যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ভিত্তিক সাময়িকী ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিন প্রকাশিত বিশ্বের নেতৃস্থানীয় ১০০ চিন্তাবিদের এক তালিকায় স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, জলবায়ু পরবির্তনের বিরূপ প্রভাব নিয়ে সচেতনতা তৈরি ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য এই তালিকায় ‘ডিসিশন মেকার্স’ ক্যাটাগরিতে বিশ্বের শীর্ষ ১৩ চিন্তাবিদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
একই ক্যাটাগরিতে এ বছর শেখ হাসিনার সঙ্গে আছেন জার্মান চ্যান্সেলর এ্যাঞ্জেলা মের্কেল, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন এবং মরিশাসের প্রেসিডেন্ট আমিনাহ গুরিব-ফাকিম।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তালিকায় রাখার ব্যাপারে ‘ফরেন পলিসি’ বলেছে, ‘সারা বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশে মাত্র দশমিক ৩ শতাংশ (কার্বন) নির্গমন হলেও ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে দেশটির এক কোটি ৮০ লাখ নাগরিক বাস্তচ্যুত হয়ে পড়বে। অলস সময় পার না করে ৩০ শতাংশ দারিদ্র্যসহ অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবেশ সুরক্ষাকে একটি জাতীয় অগ্রাধিকার বিষয়ে পরিণত করেছেন; এ জন্য চলতি বছর তিনি জাতিসংঘের চ্যাম্পিয়ন অব দি আর্থ পুরস্কার পেয়েছেন।
২০০৯ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ছিল প্রথম, যার জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত কৌশল প্রণয়নের প্রয়োজন ছিল; এরপর দেশটি প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের জন্য সংবিধান সংশোধনের অঙ্গীকার করে এবং লাখ লাখ বাড়িকে সৌরশক্তির আওতায় নিয়ে এসেছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিযোজনের লক্ষ্যে দেশটির বাজেটে ৬ থেকে ৭ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে।’
‘ফরেন পলিসি’ ২০০৯ সাল থেকে প্রতি বছর ‘১০০ লিডিং গ্লোবাল থিংকার্স’ শিরোনামে এই তালিকা প্রকাশ করে। বিশ্বে পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে আগের বছরের সুনির্দিষ্ট অবদান ও ধারণাকে বাস্তব রূপ দেয়ার ক্ষমতা বিবেচনায় বিভিন্ন দেশের রাজনীতিক, আইনজীবী, উদ্ভাবক, শিল্পী, সরকারি কর্মকর্তা ও স্বপ্নদ্রষ্টাদের নিয়ে এ তালিকা তৈরি করা হয়। ১০০ চিন্তাবিদকে ডিসিসন মেকারস, চ্যালেঞ্জার্স, ইনোভেটরস, অ্যাডভোকেটস, আর্টিস্টস, হিলার্স, স্টুয়ার্ডস, ক্রনিক্লার্স ও মোঘলস এই ৯টি বিভাগে স্থান দেয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি, মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি এবং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের নাম বিভিন্ন বছর এই তালিকায় এসেছে।
শান্তি প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার জন্য বিশ্বের বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠান শেখ হাসিনাকে ডক্টরেট ডিগ্রি এবং পুরস্কার প্রদান করে। সামাজিক কর্মকান্ড, শান্তি ও স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে অসামান্য ভূমিকার জন্য শেখ হাসিনা অর্জন করেছেন ইউনেস্কো’র ‘হুপে-বোয়ানি’ (Houphouet-Boigny) শান্তি পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্রের রানডলপ ম্যাকন উইমেন্স কলেজ এর মর্যাদাসূচক Pearl S. Buck `99 পুরস্কার, জাতিসংঘের সম্মানজনক ‘সেরেস’ (CERES) মেডেল, সর্বভারতীয় শান্তিসংঘ’র ‘মাদার টেরেসা’ পদক, আন্তর্জাতিক রোটারি ফাউন্ডেশন এর Paul Haris ফেলোশিপ, পশ্চিমবঙ্গ সর্বভারতীয় কংগ্রেস এর নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু স্মৃতি পদক, আন্তর্জাতিক লায়ন্স ক্লাব এর Medal of Distinction পদক ও ‘Head of State ’ পদক, ভারতের ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়াল ট্রাস্ট এর ইন্দিরা গান্ধী পুরস্কার, ব্রিটেনের গ্লোবাল ডাইভারসিটি পুরস্কার এবং সাউথ সাউথ পুরস্কার, ইউনেসকো’র ‘শান্তিরবৃক্ষ’ পুরস্কার, উইমেন ইন পার্লামেন্টস গ্লোবাল ফোরাম এর রিজিওনাল লিডারশিপ পুরস্কার, গ্লোবাল সাউথ-সাউথ ডেভলপমেন্ট এক্সপো-২০১৪ ভিশনারি পুরস্কার ইত্যাদি। দেশে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় উদ্যোগের স্বীকৃতি হিসেবে চলতি বছর ‘পলিসি লিডারশিপ’ ক্যাটাগরিতে জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্যা আর্থ - ২০১৫’ পুরস্কার পেয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউনেপ) সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্যা আর্থ’ প্রদান অনুষ্ঠানে ইউনেপ এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর আচিম স্টেইনার প্রধানমন্ত্রীকে ‘একজন অনুপ্রেরণাদায়ক নেতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, পরিবেশ রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কাজ করার প্রয়োজনীয়তা শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন। বাংলাদেশ হচ্ছে প্রথম দেশ, যে দেশটি জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং আরো অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
