বিশেষ খবর



Upcoming Event

অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত এর বর্ণাঢ্য শিক্ষাজীবন -৩

ক্যাম্পাস ডেস্ক প্রিয় মানুষের মুখোমুখি
img

বিদেশে উচ্চশিক্ষা

অক্সফোর্ডে রোডস স্কলারশিপের জন্য আবেদন করেছিলাম আমি এবং সেজন্য যখন লাহোরে ইন্টারভিউ দেবার আমন্ত্রণ পাই, তখনই পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেবার নিযুক্তিও পাই। ইন্টারভিউয়ের জন্য গিয়েওছিলাম, কিন্তু রোডস ফাউন্ডেশনের দায়িত্বে নিযুক্ত Justice Ortcheson জানালেন যে সিএসপি হিসেবে অক্সফোর্ডে অথবা ক্যামব্রিজে যেতে হবে। সুতরাং তিনি আর আমার আবেদন মঞ্জুর করবেন না। এক বছর পরে তাই দেশে প্রশিক্ষণ সম্পূর্ণ করে আমি অক্সফোর্ডে যাই ১৯৫৭ সালে এবং আমার কলেজ ছিল বেলিওল কলেজ।

এজন্য ঢাকা থেকে যাই করাচি, সেখান থেকে লন্ডনে। এই বিদেশ যাত্রাটি খুব সুখকর ছিল না। আমরা দলবেঁধে প্রায় ২০ জন করাচিতে গেলাম, অক্সফোর্ড এবং ক্যামব্রিজে উড়াল দেবার জন্য। যেদিন আমার দলের যাত্রা ছিল, সেদিন অকস্মাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ি আমি। সবাই মিলে ঠিক করে যে, এই অবস্থায় আমার ভ্রমণ ঠিক হবে না এবং আমাকে নিকটস্থ বিমান যাত্রীদের একটি হোটেলে স্থানান্তরের ব্যবস্থা হলো। করাচিতে আমার এক চাচা এবং ফুফা দুজনকেই খবর দেয়া হলো। তাঁদের মধ্যে একজন তখনই আমাকে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ ব্রিটিশ কাউন্সিল তাঁকে জানালেন যে, আমাকে ইতোমধ্যে ডাক্তার পরীক্ষা করেছেন এবং তাদের ধারণা যে, আগামীকাল আমি ভ্রমণ করতে সক্ষম হব। তারা আমাকে বললেন যে আমার যদি যেতে দেরি না হয়, তাহলে লন্ডন এবং অক্সফোর্ডের ভ্রমণসূচি খুব বিঘিœত হবে না।

আশ্চর্যের বিষয়, রাতেই আমার শারীরিক অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে এলো। সকালে আমার মনে হলো যে, আমি সেরে উঠেছি এবং বেশ সুস্থবোধ করতে লাগলাম। তবে জ্বর খুব বেশি ছিল, সেজন্য কিছুটা কাহিল ছিলাম। তারপরও আমি ঠিক করলাম যে, ঐদিন রাতেই লন্ডনের জন্য বিমান আরোহন করব।

