বর্তমান সরকার-ঘোষিত রূপকল্প অনুযায়ী বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতকরণ, ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে সরকারের মন্ত্রণালয়গুলো গুরুদায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। এর মধ্যে জনগুরুত্বপূর্ণ ও অগ্রগতির দিকে বিবেচনা করলে যে মন্ত্রণালয়কে প্রথম সারির দিকে রাখতে হয়, সেটি হচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
যার ঐকান্তিক দিকনির্দেশনায় এমন সফলতা, তিনি আর কেউ নন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সুযোগ্য মন্ত্রী টিপু মুনশি এমপি। করোনা দুর্যোগেও তার সুযোগ্য নেতৃত্বে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পেয়েছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার জনস্বার্থে নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। এই দুর্যোগময় পরিস্থিতিতেও তিনি সচল রেখেছেন দেশের অর্থনীতির চাকা।
বীর মুক্তিযোদ্ধা টিপু মুনশি ১৯৫০ সালের ২৫ আগস্ট গোপালগঞ্জে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ৫২ বছর ধরে তিনি রাজনীতির সাথে জড়িত। ১৯৭০ সালে তিনি ঢাকা তিতুমীর কলেজের ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন। ১৯৭১ সালে জিন্নাহ সরকারি কলেজের নাম পরিবর্তনে তাঁর ভূমিকা ছিল অগ্রণী, যা আজ সরকারি তিতুমীর কলেজ নামে প্রতিষ্ঠিত। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ এর অন্তর্গত তেজগাঁও উত্তরাঞ্চলের সভাপতি হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি ব্যবসার পাশাপাশি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন।
উল্লেখ্য, ১৯৯২ সালে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গুলশান থানার সভাপতি নির্বাচিত হয়ে বিরতিহীনভাবে ২২ বছর সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রংপুর জেলার সহ-সভাপতি হিসেবে নিষ্ঠার সাথে কাজ করেছেন। তিনি মাত্র একুশ বছর বয়সে পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা রমজান আলী মুনশিসহ ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বিরল।
তিনি ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়নে রংপুর-৪ আসন থেকে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ৯ম জাতীয় সংসদে তিনি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০০৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়নে তিনি রংপুর-৪ আসন থেকে দ্বিতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১০ম জাতীয় সংসদে তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৭ সালে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর কেন্দ্রীয় কমিটির অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদের নির্বাচনে রংপুর-৪ আসন থেকে তৃতীয়বারের মত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। টিপু মুনশি ৭ জানুয়ারি ২০১৯ তারিখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রী পরিষদে মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা টিপু মুনশি একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত। তিনি ২০০৫-২০০৬ সময়ে বিজিএমইএ এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে গার্মেন্টস মালিকদের মিলিত সংগঠনের সম্মিলিত-ফোরামের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হয়ে ব্যবসায়ী প্রতিনিধি হিসেবে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া ও ভারত ভ্রমণ করেন।
টিপু মুনশি বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত। তিনি অসংখ্য জনকল্যাণমূখী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার প্রতিনিধিদল বহুমুখী প্রতিভায় ভাস্বর বর্ণিল গুণাবলির কর্মযোগী জনাব টিপু মুনশি এমপি এর সাথে সাক্ষাৎকারে অংশগ্রহণ করে। সেই সাক্ষাৎকারের উল্লেখযোগ্য অংশ তুলে ধরা হলো।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসঃ সরকারের জরুরি ও জনগুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনে আপনার অনুভূতি জানতে চাচ্ছি।
টিপু মুনশি এমপিঃ বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে আমার অনুভূতি হলো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যে দায়িত্ব দিয়েছেন, সে দায়িত্ব পালনে আমাকে অবশ্যই সফল হতে হবে। বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা, বাণিজ্যিকভাবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই আমার প্রধান দায়িত্ব। আমি মনে করি, আজকে সারা পৃথিবীর যে গ্লোবাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছে, তাতে করে বাণিজ্যটাই এখন সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই সেই দায়িত্বটা আমাকে যথাযথভাবে পালন করে এদেশকে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
বি ক্যাঃ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর আপনি কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ বা বাস্তবায়ন করেছেন?
