বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন যদি হয় স্বাধীনতা; তাহলে এ কথা মানতেই হবে, এই অর্জনের সারথি ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অথচ ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে বাঙালি হলো নেতৃত্বঘাতী! এর পরের বহুদিন তো অন্ধকারের ইতিহাস! দেশ এগিয়ে যায় কতিপয় অক্ষুন্ন নীতির ভিত্তিতে। যেমন- স্বরাষ্ট্রনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, জাতীয় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং অবশ্যই শিক্ষানীতি। সে কারণেই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপদ্রষ্টা এই মহান পুরুষ বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পরই অন্যান্য জাতীয় নীতিমালার সঙ্গে শিক্ষানীতি প্রণয়নের যে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন, তার ফলেই গঠিত হয় ১৯৭২ সালের কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন। উন্নত বিশ্বের বহু দেশেই রাষ্ট্র ও জননেতাদের মতামতসংবলিত লিটারেচার থাকে। লিখিতভাবে না হলেও নেতাদের প্রদত্ত বক্তৃতা-বিবৃতি থেকে মূল ধারণা গ্রহণ করে এগুলো তৈরি করা হয়। যেকোনো কারণেই হোক না কেন, আমাদের এগুলো একেবারেই নেই। বঙ্গবন্ধুর লিখিত লিটারেচার যেহেতু কম, সেহেতু শিক্ষাবিষয়ক তাঁর নিজস্ব মতামত সুশৃঙ্খল ও সম্পূর্ণভাবে একত্রে কোথাও পাওয়া যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাঁর প্রদত্ত বক্তৃতাগুলো গবেষণা করলে অনেক নতুন তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু সে রকমের গবেষণারও অভাব। বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায় ও প্রত্যক্ষ অনুমোদনে বাংলাদেশে প্রথম যে শিক্ষানীতি প্রণীত হয় তার আলোকেই জাতির জনকের শিক্ষাচিন্তা অনেকটাই বিচার্য।
১৯৪৭ সালের মধ্য-আগস্টে সৃষ্ট পাকিস্তান এবং তারপর দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় অর্জিত বাংলাদেশের এ যাবৎকাল সুদীর্ঘ এই সময় পরিক্রমার তুলনায়, বঙ্গবন্ধু সরকারের এই শিক্ষাসুপারিশ অধিকতর বৈজ্ঞানিক, আধুনিক ও সময়োপযোগী। স্বীকার করতেই হবে, পাকিস্তানি ঔপনিবেশিককালের তুলনায় বরং ব্রিটিশদের শাসনামলে আমাদের শিক্ষানীতির একটি বিশেষ মানদন্ড ছিল এবং তা হলো অসাম্প্রদায়িকতা। পাকিস্তান শাসিত বাংলাদেশের ২৪ বছর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে জব্দ করে ইসলামী পাকিস্তান ‘কায়েমে’র লক্ষ্যে যে মধ্যযুগীয় শিক্ষাব্যবস্থার গোড়াপত্তন করা হয়, তাতে ইমান, আদব, তমিজের কথা ছিল বটে; কিন্তু ‘মনুষ্যত্ব’ অর্জনের কথা ছিল না। তাছাড়া ইমান, আদব, তমিজ- এই বিমূর্ত ও অধরা প্রতীতিগুলোর কোনো ব্যাখ্যাও দেয়া হয়নি। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে যেহেতু প্রাপ্ত পাকিস্তানের স্বাধীনতা, সেহেতু ধর্মের নামে অন্ধ ‘জোশে’ সব কিছুই ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে সে সময় এবং পাকিস্তান শাসিত বাংলাদেশের ২৪ বছরে আসলে ধর্মের ব্যবহার বা অপব্যবহার করে সৃষ্টি করার চেষ্টা হয়েছে মোহগ্রস্ত অর্ধশিক্ষিত এক জনগোষ্ঠী। কিন্তু অসৎ পরিকল্পনা প্রথমেই বাধা পায় ১৯৪৮ সালে বাঙালির ভাষা-ভাবনায়, পরে ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে। তথাপি রাষ্ট্রক্ষমতা যেহেতু তাদের হাতে, একনায়কতন্ত্রী মনোভাব নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত অবধি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের অনুগত সেবাদাস তৈরির শিক্ষা বাঙালির ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ঘটে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র- তৎকালে