সে সময় বিমানে ভ্রমণ এখনকার মতো এত আরামদায়ক ছিল না। Journey হতো খুব tedious  এবং কিছুটা Uncomfortable। দূরপাল্লার Journey করতে যাত্রাবিরতি হতো অনেকবার। ফলে যাত্রাটি বেশ boring মনে হতো। বিমানকে রাস্তায় অনেকবার থামতে হতো ফুয়েল নেবার জন্য। করাচিতে প্লেনে চড়ার পর আমার প্রথম যাত্রাবিরতিটি হলো বাহারাইনে। সে সময় আজকালকার মতো বিশাল বিশাল বিমানবন্দর ছিল না। অনেক বিমানবন্দরের একমাত্র স্থাপনা ছিল সাময়িক ব্যারাক টাইপের ঘর। যেখানেই বিমান থামতো, সেখানেই যাত্রীদের নামতে হতো। কারণ, রিফুয়েলিংয়ের সময় কর্তৃপক্ষ বিমানের কোনো প্যাসেঞ্জারকে বিমানে থাকতে দিত না। যাত্রাবিরতি যে জায়গায়ই হতো, সেখানেই বিমান কর্তৃপক্ষ কিছু না কিছু খাওয়াবার ব্যবস্থা রাখতো। বাহরাইনের পরে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে হলো আরেক যাত্রাবিরতি। তারপরের যাত্রাবিরতি হলো লেবাননের রাজধানী বৈরুতে। আমি খুব বেশি সুস্থ ছিলাম না বলে বার বার যাত্রাবিরতি আমার বিরক্তির উদ্রেক করে। লেবানন থেকে সম্ভবত বিমানটি থামলো এথেন্সে। তারপরে গেলো প্যারিসে। ইতোমধ্যে উষ্ণ আবহাওয়ার পরিবর্তে শীতল আবহাওয়ার এলাকায় পৌঁছে যাওয়ায় আমার মনে হলো যে, আবহাওয়া পরিবর্তনে আমি অনেক চাঙ্গা হয়ে গেছি।  I was feeling better. In  fact my health condition improved.  প্যারিস থেকে বিমান যখন লন্ডনে পৌঁছালো, তখন রাত প্রায় ৯টা। ব্রিটিশ কাউন্সিলের একজন প্রতিনিধি এবং পাকিস্তান হাই-কমিশনের একজন কর্মচারী আমাকে নিতে এসেছিলেন। আমি অসুস্থ; তাই তারা বিশেষ ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। একজন ডাক্তার এবং একটি হাসপাতালের গাড়ি আমার জন্য উপস্থিত ছিল। কিন্তু আমার অবস্থা দেখে তারা আর মেডিক্যাল পরীক্ষার কোনো প্রয়োজন বোধ করলেন না এবং স্ট্রেচারটাও আর ব্যবহার করার প্রয়োজন হলো না।

লন্ডনের ট্যাক্সি সে যুগে যেমন ছিল, এখনও তেমনটি আছে। যাত্রীদের জন্য বেশ আরামদায়ক এবং মালপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য বেশ ভালো ব্যবস্থা। বস্তুতপক্ষে এটি ছিল আমার প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। এর আগে বিদেশ বলতে কলকাতা গিয়েছিলাম ১৯৫২ সালে এবং তখন কোনো ভিসার প্রয়োজন হয়নি। লন্ডনে আমাকে একটি হোটেলে নিয়ে যাওয়া হলো এবং বলা হলো যে, সকালে একজন গাইড আসবে এবং আমার অক্সফোর্ড যাত্রার ব্যবস্থা করে দেবে। সকালে একজন এসে আমাকে পাকিস্তান হাই-কমিশনে নিয়ে গেলেন।

ওখানকার পরিবেশটা খুব ভালো লাগলো আমার, শীত শীত ভাব। একটা কোট চাপিয়ে হেঁটেই গেলাম হাই-কমিশন অফিসে। এডুকেশন এটাশে কিছু কাগজপত্র দিলেন। তখন হাই-কমিশনার ছিলেন একরাম উল্লাহ, পাকিস্তানের প্রথম Foreign Secretary; তিনি ছিলেন ICS অফিসার। লন্ডনে হাই-কমিশনার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।

হাই-কমিশনে গেলে আমাকে বেশ কিছু প্রশ্ন করা হলো। যিনি প্রশ্ন করলেন তিনি আসলে শিক্ষক, যাচাই-বাছাই করে নিচ্ছিলেন। আমাকে বলা হলো, তোমাদের দেশের পড়ার সাথে এখানকার পড়ার মিল নেই; তোমার জন্য সেভাবেই কোর্স ডিজাইন করা হবে, যা তোমার Interest এর সাথে মেলে।

হাই-কমিশনার সাহেব আমাদের প্রথম আসা উপলক্ষে সবাইকে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানালেন। হোটেলে যারা ছিলেন, তারা ব্রিটেনের নানান কলেজের ছাত্র; আমরা অক্সফোর্ডের ১১ জন (পাকিস্তানি-বাংলাদেশি)। ডিনার শেষে সিলেটেরই লোক বন্ধুবর সালাহুদ্দিনকে পেলাম আমি। সেও অক্সফোর্ড যাবে এবং আমরা দুজনই এখানে একটি বাড়িতে থাকব বলে জানা গেল।

