প্রবাসী যে ক’জন ব্যক্তির জন্য বাংলাদেশ গর্ব করতে পারে, রোটারিয়ান মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া তাদেরই একজন। প্রবাসে আছেন ঠিকই, কিন্তু মন পরে আছে এই সবুজ-শ্যামল দেশে। তাইতো ২০টি’রও বেশি সংগঠনের সাথে যুক্ত রেখেছেন নিজেকে। আমরা দেশে বসে যতটা খবরাখবর রাখি, এর চাইতে বেশি ভাবেন তিনি দেশকে নিয়ে। সুদূর যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় নিজ মেধা, মনন, প্রচেষ্টা, অধ্যাবসায়, শ্রম ও কর্তব্যনিষ্ঠার গুণে যেখানেই গিয়েছেন, পেয়েছেন সাফল্য। আমরা সুযোগ পেলে, মূল্যায়ন পেলে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে সাফল্যের সাক্ষর রাখতে পারি, মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া তাঁরই জ্বলজ্বলে উদাহরন। প্রবাসের মতো একদম নতুন জায়গায়, আত্মীয়-পরিজন ছাড়া, কারো সহায়তা ছাড়া পুরোপুরি নিজগুণে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজেকে। দেশকে তিনি ভালবাসেন, তাই দেশকে নিয়ে গিয়েছেন নতুন উচ্চতায়। তাঁর মতো মহান মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমে, ত্যাগে আজ আমরা স্বাধীন দেশে মাথা উঁচু করে কথা বলছি, স্বগর্বে বাঁচতে পারছি। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, খুব অল্প বয়সেই যোগ দিয়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধার নানামুখী অবদানের কথা না বললেই নয়। সর্বক্ষেত্রে তাঁর বিচরন, তাঁর পথচলা। তিনি থাকেন কানাডায়, কিন্তু মন পড়ে থাকে এদেশের মানুষের মাঝেই। তাঁর হৃদয় পোড়ে এদেশের জন্য। কারণ দেশকে ভালবেসেই নিজের জীবন বাজি রেখে স্বাধীন করেছিলেন তিনি। তাইতো এদেশের মা ও শিশুদের কল্যাণ তাঁর কাছে এতোটাই আগ্রহের বিষয়।
মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। কাটির হাট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে স্কুলের পড়াশুনা শেষ করেছেন। তিনি যখন দশম শ্রেণির ছাত্র তখন দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। আর সকল দেশপ্রেমিকের মতো কিছু না ভেবেই তিনিও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তাছাড়া তিনি ছাত্র-জীবনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে গঠিত স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ তথা নিউক্লিয়াসের সাথে যুক্ত হয়ে ছাত্র-রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। পাকিস্তানী শাসন-শোষনের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে এবং তৎকালীন পাকিস্তানের সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে লিখিত বই ‘পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি’ বইটি বাতিলের আন্দোলনে স্কুলের ছাত্র হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন এবং বিজয়ী হন। স্বাধীনতা-পূর্ব ও স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে স্কুল-কলেজ-থানা-বিশ্ববিদ্যালয়-জেলা ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বিভিন্ন পদে থেকে দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া দেশে ও বিদেশে তিনি বিভিন্ন সামাজিক-সংস্কৃতিক ও অদলীয় কর্মকান্ডে জড়িত আছেন।
মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটি এলামনাই এসোসিয়েশন অব কানাডা এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, চট্টগ্রাম এসোসিয়েশন অব কানাডা এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, চট্টগ্রাম এসোসিয়েশন অব উত্তর আমেরিকা এর সাবেক সভাপতি, চট্টগ্রাম এসোসিয়েশন ঢাকা এর আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি, চট্টগ্রাম এর আজীবন সদস্য; চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ এর আজীবন সদস্য, মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা পরিষদ-কাটিরহাট এর চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম কদম মোবারক মুসলিম এতিমখানার আজীবন সদস্য। তিনি সাউথ এশিয়ান-আমেরিকান ডেমোক্রেটিক এসোসিয়েশন, নিউইয়র্ক এবং বাংলাদেশি-আমেরিকান পাবলিক অ্যাফেয়ার্স ফ্রন্ট, নিউইয়র্ক এর সহ-সভাপতি ছিলেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটি কাউন্সিল কর্তৃক কমিউনিটিতে সমাজসেবায় সমগ্র উত্তর আমেরিকায় বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে প্রক্লেমেশন প্রদান করা হয়।
এছাড়া জেনারেল সেক্রেটারী হিসেবে যুক্ত ছিলেন উপজেলা সোস্যাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে; বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, চট্টগ্রাম মহানগর ইউনিট কমান্ডের সাবেক সদস্য সচিব। এতোগুলো প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিয়ে বেড়াচ্ছেন দেশকে ভালবেসে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, তিনি কানাডার মূলস্রোতোধারার রাজনীতির সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। তিনি কানাডার বর্তমান ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টি অব কানাডার একজন সক্রিয় সদস্য এবং Scarborough-Gillwood Federal Liberal Association, Canada এর নির্বাহী কমিটির পরিচালক এবং Representative for Seniors, Federal Liberal Party, Scarborough-Gillwood Riding.