আধুনিক এই চারটি মূলনীতি গ্রহণ করে বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করে ভবিষ্যতের দিকে। ১৯৭২ সালের কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টও এর আলোকে তৈরি। স্বীকার করতেই হবে, সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের মানসে বঙ্গবন্ধু এগিয়ে যাওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন। এ লক্ষ্যে তিনি অনেক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে এক বক্তৃতায় নিজের নেয়া পদক্ষেপগুলোর উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু এক বক্তৃতায় বলেন, ‘এই সমস্ত পদক্ষেপগুলো নেয়া হয়েছে শান্তিপূর্ণভাবে সমাজতন্ত্র কায়েমের উদ্দেশ্যে।’ সমাজতন্ত্রের আগে ‘শান্তিপূর্ণ’ শব্দের ব্যবহার অতীব তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর শিক্ষানীতিতেও ‘শান্তিপূর্ণভাবে সমাজতন্ত্র’ -এর দিকে ধাবিত হওয়ার ব্যাপার ছিল। কিন্তু এ কথাও সত্য যে বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্র মার্ক্সীয় সমাজতন্ত্র নয়। দুনিয়া কাঁপানো দর্শন মার্ক্সের সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা তাঁর অধীত বিদ্যার মধ্যে ছিল না বা তিনি সে দীক্ষা নেননি। লেনিনীয় নীতিও তিনি রপ্ত করেননি। প্রয়োজন নেই। সবাইকে মার্ক্সবাদী হতেই হবে- এমন কথা কেন! মার্ক্সের দর্শনের মূলকথা যদি হয় শোষণমুক্তি এবং সর্বত্র সমতা প্রতিষ্ঠা- সেই শোষণমুক্তি ও সমতা প্রতিষ্ঠা নিশ্চিতকরণটাই তো জরুরি। বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্র বলতে বুঝতেন বৈষম্যমুক্তি, সব মানুষের সমান অধিকার, বিজ্ঞানভিত্তিক সর্বজনীন শিক্ষা, শিক্ষা শেষে কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তা আর অসীম দেশপ্রেম। সমাজতন্ত্র বলতে বঙ্গবন্ধু যা বুঝতেন, তিনি তা তখন একটি মাত্র ধ্রুপদী বাক্যে প্রকাশ করেছেন- ‘বিশ্ব আজ দুইভাবে বিভক্ত- শোষক ও শোষিত, আমি শোষিতের পক্ষে।’ বিশাল এই নিপীড়িত জনগণের পক্ষ নিয়ে শোষণমুক্তিই ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের সব চিন্তা ও কর্মের মূলে। তাঁর শিক্ষাচিন্তাকে এ থেকে বাইরে নিয়ে যাওয়া যায় না।
কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, দেশপ্রেম ও সুনাগরিকত্ব, মানবতা ও বিশ্বনাগরিকত্ব, নৈতিক মূল্যবোধ, সামাজিক রূপ-রূপান্তরের হাতিয়াররূপে শিক্ষা, প্রয়োগমুখী অর্থনৈতিক অগ্রগতির অনুকূলে শিক্ষা, কায়িক শ্রমের মর্যাদাদান, নেতৃত্ব ও সংগঠনের গুণাবলি, সৃজনশীলতা ও গবেষণা এবং সামাজিক অগ্রগতি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক প্রগতি। এখানে ‘প্রয়োগ অর্থনৈতিক অগ্রগতির অনুকূলে শিক্ষা’ কথাটি সর্বাপেক্ষ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। অর্থনীতির পরিবর্তনীয় যুগে, বাজার বা মুক্ত অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা ভিন্ন, যেখানে আজ অস্তিত্ব রক্ষা করা দায়, সেখানে ১৯৭২ সালের শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে যে ইতিবাচক অগ্রবর্তীতার ইঙ্গিত আছে তা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কায়িক শ্রমের মর্যাদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার যে গুরুত্ব সেদিন দেয়া হয়েছিল, তা অব্যাহত থাকলে আজ এই কম্পিউটার বা ইন্টারনেটের যুগে আমরা নিশ্চিত আরো বেশি অর্থনৈতিক সাফল্য বহন করতে পারতাম এবং জাতি হিসেবেও অধিকতর স্বাবলম্বী হওয়া যেত।
