চিকিৎসা শিক্ষা থেকে শুরু করে সেবা ও গবেষণা -সব কিছুতেই নতুন উচ্চতায় উঠে যাচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। এর স্বীকৃতি কেবল দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকেও মিলছে।
গবেষণায় সাফল্যের কারণে সম্প্রতি স্পেনের সিমাগো রিসার্চ গ্রুপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্কপাস পরিচালিত জরিপে শীর্ষস্থানীয় ১১টি বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পঞ্চম স্থান অধিকার করে নিয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হাজার ৯০৪ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে বহির্বিভাগে প্রতিদিন এখন পাঁচ হাজারের বেশি রোগী সেবা নিতে ভিড় করে। বহির্বিভাগে রোগীর চাপ সামাল দিতে কয়েক বছর আগে চালু করা হয়েছে বৈকালিক স্পেশালাইজড (বিশেষায়িত) কনসালটেশন সার্ভিস। সেখানে ২০০ টাকার টিকিটের বিনিময়ে বহির্বিভাগে অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপকদের পরামর্শ নিতে পারে রোগীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে রয়েছে সাতটি অনুষদ ও ৫৩টি বিভাগ। অধিভুক্ত কলেজের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২-এ। ৯০টিরও বেশি উচ্চতর মেডিকেল শিক্ষাবিষয়ক কোর্স পরিচালিত হচ্ছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। জাপানের নাগোয়া ইউনিভার্সিটি, জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি, রক ফেলার ফাউন্ডেশন, ইউনিসেফ, ইউএসএআইডি, সেভ দ্য চিলড্রেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আইসিডিডিআরবি, ভারতের এআইএমএসসহ বিশ্বের নামকরা অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও সংস্থার সঙ্গে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ও সংস্থার সঙ্গে রয়েছে যৌথ গবেষণার চুক্তিও। উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো ইউনিভার্সিটির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হওয়ায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নততর চিকিৎসা শিক্ষা, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। এ সমঝোতার ফলে অসংক্রামক রোগ বিষয়ে গবেষণাসহ নানা কার্যক্রম পেয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ কামরুল হাসান খান বলেন, প্রতিষ্ঠানটিকে দিনে দিনে আরো গণমুখী করে তোলার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রতিষ্ঠানের প্রতি বিশেষ নজর রাখছেন। শিক্ষা ও গবেষণার পাশাপাশি একে বিশ্বের একটি অন্যতম সেরা চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের কাজ চলছে। এরই মধ্যে এক হাজার বেডের নতুন একটি সুপার স্পেশাল হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া নিত্যনতুন নানা ধরনের যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হচ্ছে, যাতে রোগীরা এখানে সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে পারে। আর চিকিৎসা ব্যয়ও অন্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ে এখানে কম।
ডাঃ কামরুল হাসান খান আরো বলেন, প্রতিদিন সকাল ৮টার আগেই আমরা ক্যাম্পাসে চলে আসি। ৮টায় পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে দেখি। রোগীদের সঙ্গে কথা বলি। সুবিধা-অসুবিধা জানার চেষ্টা করি। নিত্যনতুন পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি। এসবের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালটি মানুষের অনেক বেশি আস্থার জায়গা হয়ে উঠেছে। রোগীর ভিড় সামাল দেয়া মুশকিল হলেও আমরা হাসপাতালেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দিয়ে বৈকালিক সেবা চালু করায় বড় সুফল দেখতে পাচ্ছি।
গবেষণায় এগিয়ে চলা