গত ১৭ জুলাই ক্যাম্পাস পত্রিকার অডিটরিয়ামে এসেছিলেন এই বর্ণিল গুণাবলির কর্মযোগী ও ডায়নামিক ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া। এসময় ক্যাম্পাস সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্রের মহাসচিব ড. এম হেলাল বহুমুখী প্রতিভায় ভাস্বর মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়াকে শুভেচ্ছা উপহার হিসেবে অর্পণ করেন ক্যাম্পাস’র জ্ঞানমেলা সিরিজে প্রকাশিত সৃজনশীলতা বৃদ্ধি, আত্মোন্নয়ন ও জাতি জাগরণমুলক বিভিন্ন বই, জাতীয় সকল সমস্যার সমাধান অন্বেষণে ক্যাম্পাস রিসার্স সেলের দু’টি মডেল ও বিভিন্ন সুভ্যেনির। এছাড়া ক্যাম্পাস’র সহকারি-পরিচালক মোঃ কামাল হোসেনও ক্যাম্পাস’র অভিভাবক ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আমন্ত্রণ জানান মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়াকে। তিনি সাদরে সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। এরপর শুরু হয় মূল অনুষ্ঠানপর্ব। ইংলিশ এন্ড স্মার্টনেস কোর্স ফর লিডারশিপের ছাত্র-যুবকদের উদ্দেশ্যে অনুপ্রেরণাদায়ী অনেক কথা বললেন তিনি। কত স্মৃতি, কত অভিজ্ঞতা, কত যন্ত্রণার কথা! শিক্ষার্থীদের সাথে আদান-প্রদান করলেন তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতা। তাদের দিলেন নানা পরামর্শ, যাতে তারা ভবিষ্যতে সফল মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। হয়ে উঠতে পারে এক একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক।
ছাত্র-ছাত্রীরা মুক্তিযুদ্ধের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। ২৫ শে মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাঙালীদের উপর ঝাঁপিয়ে পরে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায়। শত শত নিরীহ মানুষ প্রাণ দেয় সেই নারকীয় হত্যাকান্ডে। পরবর্তীতে বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর বাঙালী সেনাসদস্যরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে। তারা ১১ দিন চট্টগ্রামকে নিজেদের নিয়ন্ত্রনে রাখতে পেরেছিলেন। আমাদের স্কুলের ছাত্র সাবেক সেনাপ্রধান লে. জে. হারুন-অর রশিদ এর পিতা ডাঃ মাহমুদুল হক এর নেতৃত্বে সেনাক্যাম্প পরিচালিত হতো। তাঁরা সকলেই যুদ্ধে অংশ নেয়। আমিও সাথে সাথে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতে গমন করি। ভারত তখনও সামরিক সহায়তা দেয়নি। যা সম্পদ আছে, তা নিয়ে সেনাবাহিনী আমাদের সাময়িক ট্রেনিং দেয়। সীমান্ত এলাকায় দেশের সাধারণ মানুষ চাল, ডাল, চাদর, মাংস, মুরগি দিয়ে সাহায্য করত আমাদের। সেগুলো দিয়ে রান্নাবান্নার কাজ চলে যেত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা হরিণা ক্যাম্পে আমাদের সাময়িকভাবে সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। সেখানে আরও দু’টি ক্যাম্প এর নাম ছিল ২৫শে মার্চ এর রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হওয়া রওশন আরা বেগম এবং চট্টল শার্দুল এক দফার প্রবর্তক এম এ আজিজ এর নামে। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের হরিণা ট্রানজিট ক্যাম্পে আমরা অবস্থান করি। তারপর ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অম্পি নগরের প্রথম এফ.