টিপু মুনশিঃ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর বিভিন্ন ধরনের সমস্যা ও সম্ভাবনা আমি কো-অর্ডিনেট করেছি। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি আমাদের চলার পথকে কিছুটা বাধাগ্রস্ত করেছে। তারপরেও আমরা অনেক সমস্যা মোকাবেলা করে অগ্রসর হয়েছি। বিভিন্ন দেশের সাথে ট্রেড এগ্রিমেন্ট করার চেষ্টা করেছি। একটা পিটিএ হয়েছে ভুটানের সাথে। আশা করা যায়, আরো দশ-বারোটা দেশের সাথে আমরা এফটিএ, পিটিএ ইত্যাদি এগ্রিমেন্ট করব। আমরা আমাদের এক্সপোর্ট আইটেমগুলো বাড়ানোর চেষ্টা করছি। প্রতিবছরই আমরা বিভিন্ন নতুন বাণিজ্যিক আইটেমগুলোকে প্রায়োরিটি দিচ্ছি।
বি ক্যাঃ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন দপ্তর বা সংস্থাগুলোর কার্যক্রমে গতি বৃদ্ধিতে গৃহীত পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে বলবেন কী?
টিপু মুনশিঃ আন্তর্জাতিক পরিসরে আমাদের প্রতিনিধি বারবার যাচ্ছে। তাছাড়া, আমাদের যে ফরেন মিশনগুলো আছে, তাদেরকে রপ্তানি বাণিজ্য বাড়ানোর দিকে লক্ষ্য রেখে প্রো-অ্যাকটিভ হতে বলেছি। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন বিজনেস হাউস এবং সেক্টরগুলোকে আমরা রিইনফোর্স করার চেষ্টা করছি। করোনাকালীন সময়ে আমাদের সরকার বিভিন্ন স্টিমুলেশন প্যাকেজ দিয়ে বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য সহায়তা করে যাচ্ছে। লক্ষ্যণীয়ভাবে আমাদের প্রতিটা ক্ষেত্রে অগ্রগতি হচ্ছে। যদিও কোভিড আমাদের কিছুটা শ্লথ করে দিয়েছে।
বি ক্যাঃ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম নিয়ে আপনার পরবর্তী পরিকল্পনা জানাবেন কী?
টিপু মুনশিঃ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমরা একটা টার্গেট ফিক্স-আপ করেছি, ৪৮ বিলিয়ন ডলারের খুব বড় একটা টার্গেট নিয়েছি আমরা। সেই টার্গেটটা ফুলফিল করার জন্য আমরা খুব চেষ্টা করছি। পাশাপাশি আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে যেÑ ২০২৪ সালের মধ্যে গ্রাজুয়েশন হবে, ২০২৭ সালে আমরা বেনিফিটেড হবো, ২০৩০ সালে আমাদের এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে। এসব সামনে রেখেই আমরা আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সমন্বিতভাবে কাজ করে এগিয়ে যাচ্ছি। তাই আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে যে, সবকিছু সমন্বয় করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে একটি অনন্য উচ্চতর অবস্থানে নিয়ে যাওয়া, এসডিজি’র এচিভমেন্ট অর্জন করা। অর্থ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইত্যাদি সকল গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে আমরা আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছি।
বি ক্যাঃ মুজিববর্ষকে ঘিরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গৃহীত কার্যক্রম ও কর্মপরিকল্পনা জানতে চাই।
টিপু মুনশিঃ মুজিববর্ষ ঘিরে আমাদের অনেক পরিকল্পনা আছে। কিন্তু এই করোনাকালে অনেক পরিকল্পনা আমাদের সংক্ষিপ্ত আকারে করতে হয়েছে। তবে করোনা মহামারী পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমরা আগামীতে সাড়ম্বরে মুজিববর্ষ উদযাপিত করবো বলে আশা রাখি। মুজিববর্ষ উপলক্ষে আমাদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা আয়োজন করার পরিকল্পনা আছে। করোনা মহামারী পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এই মুজিব জন্মশতবর্ষের মধ্যেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার আয়োজন করবো ইনশাআল্লাহ। সেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় সারা বিশ্বের বড় বড় দেশগুলোর বাণিজ্য সংস্থা এবং বিনিয়োগকারীগণ অংশগ্রহণ করবে। এভাবে নানারকম কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপনের লক্ষ্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করছি এবং সেসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি।
কোভিডের সীমাবদ্ধতার কারণে আমাদের অনেক কিছু বাদ দিতে হয়েছে, অনেক কিছু সংক্ষিপ্ত করতে হয়েছে। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি, যাতে এই মুজিববর্ষ উদযাপনের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত না হয়। তবে এই কোভিডে ই-কমার্সটা খুবই ডেভেলপ করেছে। এটা একটা পজিটিভ দিক। ই-কমার্সের এই ডেভলপমেন্ট আমরা ধরে রাখতে চাই এবং আরো বৃদ্ধি করতে চাই। নতুন নতুন উদ্যোক্তাও আমরা সৃষ্টি করতে চাই।
আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তরুণদের উদ্দেশ্যে সবসময়ই বলেন, চাকরি করার পরিবর্তে তোমরা চাকরি দেয়ার চিন্তা করো। তোমরা উদ্যোক্তা হও, উদ্যোক্তা হয়ে নিজে স্বাবলম্বী হও। আত্মনির্ভরশীল হও, আত্মকর্মসংস্থান করো, নিজের পায়ে দাঁড়াও এবং অন্যকে চাকরি দাও। তাই আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় অনুযায়ী তরুণ প্রজন্মের মধ্যে উদ্যোক্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। তৃণমূল পর্যায়ের সাধারণ এসএমই, ওম্যান এন্ট্রারপ্রেনিউর ইত্যাদি নানা ধরনের উদ্যোক্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে আমরা গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। ছোট উদ্যোগকে আমরা উৎসাহিত করছি, যাতে তারা এগিয়ে আসে। কেননা, ছোট উদ্যোগ থেকেই বৃহৎ কর্মযজ্ঞ তৈরি হয়।
বি ক্যাঃ কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও আমদানি-রপ্তানিখাতে যে ক্ষতি হয়েছে, সেই ক্ষতিপূরণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে?
টিপু মুনশিঃ কোভিডের কারণে আমাদের দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের যে ক্ষতি হয়েছে, সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আমরা নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি। যেসব খাতে ক্ষতি হয়েছে, সেসব খাতকে আমরা নানাভাবে কমপেনসেট করেছি। সেসব খাতকে পুনরুজ্জীবিতকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। রেডিমেড গার্মেন্টস, জুট, লেদার, লাইট মেশিনারিজ ইত্যাদি সেক্টরকে আমরা ব্যাকআপ করার চেষ্টা করছি, তারা যাতে পুনরুজ্জীবিত হয়ে এগিয়ে যেতে পারে।
বি ক্যাঃ বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতকরণ, ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বর্তমানে কতটুকু অগ্রসর হয়েছে?
টিপু মুনশিঃ ২০৩০ সালে আমাদের এসডিজি’র লক্ষ্যমাত্রা। আমরা খুব আশা করেছিলাম, সে লক্ষ্যে আমরা ইতোমধ্যে অনেকদূর এগিয়ে যাব, কিন্তু কোভিডের কারণে তা খানিকটা ব্যাহত হয়েছে। তবে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ২০৩০ সালের দুই বছর আগে অর্থাৎ ২০২৮ সালের মধ্যেই আমরা এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হব। এখনও আমরা সেই লক্ষ্যেই আছি, কিন্তু একটুখানি হলেও আমাদের চিন্তিত করেছে কোভিড। তারপরও আমরা প্রচন্ড আশাবাদী যে, ২০৩০ সালের আগেই আমরা এসডিজি’র লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হবো। ২০২১ সালে বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য, বাংলাদেশ বিশ্বের ২৫ টি উন্নত দেশের মধ্যে আসবে, সেই লক্ষ্য অর্জনে আমরা খুব শক্তভাবে দ্রুতগতিতে কাজ করে চলেছি।
বি ক্যাঃ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কি কি সামাজিক সচেতনতা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে?