পুরস্কার গ্রহণ করে শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্ব যখন সকলের জন্য একটি অভিন্ন ভবিষ্যতের কথা বলে তখন আমরা আমাদের পৃথিবীর সুরক্ষা ও লালনের লক্ষ্যে আমাদের দায়িত্ব পালন করতে প্রস্তুত। এই পুরস্কার জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আমাদের জনগণের চেতনা ও সহিষ্ণুতার একটি স্বীকৃতি।
এছাড়া, টেকসই ডিজিটাল কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সম্প্রতি International Telecommunication Union (ITU) শেখ হাসিনাকে ICTs in Sustainable Development Award-2015 প্রদান করে।
পুরস্কারের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইংয়ের অফিসিয়াল ফেইসবুক পেইজে বলা হয়, প্রতিবেশগতভাবে ‘নাজুক অবস্থায় থাকা’ বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিশ্বের অন্যতম স্বল্পোন্নত দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েও শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিনিয়োগ সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জনের ক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ।
ইতোপূর্বে বিশ্বকে ‘পাল্টে দিতে’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ‘শান্তি-কেন্দ্রিক উন্নয়নের’ যে মডেল তুলে ধরেছিলেন তাতে সমর্থন জানিয়েছিল জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো। জাতিসংঘের ৬৭তম সাধারণ অধিবেশনের ২৯ নম্বর এজেন্ডা হিসেবে উত্থাপিত ওই প্রস্তাবের পক্ষে সংস্থাটির সব সদস্য দেশই সমর্থন জানায়। এই শান্তি কেন্দ্রিক উন্নয়ন মডেল একটি বহুমাত্রিক ধারণা, যার ভিত্তি হচ্ছে জনগণের ক্ষমতায়ন, যেখানে গণতন্ত্র এবং উন্নয়নকে সর্বাগ্রে স্থান দেয়া হয়েছে। এতে আছে সাতটি পরস্পর ক্রিয়াশীল বিষয় যা শান্তিপ্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এগুলো হচ্ছে ক্ষুধা এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বৈষম্য দূরীকরণ, বঞ্চনার লাঘব, সবার জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ঝরেপড়া মানুষদের সমাজের মূলধারায় অন্তর্ভুক্তি, মানবসম্পদ উন্নয়ন তরান্বিত করা এবং সন্ত্রাসবাদের মূলোৎপাটন।
শেখ হাসিনা বেশ কয়েকটি গ্রন্থের রচিয়তা। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেঃ শেখ মুজিব আমার পিতা; ওরা টোকাই কেন? (১৯৮৭); বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম (১৯৯৩); দারিদ্র্য বিমোচন, কিছু ভাবনা (১৯৯৩); আমার স্বপ্ন, আমার সংগ্রাম (১৯৯৬); People and democracy (১৯৯৭), আমরা জনগণের কথা বলতে এসেছি (১৯৯৮); বৃহৎ জনগোষ্ঠির জন্য উন্নয়ন (১৯৯৯); Development of the masses (১৯৯৯); সামরিকতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র (১৯৯৯), আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন (২০০১); বিপন্ন গণতন্ত্র, লাঞ্চিত মানবতা (২০০২); উDemocracy in distress, demeaned humanity (২০০৩); সহেনা মানবতার অবমাননা (২০০৩); সাদা কালো, সবুজ মাঠ পেরিয়ে, Living with tears, Miles to Go, The Quest for Vision-2021 (two volumes)।
শেখ হাসিনা সরকারের উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে ভারত ও মায়ানমারের সাথে সামুদ্রিক জলসীমা বিরোধের নিষ্পত্তি, প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন, মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, জাতিসংঘ কর্তৃক শেখ হাসিনার শান্তির মডেল গ্রহণ, বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতকরণ, ভারতের পার্লামেন্ট কর্তৃক স্থল সীমানা চুক্তির অনুমোদন এবং দুই দেশ কর্তৃক অনুসমর্থন, (এরফলে দুই দেশের মধ্যে ৬৮ বছরের সীমানা বিরোধের অবসান হয়েছে), দারিদ্র্যের হার ২২.৪ শতাংশে হ্রাস, পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন শুরু ইত্যাদি। -তথ্যসূত্রঃ www.pmo.gov.bd, en.wikipedia.org/wiki/Sheikh_Hasina অবলম্বনে