এফ ট্রেনিং সেন্টারে পরিপূর্ণ সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করি। ১নং সেক্টরের অধীনে চট্টগ্রামের হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, রাউজান ও চট্টগ্রাম মহানগরের কিছু এলাকায় পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করি। তাছাড়া আমাদের আরও দায়িত্বের মধ্যে ছিল জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংঘটিত করা ও সংগঠক তৈরি করা, ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা, মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য শেল্টার ঠিক করা, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও রাজাকার আল-বদরদের বিরুদ্ধে গেরিলা পদ্ধতিতে Hit & Run এর মাধ্যমে তাদেরকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলা, যাতে কোথাও পাকিস্তান দিবস পালন করতে না পারে, সেদিকে সজাগ থাকা ইত্যাদি। আমাদের আকাঙ্খা আর স্বপ্ন ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের। আমরা টাকার জন্য যুদ্ধ করিনি, ক্ষমতার জন্য যুদ্ধ করিনি; যুদ্ধ করেছি দেশকে ভালবেসে, দেশের মানুষকে ভালবেসে, স্বাধীন একটি দেশের জন্য। আমাদের আশা ছিল ঘুষ ও দুর্নীতি মুক্ত সমাজ গড়ে তুলব; স্বাধীন দেশের মানুষ অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বাসস্থানের গ্যারান্টি থাকবে এবং শোষণহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু দেশ ছেড়ে আমরা আজ পরবাসী। আমরা প্রবাসীরাও সুযোগ সুবিধা পেলে দেশে ফিরতে চাই। কিন্তু দুঃখজনক, দেশের ছেলেদের দেশে ফেরাতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।
প্রবাস জীবন সম্পর্কে তিনি বলেন আরো ভালো জীবন পাবার জন্য, নিজের পরিবারকে আরেকটু বেশি স্বাচ্ছন্দ্য দেবার জন্য এবং দেশের গরিব মানুষকে সৎ উপার্জনের মাধ্যমে আর্থিক সহযোগিতা করার নিমিত্তে ১৯৯০ এর জুন মাসে ভিজিট ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাই। দেশকে বিশ্বদরবারে পরিচিত করানোর জন্যই বিদেশে চলে যাই, আমাদের রেমিটেন্স কিন্তু দেশেই আসে। পরবর্তীতে আমেরিকাতে বৈধ হওয়ার জন্য আবেদন করি এবং অক্টোবর মাসের দিকে Employment Authori“ation পাই। তারপর সাহস করে নিউইয়র্ক সিটি Board Of Education এ গেলাম। আমার সার্টিফিকেট কর্তৃপক্ষকে দিলাম। তারা সব দেখে আমাকে আমেরিকার ব্যাচেলর ডিগ্রি প্রদান করল। আমাকে Day to Day Substitute Teacher হিসেবে সনদ দেয়া হয় এবং বলা হয় Lack of 12 Credits in Education। সেখানে স্থায়ীভাবে Teaching Profession যেতে হলে তিনটি ধাপের মাধ্যমে নিজের যোগ্যতা দেখাতে হয়। প্রথম Day to Day Substitute Teacher, দ্বিতীয় Preparatory License, তারপর Final License। আমি সকালে ড্রেস পরে বসে থাকতাম। যেকোনো স্কুল থেকে কল এলে পড়াতে যেতাম। এখানে বলে রাখা ভালো, যখন আমরা পড়াতে যেতাম কলেজের প্রিন্সিপাল, ভাইস-প্রিন্সিপাল এরা আমাদেরকে অবজার্ভ করতেন। তাদের পছন্দ হলে, আমাদেরকে যোগ্য মনে করলে পরবর্তী কল অনায়াসে পেতাম। শিক্ষক এর শিক্ষাপদ্ধতি কর্তৃপক্ষের পছন্দ না হলে আর কোনো কল আসবেনা। এভাবে বছরে ৪০টি কল পেলে যে ক্রেডিটগুলো অসম্পূর্ণ সেগুলো শেষ করতে হবে এবং তারপর প্রিপারেটরী লাইসেন্স দেয়া হবে। তখন এক বছরের জন্য স্থায়ীভাবে একটি স্কুলে শিক্ষকতার সুযোগ পাবেন। আমি আপনাদের দোয়ায় ৬০ টি কল পেয়েছি, কিন্তু আমি প্রিপারেটরি লাইসেন্স আর নেই নাই। ১৯৯২-সালে নিউইয়র্ক সিটি ডিপার্টমেন্ট অব সোস্যাল সার্ভিস এর কেইস ম্যানেজারের জন্য পরীক্ষা দিলাম। সেখানে আমি ঈধংব গধহধমবৎ এর চাকরি পেলাম। তখন আমি আর Teaching Profession -এ গেলাম না। কারন ওদের কালচার আলাদা।
