॥ গোলাম কবির ॥
প্রজ্ঞা, জ্ঞান, বোধ, শিক্ষা প্রায় সমার্থক শব্দ। বিষয়ের ব্যাপ্তির প্রয়োজনে এই শব্দগুলো দিয়ে বিভিন্ন চেতনার রূপ দেওয়া হয়। মানুষের মননশক্তির আদ্যভাব প্রজ্ঞা। এই প্রজ্ঞা কিভাবে এলো, তা নিয়ে মনীষীদের ভাবনার অবধি নেই। ধর্ম বলছে, স্রষ্টাই আদি প্রজ্ঞাবান। তিনি তাঁর অশেষ প্রজ্ঞার কিছু অংশ দিয়ে মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। সমাজবিজ্ঞান বলছে, প্রকৃতির কোলে লালিত মানুষ দীর্ঘ অনুশীলনের মাধ্যমে জ্ঞান আয়ত্ত করেছে। প্রতিনিয়ত তার পরিধি বিরামহীন গতিতে এগিয়ে চলেছে। একেই আমরা বলি প্রজ্ঞা বা জ্ঞান। আর এই জ্ঞানের প্রয়োগ করার দিকটাই হলো শিক্ষা।
জ্ঞানই শক্তি। এই জ্ঞান অন্বেষণ বা গ্রহণ বিষয়টি সর্বজনীন। এ নিয়ে দ্বিমত পোষণের অবকাশ কম। জ্ঞান বা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো চেতনাকে তীক্ষ ও পরিশীলিত করা এবং সমাজজীবনকে আলোকিত করা। তাই সমাজ ও জীবনকে সুন্দর করে তোলার প্রয়োজনে যা কিছুর আয়োজন, তাই শিক্ষার আওতায় পড়ে বলে শিক্ষার পরিধি বহুবিস্তৃত।
সুশিক্ষা ও কুশিক্ষা বলে যে অভিধা দু’টি প্রচলিত আছে, তা এমনি এমনি হয়নি। সুশিক্ষা মানুষের মনুষ্যত্ব অর্জনে সহায়ক হয়, সমাজ ও জীবনকে সুন্দর ও শোভন করে তোলে। আর কুশিক্ষা সব কল্যাণ ও সুন্দরের বিনাশকারী। তাই শিক্ষা বলতে আমরা সুশিক্ষাকেই বুঝব। মানবতাবিধ্বংসী মারণাস্ত্র তৈরির গোপন শিক্ষা দেওয়া কুশিক্ষার পর্যায়েই পড়ে।
শিক্ষক হতে হলে যেসব বৈশিষ্ট্য অপরিহার্য তার মধ্যে প্রথম ও প্রধান হলো পাঠদানের বিষয়ে সম্যক জ্ঞান ও সততা। মনুষ্যত্বের মানদ-ের মধ্যে যেমন সততার বিকল্প নেই, তেমনি শিক্ষকতায় নির্ভেজাল জ্ঞান ও সততার অভাব থাকলে তাঁকে আর যাই হোক শিক্ষক ভাবা সমীচীন নয়। মিথ্যাচারী ব্যক্তি শিক্ষক নামের কলঙ্ক।
শিক্ষার্থী মা-বাবার পরই শিক্ষককে অনুসরণ করে। তাই মিথ্যাচার, তোষামোদি, লোভ-লালসাবৃত্তি যদি কারো সুপ্রবৃত্তিকে হার মানায়, তবে তার জন্য শিক্ষকতা নয়। না জেনে জানার ভান করে প্রতারণা করা নরহত্যার চেয়েও অপরাধ। প্রাইভেট পড়ানো শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন ফাঁস করে দিয়ে সমাধান করে দেওয়া, শিক্ষার্থীকে প্রলুব্ধ করার জন্য যোগ্যতার চেয়ে বেশি নম্বর দেওয়া কোনোক্রমেই শিক্ষকের পরিচায়ক নয়।