টিপু মুনশিঃ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের জন্য আমরা খুব স্ট্রংলি কাজ করছি। কিভাবে ভোক্তা অধিকার মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা যায়, কিভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সে লক্ষ্যেও আমরা কাজ করছি। বাজার নিয়ন্ত্রণ করার চেয়ে আরেকটা বড় দায়িত্ব আমরা মনে করি, মানুষের অধিকারটা মানুষকে বুঝিয়ে দেয়া। ভোক্তা হিসেবে অধিকার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলা, তাদেরকে ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে জানানো, ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে শিক্ষিত করে তোলার বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছি; যেন মানুষ বলতে পারে যে, হ্যাঁ ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে আমি জানি, ‘দিস ইজ মাই রাইট’। যখন মানুষ জানবে তার অধিকার, তখন মানুষ সেই অধিকার থেকেই লড়াই করবে। ভোক্তা অধিকারের সেই এডুকেশনও আমরা মানুষকে দিতে চাই।
বি ক্যাঃ পণ্য মজুদ করে, সিন্ডিকেট করে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয় বলে জনসাধারণের অভিযোগ। এরকম ব্যবসায়ীদের মধ্যে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সৃষ্টিতে আপনার মন্ত্রণালয়ের গৃহীত কার্যক্রমসমূহ সম্পর্কে জানতে চাই।
টিপু মুনশিঃ পণ্য মজুদ আসলে আমাদের দেশে একটি বিরাট সমস্যা। আমাদের দেশের কিছু ব্যবসায়ীদের কোনো বিজনেস এথিকস নেই। যখনই এসব ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষের কোনো দুর্বলতার সুযোগ পায়, তখনই তারা সেই সুযোগটা লুফে নেয়। পণ্য মজুদ সিন্ডিকেটকে আমরা শক্তভাবে হ্যান্ডেল করছি। সিস্টেমটাই আমরা এমন করছি, যাতে তারা আর সুযোগটা না পায়। পণ্য সরবরাহ যদি আমরা ব্যাপকভাবে করতে পারি, তাহলে সিন্ডিকেট আর সেই সুযোগটা নিতে পারবে না। সিন্ডিকেটকে চাপ দেয়ার চাইতে তাদের সুযোগ নেয়ার পথ বন্ধ করে দিতে হবে। সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। রাতারাতি তো আর এই সিন্ডিকেটগুলোকে ভাঙ্গা সম্ভব হবে না। তবে আমরা আশা করি, যে প্রক্রিয়ায় আমরা এই সিন্ডিকেটগুলো দমন করার চেষ্টা করছি, তাতে আমরা অবশ্যই সফল হব।
বি ক্যাঃ বিভিন্ন দেশের সাথে বাণিজ্য ঘাটতি পূরণে আপনার মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে জানাবেন কী?
টিপু মুনশিঃ বাণিজ্য ঘাটতি তো আমাদের রয়েছেই। আমাদের এক্সপোর্ট বাড়াতে হবে, সেই চেষ্টা চলছে আমাদের। আমরা শুধুমাত্র রেডিমেড গার্মেন্টসের উপরই ডিপেন্ড করতে চাই না। আমরা দশ-বারোটা আইটেম বাড়াতে চাই। নতুন নতুন ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে চাই, যেগুলো থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আসবে। সেসব দিকেও আমরা নজর রাখছি।
বি ক্যাঃ ব্লু-ইকোনমি বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে বিশিষ্টজনের অভিমত। এবিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো বিশেষ কর্মপরিকল্পনা রয়েছে কী?
