॥ গোলাম কবির ॥
শিক্ষণীয় বিষয়ের বিবর্তিত জগতের ফেলে আসা অতীত এবং বর্তমানকে সম্যক উপলব্ধির প্রয়োজনে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য ধর্মগ্রন্থে ভুপৃষ্ঠ সফরের নির্দেশ আছে। এখন তার দরকার কম। কারণ যন্ত্রই সব দেখিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। কিন্তু বাস্তব দর্শন আর যান্ত্রিক দেখা কি এক! সে বিতর্কে না গিয়ে বর্তমান অবস্থায় আমাদের শিক্ষা নিয়ে চিন্তিত আমরা সবাই। সবার জানা, রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার প্রকৃত প্রতিফলন সমাজে ও কর্মে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে নোবেল বিজয়ের এক বছর আগে ইউরোপ ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। উপরন্তু নিজের গড়া আশ্রমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর প্রতিনিধি হয়ে কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। কবি নিজেই তার বর্ণনা দিয়েছেন পথের সঞ্চয় গ্রন্থে। ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় তিনি বুঝেছিলেন আমাদের শিক্ষার দীনতার কারণ। তাঁর মনে হয়েছিল, মুদির দোকানদাররা যেন শিক্ষকতায় এসেছেন। শতবর্ষেরও আগের সেই মুদির দোকানদারদের হাত থেকে শিক্ষা এখন বাজার অর্থনীতির করপোরেটদের করায়ত্ত। তবু সেখান থেকে আমাদের সন্তানরা যতটুকু আহরণ করার সুযোগ পাচ্ছিল, করোনা বিপর্যস্ত পৃথিবী থেকে যেন ওই প্রাপ্তিটুকুও অপসারিত হয়ে যায়!
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে কোভিড চীনকে তছনছ করা শুরু করে। আমরা তার উত্তাপ অনুভব করি অচিরেই। দেখতে দেখতে সারা বিশ্ব করোনায় আক্রান্ত। ক্ষমতাধররা মুহূর্তে পৃথবী ধ্বংস করতে পারে। তারা প্রতিরোধের উপায় অনুসন্ধানে হিমশিম খাচ্ছে। গোটা পৃথিবীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। কেউ কেউ খোলার আয়োজন করছে। মার্চ ২০২০-এর শেষ দিক থেকে আমাদের শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে পারছে না। আর শহুরে শিক্ষার্থীদের অবস্থা আরো করুণ। তারা শুধু বিদ্যালয় নয়, খোলা আকাশের নিচে যাওয়ার সাহস পায় না। শিক্ষা শিকেয় ওঠার উপক্রম।
বাংলাদেশে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখার যান্ত্রিক প্রচেষ্টা চলছে। দৈনিক পত্রিকা, টেলিভিশনে আগে থেকেই অনেকটা ব্যবসায়িক তাগিদে করত। এখন তার পরিধি বেড়েছে। সেনাবাহিনী পরিচালিত অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইনে শিক্ষার ব্যবস্থা করছে। আমরা লক্ষ করছি, রাজশাহীতে রাজশাহী কলেজ, রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ নিয়মিতভাবে অনলাইন শিক্ষা দেওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এটা যেন নিবিড় অন্ধকারে জোনাকির আলো অথবা সাগরের বুকে গোষ্পদ। দেশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী অন্ধকারে।
আমাদের দেশের শিক্ষার প্রকারভেদ দুষ্কর। দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা একমুখী হলে একটি কেন্দ্র থেকে সারা দেশের শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে তাদের প্রয়োজনীয় অনেক বিষয় অনুশীলন করতে পারত। তা হওয়ার নয়। শিক্ষার বহুমুখী রূপ সে পথের অন্তরায়। তাছাড়া প্রত্যন্ত গ্রামের অনেক দরিদ্র শিক্ষার্থী এসব সুবিধা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত। তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় পাঠের বিষয় ভুলতে বসছে। ইটের পরে ইট, মাঝে মানুষ-কীট-এর মতো নগরবাসীর শিশু-কিশোররা জগতের আলো থেকে বঞ্চিতপ্রায়, আর করোনাকালে তাদের প্রতিটি পদক্ষেপে শঙ্কা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া সব কিছু সীমিত আকারে খুলছে। লেখা বাহুল্য, বাধ্য হয়েই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হচ্ছে দ্রুত সংক্রমণ রোধে ব্যক্তিক