সেদিন বিকেলেই আমাকে অক্সফোর্ড যেতে হলো। কারণ হাই-কমিশন থেকে বলা হলো, সেদিন রাতে আমার কলেজে নবীনবরণ অনুষ্ঠান আছে এবং তাতে যোগ দিলে ভালো হবে। আমি অক্সফোর্ড পৌঁছলে সেইন্ট এনটনি কলেজের পিটার হেইলি আমাকে স্বাগত জানালেন এবং একটি ট্যাক্সিতে বসিয়ে দিয়ে বেলিওল কলেজে যেতে বললেন। সেখানে স্বাগতিক নৈশভোজ যতটা আকর্ষণীয় ছিল, তারচেবেশি আকর্ষণীয় ছিল বিভিন্ন ছাত্র প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সদস্য সংগ্রহের উদ্যোগ। যেমন বোট ক্লাব বা টেনিস ক্লাব তাদের সদস্য খুঁজছিল। বিবেচনা করে কোনো ক্লাবেরই সদস্য হলাম না আমি। নৈশভোজ শেষে ট্যাক্সিযোগে ১০৩ নং উইন্ড মিল স্ট্রীটে হাজির হলাম। সেখানে আমার আরও ২ জন সহকর্মীসহ সকলের থাকবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের বাড়িওয়ালি নির্দিষ্ট কামরায় আমাকে নিয়ে গেলেন এবং জানালেন, তিনি ব্রেকফাস্ট খাওয়াবেন। এই বাড়িতে আমি মাসখানেক ছিলাম। আমি কলেজে থাকতে চেয়েছিলাম, কলেজ আসলেই ছাত্রাবাস। আমাকে  জানানো হলো যে, একটি কামরা খালি আছে। কারণ যাকে এই কামরাটি বরাদ্দ করা হয়েছিল, তিনি এই কামরাটি নিচ্ছেন না। একইসঙ্গে বলা হলো যে, আমাকে একটু বেশি ভাড়া দিতে হবে। আমি সাগ্রহে প্রস্তাবটি গ্রহণ করলাম এবং কলেজে চলে গেলাম।

কয়েকদিন পরেই আমার পড়াশোনা শুরু হলো। অক্সফোর্ডের পড়াশুনার মূল বিষয়টি হলো একজন শিক্ষকের সঙ্গে একজন বা কয়েকজন ছাত্রের নিয়মিতভাবে জ্ঞানচর্চার আসরে সমবেত হওয়া। এই ব্যবস্থা টিউটোরিয়াল পদ্ধতিতে শিক্ষাদান বলে পরিচিত। পড়াশুনার সময় হলো অক্টোবর থেকে শুরু করে জুন পর্যন্ত এবং এই সময়টি ৩ মেয়াদে বিভক্ত। প্রথম টার্মে আমার টিউটর হলেন দুজন। অর্থনীতিতে পল স্ট্রিটেন এবং রাজনীতিতে কলিন লীস। প্রতি সপ্তায় তাদের সঙ্গে স্বতন্ত্রভাবে বৈঠক করতে হতো।  টিউটোরিয়াল ক্লাসে আমি একাই ছিলাম। কোনো কোনো টিউটোরিয়াল ক্লাসে ৪/৫ জন ছাত্র একসঙ্গে জ্ঞানচর্চা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয়ে লেকচার হয় এবং যেকোনো ছাত্র তার ইচ্ছামতো যেকোনো লেকচার শুনতে যেতে পারে। এছাড়াও অনেকগুলো সেমিনারের ব্যবস্থাও আছে। যেখানে কোন্্ ছাত্র তাতে অংশ নিতে পারে সেটি সেমিনার যিনি পরিচালনা করেন সেই শিক্ষক ঠিক করে দেন। আমার প্রথম টিউটোরিয়াল আসরটি হলো অর্থনীতির পল স্ট্রিটেনের সঙ্গে। পল স্ট্রিটেন বেশ নামকরা অর্থনীতিবিদ। অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজের তিনি শিক্ষক ছিলেন প্রায় ১৬ বছর (১৯৪৮-১৯৬৪)। ইউএনডিপি ১৯৯০ সালে হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট নামে যে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রণয়ন করা শুরু করে, তাতে তিনি সবিশেষ অবদান রাখেন। এই প্রতিবেদনটি প্রকাশনার দায়িত্বে ছিলেন আমার বন্ধু এবং সহকর্মী পাকিস্তানের এক সময়ের পরিকল্পনা মন্ত্রী মরহুম মাহবুবুল হক। পল বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ছিলেন এবং ইউনেস্কোর সঙ্গেও অনেক কাজ করেন। তিনি প্রথম দিনে আমাকে বললেন যে, তুমিতো অর্থনীতিতে তেমন পড়াশুনা করনি। সুতরাং আমরা একেবারে মৌলিক বিষয় নিয়ে পড়াশুনা শুরু করতে চাই। তিনি অনেকক্ষণ জাতীয় আয় কী করে হিসাব করা হয়, সে সম্বন্ধে আলোচনা করলেন এবং প্রায় ঘন্টার বেশি সময় আলোচনার শেষে বললেন যে, তুমি জাতীয় আয় কী করে হিসাব করা হয়, সে বিষয়ে একটি প্রবন্ধ রচনা করে আগামী সপ্তাহে আমার সঙ্গে আলোচনা করবে। একইসঙ্গে তিনি এ সম্বন্ধে অধিকতর জানবার জন্য কিছু বই এবং প্রবন্ধের ফর্দ দিলেন। প্রায় ৬ মাস তিনি এইভাবে আমাকে অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান দান করেন। তিনি খুবই ভালো শিক্ষক ছিলেন এবং তার জানা শোনার পরিধিও ছিল বিস্তৃত।