টিপু মুনশিঃ প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য নেতৃত্বে আমরা সমুদ্র বিজয় করেছি। ব্লু-ইকোনমির বিশাল একটা ক্ষেত্র আমরা লাভ করেছি। কিন্তু ব্লুু-ইকোনমির প্রকৃত বেনিফিট আমরা এখনো সেভাবে পাইনি। তবে কাজ শুরু হয়েছে। সরকারিভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিভাবে ব্লু-ইকোনমি থেকে লাভবান হওয়া যায়, সেসব বিষয়ে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। শুধুমাত্র মৎস্য আহরণ নয়, তেল-গ্যাস-খনিজসহ ব্লু-ইকোনমির আরো অনেক লাভজনক অর্থনৈতিক ক্ষেত্র আছে, সেসব ক্ষেত্রে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। আশা করি, আমরা ব্লু-ইকোনমির মাধ্যমে আগামীতে এদেশের অর্থনীতিকে আরো শক্তিশালী করতে সক্ষম হব। আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এ ব্যাপারে বিভিন্ন পরিকল্পনার কাগজপত্র তৈরি করছি, যাতে করে আগামী দিনগুলোতে ব্লুু-ইকোনমির সুযোগ-সুবিধা দেশের মানুষকে দিতে পারি। ব্লু-ইকোনমির সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে মানুষ যেন অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হতে পারে, সে লক্ষ্যেই আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছি।
বি ক্যাঃ ব্যবসা-বাণিজ্যে অযুত সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে কান্ট্রি ব্রান্ডিং কেন গুরুত্বপূর্ণ? ব্রান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে কার কি করনীয়?
টিপু মুনশিঃ ‘ব্রান্ডিং বাংলাদেশ’ তাৎপর্যপূর্ণ করার লক্ষ্যে আমাদের কান্ট্রি ব্রান্ডিং হওয়া খুবই প্রয়োজন। আমাদের অনেকগুলো প্রোডাক্টের ব্রান্ডিং করার সুযোগ রয়েছে। সেদিকে আমাদের নজর দেয়া খুব জরুরী। আমরা চাই, আমাদের প্রোডাকশনের স্ট্যান্ডার্ড একটা সার্টেন অবস্থায় নিয়ে যেতে, যেগুলো আমাদের বাংলাদেশের ব্রান্ড হিসেবে পরিচিতি পাবে। এখন যেমন রেডিমেড গার্মেন্টসের ব্রান্ডিংয়ের প্রচুর সুযোগ আছে। কিছুদিন আগে ইন্ডিয়ান হাইকমিশনার এখানে এসেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তার গায়ের শার্টটাও বাংলাদেশের। আসলে ব্রান্ডিং বাংলাদেশের অনেক ক্ষেত্র আছে আমাদের। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্রান্ডিং বাংলাদেশকে সেই সুউন্নত লক্ষ্যে পৌঁছাতে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে।
বি ক্যাঃ বর্তমান সরকার ব্যবসাবান্ধব সরকার। ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকারের কী কী পরিকল্পনা রয়েছে?
টিপু মুনশিঃ আমরা চাই যে, সরকার ব্যবসা করবে না, ব্যবসায়ীরাই ব্যবসা করবে। সরকার তাদেরকে সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা করবে। সরকার ব্যবসা করলে সে ব্যবসায় লাভ হয়না। সরকার ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ তৈরি করবে, যাতে করে ব্যবসায়ীরা ভালোভাবে ব্যবসা করতে পারে। সরকার সাপোর্টিং স্ট্রেংথ হিসেবে কাজ করবে। ব্যবসায়ীরা সরকারের সাপোর্টিং নিয়ে ব্যবসা করবে।
বি ক্যাঃ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোন কোন খাত বেশি সম্ভাবনাময়? কোন্ সেক্টরগুলোতে বিনিয়োগে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা?
টিপু মুনশিঃ বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এবং নতুন নতুন ইনভেস্টমেন্টের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনেক পরিকল্পনা আছে। বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন নতুন ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট তথা এফডিআইয়ের যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, সে সুযোগ কাজে লাগাতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। আশা করা যায়, আগামীতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং নতুন ইনভেস্টমেন্টের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধন সক্ষম হবে।
বি ক্যাঃ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে দেশী বিদেশী বিনিয়োগকারীরা কি কি বিশেষ সুবিধা পাবে? আর অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কি কি পদক্ষেপ নিয়েছে?
