সংসদে প্রস্তাবিত বাজেট উত্থাপন করার সময় অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তাফা কামালের বক্তব্যেই স্পষ্ট ছিল যে চলমান করোনা ভাইরাস মহামারির এই সময়ে একটি ভিন্ন ধরনের বাজেট তৈরি করতে হয়েছে এবার।
বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলছিলেন, কোভিড-১৯-এর প্রভাবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে যে জরুরি এবং অপ্রত্যাশিত আর্থিক প্রয়োজন দেখা দিয়েছে তা মেটাতে এবং অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা পুনরুদ্ধারের কৌশল বিবেচনায় নিয়ে মূলত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তুত করা হয়েছে।
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে স্বাস্থ্য খাতে এতদিন কতটা কম মনোযোগ দেয়া হয়েছে এবং কত বড় ধরনের সংস্কার এক্ষেত্রে দরকার।
তাই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে অনেকেরই ধারণা ছিল এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য খাত অনেক বেশি গুরুত্ব পাবে। কিন্তু বাজেটে অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাবনায় তেমনটা দেখা যায়নি।
এই অর্থ বছরের প্রস্তাবিত মোট বাজেটের ৭.২ শতাংশ অর্থাৎ ২৯ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি অর্থ স্বাস্থ্য খাতে দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। যা গত অর্থ বছরের তুলনায় তিন হাজার কোটি টাকার মতো বেশি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলছেন, এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে সংস্কার প্রস্তাবের ক্ষেত্রে তেমন কোনো চমক রয়েছে বলে তিনি মনে করেন না।
তিনি বলছেন, যেটা হয়েছে সেটা ক্ষতে মলম লাগানোর মতো। এখন একটা ঘা তৈরি হয়েছে, মলম লাগিয়ে ভাল করলাম।
এবার শুধু করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবেলায় ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সমন্বিত স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান গবেষণায় ১০০ কোটি টাকা। চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী যারা কোভিড-১৯ মোকাবেলায় কাজ করছেন তাদের জন্য ৮৫০ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে।
কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবেলায় দুটি জরুরি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। একটি বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় এক হাজার ১২৭ কোটি টাকার। অন্যটি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের দেয়া এক হাজার ৩৬৬ কোটি টাকার।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণ মোকাবেলায় যেসব সুরক্ষা সামগ্রী রয়েছে, যেমন- মাস্ক, গ্লাভস, পিপিই, সেগুলোর দাম কমবে। হাসপাতালে আইসিইউ বা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র পরিচালনায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির দামও কমবে।
১৩০ পাতার বাজেট প্রস্তাবনায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণের জন্য যে অংশ রয়েছে, সেখানে কী করা হয়েছে, কী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে সেটিই বেশি উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে স্বাস্থ্য খাতে সংস্কারের ক্ষেত্রে কী করা হবে এবং কীভাবে করা হবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট করে কিছু নেই বললেই চলে। করোনা ভাইরাস মোকাবেলার বিষয়টিই স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সামনের দিকের পরিকল্পনায় আপাতত সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।
ডা. লেলিন চৌধুরী বলছেন, দেশে পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাই যে ভেঙে পড়েছে, এছাড়া অন্যান্য যে স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো রয়েছে সেগুলো যাতে না হয় তার জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা যে নেয়া হয় না, সেসব ব্যাপারে তেমন কোনো পরিকল্পনা সেভাবে নেই।
সরকারের উচ্চপর্যায়ের নেতৃবৃন্দের মুখ থেকেই বক্তব্য এসেছে যে স্বাস্থ্য বিষয়ক সরকারি কর্মকর্তাদের অর্থ ব্যবহার করার সক্ষমতা নিয়ে। গত কয়েক অর্থবছরে দেখা গেছে বরাদ্দকৃত অর্থ অব্যবহৃত থেকে যায়। তার কারণ কি?
বাংলাদেশে যে রোগগুলো বেশি হয় সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক নাসরিন সুলতানা বলছিলেন, সময় মতো বরাদ্দ পাওয়া যায় না। বাজেট দেয়া হয় জুন মাসে। সেটা ছাড় করতে দুই-তিন মাস চলে যায়। যখন টাকাটা পাওয়া যায়, তখন সময় মতো টাকা খরচ করার সময় থাকে না। খুব তাড়াহুড়ো হয়ে যায়। যার কারণে কাজ যে মানের হওয়া দরকার, তেমন কাজ আমরা করতে পারি না।
তিনি আরও বলছেন, প্রয়োজন কোথায়, কোন ক্ষেত্রে কতটুকু দরকার সেটা যাচাই করে বরাদ্দ হয় না। এটা একটা সমস্যা। বাজেট যখন করা হয়, পূর্ববর্তী বছরের যে টাকাটা থাকে, সেখান থেকে কিছু পার্সেন্ট বাড়িয়ে দেয়া হয়।
তিনি বলছেন, সরাসরি স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে নিয়োগ না করে আমলাদের দ্বারা স্বাস্থ্য খাত পরিচালনা করা হচ্ছে বলে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারে নজর থাকছে না। যাদের স্বাস্থ্য খাতে মাঠ পর্যায়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে তাদেরকে নীতি নির্ধারক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার কথা বলছেন তিনি।
তিনি বলছেন, যারা নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করে, তাদের স্বাস্থ্য খাতে মাঠ পর্যায়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই। দেখা গেল হঠাৎ করে একজন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বদলি হল। আগে বিষয়টা জানতে হবে, তারপর বাস্তবায়ন। কিন্তু দেখা গেল জেনে ওঠার আগেই তিনি বদলি হয়ে গেছেন।
তিনি বলছেন, বাজেট সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারার উপর সঠিকভাবে সংস্কার করতে পারার বিষয়টি নির্ভরশীল। স্বাস্থ্য খাতে সুশাসনের অভাবের কথা বলছিলেন তিনি। সেই প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলছেন এই খাতে সামগ্রী ও উপকরণ ক্রয়ে বেশি দুর্নীতি হচ্ছে।
বাংলাদেশে গত কয়েক বছর স্বাস্থ্য খাতে বেশ কিছু দুর্নীতির কেলেঙ্কারির বিষয় সামনে এসেছে। গত বছরের শুরুতে দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে একটি প্রতিবেদন দিয়েছিল। এতে বলা হয়েছিল স্বাস্থ্য খাতে ১১ টি উৎস থেকে দুর্নীতি হয়, যার মধ্যে রয়েছে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, ