॥ হাবিবুল হায়দার চৌধুরী ॥
সাম্প্রতিক কালে জাতিসংঘ ঘোষিত ১৭টি ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’-র চতুর্থ লক্ষ্যমাত্রাটি মৌলিক শিক্ষা সম্পর্কিত। ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বস্তরে বৈষম্যহীন মানসম্পন্ন শিক্ষার তাগিদ দেয়া হয়েছে তাতে।
বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে এটি আদৌ সম্ভব কিনা এতে মতানৈক্য থাকতে পারে, তবে একেবারেই যে সম্ভব নয় তা বলা যায় না। লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে সময় ব্যাপ্তির যে তালিকা দেয়া হয়েছে, তা সবে মাত্র শুরু হয়েছে। পরিকল্পিত কর্মকান্ডের মাধ্যমে সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমার কিছু ব্যক্তিগত প্রস্তাবনা রয়েছে তা নিয়ে আলোচনার জন্য উপস্থাপন করছি।
১। শিক্ষক পুল
প্রতিটি প্রধান বিষয়ে এলাকাভিত্তিক শিক্ষক পুল গঠনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। পুলের শিক্ষকগণ এলাকার শিক্ষকদের মান উন্নয়নে প্রশিক্ষন প্রদানসহ শিক্ষা উপকরণ ব্যবহারে তাদেরকে সহায়তা প্রদান করবেন। স্থানীয় শিক্ষকদের সংগঠনকে এ ব্যাপারে সম্পৃক্ত করতে হবে।
২। কর্ম এলাকা সমন্বয়ে চেপ্টার কোর্ডিনেটর
প্রতিটি উপজেলাকে একটি স্বতন্ত্র ‘চেপ্টার’ বা ‘কর্ম এলাকা’ ধরে এক বা একাধিক বেসরকারি সাহায্য সংস্থাকে (এনজিও ) সমন্বয়ের দায়িত্ব দিতে হবে। এ সকল এনজিও ‘চেপ্টার কোর্ডিনেটর’ বা ‘কর্ম এলাকা সমন্বয়কারী’ হিসাবে পরিচিত হবে। চেপ্টার কোর্ডিনেটর শিক্ষক পুলের মাধ্যমে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রশিক্ষণ সেমিনার ও ওয়ার্কশপের ব্যবস্থা করবে।
৩। চেপ্টার মেম্বার
প্রতিটি স্থানীয প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, কারিগরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসা (আলিয়া) ‘চেপ্টার মেম্বার’ বা ‘কর্ম এলাকা সদস্য’ হিসাবে পরিচিত হবে। প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষগণ ‘কর্ম এলাকা সদস্য প্রতিনিধি’ হিসাবে পরিচিত হবেন। ‘চেপ্টার কোর্ডিনেটর’ বা ‘কর্ম এলাকা সমন্বয়কারী’ এনজিও এলাকার এ সকল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় রক্ষা করবে। কর্ম এলাকা সদস্য প্রতিনিধিগণ প্রতি ৬ মাসে একবার শিক্ষা কর্মকান্ডের অগ্রগতি ও শিক্ষার মান উন্নয়নের প্রভাব পর্যালোচনা করবেন।
৪। ঝুঁকিগ্রহীতাদের আলোচনা মঞ্চ বা ষ্টেকহোর্ল্ড্স ফোরাম
প্রতিটি কর্ম এলাকায় উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের তত্ত্বাবধানে ‘ষ্টেকহোর্ল্ড্স ফোরাম’ বা ‘ঝুঁকিগ্রহীতাদের আলোচনা মঞ্চ’ তৈরি করতে হবে। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদসমূহের চেয়ারম্যান, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা শিক্ষক সমিতির প্রতিনিধি, স্থানীয় এনজিও প্রতিনিধিসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এই ফোরামের সদস্য হবেন। এই ফোরাম প্রতি ৩ মাসে একবার শিক্ষা কর্মকান্ডের অগ্রগতি পর্যালোচনা করবেন। এই ফোরাম সবাইর জন্য উন্মুক্ত থাকবে। যে কোন শিক্ষানুরাগী গবেষক এই ফোরামে অন্তর্ভূক্ত হতে পারবেন।
৫। অগ্রগতি মূল্যায়ন
কেন্দ্রীয় পর্যায়ে উদার দৃষ্টিভঙ্গির শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের (অবসরপ্রাপ্তসহ) নিয়ে একটি ‘অগ্রগতি ও মানোন্নয়ন মূল্যায়ন কমিটি’ গঠন করতে হবে। এই কমিটি এলাকাভিত্তিক মূল্যায়ন কমিটি বা ‘চেপ্টার ইভ্যালুয়েশন কমিটি’ কে মূল্যায়নের পদ্ধতি সম্বন্ধে যথাযথ নির্দেশনা প্রদান করবে। ‘চেপ্টার কোর্ডিনেটর’ বা ‘কর্ম এলাকা সমন্বয়কারী’ এনজিও চেপ্টার ইভ্যালুয়েশন কমিটির কার্যালয়ের দায়িত্বে থাকবে ও এই মূল্যায়ন কমিটির কাজে সহযোগিতা প্রদান করবে।