টিপু মুনশিঃ বাংলাদেশের একশ’টা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বৈদেশিক বিনিয়োগের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। সারা বিশ্বের বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা এতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। আমরাও তাদেরকে বিনিয়োগ করার জন্য উৎসাহ দিচ্ছি। সারা বিশ্ব থেকে বিনিয়োগকারীদের আহ্বান জানাচ্ছি। একশ’টা অর্থনৈতিক অঞ্চলে আমরা বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের জন্য বিজনেসের সুযোগ-সুবিধা বেটার করার চেষ্টা করছি। আমরা তাদের অনেক রকম সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছি। ডলার বা ফরেন কারেন্সিতে বিনিয়োগ করলে তারা ফরেন কারেন্সিই প্রফিট নিয়ে যেতে পারবে। বিদ্যুৎ সুবিধা, ট্যাক্স হলিডে, এরকম সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা আমরা তাদেরকে দিচ্ছি, যাতে তারা আমাদের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগ করে। তারা যেন বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে সবসময়ই বাংলাদেশকে প্রায়োরিটি দেয়, সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
বি ক্যাঃ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ দেশীয় বাণিজ্যিক প্রসারে এবং ব্র্যান্ডিংয়ের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ভেজাল খাদ্যের জোয়ারে দেশীয় পণ্যগুলোর ওপর মানুষ আস্থা হারাচ্ছে। বিদেশেও অনেক পণ্য ব্যান হয়ে দেশের সুনাম ক্ষুন্ন করছে। এ লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং এর অঙ্গ সংগঠন সমূহ কি কি পদক্ষেপ নিয়েছে?
টিপু মুনশিঃ ভেজাল খাদ্য আমাদের দেশে একটি মারাত্মক সমস্যা। বিএসটিআই এক্ষেত্রে কাজ করে যাচ্ছে। আমরাও কাজ করে যাচ্ছি। ভোক্তা অধিকার ও ভেজাল খাদ্য নিরসনের জন্য আমাদের কমিশন আছে। এসব প্রতিরোধে আমরা সকলে মিলে সম্মিলিতভাবে কাজ করে চলেছি। ভেজাল খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন করে কেউ যাতে জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে না পারে, সে বিষয়ে আমাদের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো সদা তৎপর আছে। আমরা এগুলো নিয়মিত মনিটরিং করছি। ভেজাল খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন করে কেউ যাতে জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে না পারে, সে বিষয়ে আমরা সকলেই তৎপর আছি।
বি ক্যাঃ বর্তমান সময়ের ছাত্র-যুবকদের উদ্দেশ্যে পরামর্শ জানতে চাই।
টিপু মুনশিঃ ছাত্র-যুবকদের উদ্দেশ্যে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথাটাই বলবো যে, চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হতে হবে। আর কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। কঠোর পরিশ্রম ছাড়া কোনোভাবেই সামনে এগোনো যাবে না। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমেই জীবনের সার্থকতা আসবে, সফলতা আসবে। আর নিজে চাকরি করার চেয়ে চাকরি দেয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। তাই ছাত্র-যুবকদের আমি বলব, You shouldn’t be employee, you should be employer. ছাত্র-যুবকদের তাই উদ্যোক্তা হতে হবে এবং কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। তাহলেই জীবনের সাফল্য আসবে।
বি ক্যাঃ সুদীর্ঘ ৩ যুগ/৩৬ বছর থেকে নিয়মিত প্রকাশিত শিক্ষা ও যুব উন্নয়নমূলক একমাত্র নিয়মিত পত্রিকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস’র প্রকাশনা সম্পর্কে আপনার পরামর্শ জানতে চাচ্ছি।
টিপু মুনশিঃ জ্ঞানভিত্তিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ এবং আলোকিত জাতি গঠনের জন্য নিবেদিত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক ও সংশ্লিষ্ট সকলকে আমি সাধুবাদ জানাই। সুদীর্ঘ ৩৯ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকা জ্ঞানভিত্তিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ এবং আলোকিত জাতি গঠনের জন্য নিবেদিত হয়ে কাজ করছে। তাই আমি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার সংশ্লিষ্ট সকলকে কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ জানাই। এভাবে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের এদেশ এগিয়ে যাবে। আমি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার উত্তরোত্তর সাফল্য ও সমৃদ্ধি কামনা করি।