কানাডার জীবনযাপন সম্পর্কে তিনি বলেন, ৯৬-৯৭ সালে কানাডায় প্রফেশনাল ও দক্ষ লোক নেয়ার জন্য বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। আমি সেটা দেখে কানাডায় অভিবাসন এর জন্য এপ্লাই করলাম এবং ১৯৯৭ সালের শেষের দিকে আমি Permanent Resident এর অনুমোদন পাই । আমি ১৯৯৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কানাডায় চলে যাই। সেখানে কমিউনিকেশন ব্যবসায় কানাডার নাম্বার ওয়ান কোম্পানি Rogers Communication G Sales Consultant হিসেবে নিয়োগ পাই এবং কানাডাতে পুরো সময়টাতে এই একটিমাত্র কোম্পানিতে কাজ করেছি। আপনারা জেনে খুশি হবেন Sales Consultant হিসেবে পুরো কানাডাতে আমি প্রথম হয়েছি। এটা আমার জন্য, দেশের জন্য একটা পরম পাওয়া। আমার তখন মনে হয়েছে, আমি দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেলাম। সবাই জানল আমরা শুধু গরিব দেশ না, মেধা মননেও সেরা জাতি, প্রথম হওয়া জাতি।
প্রবাসের স্মরনীয় স্মৃতি বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন প্রবাসে কত শত স্মৃতি যে আছে! সব হয়তো বলতে পারবো না। এর মাঝে যেসব স্মৃতিতে আছে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার গল্প, দেশের পরিচয় তুলে ধরতে পারার গল্প সেগুলোই আমার প্রিয়। আমি তখন আমেরিকার একটি স্কুলে Day to Day Substitute Teacher হিসেবে কাজ করছি। একজন ছাত্র আমার স্যুট এর পিছনে চুইংগাম লাগিয়ে দিল, যেটা আমি দেখিনি। তখন ক্লাসের একজন ছাত্র আমাকে বলল, May i go out sir? হয়তো ছেলেটির বিষয়টি ভালো লাগেনি। এরপর ঐ ছেলেটি Principal -কে নালিশ করে আসলো দুষ্টু ছেলেটির বিরুদ্ধে। তৎক্ষনাৎ Principal তার পরিবারকে স্কুল থেকে বিষয়টি জানালেন এবং স্কুলে ডেকে পাঠালেন; যা খুবই অপমানজনক ওদের জন্য। Principal ছাত্রটিকে ৭ দিনের জন্য Suspend করে দিলেন। তখন আমি Principal কে বললাম, তোমাদের দেশে শিক্ষকের কোনো মর্যাদা নেই। আমাদের দেশে মা-বাবা’র পর শিক্ষকের স্থান। আমরা শিক্ষককে পা ধরে সালাম করি। বড় হয়ে মন্ত্রী হয়ে যাই বা রাষ্ট্রপতি হয়ে যাই, নিজেকে ছোটবেলার শিক্ষকের চাইতে তবুও খুব ক্ষুদ্র মনে করি। আমাদের আছে পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো সংস্কৃতি, আমরা বীরের জাতি। আমাদের দেশকে স্বাধীন করার জন্য ত্রিশ লক্ষ লোক শহীদ হয়েছেন, দুই লক্ষ মা-বোন ইজ্জত বিসর্জন দিয়েছেন। তখন তিনি খুব অবাক হলেন।
আমি পুরো কানাডায় প্রথম হওয়াতে রজার্স কমিউনিকেশন এর ভাইস-প্রেসিডেন্ট আমাকে জড়ষবী ঘড়ি উপহার দেয়ার জন্যে আমাদের সেন্টারে আসেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার দেশ কোথায়? আমি বললাম, বাংলাদেশ। তিনি প্রথমে চিনলেন না। তারপর তিনি বললেন, Its near India? আমি বললাম, No India is near Bangladesh. আমার দেশ নিয়ে এতো গর্ব দেখে তিনি খুব অবাক হলেন। ড. ইউনুছ এর কথা বলাতে তিনি বাংলাদেশকে খুব ভালো করে চিনলেন। আমার তখন আরো ভালো লাগলো। আমাদের দেশের একটা ছবি সবার মনে গাঁথা হয়ে গেছে। গরিব, দুঃখী, বন্যা ও খরা কবলিত অভুক্ত মানুষের দেশ। এখন আমরাই পারি মেধা দিয়ে, শ্রম দিয়ে সে ছবিকে পরিবর্তন করতে।
প্রবাসের সাথে দেশের পার্থক্য নিয়ে তিনি বলেন, আমি একবার আমার ছাত্রদের প্রশ্ন করলাম, তোমাদের Aim in life কি? মজার ব্যপার, বেশিরভাগ ছাত্র বললো, তারা ভলিবল খেলোয়াড় হতে চায়; যা আমাদের দেশের যুবকদের চাইতে একদম আলাদা ভাবনা। তারা খুব কমই শিক্ষক, ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। অথচ আমাদের দেশের প্রায় সবাই শিক্ষক, ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। এছাড়া, নিয়োগ প্রদানের ক্ষেত্রে দেখা যায়, আমাদের দেশে সরকারি চাকরি হলে নিজ জেলায় নয়, একদম অন্য জেলায় বদলি করা হয়। এটাকে আমি মনে করি পুরোপুরি সিস্টেম লস। কারন আপনি একজন মানুষ; আপনার পরিবার আছে, বন্ধু আছে। সব রেখে একদম অন্য পরিবেশে জীবনধারনে খুব ভোগান্তি পোহাতে হয়। না দেয়া যায় কাজে মনোযোগ, না দেয়া যায় পরিবারে মনোযোগ। জীবনের দু’টি ক্ষেত্রই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কিন্তু এর সম্পুর্ন ভিন্ন অবস্থা আমেরিকা এবং কানাডায়, যার যেই জিপ কোড সেখানেই তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। তাতে ব্যক্তির মানসিক শান্তি থাকে। প্রফুল্ল মনে কাজের ফলে সবচেয়ে ভালো আউটপুট পাওয়া যায়। বাংলাদেশ সরকারও যদি এটা নিয়ে ভাবে, তবে খুব ভালো ফলাফল পাবে আশা করি, দেশও এগিয়ে যাবে। যখন খুশি মনে সবাই কাজ করতে পারবে, আউটপুটও ভাল আসবে।
তাঁর স্বপ্ন সম্পর্কে সুবক্তা মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, দেশকে পুরো পৃথিবীর সামনে তুলে ধরে দেশের সামগ্রিক কল্যাণ সাধনই আমার একমাত্র স¦প্ন। বর্তমানে আমরা Connect Bangladesh নিয়ে কাজ করছি। এর কাজ হচ্ছে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশিদের মাঝে সংযোগ স্থাপন করা। আমাদের কাজ হচ্ছে, বিদেশে থেকেও জন্মস্থানের জন্য কাজ করে যাওয়া। মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার একজন লোকের পক্ষে দেশকে ভুলে থাকা কখনো সম্ভব নয়। প্রবাসে যত আরাম আয়েশেই থাকি না কেন, দেশের মজার সাথে কোনোকিছুর তুলনা চলে না। দেশ সবসময় দেশেই থাকে। প্রায় এক কোটির উপরে প্রবাসীরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে বলে এই প্রবাসীরা পৃথিবীর সর্বত্রই বাংলাদেশের পতাকা বহন করছে। বাংলাদেশকে সুখী-সৃমদ্ধীশালী বৈষম্যহীন দেশ দেখার জন্য সবসময় আগ্রহী এবং সাথে সাথে প্রবাসীরা দেশে মর্যাদার সাথে আসতে পারে, নিরাপদ থাকতে পারে এবং দেশের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রবাসীদের জন্মগত সূত্রে পাওয়া নাগরিক অধিকারগুলো যাতে সুসংহত থাকে সে ব্যাপারে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক ও উদ্যোগী থাকতে হবে। দেশের কল্যাণে এভাবে আমরা প্রবাসীরা দূরে থেকে নিভৃতচারীর মতো কাজ করে যাচ্ছি। আমরা কোনো নাম চাইনা, শুধু চাই দেশ এগিয়ে যাক। সবাই বলুক, এটা আমার দেশ। এরা আমার দেশের মানুষ, যারা পুরো পৃথিবীতে আলোর মতো জ্বলজ্বল করছে।