৬। রিসোর্স সেন্টারের সম্পৃক্ততা
এই পরিকল্পনায় উপজেলা রিসোর্স সেন্টারকে সম্পৃক্ত করলে সেটা আরো অর্থবহ হবে। তাই, ‘চেপ্টার কোর্ডিনেটর’ বা ‘কর্ম এলাকা সমন্বয়কারী’ এনজিও উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে প্রশিক্ষণে সহযোগিতা গ্রহন করতে পারে।
৭। অর্থায়ন
এ ধরনের প্রকল্পে অর্থায়ন একটি প্রধান বিবেচ্য বিষয়। সাধারণতঃ সরকার ও দাতা সংস্থাসমূহ এ ক্ষেত্রে মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। অর্থমন্ত্রনালয়ের অধিনস্ত স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশন (বিএনএফ) প্রকল্পে অর্থায়নের কেন্দ্রবিন্দুতে থেকে প্রকল্পকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে। ‘চেপ্টার কোর্ডিনেটর’ বা ‘কর্ম এলাকা সমন্বয়কারী’ এনজিও তাদের নিজ নিজ কর্ম এলাকার জন্য প্রকল্প অর্থায়নে সুবিধাভোগি হিসাবে অর্থগ্রহন ও ব্যবহারের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হবে।
প্রস্তাবকের কথা
‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-৪: সর্বস্তরে বৈষম্যহীন মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং সবার জন্য আজীবন শিখনের সুযোগ সৃষ্টি করা’ লক্ষ্যমাত্রাটি প্রকৃতপক্ষে অন্যতম একটি মৌলিক চাহিদা ও মৌলিক অধিকারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়াস। এই মৌলিক চাহিদা পূরণে সরকারের উচিত একটি সরকারি-বেসরকারি যৌথ পরিকল্পনা হাতে নেয়া যাতে এই দুরুহ কিন্তু অসম্ভব নয় লক্ষ্যমাত্রাটি অর্জন করা যায়। টেকসই উন্নয়নের মূল লক্ষ্য হচ্ছে-অর্থনৈতিক ও পরিবেশের দীর্ঘস্থায়িত্ব নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে দরকার জাতীয় নীতি নির্ধারণ পর্যায়ে অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও সামাজিক চাহিদার সমন্বয় ঘটানো।
আমি ১লা জানুয়ারী, ২০১৬ তারিখে নোয়াখালী জেলার সেনবাগ উপজেলায় দুই দিন ব্যাপি একটি ইংরেজি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় প্রশিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করি। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-৪ কে সামনে রেখে আয়োজিত এই কর্মশালাটি সম্ভবতঃ এ ধরণের প্রথম উদ্যোগ। সেনবাগ উপজেলার ২০টি উচ্চ বিদ্যালয় ও ৩টি মাদ্রাসার ২৩ জন শিক্ষক এতে অংশগ্রহন করেন। এই প্রশিক্ষণ কর্মশালার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল এতে সরকারি-বেসরকারি সাহায্য সংস্থা-স্থানীয় সরকার সবাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নিজে অংশগ্রহনকারীর তালিকা চুড়ান্ত করেন। ‘বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশন (বিএনএফ)’ এই কর্মশালায় অর্থায়ন করে ও স্থানীয় বেসরকারি সাহায্য সংস্থা মুনসী আতর আলী ওয়েলফেয়ার সোসাইটি (মস্) আয়োজন ও ব্যবস্থাপনা করে পেশাগত দক্ষতার একটি অনন্য নজির স্থাপন করে। প্রশিক্ষণ কর্মশালায় সম্পূর্ণ নুতন ইংরেজি শিক্ষণ পদ্ধতি ‘হায়দার্স এপ্রোচ টু কুয়িক ইংলিশ লার্ণিং (হ্যাকেল)’ অনুসরণ করে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান পূর্ব ‘মানসিক প্রস্তুতি’ ও পাঠদানে ‘লেসন কার্ড’ ব্যবহারের পদ্ধতি শিক্ষা দেয়া হয়। এই পদ্ধতিতে সর্বস্তরে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা যেতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। মানসম্পন্ন শিক্ষক দেশকে মানসম্পন্ন শিক্ষা উপহার দিতে পারে। তাই, দেশকে মধ্য আয়ের দেশ তৈরি করতে হলে আমাদেরকে মানসম্পন্ন শিক্ষক তৈরি করার দিকে মনযোগি হতে হবে।
- হাবিবুল হায়দার চৌধুরী, লেখক ও গবেষক। নুতন ইংরেজি শিক্ষণ পদ্ধতি ’হ্যাকেল’ এর উদ্ভাবক। যোগাযোগ:hhaiderchy@live.com, hhaiderchy@gmail.com