কলিন লীস সদ্য নিয়োজিত একজন শিক্ষক ছিলেন। ভালো ছাত্র হিসেবে তার সুনাম ছিল এবং তিনি ডিগ্রি নেয়ার পরেই অধ্যাপনা শুরু করেন। তিনি আমার চেয়ে হয়ত ৪/৫ বছরের বড় ছিলেন। তার স্ত্রীও একজন মেধাবী ছাত্রী ছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়েই তাদের পরিচয় হয়। তিনি প্রথম টিউটোরিয়ালে আমাকে বললেন যে, তুমিতো পলিটিক্যাল সাইন্স মোটামুটিভাবে পড়েছ। তিনি প্রশ্ন করলেন যে, এ ব্যাপারে আমি কী জানি। আমি জানালাম যে, সিভিল সার্ভিসে যোগ দেয়ার পর আমাকে রাজনীতি বিষয়ে কিছু পড়াশুনা করতে হয়েছে এবং পাকিস্তান, ভারত, ব্রিটেন, আমেরিকা ও জাপানের রাজনীতি ও প্রশাসন সম্বন্ধে কিছু জ্ঞান আহরণ করতে হয়েছে। তিনি আমাকে ২/৪টা মৌলিক গ্রন্থ নাড়াচাড়া করতে উপদেশ দিলেন এবং প্রথম প্রবন্ধটি রাজনৈতিক দলের ওপর লিখতে বললেন। আমার ধারণা হলো যে, অক্সফোর্ডে পড়াশুনার ভালো-মন্দ অনেকটা নির্ভর করে টিউটর-ভাগ্যের ওপর। ভালো টিউটর পেলে জ্ঞানচর্চা ভালো হয়; ফাঁকিবাজ বা নীরস শিক্ষক পেলে তা দুর্বল হয়।

আমি দুই টার্ম অর্থনীতি এবং রাজনীতি নিয়ে পড়াশুনা করি এবং তৃতীয় টার্মে আইন সম্বন্ধে একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা করি। অর্থনীতি এবং রাজনীতি বিষয়ে এক ধরনের পরীক্ষাও আমাকে দিতে হয়। তৃতীয় টার্মে আমি ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বিচার ব্যবস্থার বিকাশ সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ রচনা করি। এই প্রবন্ধ রচনায় আমার টিউটর ছিলেন নিউজিল্যান্ডের অধিবাসী বেলিওলের শিক্ষক বিল হ্যারিস।