গত ২৫ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা দিবস পালন করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব রিসার্চ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড প্রোমোশন সেলের আয়োজনে ওই দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। অনুষ্ঠানে এ পর্যন্ত সম্পাদিত সব গবেষণাপত্র প্রকাশ করা হয় এবং গবেষণার জন্য তিনজন গবেষককে বিশ্ববিদ্যালয় পদক দেওয়া হয়। ওই দিন ‘মেডিকেল গবেষণাঃ বাংলাদেশ প্রেক্ষিত’ শিরোনামে এক মুক্ত আলোচনায় বাংলাদেশে মেডিকেল গবেষণার অর্জন, প্রতিকূলতা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে মতবিনিময়ে অংশ নেন দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের চিকিৎসা গবেষক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা।
বিএসএমএমইউ সূত্রে জানা যায়, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পর্যন্ত মোট এক হাজার ৪৪৭টি গবেষণাকাজ সম্পন্ন হয়েছে। ২০১৬ সালে ৭০ জন শিক্ষক ও ২০০ শিক্ষার্থীকে গবেষণার জন্য অনুদান দেয়া হয়েছে।
উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ কামরুল হাসান খান জানান, এখানে চিকিৎসাসেবার গুণগত মানোন্নয়নে শিক্ষকদের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরও পাঁচ বছরের মধ্যে দুই বছর বাধ্যতামূলক গবেষণা করতে হয়। গবেষণা কার্যক্রম আরো সম্প্রসারণ করার প্রক্রিয়া চলছে।
পাঁচ শতাধিক রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন
কিডনি বিকল হওয়া শতাধিক রোগীর দেহে এ পর্যন্ত কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট বা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে শিশু বিভাগের কিডনি ইউনিট দুই দশক ধরে দেশের শিশু কিডনি রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছিল। রোগী বেড়ে যাওয়ায় ২০০৫ সালে একটি পূর্ণাঙ্গ বিভাগ চালু করা হয়। বর্তমানে বিভাগটি তিনটি ইউনিটের ২৪টি শয্যার মাধ্যমে আন্তবিভাগীয় চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে। এ ছাড়া বহির্বিভাগেও সমানভাবে সেবা দেয়া হচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা শিশু কিডনি রোগীদের। কিডনি ইউনিটে একটি পূর্ণাঙ্গ ডায়ালিসিস সেন্টার রয়েছে, যেখানে কিডনি রোগীদের হেমোডায়ালিসিস সেবা দেয়া হয়।
সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল প্রকল্প একনেকে অনুমোদন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশেষ গুরুত্ব দেয়ায় গত বছরের ২ ফেব্রুয়ারি একনেক সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল নামের একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। চার বছর মেয়াদি এ প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৩৬৬ কোটি ৩৩ লাখ ৭২ হাজার টাকা। এর মধ্যে এক হাজার ৪৭ কোটি ৩৩ লাখ ৮৪ হাজার টাকা সহজ শর্তে ঋণ দিচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ড। হাসপাতালটি হবে দেশে প্রথম এক হাজার শয্যার সেন্টার বেইসড সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল। ওই হাসপাতালে থাকবে ইমার্জেন্সি মেডিকেল কেয়ার সেন্টার, গ্যাস্ট্রো-এন্টেরোলজি ও হেপাটোবিলিয়ারি সেন্টার, চাইল্ড অ্যান্ড মাদার হেলথ কেয়ার সেন্টার, কার্ডিও অ্যান্ড সেরেব্রোভাসকুলার সেন্টার, কিডনি সেন্টার, আইসিইউ এবং কেন্দ্রীয় ডায়াগনস্টিক ও প্যাথলজি বিভাগ। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে এক ছাদের নিচেই বিশ্বমানের হৃদরোগ চিকিৎসা ও সার্জারি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে।
১০০ শ্রবণপ্রতিবন্ধী মা-বাবার মুখে হাসি
শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ডেভেলপমেন্ট অব কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট প্রোগ্রাম ইন বিএসএমএমইউ’ নামে প্রথমে তিন বছর মেয়াদি একটি কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল। ২০১০ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া কর্মসূচিটি ২০১৩ সালের জুনে সফলভাবে শেষ হয়। প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায় চলছে। এ প্রকল্পের আওতায় ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১০০ জনের সার্জারির মাধ্যমে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট ডিভাইস লাগানো হয়েছে।
বিরল রোগ থেকে নতুন জীবন
বিরল রোগে আক্রান্ত ছিল টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার জয়ভোগ গ্রামের দিনমজুর আব্দুর রাজ্জাকের মেয়ে বীথি। জয়ভোগ পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির এ শিক্ষার্থীর জন্ম থেকেই মুখে দাড়ি-গোঁফ ও শরীরে লোম ছিল। ১১ বছর বয়স থেকে বুক অস্বাভাবিক আকারে বাড়তে থাকে। সেখানে জ্বালাপোড়া শুরু হয়। এর আগে সাত বছর বয়সে দাঁত পড়ে যায়। সেই দাঁত আর গজায়নি। গত বছর ১৬ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এন্ডোক্রাইনোলজি (ডায়াবেটিস ও হরমোন) বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোঃ ফরিদ উদ্দিনের অধীনে ভর্তি করা হয় বীথিকে। ২৩ মে মুখের লোম অপসারণের জন্য মুখম-লে প্রথমবারের মতো লেজার থেরাপি দেয়া হয়। এরপর অস্ত্রোপচার করা হয় স্তনে। বর্তমানে সুস্থ ও সুন্দর জীবনে ফিরে যাওয়ার পথে রয়েছে বীথি।
বৈকালিক বিশেষায়িত বহির্বিভাগ সেবা
রোগীদের সুবিধার্থে ২০১১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের বহির্বিভাগে চালু করা হয় বৈকালিক স্পেশালাইজড কনসালটেশন সার্ভিস। এ পর্যন্ত ২১টি বিভাগে এ সেবা চালু করা হয়েছে। বিভাগগুলো হলো শিশু, চর্ম ও যৌনব্যাধি; নাক কান ও গলা; কার্ডিওলজি; ইন্টারনাল মেডিসিন; এন্ডোক্রাইনোলজি (ডায়াবেটিস ও হরমোন) মেডিসিন; রিউমাটোলজি মেডিসিন; বক্ষব্যাধি উইং; ফিজিক্যাল অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন মেডিসিন, অব্স অ্যান্ড গাইনি; চক্ষু বিজ্ঞান; গ্যাস্ট্রো-এন্টেরোলজি; নেফ্রোলজি (কিডনি); ইউরোলজি; নিউরো মেডিসিন; মনোরোগ বিদ্যা; হেপাটোলজি (লিভার); জেনারেল সার্জারি; অর্থোপেডিক সার্জারি; হেমাটোলজি; পেইন ক্লিনিক ও নিউরোসার্জারি।
বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট প্রক্রিয়া
গত বছর ১৯ মে এ বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চালু হয় হেমাটোলজি স্পেশালাইজড ল্যাব। এ প্রক্রিয়ার পথ ধরেই দ্রুত সময়ের মধ্যে বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট চালু করার কাজ এগিয়ে চলছে। আপাতত এ হেমাটোলজি স্পেশালাইজড ল্যাবটিতে রক্তরোগের বিভিন্ন জটিল এবং নতুন বিশেষায়িত পরীক্ষা সংযোজন করা হয়েছে।
অপূর্ণাঙ্গ জোড়া শিশুর সফল অস্ত্রোপচার
এ বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে সম্প্রতি অপূর্ণাঙ্গ জোড়া যমজ শিশুর অস্ত্রোপচার সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
শিশুটির মা হীরামনি বলেন, এমন অপূর্ণাঙ্গ জোড়া শিশুর চিকিৎসা দেশে আছে তা এই হাসপাতালে না এলে জানতেই পারতাম না।
এ ছাড়া একই বিভাগে আরেকটি শিশুর শরীরের প্রায় অর্ধেক অংশ নিয়ে জন্মানো পূর্ণাঙ্গ শিশু মোহাম্মদ আলীরও চিকিৎসা চলছে।
প্রথম লিকুইড বেইসড সাইটোলজি প্রযুক্তি
জরায়ুমুখের ক্যান্সার নির্ণয় করতে দেশে প্রথমবারের মতো চালু হলো উন্নততর লিকুইড বেইসড সাইটোলজি পদ্ধতি। গত ২৪ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পদ্ধতি উদ্বোধন করেন উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ কামরুল হাসান খান। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সুলভ মূল্যে সংশ্লিষ্ট রোগীরা এ পরীক্ষাটি করাতে পারবে। ভবিষ্যতে লিকুইড বেইসড সাইটোলজি পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে জরায়ুমুখের ক্যান্সার ছাড়াও অন্যান্য ক্যান্সার সঠিকভাবে নির্ণয় করা যাবে।