বিশেষ খবর



Upcoming Event

শিক্ষার মান উন্নয়ন নিয়ে ভাবার সময় এখনই

ক্যাম্পাস ডেস্ক মতামত

স্বাধীন বাংলাদেশে গত চার দশকে যে ক’টি ক্ষেত্রে চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন হয়েছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে শিক্ষা। এই উন্নয়নটি অধিক মাত্রায় ঘটেছে বিগত দুই দশকে। শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে যে অগ্রগতি তা এখন বিশ্বস্বীকৃত। এমনকি ভারত থেকেও বাংলাদেশ যেসব আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বেশ এগিয়ে আছে তার মধ্যে শিক্ষা অন্যতম। সাধারণত শিক্ষাকে আমরা তিন স্তরে ভাগ করি। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা। এই তিন স্তরের মধ্যে বিভাজনও বহুবিধ। প্রাথমিক স্তরে প্রধানত তিন ধরনের বিভাজন পাওয়া যায়। সাধারণ সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের স্কুল, ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল আর মাদ্রাসা শিক্ষা। এইসবের মধ্যেও আবার নানা ধরনের বিভাজন রয়েছে। তবে মূল বিভাজনটি হচ্ছে পাঠ্যসূচিতে, যেটি কখনও কাম্য নয়। সাধারণ পর্যায়ের স্কুলগুলো সরকারি নিয়ন্ত্রণে সরকারি পাঠ্যসূচি অনুযায়ী চলে, যদিও এই পাঠ্যসূচিকে উন্নত করার যথেষ্ট সুযোগ আছে। ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলো অধিকাংশই বিদেশি পাঠ্যসূচি অনুযায়ী চলে। এইসব স্কুলে যারা পড়ালেখা করে, তাদের একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থীর সঙ্গে দেশের ইতিহাস, সমাজ আর সংস্কৃতি সম্পর্কিত বিষয়াদির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকে না। তাদের দেশের কিছু দর্শনীয় স্থানের নাম করতে বললে তারা অবলীলাক্রমে বলে লন্ডনের টাওয়ার ব্রিজ অথবা সিডনির অপেরা হাউস। কোনো কোনো স্কুল তো তাদের বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করে, এই স্কুলে অস্ট্রেলিয়া অথবা ইংল্যান্ডের সিলেবাস অনুযায়ী পড়ালেখা করানো হয়। আমাদের দেশের স্কুলের সিলেবাস কী দোষ করল, তা তারা কখনও বলে না। তারা হয়ত ‘ও’ বা ‘এ’ লেভেল পাঠ্যসূচি অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করে, তবে সেই পাঠ্যসূচিতে কেন নিজ দেশের ইতিহাস, সমাজ আর সংস্কৃতির ওপর জোর দেয়া হবে না, তা বোধগম্য নয়। আর মাদ্রাসা শিক্ষার বেলায় যত কম বলা যায়, ততই ভাল। অথচ এই একটি ক্ষেত্রে প্রতিবছর পড়ুয়ার সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলো হতে যারা পাস করে বের হয়, তারা জাতিকে তেমন একটা কিছুই দিতে পারে না। দীর্ঘ চল্লিশ বছরে এই শিক্ষা ব্যবস্থা কোন বিশ্বমানের তো দূরে থাক, আঞ্চলিক বা জাতীয় মানের একজন ইসলামিক প-িতও উপহার দিতে পারেনি। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারের সাফল্য, বিশেষ করে বর্তমান সরকারের বড় সাফল্য হচ্ছে, দেশের প্রায় একশত ভাগ শিশুকে স্কুল পর্যায়ে টেনে আনা, যদিও ঝরে পড়ার হার এখনও বেশ উঁচু।
হ্যাঁ, এটি সত্য, বিগত বছরগুলোতে শিক্ষার ব্যাপ্তি বেড়েছে অনেকগুণ। এখন সমাজে টিপসই দেয়ার মানুষের সংখ্যা দ্রুত কমছে। তবে যা অত্যন্ত পীড়াদায়ক, তা হচ্ছে পড়ালেখার মান। মানের নিম্নগতি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় হতে শুরু করে একেবারে স্কুল পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এর হয়ত অনেক কারণ আছে। তবে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এই মানের প্রচ- ঘাটতি। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল সর্বসাকুল্যে ছয়টি। তার মধ্যে কৃষি ও বুয়েট ছিল বিশেষায়িত। আর সব বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট পড়ুয়ার সংখ্যা কোনক্রমেই চল্লিশ হাজারের বেশি ছিল না। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ত্রিশ লাখ শিক্ষার্থী দেশের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে। দেশে গড়ে উঠেছে ৭৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। আর আছে ৩৫টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। আবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি তাদের বেআইনি কার্যকলাপের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বন্ধ করে দিলেও, আদালতের অনুমতি নিয়ে তারা তাদের কার্যকলাপ চালু রেখেছে। আরও আছে সরকারি-বেসরকারি মিলে প্রায় ছয় হাজার কলেজ। এই কলেজগুলোতে আনুমানিক সাড়ে পাঁচ লাখ শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আর সরকারি কলেজ সরকারি অর্থায়নে চলে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ছাত্র বেতন ও প্রতিষ্ঠাতাদের অর্থায়নের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে এখনও শিক্ষার জন্য চাহিদা আর যোগান দুটির মধ্যে পার্থক্য বিশাল। যার ফলে আবার এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী এর সুযোগ নিয়ে উচ্চশিক্ষাকে ব্যবসা হিসেবে নিয়েছে এবং তাদের প্রধান কাজ হচ্ছে, জ্ঞান বিতরণের ব্যবস্থা করা নয়; বরং এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে অর্থউপার্জন। এই কাজটি বেশি হয় স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও পরিস্থিতি অনেকটা অনুরূপ, যদিও একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু অনেক সময় ক্লাসের সংখ্যা এত বেশি হয় যে, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে তেমন কোনো ভাল মানের গবেষণা হয় না। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার জন্য খুব বেশি বরাদ্দ না থাকলেও, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন হতে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় গবেষণার জন্য ভাল বরাদ্দ পাওয়া যায়। তবে এইসব বরাদ্দ যত না গবেষণায় ব্যয় হয়, তার চেয়ে বেশি ব্যয় হয় কেনাকাটার জন্য। তারপরও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হতে কিছু গবেষণালব্ধ কাজ প্রতিবছর বের হয়। তবে তার বেশিরভাগই কোন মৌলিক গবেষণা নয়। অপ্রিয় হলেও সত্য, আমাদের দেশের অনেক গবেষকই মৌলিক গবেষণার তেমন কোনো ধারণা পোষণ করেন না। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবার গবেষণার চেয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়াটাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন কারণ এতে তার টানাপোড়েনের সংসারে কিছুটা হলেও স্বস্তি আসে। অনেক সময় শিক্ষক নিয়োগের সময় মেধাকে গুরুত্ব না দিয়ে দলীয় পরিচয়কে গুরুত্ব দেয়া অথবা কোনো শিক্ষকের সঙ্গে ভাল সম্পর্কই নিয়োগের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হয়ে ওঠে। কোনো একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিভাগের একাধিক শিক্ষকের নিজস্ব পরামর্শক প্রতিষ্ঠান অথবা এনজিও আছে। প্রথমে একজন শিক্ষার্থীকে তার প্রতিষ্ঠানে তিনি চাকরি দেন এবং পরবর্তীকালে প্রথম সুযোগেই তাকে তার নিজ বিভাগে ওই শিক্ষার্থীর চাকরির ব্যবস্থা করা হয়। আর আছে শিক্ষক প্রশিক্ষণের অভাব। এটি সকল স্তরেই প্রযোজ্য। শুধু একজন মেধাবী শিক্ষার্থী ভাল শিক্ষক হতে পারে না। শিক্ষাদান একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কলা বা কৌশল, যা অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীর জানা থাকে না। পাশ্চাত্যের অনেক দেশে, এমনকি ভারতবর্ষেও শিক্ষক হতে হলে তাকে প্রথমে কোনো একটি স্বীকৃত প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান হতে শিক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে হয়। এই প্রশিক্ষণ ছাড়া কেউ শিক্ষক হতে পারেন না। এটিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় প্রাথমিক পর্যায়ে। কারণ এই পর্যায়ে শিক্ষাটি ভাল না হলে ওপরের পর্যায়ে তা হোঁচট খাবে। বাংলাদেশে এই নিয়মটি এখনও চালু হয়নি। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষকরা অনেকেই প্রকৃত শিক্ষা আর ক্লাসে পাঠদানের মধ্যে তফাৎ বোঝেন না। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও একই অবস্থা। শিক্ষক হয়ত অনেক বিষয়ে জানেন, কিন্তু তা শিক্ষার্থীদের বোঝাতে পারেন না। শিক্ষা ক্ষেত্রে এসব প্রতিবন্ধকতা দূর না করলে, শিক্ষার মান কখনও উন্নত হবে না। চাই স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।
সবশেষে কারিগরি ও নার্সিং শিক্ষা সম্পর্কে দুটি কথা বলতে চাই। এই দুটি শিক্ষা খাত বাংলাদেশে হয় সম্পূর্ণ উপেক্ষিত অথবা মেধাবী শিক্ষার্থী আকর্ষণ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলে শিক্ষার্থীরা যেভাবে সাধারণ শিক্ষা, মেডিক্যাল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে, তার ছিটেফোঁটাও সাধারণ টেকনিক্যাল শিক্ষা সম্পর্কে দেখা যায় না। অথচ এই দুটি ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত শিক্ষার্থীদের জন্য দেশে ও দেশের বাইরে চাকরির অপার সম্ভাবনা অপেক্ষা করছে। যুক্তরাষ্ট্রে একজন ভাল নার্সের বার্ষিক বেতন এক লাখ ডলারের বেশি। কারিগরি বিদ্যায় পারদর্শী যে কোনো ব্যক্তি বিশ্বের যে কোনো অঞ্চলে সমাদৃত।
শিক্ষা জাতির মেরুদ- তা যদি স্বীকার করা হয়, তা হলে সরকারকে এসব বিষয়ে একটি সামগ্রিক কর্মকৌশল প্রস্তুত করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। সেটি যদি করা যায়, তা হলে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে কেউ থামিয়ে রাখতে পারবে না ।

 -লেখকঃ আবদুল মান্নান
গবেষক  ও বিশ্লেষক



বিশ্ববিদ্যালয় কম্পাস পত্রিকার সংখ্যা সমূহ

আরো সংবাদ

শিশু ক্যাম্পাস

বিশেষ সংখ্যা

img img img