দূরত্ব রক্ষার্থে। তবে অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে অচিরে হয়তো তারা হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে অন্ধকার দেখবে। রবীন্দ্রনাথের কথায় : বিজ্ঞানশাস্ত্রে বলে, চক্ষুষ্মান প্রাণীরা যখন দীর্ঘকাল গুহাবাসী হইয়া থাকে তখন তাহারা দৃষ্টিশক্তি হারায়। না, আমরা আশাহত হতে রাজি নই। রবীন্দ্রনাথের কথা দিয়ে আবারও বলি : আশা করিবার অধিকারই মানুষের শক্তিকে প্রবল করিয়া তোলে। (লক্ষ্য ও শিক্ষা পথের সঞ্চয়) কবি বাহাদুর শাহ জাফরের কথা দিয়ে বলা যায়, এ জীবন তো চারদিনের, দুদিন কাটে প্রতীক্ষায় আর দুদিন আশায় আশায় আর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তো বলেছিলেন, আমরা মারি নিয়েই আছি। সুতরাং আমরা আশায় বুক বেঁধে থাকব। সুপ্রভাত আসবেই।
সভ্যতার ইতিহাসে দেখা গেছে বহু মারি পর্যুদস্ত করতে চেয়েছে পৃথিবীকে। একটা তান্ডব সৃষ্টি করে রেখে যায় তার ক্ষত। আজকের বিজ্ঞান সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পন্থা তৈরিতে ব্যস্ত। আমরা প্রতীক্ষারত। সাংঘাতিক ছোঁয়াকে রোগ থেকে রক্ষার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। শিক্ষানুরাগীরা চাচ্ছেন, শিক্ষার প্রবাহ চালু থাক। এরই মধ্যে আমরা কিছু প্রচেষ্টা লক্ষ করেছি। এ দিয়ে গোটা শিক্ষাপরিবার আগলিয়ে রাখা সহজ নয়। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে শিক্ষায় বিপর্যয় দেখা দিলেও তা পুষিয়ে নেওয়া গিয়েছিল সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। আজকের কোভিড কখন তার থাবা গুটাবে, কে জানে! বিজ্ঞানীরা অবিরাম সচেষ্ট। আমরাও আশাবাদী। তবে শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে যে নিষ্ফলা সময় পার হয়ে যাচ্ছে, তা ফিরে পাওয়ার উপায় উদ্ভাবন করতে হবে শিক্ষাব্রতীদের। আমাদের বিশ্বাস, আমরা পারব। না, শুধু পারব নয়, পারতেই হবে।
আমাদের দেশের প্রায় সব শিক্ষার্থী জীবনযুদ্ধে দুঃখ জয়ের কান্ডারি। লেখাপড়া শেষ করে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে সুখের মুখ দেখার স্বপ্ন দেখে। তাদের স্বপ্ন সফল করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্ব আছে। শিক্ষকতা নামের চাকরিতে নাম লেখিয়ে মাস ফোরালে শুধু বেতন পাওয়ার জন্য দিন গোনা বোধ করি অনৈতিক। কিছু শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে অনলাইনে শিক্ষাদানে অংশ নিতে অনীহ। এটা একমাত্র আলস্যের জন্য নয়। পাছে যোগ্যতার ঘাটতি ধরা পড়ে যায় হয়তো সেই ভয়ে। অবশ্য এঁদের সংখ্যা খুব বেশি নয়।
আমাদের বিশ্বাস, শিক্ষকতা ব্রতে যাঁরা শামিল হয়েছেন তাঁরা করোনা প্রতিরোধক উদ্ভাবকদের মতো আমাদের আশাবাদী শিক্ষার্থীদের দুঃখ জয়ের গান শোনাবেন।
আমাদের এত সব কথা আংশিক ভাগ্যবান নাগরিক শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও গ্রামীণ জনপদের শিক্ষার্থীদের জন্য ভাবা যায় না। বাস্তবে তাদের সংখ্যাই বেশি। গ্রামের প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইন সুবিধা আছে। তবে যেসব শিক্ষার্থীর নুন আনতে পান্তা উজাড়, যারা বাঁচার তাগিদে স্কুল অবসরে অভিভাবকদের কাজে সহায়তা করে অথবা অন্যের সৃহে বা কৃষিজমিতে কামলা দিতে বাধ্য হয়, তারা হয়তো অন্ধকারেই থেকে যাবে। তাদের জন্য বোধ করি নতুন করে ভাবা দরকার। কারণ তারা অনলাইনের সুবিধাদি ব্যবহারের মাধ্যমগুলো কেনার সামর্থ্য রাখে না। তা ছাড়া তাদের সবার ঘরে বিদ্যুতের সংযোগ নেই। অথচ বিপর্যস্ত শিক্ষাকে মূল প্রবাহে ফিরিয়ে আনার অন্যতম অন্তরায় করোনা। তাই বিধি মেনে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় করোনা আঁধার তাড়াতে না পারলে শিক্ষাবিপর্যয় হয়তো দীর্ঘায়িত হবে। তবে আশা করতে বাধা নেই, এ আঁধার অবশ্যই কাটবে। আমরা জয়ী হব।
-লেখকঃ সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