বিলেতে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট শিক্ষা পদ্ধতি খুবই উত্তম। যেসব বিদ্যাপীঠে পুরোপুরি টিউটোরিয়াল ব্যবস্থা নেই, সেখানেও পড়াশুনা খুব ভালো হয়। কিন্তু পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শিক্ষা ব্যবস্থা ব্রিটেনের চেয়ে সম্ভবত আমেরিকায় অপেক্ষাকৃত ভালো বলে আমার মনে হয়। ব্রিটেনের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট পড়াশুনাটা খুবই বিশেষায়িত। সেখানে একটা নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে গভীর জ্ঞান লাভ করা হয়। কিন্তু এই নির্দিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে তেমন জ্ঞান লাভ হয় না। আমেরিকার ব্যবস্থাটি সেক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত ভালো।

ছাত্রাবাসে যারা থাকতেন, তাদের ঠিকানা ছিল স্টেয়ারকেস হিসেবে। যেমন আমার নিজের কামরাটি ছিল স্টেয়ারকেস ১৯ নম্বরে। এই  স্টেয়ারকেসে আরেকজন ছাত্র বসবাস করতো। এছাড়া বাকি সব কামরাতেই শিক্ষকদের অবস্থান ছিল। শিক্ষকরা তাঁদের কামরায় টিউটোরিয়াল পদ্ধতিতে পাঠদান করতেন এবং সেখানেই তাঁদের পড়াশুনা চালিয়ে যেতেন।

ছাত্রাবাসে কতগুলো ব্যবস্থা ছিল, যা অত্যন্ত সাবধানে মানতে হতো। সকালবেলা স্কাউট এসে ঘুম ভাঙিয়ে দিত। নাস্তা করার জন্য ডাইনিং হল নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খোলা থাকতো। দুপুরে ডাইনিং হলে খাবার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সেই খাবার কারো ইচ্ছা হলে খেতো এবং তার জন্য কুপন দিয়ে দাম মেটাতে হতো। প্রতি সপ্তায় কয়েকটি নৈশভোজে হাজির থাকা বাধ্যতামূলক ছিল এবং এজন্য টার্মের শুরুতেই যে ফিস দিতে হতো তাতে নৈশভোজের দাম অন্তর্ভুক্ত থাকতো। ডর্মের কমন রুমটি ছিল খুবই আকর্ষণীয়। সেখানে সংবাদপত্র বা কিছু জার্নাল ছাড়াও বিকেলের চায়ের ব্যবস্থা ছিল এবং সেখানে দলে দলে আড্ডা দেয়াটা ছিল সবচেয়ে উত্তম বিষয়। এখানেই ব্যক্তিগত পরিচয়ের বলয় সৃষ্টি হতো এবং ছাত্রদের মধ্যে ভাবের ও চিন্তার আদান-প্রদানের সুযোগ মিলতো।

প্রতিটি কলেজের একজন শীর্ষ ব্যক্তি ছিলেন মাস্টার অথবা ওয়ার্ডেন। বেলিওল কলেজের একটি এনেক্স ছিল এবং সেই এনেক্সের প্রভোস্ট ছিলেন একজন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক রাসেল মেইগ। তিনি ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন এবং অসংখ্য ছাত্রের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, তিনি ছাত্রদেরকে সবিশেষ লাই দিতেন এবং এজন্য অনেকেই তাঁকে অপছন্দ করতো। তাঁর সঙ্গে আমার মধুর সম্পর্ক স্থাপিত হয়। তিনি আইন বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান রাখতেন এবং এই বিষয় নিয়েই তাঁর সঙ্গে আলোচনা জমতো।

ইতিহাসের বেশ নামকরা একজন প-িত মরিস পইক। আমাদের ১৯ নম্বর সিঁড়ির আরেকজন অধিবাসী ছিলেন। তার সঙ্গে আমার সংযোগের বিষয়টি না বললেই নয়। প-িত হয়তো তিনি ছিলেন কিন্তু মোটেই ভদ্রলোক ছিলেন না। তিনি বেশ বৃদ্ধ ছিলেন এবং তাঁর কামরাটি মোটামুটিভাবে একটি গ্রন্থাগারের মতো ছিল। একদিন দুপুরে কলেজের ডিন আমাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি জানালেন যে অভিযোগ হয়েছে যে, আমি গোসল করতে যেয়ে বাথটাবে বেশি পানি নিয়েছি এবং সেই পানি উথলে পড়ে অথবা পাইপ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে অধ্যাপক পইকের গ্রন্থাগারের ক্ষতিসাধন করেছে। সুতরাং তিনি আমাকে বললেন যে, এজন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ আমার কাছ থেকে জরিমানা আদায় করবেন এবং আমি পইক সাহেবের কাছে গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করব। আমি নালিশটি ঠিক বুঝতে পারলাম না। কারণ আমি খুব সাবধানেই বাথটাবে পানি ব্যবহার করেছি এবং পানির কোনো ওভারফ্লো আমার নজরে পড়েনি। ডিন সাহেব জানালেন যে, বিষয়টি তদন্ত করে দেখা যাবে। কিন্তু আপাতত বয়ঃজ্যেষ্ঠ অধ্যাপক পইক সাহেবের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। আমি পইক সাহেবের কামরায় গেলাম। তাঁর ব্যবহার ছিল খুবই অভদ্র এবং অশোভন এবং তিনি শুধু অভিযোগই করলেন। আমার কথা কিছুই শুনলেন না। আমি গভীর অসন্তোষ নিয়ে সে কামরা থেকে বের হয়ে এলাম। কয়েকদিন পরে আমাকে ডিন সাহেব আবার ডাকলেন এবং জানালেন যে, আমার বিরুদ্ধে অযথা অভিযোগ করা হয়েছে। সেজন্য আমি যেন কিছু মনে না করি এবং আমাকে কোনো জরিমানা দিতে হবে না। তিনি জানালেন যে সেদিনও পইক সাহেবের গ্রন্থাগারে বন্যা হয়েছে এবং অনুসন্ধানে দেখা গেল যে, তার কামরায় পানি প্রবাহের পাইপটি ফেটে গেছে। অধ্যাপক পইক এ ব্যাপারে কোনো মাফও চাইলেন না, অনুশোচনাও প্রকাশ করলেন না।

ভালোমন্দের মিশেল নিয়েই আমার বিদ্যার্জন এগিয়ে চলে বিদেশে। অক্সফোর্ডে আমার খুবই পছন্দের জায়গা ছিল বোডলিয়েন লাইব্রেরি। ওপেন শেলফ থেকে সেখানে নিজের ইচ্ছামতো বই পড়া যেত এবং ঘুম লাগলে কিছু সময়ের জন্য শ্রান্তিও নেয়া যেত। এছাড়া অক্সফোর্ডের বসন্তে নৌকা বাইচে অংশ নেয়া, টেনিস ও স্কোয়াশ খেলা বা পার্কে বিচরণ করা খুবই আনন্দের বিষয় ছিল। মাঝে মাঝে দল বেঁধে নিকটস্থ এলাকা যেমন চার্চিলের বাড়ি, শেকসপীয়রের জন্মস্থান স্ট্রাটফোর্ড অন আভন, ম্যানচেস্টারে ক্যাডবেরি চকোলেট ফ্যাক্টরিতে ভ্রমণেরও সুযোগ হতো। লন্ডনে আসা-যাওয়া বা ক্যামব্রিজে যাওয়াও মাঝে মাঝে ছিল অবসর বিনোদনের উপায়। অক্সফোর্ডে তখন একটি উপমহাদেশীয় রেঁস্তোরা ছিল, যা আমার কলেজের সামনেই অবস্থিত ছিল। সেখানে প্রায় সব কর্মচারী ছিলেন সিলেটের লোক। প্রায়ই তারা আমাকে দাওয়াত করে খাওয়াতেন। তাদের চিঠি লেখা ও পড়া, পোস্ট অফিসের মাধ্যমে টাকা প্রেরণ এই সব কাজে তারা সহায়তা চাইতেন এবং আমি সানন্দে সেই সহায়তা করতাম।                          

 (সমাপ্ত)


বিশ্ববিদ্যালয় কম্পাস পত্রিকার সংখ্যা সমূহ

আরো সংবাদ

শিশু ক্যাম্পাস

বিশেষ সংখ্যা

img img img