২০০৮ সাল থেকে মাধ্যমিক শিক্ষায় চালু হয় সৃজনশীল পদ্ধতি। নতুন পদ্ধতি চালু হওয়ার ছয় বছর পরই গত বছরের জানুয়ারিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক নির্দেশনায় সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের যার যার বিষয়ের পরীক্ষার প্রশ্ন প্রণয়ন করতে বলে। স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকদের বাইরে থেকে রেডিমেড প্রশ্নপত্র কিনে বা অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সংগ্রহ করে পরীক্ষা নেয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। অথচ গত বছরই মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের এক জরিপে বলা হয়, এখনো ৪৫ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন করতে পারেন না। একে তো অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাহায্য নেয়া নিষিদ্ধ, আবার নিজেরাও সৃজনশীল পুরোপুরি বোঝেন না; শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও অতটা জোরদার নয়। এ অবস্থায় প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে নোট-গাইডের আশ্রয় নিচ্ছেন শিক্ষকরা। অনুসন্ধানেও এবারের এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নে নোট-গাইড থেকে হুবহু প্রশ্ন তুলে দেয়ার প্রমাণ মিলেছে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, সৃজনশীল পদ্ধতি চাপিয়ে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
সৃজনশীল বোঝার ব্যাপার। শিক্ষকরাই যদি সৃজনশীল না বোঝেন তাহলে তো তাঁরা গাইড থেকে প্রশ্ন করবেনই। এভাবে জোড়াতালির সৃজনশীল দিয়ে শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘যেহেতু গাইড থেকে প্রশ্ন করার অভিযোগ উঠেছে, পরীক্ষা শেষ হলে আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখব। অভিযোগ প্রমাণিত হলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে আমাদের দক্ষ শিক্ষকের অভাব রয়েছে, এটা অস্বীকারের উপায় নেই। আমি সব সময়ই বলি, শিক্ষার মান বাড়াতে হলে আগে শিক্ষকদের দক্ষ হতে হবে। তাই সৃজনশীল পদ্ধতি ভালোভাবে বোঝাতে আমরা শিক্ষক প্রশিক্ষণ জোরদার করেছি।’
নোট-গাইড থেকে পাবলিক পরীক্ষায় হুবহু কমন পড়ার অভিযোগ আগে থেকেই থাকলেও আমলে নেয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষার পরই প্রকাশ্যে আসে বিষয়টি। ওই দিনের ইংরেজি ভার্সনের পদার্থবিজ্ঞানের প্রশ্নের সঙ্গে বাজারের একটি নামি সৃজনশীল গাইড হুবহু মিলে যায়। এমনকি গণিত পরীক্ষায়ও একই ধরনের অভিযোগ ওঠে।
এরপর ১৬ মার্চ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবাল এ বিষয়ে গণমাধ্যমের সম্পাদকদের প্রতি একটি চিঠি পাঠান। সেই চিঠিতে জাফর ইকবাল বলেছেন, ‘সম্প্রতি পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে গাইড বই থেকে প্রশ্ন তুলে দেয়ার একটি বিষয় ঘটতে শুরু করেছে। এক অর্থে এই বিষয়টি প্রশ্ন ফাঁস থেকেও গুরুতর। প্রশ্ন ফাঁস কারা করছে সেটি ধরা সম্ভব না হতে পারে, কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারা গাইড বই থেকে পরীক্ষায় প্রশ্ন তুলে দিচ্ছেন, সেটি বের করা সম্ভব।’
অনুসন্ধানে দেখা যায়, এবার এসএসসি পরীক্ষার ইংরেজি ভার্সনের পদার্থবিজ্ঞানে ২০১৫ সালের সিলেবাস অনুযায়ী পরীক্ষা দেয়া পরীক্ষার্থীদের ‘ক সেট’ প্রশ্ন সরবরাহ করা হয়েছে। এই পরীক্ষায় ৪০ নম্বরের রচনামূলক, ৩৫ নম্বরের নৈর্ব্যক্তিক ও ব্যবহারিকে রয়েছে ২৫ নম্বর। দুই ঘণ্টা ২০ মিনিট সময়ের রচনামূলক প্রশ্নে ৬টি প্রশ্ন রয়েছে। সেখান থেকে শিক্ষার্থীদের চারটির উত্তর দিতে হবে। রচনামূলক অংশের ৬ নম্বর প্রশ্নে বৈদ্যুতিক একটি বিষয় নিয়ে সৃজনশীল প্রশ্ন রয়েছে। সেখানে (এ) নম্বর প্রশ্নে রয়েছে, ‘হোয়াট ইজ কলড ফ্লো অব কারেন্ট’? আর বাজারের একটি স্বনামধন্য গাইডের ২৪৪ নম্বর পৃষ্ঠায়ও একই প্রশ্ন রয়েছে। তবে সেখানে প্রশ্নের একটু ভাষাগত পার্থক্য রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘হোয়াট ইজ দ্য কোটেন্ট অব পাওয়ার বাই কারেন্ট ফ্লো কলড’? একই প্রশ্নের অন্য অংশেও মিল রয়েছে। গাইডে সেটি ‘সি’ নম্বর প্রশ্ন; পরীক্ষায় সেটিকে দেয়া হয়েছে ‘বি’ নম্বরে আর ‘বি’ কে দেয়া হয়েছে ‘সি’ নম্বরে। ‘ডি’ নম্বর প্রশ্ন ঠিকই রয়েছে। তবে সব প্রশ্নেই কিছু ভাষাগত পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু সব প্রশ্নের বাংলা অর্থ একই। এভাবে সব প্রশ্নেরই মিল রয়েছে।
এমনকি নৈর্ব্যক্তিকেও একই মিল রয়েছে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র দেখার সুযোগ বোর্ডেরও নেই। তাই কোনো শিক্ষক গাইড বইয়ের সঙ্গে মিল রেখে প্রশ্ন করলে আগে থেকে বোর্ডের বোঝার কোনো উপায় থাকে না। বিভিন্ন বোর্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রশ্ন করে মডারেটরের কাছে পাঠান। মডারেটর লটারি করে প্রশ্ন বাছাই করেন। লটারিতে যে সেটগুলো ওঠে, সেটি ছাপানোর জন্য বিজি প্রেসে পাঠানো হয়। এরপর বিজি প্রেস থেকেই কেন্দ্রে যায়।
জানতে চাইলে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু বক্কর ছিদ্দিক বলেন, ‘ইংরেজি ভার্সনের পদার্থবিজ্ঞানের প্রশ্ন একটি সহায়ক বইয়ের সঙ্গে মিলে যাওয়ার অভিযোগ আমাদের কাছেও এসেছে। পরীক্ষা শেষে প্রশ্নের পা-ুলিপির সঙ্গে ওই গাইড মিলিয়ে দেখা হবে। প্রশ্ন মিললে খুঁজে বের করা হবে সংশ্লিষ্ট প্রশ্ন প্রণয়নকারী শিক্ষককে। এরপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
মাউশি’র প্রশিক্ষণ শাখা সূত্র জানায়, শিক্ষকরা যাতে সহজেই সৃজনশীল বিষয়গুলো পড়াতে পারেন এবং প্রশ্ন করতে পারেন এ জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। ইতোমধ্যে মাধ্যমিকের ২৩টি বিষয়ে প্রায় সাড়ে চার লাখ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। বর্তমানে সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রামের অধীনে কারিকুলামের ওপর ২০১৬ জন মাস্টার ট্রেইনার ও ৭০ হাজার শিক্ষক প্রশিক্ষণের কার্যক্রম চলছে। এ ছাড়া লাইফস্কিল, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও আইসিটি’র ওপর বিভিন্ন পর্যায়ের প্রশিক্ষণ চলছে। গড়ে প্রতিবছর ৫০ থেকে ৭০ হাজার শিক্ষক বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকে।
কিন্তু শিক্ষকরা বলছেন, ভিন্ন কথা। বর্তমানে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ ৬০ হাজার। সরকারি স্কুলে শিক্ষকদের সংখ্যা প্রায় আট হাজার ৫০০ জন। আর এমপিওভুক্ত হয়নি অথচ মাধ্যমিকে পড়ান এমন শিক্ষকের সংখ্যাও লক্ষাধিক। ফলে সৃজনশীল বিষয়ে সাড়ে চার লাখ শিক্ষক প্রশিক্ষণ পেলেও এ সংখ্যা অপ্রতুল। বেশির ভাগ শিক্ষকই সৃজনশীল বিষয়ে একবার প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। ভাগ্য ভালো হলে কেউ কেউ দু’বার পেয়েছেন। একবার তিন বা সাত দিনের প্রশিক্ষণে একজন শিক্ষকের পক্ষে কতটুকু সৃজনশীল আয়ত্ত করা সম্ভব, সে প্রশ্ন রেখেছেন শিক্ষকরাও।
জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক খান হাবিবুর রহমান বলেন, ‘মাধ্যমিক পর্যায়ে যারা শিক্ষকতা করছেন তাঁদের অনেকেরই শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা নেই। তাঁদের প্রশিক্ষণ দিলেও তা ধারণ করতে পারেন না। সৃজনশীলের ক্ষেত্রে একজন ছাত্রকে যেমন চিন্তাভাবনা করে উত্তর দিতে হয়, তেমনি সৃজনশীল নিয়ে শিক্ষকদেরও চিন্তাভাবনা থাকা উচিত। যাঁদের সৃজনশীল নিয়ে ধারণা কম তাঁরা তো নোট-গাইড থেকে প্রশ্ন করবেনই। আর যেসব শিক্ষক নিজেরাই ভালো বুঝতে পারছেন না তাঁরা শিক্ষার্থীদের কি পড়াচ্ছেন সেটা সহজেই অনুমেয়।’
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (নজরুল) সভাপতি মোঃ নজরুল ইসলাম রনি বলেন, ‘সৃজনশীল বিষয়ে এখনো যথাযথ প্রশিক্ষণ পাননি শিক্ষকরা। যাঁরা এখনো ভালোভাবে সৃজনশীল বুঝতে পারেননি তাঁরাই গাইডের সাহায্য নেন। তবে পাবলিক পরীক্ষায় গাইডের সঙ্গে মিল রেখে প্রশ্ন করার বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। অন্যদিকে বলতে হয়, তিন বা সাত দিনের প্রশিক্ষণে একজন শিক্ষক কতটুকুই বা বুঝতে পারেন! একজন শিক্ষক এক বছর পর কতটুকু শিখলেন বা বুঝতে পারলেন সেই ব্যাপারে কিন্তু কোনো খোঁজ নেয়া হয়নি। একবার প্রশিক্ষণ দিয়েই মন্ত্রণালয় বলছে, শিক্ষকরা সৃজনশীল বুঝে গেছেন। মন্ত্রণালয় তো কোনো কিছু চাপিয়ে দিলেই হবে না, শিক্ষকরা যাতে সৃজনশীল বুঝতে পারেন সে ব্যাপারটি তাঁদেরই নিশ্চিত করতে হবে। আসলে প্রশিক্ষণ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।’