শিক্ষা হচ্ছে সামাজিক রূপান্তরের একটি সুষম হাতিয়ার। শিক্ষা তখনই শক্তিতে পরিণত হয় যখন শিক্ষাকে সামষ্টিক প্রয়োজনে লাগানো হয়। এর সঠিক ব্যবহারে প্রথাগত কথিত আচার-শুদ্ধতা উবে যায় এবং পরিবর্তিত হয় সমাজের আন্তকাঠামো। কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল ‘সব নাগরিকের মেধা ও প্রবণতা অনুযায়ী শিক্ষা’ প্রদানের বিষয়টি। শিক্ষার্থীর মেধা ও প্রবণতা অনুসারে অর্থাৎ কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে যেমনটি বলা হয়েছিল, সেভাবে শুরুটা করা গেলে আধুনিক বিশ্বে নিশ্চয়ই এত দিনে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয় ও প্রতিষ্ঠা সমুন্নত করা যেত। কিন্তু তা করা সম্ভব হয়নি। তাই আজও চলছে মেধার অপচয়। এই অপচয়ের অন্যতম কারণ দেশে আজও বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত আছে। ফলে তীক্ষè মেধাসম্পন্ন হলেও যদি আর্থিক দৈন্য কাবু করে ফেলে, তাহলে তাকে কেরানিই হতে হবে। অথচ বিত্তধারীর মধ্যম বা তার চেয়েও দুর্বল মেধার সন্তানরা আজ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুধু অর্থের উপঢৌকন দিয়ে ডাক্তার বা প্রকৌশলী হওয়ার পড়া পড়ছে।
১৯৭২ সালে গঠিত শিক্ষা কমিশন শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণের ওপর জোর দিয়েছিল। প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি প্রি-ক্যাডেট, ক্যাডেট শ্রেণির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যে সামাজিক বৈষম্যের সৃষ্টি করে তা গোটা জাতিকে বিভক্ত করে দেয়। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন শিক্ষাকে জাতীয়করণ করা। যদি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় প্রত্যেক নাগরিককে মেধা ও প্রবণতা অনুযায়ী শিক্ষা প্রদানের নিশ্চয়তা থাকে, তাহলে আর যা-ই হোক জাতিকে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয় না। এই লক্ষ্যে কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন ধাপে ধাপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারের আওতায় নিয়ে আসার প্রস্তাব দিয়েছিল, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ ও রাষ্ট্রায়ত্তকরণের মাধ্যমে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বর্তমান শিক্ষক, শিক্ষকদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষার উপকরণ এবং শিক্ষাদানের মানের যে বিশাল বৈষম্য বিদ্যমান, তা দূর করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। যত দিন সম্পূর্ণ জাতীয়করণ ও রাষ্ট্রীয়করণ সম্ভব না হয় তত দিন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষামানের উন্নয়নের জন্য ব্যাপক রাষ্ট্রীয় সাহায্যের ব্যবস্থা করতে হবে।’ অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, ১৯৭৫ সালের পর যে সরকারগুলো ক্ষমতায় এসেছে, শিক্ষানীতিতে এই বৈষম্য কমানোর তেমন কোনো উদ্যোগই তারা গ্রহণ করেনি। বরং কোনো কোনো সরকার মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা জোরদার, কোনো কোনো সরকার ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠায় অতি উৎসাহ, কোনো কোনো সরকার ইংরেজি ভাষায় সাধারণ শিক্ষা চালুর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আধুনিক শিক্ষা ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যোজন দূরত্বে থাকা কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থাও এখন দেশে আছে এবং তার প্রতি অনেকেই আকৃষ্ট হচ্ছে। অবস্থাটা মোটেই স্বস্তির নয়, আতঙ্কের! মুক্তিযুদ্ধের পর আজ চার দশকেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হলো সত্যি; কিন্তু এই ‘বিশাল বৈষম্য’ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বিপ্লবী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাচ্ছে না। ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে চেষ্টা আছে; কিন্তু প্রতিবন্ধকতা যারা সৃষ্টি করতে চায়, তাদের সংখ্যাও অনেক। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা আজও প্রয়োজন ও চাহিদা অনুপাতে বেতন পান না, ছাত্ররা গাছতলাতেও পাঠ গ্রহণ করে- এটা দেশের বাস্তবতা। অন্যদিকে এ দেশেই আছে আবাসিক মডেল কলেজ, ক্যাডেট কলেজের মতো সব সুবিধাপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেগুলো চলে মূলত সরকারি অর্থানুকূল্যে। একটি ক্যাডেট কলেজ পরিচালিত হতে বছরে যে সরকারি অর্থ খরচ হয়, তা দিয়ে বছরে ৫০০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় চলতে পারে। কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছিল এই প্রতিষ্ঠানগুলো বিলোপ করে, এ ধরনের বর্তমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কারিগরি শিক্ষায়তন, কৃষি পলিটেকনিক অথবা উন্নতমানের বিজ্ঞান বা সাধারণ শিক্ষানিকেতন রূপে চালু রাখার কথা। কিন্তু আজকের বাংলাদেশ এই বক্তব্য বা অভিমতের উল্টো প্রতিক্রিয়াই প্রমাণ করে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের পর একটি গণমুখী প্রযুক্তি অনুগামী শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলনের পরিকল্পনা সুকৌশলে ধ্বংস করে দেয়া হয়। ফৌজি শাসক জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর এক বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুর সময়ে পরিকল্পিত কারিগরি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বদলে তথাকথিত ‘চরিত্র গঠনে’র নামে ধর্মীয় শিক্ষার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেন। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী কাজী জাফর আহমদের নেতৃত্বে গঠিত শিক্ষাপরিষদ যে শিক্ষানীতি দাঁড় করায়, তাতে দেখা যায় মধ্যযুগের ন্যায় বা মধ্যপ্রাচ্যের জ্ঞান-বিজ্ঞানে পশ্চাৎপদ দেশগুলোর মতো ধর্মশিক্ষাকে অধিকতর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিচর্চা তাতে হয়েছে তিরোহিত। পরবর্তীকালে আরেক ফৌজি শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মজিদ খানের নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। এই কমিশন প্রস্তাব করে যে প্রথম শ্রেণি থেকে শিশুদের আরবি ভাষা বাধ্যতামূলকভাবে শিখতে হবে। ১৯৮৩ সালে প্রবল ছাত্র আন্দোলনের মুখে এই রিপোর্ট স্থগিত রাখা হয়। ১৯৮৭ সালে মফিজ আহমদ শিক্ষা কমিশন গড়েন এরশাদ। এই কমিশন একটু কায়দা করে ‘আরবির বদলে ধর্মশিক্ষা’ শব্দটি ব্যবহার করে। এরপর ১৯৯৬ সালে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের আলোকে আরো একটি অগ্রবর্তী শিক্ষা রিপোর্ট প্রণীত হলেও তা আবার হিমাগারে ছিল। ফলে উদার, অসাম্প্রদায়িক ও বৈজ্ঞানিক চেতনা সৃষ্টির চেষ্টার বীজ আর অঙ্কুরোদ্গম ঘটতে পারেনি। ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে গৃহীত হওয়া শিক্ষানীতি অধ্যাপক কবীর চৌধুরী শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ আলোকে প্রণীত। কবীর চৌধুরী ছিলেন কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের সদস্যসচিব।
ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর তো পরিচয় ছিলই, উপরন্তু তিনি বঙ্গবন্ধুর চেতনা সম্পর্কে ছিলেন সম্যকভাবে অবহিত। ফলে বলা যায়, জাতীয় সংসদে গৃহীত হওয়া এই শিক্ষানীতি বহুলাংশেই বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাচিন্তাকে সমুন্নত রাখতে সক্ষম হয়েছে।
লেখকঃ ড. সৌমিত্র শেখর
নজরুল-অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়