্রামকে আমরা পাকা সড়ক দিয়ে যুক্ত করেছি। আমরা বাংলাদেশকে সড়ক-জনপথের জালের মধ্যে নিয়ে এসেছি। বাড়ি বাড়ি আমরা বিদ্যুৎ দিয়েছি। বর্তমানে বাংলাদেশে ব্যাপক যে সাফল্য ও ব্যাপক যে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, তা অভ‚তপূর্ব ও অবিস্মরণীয়। আমরা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় ৫০টিতে নিয়ে আসতে পেরেছি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখন ১০৮ টি। সেক্ষেত্রে বলা যায়, ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক বিস্তৃতি ঘটেছে শিক্ষাক্ষেত্রে। প্রতি জেলায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় করছি। সার্বিকভাবে বাংলাদেশের যে সম্ভাবনা দেখছি, যে দ্রæত গতিতে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে -তা অব্যাহত থাকলে সত্যিকার অর্থে ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা সোনার বাংলা গড়তে পারব।
আরেকটি বিষয় অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে, একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশ একটি অদ্বিতীয় দেশ এই কারণে, এই একবিংশ শতাব্দীতে কোনো দেশের ১০০ বছরের পরিকল্পনা নেই। আমরা ১০০ বছরের পরিকল্পনা করেছি। জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে আমরাসহ সারা বিশ্বই চিন্তিত। প্রতিনিয়ত বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ভূ-মÐলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে, উপক‚লীয় অঞ্চলে জলোচ্ছাস ব্যাপক পরিমানে বৃদ্ধি পাচ্ছে, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ছে। বাংলাদেশ পৃথিবীর দুর্যোগপ্রবণ দেশের মধ্যে ৭ম দেশ। এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করা অর্থাৎ ক্লাইমেট দূর্যোগকে মোকাবেলা করার জন্য আমরা ১০০ বছরের একটা পরিকল্পনা করেছি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করার জন্য, সুপেয় পানির নিশ্চয়তা করার জন্য এবং শহরগুলো থেকে বন্যা দূর করার জন্য, সুষ্ঠ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রত্যেকটি শহরকে সবুজায়নের মাধ্যমে বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য আমরা এ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। এ বিষয়গুলো আমাদের ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ তে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে এবং একটি বিনিয়োগ পরিকল্পনা হিসেবে ২০৩০ এর মধ্যে কী কী প্রকল্প গ্রহণ করবো সেগুলোও সুনির্দিষ্টভাবে সন্নিবেশিত করেছি। এটিও বাংলাদেশের একটি অপূর্ব অর্জন।
বি ক্যাঃ সামনে আমাদের লক্ষ্য রূপকল্প ২০৪১; এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে সরকারের প্রস্তুতি কতটুকু?
ড. আলমঃ রূপকল্প ২০২১ অনেক সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। ২য় রূপকল্পতে আমরা আমাদের স্বপ্নের সোনার বাংলা নির্মাণের পথ নির্ণয় করেছি, যাত্রা পথচিত্র অঙ্কন করেছি। ২০৪১ সালে বাংলাদেশে বহু দলের, বহু মতের একটা সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। সেসময়ে আমরা দারিদ্রমুক্ত একটি দেশ পাবো। দরিদ্রের বিষয়টি তখন ইতিহাসের পাঠ্যবিষয় হিসেবে অর্ন্তভুক্ত থাকবে, ছেলেমেয়েরা পড়বে বাংলাদেশ একসময় দরিদ্র ছিল। সে বিষয়টি বইয়ে থাকবে, কিন্তু বাস্তবে তার অস্তিত্ব থাকবে না। এটি হবে বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্র; যেটি আমরা অঙ্কিত করেছি আমাদের দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনায়।
বি ক্যাঃ ঝউএ বাস্তবায়নে বাংলাদেশের অগ্রগতি কেমন দেখছেন? এ লক্ষ্য পূরণে আর কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিৎ?