আদর্শ শিক্ষকের বড় বৈশিষ্ট্য তিনি অর্থসম্পদকে পায়ে মাড়িয়ে চলেন। অর্থের বিনিময়ে তাঁকে কিনতে পারা কঠিন। তাঁরা ভাঙেন, মচকান না। আজকের দিনে অনেকে দেনদরবার করে, দলবাজির সুবাদে কিংবা অর্থকড়ির বিনিময়ে অপেক্ষাকৃত সুলভ চাকরি হিসেবে শিক্ষকতায় আসেন। তাঁদের কেউ কেউ মেধা যাচাইয়েরও পর্যায়ে পড়েন না। অথচ তাঁরাই চাকরি পাওয়ার পর আন্দোলনে নামেন বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে। তাঁরা ভুলে যান, পায়ে ধরে তাঁদের শিক্ষকতায় আনা হয়নি। বরং তাঁরাই আপন সত্তা বিসর্জন দিয়ে, অনেকটা ভূলুণ্ঠিত হয়ে চাকরি নিয়েছেন। লেখা বাহুল্য, তাঁরা যখন থেকে আমাদের দেশে শিক্ষক পদবাচ্য হয়েছেন, তখন থেকেই শিক্ষার অধঃপতন শুরু। বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগের।
প্রাচীন ভাবুকরা শিক্ষার্থীদের অধ্যয়নকে তপস্যা বলেছেন। মহানবী (সা.)-এর বাণী- এক ঘণ্টা স্রষ্টার সৃষ্টি সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করা ৭০ বছরের উপাসনার চেয়েও উত্তম। জাগতিক সব জ্ঞানই তো স্রষ্টার সৃষ্টির আওতায়। তাই শিক্ষার্থীরা মানবকল্যাণের যে শিক্ষায়ই মনোবিবেশ করুক না কেন, তা প্রকারান্তরে উপাসনার পর্যায়েই পড়ে, তাই বলে কুশিক্ষা নয়। যে শিক্ষা মানুষকে বিভ্রান্ত করে এবং জিঘাংসা শেখায়, তা শিক্ষা নয়।
একদা যথার্থ শিক্ষার্থীর পরিচয় প্রসঙ্গে বলা হতো, ‘শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞানম’, শিক্ষার্থী যাঁর কাছ থেকে জ্ঞান আহরণ করবে, তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও অবিচল বিশ্বাস থাকতে হবে। বিশ্বাস শ্রদ্ধা-ভালোবাসার পূর্বশর্ত। বিশ্বাস না থাকলে ভালোবাসা যায় না কিংবা শ্রদ্ধা প্রদর্শনও কঠিন। অবশ্য এ জন্য শিক্ষক শ্রদ্ধাপ্রাপ্তির উপযুক্ত হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলবেন। একজন শিক্ষার্থী দেশ, সমাজ ও পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে ভাববে না তা নয়, তবে সবার আগে প্রকৃত শিক্ষাকে প্রাধান্য দিতে হবে। কুপরামর্শে কিংবা বিপরীত গ্রোতের মতবাদে ধাবিত হয়ে সমাজ ও জীবন বিধ্বংসী কাজে জড়িয়ে পড়া শিক্ষার্থীর কাজ নয়। উচিত নয় প্রশ্ন ফাঁসের আশায় নির্ঘুম প্রতীক্ষা করা।
আমাদের দেশের ছেলেরা অন্য দেশে লেখাপড়া করতে গিয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করছে। এর মূল কারণ, সেখানে গিয়ে তারা শিক্ষার প্রতি একাগ্র হয়ে লক্ষ্যে পৌঁছে যায়। তা ছাড়া উন্নত দেশের বেশির ভাগই জাত শিক্ষক। দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশে প্রকৃত শিক্ষার চেয়ে জাঁকজমক বেশি। সত্যিকার শিক্ষার সঙ্গে যাঁদের পরিচয় হয়নি তাঁদের অনেকেই শিক্ষকতা পেশায়। এই প্রবণতা এত বেশি মারাত্মক হয়ে উঠেছে যে একদিন হয়তো তাঁদের প্রকোপের কবলে পড়ে শিক্ষা দেশ থেকে উজাড় হয়ে যাবে। আমরা কি এখনো সাবধান হব না?
-লেখকঃ সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