ড. আলমঃ আমাদের সংবিধানে স্বীকৃত হয়েছিল মানুষের ৫টি মৌলিক অধিকার। খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও চিকিৎসা। এমডিজি ও এসডিজিতে যা বলা হয়েছে, আমি মনে করি সেটি আমাদের সংবিধানে যা বলা হয়েছে সে চেতনারই বিশ্বরূপ মাত্র। সে কারণেই আমরা MDG ধারণ করেছি ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষীকি পরিকল্পনায় ২০১৫ সাল পর্যন্ত। আর ৭ম ও ৮ম পঞ্চবার্ষীকি পরিকল্পনায় আমরা SDG ধারণ করেছি। ৯ম পঞ্চবার্ষীকি পরিকল্পনায়ও আমরা SDG ধারণ করবো। অর্থাৎ এসডিজি বাস্তবায়িত হবে আমাদের তিনটি পঞ্চবার্ষীক পরিকল্পনা দ্বারা, ৭ম, ৮ম ও ৯ম। আমাদের জাতীয় পরিকল্পনা দলিলের মাধ্যমেই আমরা কর্মসূচি প্রণয়ন করেছি এবং এসডিজি বাস্তবায়ন করবো। যদিও এটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন এজেন্ডা; তবুও আমাদের চেতনা, আমাদের চাহিদার সাথে এটি সঙ্গতিপূর্ণ। এসডিজি প্রণয়নের সময় আমরা ব্যাপক ভ‚মিকা রেখেছি। আমাদের খসড়া ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছে এই আন্তর্জাতিক দলিলে। কাজেই আমাদের পরিকল্পনাগুলো যত ভালোভাবে বাস্তবায়িত হবে ততই এসডিজি অর্জন সহজতর হয়ে যাবে। এটি বাস্তবায়নে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এই কারণে; বাংলাদেশকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরার জন্য, বাংলাদেশকে ব্রান্ডিং করার জন্য এটি বাস্তবায়ন অপরিহার্য। যেমনটি বাংলাদেশকে আমরা তুলে ধরেছি এমডিজির মাধ্যমে। এ কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ প্রায় ১ ডজন পুরস্কার পেয়েছে। এটা ব্রান্ডিং এর জন্য ছিল অপূর্ব একটা সুযোগ। আর এখন সামনে আমাদের এসডিজি। এই লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নের জন্য পঞ্চবার্ষীকি পরিকল্পনার মাধ্যমেই আমরা তা করতে চাচ্ছি। সেই লক্ষ্যেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।
বি ক্যাঃ বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যায়, বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে গড় মাথাপিছু আয় বাড়লেও দরিদ্র এবং ধনী শ্রেণীর মধ্যে ব্যবধান ক্রমেই বেড়ে চলেছে; এ থেকে উত্তরণের উপায় কী হতে পারে?
ড. আলমঃ পঞ্চবার্ষীক পরিকল্পনাগুলোতেই এ থেকে উত্তরণের উপায় আমরা রেখেছি। একটি বিষয় আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, দ্রæত উন্নয়নের সময় আয় ব্যবধানটা অনেকাংশে বেড়ে যায়। এর একটা সহজ কারণ হলো বিনিয়োগ করে উদ্যোক্তা শ্রেণী, ধনীক শ্রেণী। সুতরাং মুনাফার অংশটা তারাই বেশি পায়। আর যারা দরিদ্র শ্রেণী তাদের কিন্তু পুঁজি নেই, আছে তাদের দৈহিক শ্রম। অতএব পুঁজি থেকে যে লভ্যাংশ সেটি কিন্তু তারা পায়না। অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াটাই এরকম যে, বিনিয়োগকারীরা মুনাফাটা আগে পায়, লভ্যাংশটা বেশী পায় এবং তাদের আয়ও বেড়ে যায় বেশি। সেকারণে এ বিষয়টি আমাদের মাথায় আছে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি আমরা আগের থেকে অনেক বিস্তৃত করেছি, আরও বিস্তৃত করতে চাচ্ছি । ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা সকল দরিদ্রকে কোনো না কোনো সামাজিক সহায়তা কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসবো। এই দারিদ্র্য কমিয়ে আনার লক্ষ্যেই আমরা সড়ক ও জনপথকে ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছি। বিদ্যুতায়নকে ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতকে ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছি।
এর একটি কারণ হচ্ছে এতে প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। যতই কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে ততই দারিদ্র কমে আসবে। আয় বৈষম্য কমে আসবে। এই লক্ষ্যেই আমরা আইসিটির মাধ্যমে যাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় সে চেষ্টা করছি। শিল্পায়নে প্রযুক্তি ব্যবহার করে যাতে আমাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় সেটিও আমরা চেষ্টা করছি। কৃষিকে যান্ত্রিকায়ন করছি যাতে উৎপাদন বাড়ে। এই প্রচেষ্টার ফলে ২০১৬ থেকে ২০২১ এই সময়টাতে আমাদের আয় বৈষম্য খুব একটা বাড়েনি, স্থির আছে। জিনি সহগ ২০১৫ এর পরিমাপ অনুযায়ী ০.৪৮ ছিল এবং এখনও সেটা ০.৪৮ রয়েছে। অর্থাৎ বৈষম্যকে আমরা থামিয়ে ফেলতে পেরেছি এবং এটা ক্রমান্বয়ে আমরা কমিয়ে আনতে পারবো। আমাদের ৮ম পঞ্চবার্র্ষীকির শেষ দিকে বা এসডিজি অর্জনের শেষ দিকে দারিদ্র্য বৈষমের ধারাটা অনেক কমে যাবে। দ্রæত উন্নয়নের প্রথম দিকে বলেছি, বৈষম্য কিছুটা বাড়ে কারণ ধনীক শ্রেণী এক্ষেত্রে প্রচুর বিনিয়োগ করে। সরকার প্রগতিশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে, অবকাঠামো তৈরির মাধ্যমে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়ের মাধ্যমে এ বৈষম্য কমিয়ে আনার ব্যাপারে ব্যাপক কর্মসূচি নিয়েছে।
বি ক্যাঃ দেশে শিক্ষিত বেকারের হার প্রায় ৬৬ শতাংশ। এ বেকারত্ব দূরীকরণে সরকারের পরিকল্পনা কী?
ড. আলমঃ আমাদের বেকারত্ব নিয়ে একটা ভ্রান্তি আছে। অনেক সময় এ পরিমাপের সঠিক দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়না। কারণ হলো একটি ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করে। কেউ হয়তো বার্গার শপ খোলে, কেউ পণ্য সরবরাহ করে, কেউ কোচিং করাচ্ছে, বন্ধুরা মিলে দুগ্ধ খামার গড়ে তুলছে। তখন যদি তাদের জিজ্ঞেস করা হয় তোমরা কি করো, তখন তারা নিজেদের বলছে বেকার। অথচ তারা কিন্তু আয়-উন্নতি করছে। এমনকি এদের মধ্যে অনেকে আছে মাসিক ৫০ হাজার টাকাও উপার্জন করছে। অনেকে আইসিটি সেক্টরে কাজ করছে, হোটেল-রেঁস্তোরাও চালাচ্ছে। সেই অর্থে আমি বলবো বেকারত্বের যে সাধারণ ফিগারটা আমরা উল্লেখ করি, যে সংখ্যা বা চিত্র আমরা তুলে ধরি সেটাতে সবসময় সত্যিকার অবস্থা উঠে আসেনা। প্রচুর লোকজন এখন কাজকর্ম করে যাচ্ছে। তাছাড়া যারা রিটায়ার করছে, যারা সুস্থ-সবল আছে, এরা সবাই কিন্তু কাজ করছে। এর অর্থ হলো দেশে কাজের কিন্তু খুব ঘাটতি নেই। তবে আমরা উন্নয়নশীল দেশ এটাও ঠিক, সেকারণে যেটা আছে তা হলো যোগ্যতা মতো, প্রয়োজন মতো যে চাকরিটা দরকার সেটা হয়ত কেউ কেউ পায়না। কিন্তু রুজি রোজগার অনেকেই করছে। এই বিষয়টা আমাদের মনে রাখতে হবে।
বি ক্যাঃ গ্রামীন কৃষি অর্থনীতি হতে পারে এদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতিকে উৎসাহিত করে এর অগ্রযাত্রাকে বেগবান করার লক্ষ্যে সরকার কী ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে?
ড. আলমঃ ফসল উৎপাদন, গবাদি পশু পালন, মৎস চাষ, বনায়ন এসবগুলো উপখাত মিলিয়ে আমাদের বৃহৎ কৃষি খাত। শ্রমশক্তির প্রায় ৪০ ভাগ এই খাতে নিয়োজিত। তাই এখনও বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে এই কৃষিখাত। পাশাপাশি এখাত আমাদের খাদ্য সরবরাহ ও পুষ্টিরও অন্যতম যোগানদাতাও বটে। ইতোমধ্যে কৃষিখাতে ব্যাপক উন্নয়ন ও পরিবর্তন সাধিত হয়েছে; আরও পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। একই সাথে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদিকা এবং উৎপাদনও আরও বাড়াতে হবে। উৎপাদন বাড়িয়ে সেই উৎপাদিত এবং প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য বিদেশে রপ্তানি করার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে করে দেশে ব্যাপক কর্মসংস্থান হবে, দারিদ্র্য দ্রæত অপসৃয়মান হবে এবং যারা মজুর শ্রেণী, বর্গা চাষি কিংবা প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক তাদেরও ভাগ্য উন্নয়ন হবে। কারণ অধিক মাত্রায় উৎপাদন হলে, কৃষিপণ্য বিদেশে রপ্তানি হলে তাদেরও মজুরি বেড়ে যাাবে। মজুরির হার বৃদ্ধি পেলে এই মজুর শ্রেণী, শ্রমিক শ্রেণী অনেক বেশি উপকৃত হবে।
বি ক্যাঃ দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা, খাদ্যে ভেজাল রোধ ও সিন্ডিকেট ব্যবসা বন্ধে করণীয় কী বলে মনে করেন?
ড. আলমঃ দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার অন্যতম উপায় হলো সর্বক্ষেত্রে আমাদের উৎপাদন বৃদ্ধি করা। কারণ উৎপাদন যদি বৃদ্ধি পায় এবং উৎপাদিত সেই পণ্যে যদি দেশের চাহিদা মিটে যায়, তাহলে আর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবেনা। কোনো দ্রব্যের মূল্য বাড়ে তখনই, যখন দ্রব্যের চাহিদা বাড়ে কিন্তু সে অনুযায়ী সরবরাহ না থাকে। আমরা সাধারণত দেশজ উৎপাদন এবং আমদানির মাধ্যমে আমাদের এই চাহিদাকে মিটাতে চেষ্টা করি। কাজেই দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখার জন্য কৃষিক্ষেত্রে আমাদের উৎপাদিকা অনেক বাড়াতে হবে।
উৎপাদিকা হলো প্রতি একরে সর্বোচ্চ কত মন আমরা উৎপাদন করতে পারি বা কত কেজি আমরা উৎপাদন করতে পারি সেই পরিমান, আর উৎপাদন হল সামগ্রিকভাবে মোট উৎপাদনের পরিমান। আমাদের দেশে আমরা যদি প্রতি হেক্টরে ৩ টন পণ্য উৎপাদন করে থাকি, তাহলে ভিয়েতনাম সেটা করে ৫ থেকে ৫.৫ টন। সুতরাং আমরাও সেই হারে উৎপাদিকা বাড়াতে পারলে দেশের মোট উৎপাদন অনেক বেড়ে যাবে। সেক্ষেত্রে দ্রব্যমূল্যও নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
তাই দ্রবমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে কৃষি উৎপাদন বিশেষ করে শাক-সবজি, ফল-মূল এসবের উৎপাদন ব্যাপক বাড়াতে হবে। বিশেষত জরুরি খাদ্যদ্রব্যগুলোর ক্ষেত্রে আমরা যদি নিজস্ব উৎপাদন দিয়ে দেশের চাহিদা মিটাতে পারি, তাহলে দাম আমাদের নাগালের মধ্যে থাকবে।
এছাড়া খাদ্যে ভেজাল রোধে সরকারের পক্ষ থেকে বর্তমানে বিশেষ বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। এ ভেজাল রোধে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ তাদের নিয়মিত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ওজনে কারচুপি ধরছে এবং জেল-জরিমানাও করছে।
সিন্ডিকেট বিষয়ে যেটা দেখা যায়- ধান, চাল, গম, শরিষা এসবের প্রাথমিক বিপণন পর্যায়ে সাধারণত সিন্ডিকেট হয়না। কারণ সারা দেশে অসংখ্য উৎপাদনকারী, অসংখ্য পাইকার কিংবা ফড়িয়া ব্যবসায়ী রয়েছে। তাছাড়া ঢাকায় এসেও সিন্ডিকেট হওয়ার খুব একটা সুযোগ নেই। কারণ সারা দেশ থেকে অসংখ্য উপায়ে এই পণ্য ঢাকায় আসতে থাকে। সিন্ডিকেট ব্যবসা হতে পারে সেই পণ্যগুলোতে যেগুলো ২০-২৫ জন মিলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন ভোজ্য তেল, চিনি, পেয়াজ এজাতীয় আমদানি পণ্যে পাইকারি পর্যায়ে সিন্ডিকেট ব্যবসা হতে পারে। কিন্তু মৌলিক কৃষি পণ্যে খুচরা বাজারে সিন্ডিকেশন সাধারণত হয়না। তবে পণ্য পরিবহন ব্যয় ও ক্ষেত্রবিশেষ চাঁদাবাজির কথাও শোনা যায়; এসব কারণে অনেক সময় পণ্যের ব্যয় বেড়ে গিয়ে দাম বৃদ্ধি পায়। সেগুলো নিয়ন্ত্রণে সরকার যথেষ্ঠ সক্রিয় এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।
বি ক্যাঃ দেশকে আরো ব্যবসাবান্ধব করতে সরকারি, বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে কী কী উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন?
ড. আলমঃ প্রথম প্রেক্ষিত পরিকল্পনা অর্থাৎ ৬ষ্ঠ ও ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছি তা হচ্ছে, আমরা রপ্তানির ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছি। রপ্তানি বাণিজ্য যত সম্প্রসারিত হবে, আমাদের অর্থনীতি তত শক্তিশালী হবে। প্রাকৃতিক সম্পদ আমাদের খুব বেশি নেই। এখন পর্যন্ত গ্যাস যা মজুদ রয়েছে তা আগামী ১০ বছরের মধ্যে প্রায় শেষ হয়ে যাবে; এমনটাই সংশ্লিষ্ট সূত্রে বলা হচ্ছে। যেহেতু গ্যাস ছাড়া প্রাকৃতিক সম্পদের তেমন সমাহার আমাদের নেই, তাই রপ্তানি বাড়ানো ছাড়া প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর আর অন্য কোনো ভালো পন্থা অবশিষ্ট নেই। সুতরাং দ্রæত রপ্তানি ব্যবসা বাড়াতে হবে, দ্রæত জনসম্পদ এমনকি দক্ষ জনসম্পদও আমরা রপ্তানির অনুমতি দিতে পারি যাতে তারা বিদেশে গিয়ে উপার্জন করে দেশে টাকা পাঠাতে পারে। তবে সর্বশেষ রপ্তানি নির্ভর প্রবৃদ্ধি ছাড়া আমাদের সহজ কোনো পথ খোলা নেই। সেকারণে ৬ষ্ঠ ও ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় আমরা রপ্তানির ওপর যথেষ্ঠ গুরুত্ব দিয়েছি। আমদানিকে যতটা সম্ভব উন্মুক্ত করেছি। সেভাবে আমরা এগিয়েছি বলেই প্রবৃদ্ধির হার দ্রæত বেড়েছে, রপ্তানিও দ্রæত বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি আমাদের প্রবাসী শ্রমিক পাঠানোও আগের থেকে অনেক বেড়েছে। ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আগে আমরা ৫ লক্ষ শ্রমিক বিদেশে পাঠাতাম, যা ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার পর ৭ লক্ষে উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে আমরা প্রায় ৮ লক্ষের উপরে শ্রমজীবী বিদেশে পাঠাচ্ছি।
অনুরূপভাবে বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য দেশে আমরা সেই পরিবেশ ইতোমধ্যে তৈরি করেছি। বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে ব্যাপক রাস্তা-ঘাট উন্নয়ন, ব্রীজ-কালভার্ট নির্মাণ সম্পন্ন করেছি; যাতে করে স্বল্প সময়ে নিরাপদে পণ্য পরিবহন করা যায় এবং বিদেশীরা বিনিয়োগে আকৃষ্ট হয়। সেই সাথে বিদেশীদের বিনিয়োগের জন্য আইন-কানুন অনেক সহজ করা হয়েছে এবং ট্যাক্স মৌকুফ, বিদেশে তাদের লভ্যাংশ নিয়ে যাওয়ার মতো আইনসহ নানা ধরণের বিশেষ সুবিধা তাদের জন্য রাখা হয়েছে। সবমিলিয়ে সামনে বিদেশী বিনিয়োগ অনেক বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায় এবং বৃদ্ধি পেতেও হবে। এছাড়া কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়ানো আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। ব্যবসা-বাণিজ্যে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ বিশেষ করে বেসরকারি উদ্যোগকে আরও এগিয়ে আসতে হবে। রপ্তানি খাতে তাদের আরও বড় ভূমিকা নিতে হবে। সার্বিকভাবে এ সরকারকে বলতে পারি ব্যবসা বান্ধব, প্রবৃদ্ধি বান্ধব সরকার এবং কৃষক বান্ধব সরকার। একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়, একটি সফল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সরকার ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছে।
বি ক্যাঃ জ্ঞানভিত্তিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ এবং আলোকিত জাতি গঠনে নিবেদিত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকা ৪ দশক পূর্তি উৎসব পালন করছে। ক্যাম্পাস পত্রিকা ও ক্যাম্পাস সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্রের অগ্রযাত্রায় আপনার সানুগ্রহ পরামর্শ বলবেন কি?
ড. আলমঃ ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা থেকেই আমরা মানবসম্পদ উন্নয়নে ব্যাপক ভ‚মিকা রাখছি। যেকারণে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে আমরা অনেক ব্যয় বাড়িয়েছি। কারণ শিক্ষার সাথে স্বাস্থ্য জড়িত। শিক্ষিত হয়েও ভালো স্বাস্থ্য না হলে তারা কর্ম উৎপাদনশীল হবেনা। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য দুটোরই একসঙ্গে উন্নয়ন ঘটাতে হবে। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী করার চেষ্টা করছি। প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষার প্রসার ঘটাতে চেষ্টা করছি। আমরা বাজারমুখী শিক্ষার উন্নয়ন ঘটাতে চেষ্টা করছি এবং আইসিটি শিক্ষার উপর বিশেষ জোর দিচ্ছি। সবমিলিয়ে আমরা জ্ঞাননির্ভর সমাজ গড়ে তোলার আন্তরিক প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি। সরকার একা সব করতে পারবেনা; তাই আমরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি মেডিকেল খোলার অনুমতি দিয়েছি। এপর্যায়ে আমাদের লক্ষ্য রাখা দরকার মানসম্মত শিক্ষা যেন এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিশ্চিত করে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও মানোন্নয়নে শিক্ষক সমাজের বিশেষ ভ‚মিকা প্রত্যাশা করি। আমরা জানি দেশপ্রেমিক হিসেবে তাঁরা এ দায়িত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। কোর্স-কারিকুলাম আধুনিকায়নে তাঁরা বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করছেন। ছাত্র-ছাত্রীদের আগের থেকেও বেশি সময় দিচ্ছেন। সবমিলিয়ে জ্ঞানভিত্তিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় আমরা নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছি।
ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে শহর ও গ্রামের ব্যাবধান কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি। গ্রামে বিদ্যুৎ যাওয়ায় ঘরে ঘরে প্রচুর প্রবৃদ্ধি কেন্দ্র গড়ে উঠছে। এ প্রবৃদ্ধি কেন্দ্রগুলো গড়ে উঠায় প্রচুর অকৃষিজ কার্যক্রমের বিকাশ গড়ে উঠেছে।
ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলায় অন্যতম সহায়ক নীতি হচ্ছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষায় ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটানো, যা আমরা করেছি। ছাত্র-ছাত্রীদের বিনামূল্যে বই দেয়া হচ্ছে। ৪ কোটি শিক্ষার্থীকে ৩৮ কোটি বই দেয়া হয়েছে এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে উপবৃত্তি প্রসারিত করা হয়েছে। উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে ছাত্রীদের জন্য বিশেষ ট্রাষ্ট তহবিল গঠন করা হয়েছে যাতে করে দরিদ্র ছাত্রীরা সেখান থেকে সহায়তা নিয়ে তাদের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারে। জ্ঞানভিত্তিক, ন্যায়ভিত্তিক ও আলোকিত সমাজ গঠনে সরকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সেকারণে শিক্ষায় সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর সাথে সাথে, আইসিটি শিক্ষার প্রসার ঘটানো হয়েছে। আমরা চাচ্ছি সমগ্র দেশে খেলাধুলা, বিতর্ক, নিত্যসহ এজাতীয় শিখন কার্যক্রম যাতে চালু থাকে। প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে আমাদের আশা তারা শিক্ষার্থীদের মধ্যে খেলাধুলা ও বিভিন্ন সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড অব্যাহত রাখবে। ভালো বিতার্কিক তৈরি হবে, ভালো খেলোয়াড় তৈরি হবে। অর্থাৎ গত ১৩ বছরে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যে উন্মেষ ঘটেছে, আমাদের প্রত্যাশা তা যেন অব্যাহত থাকে।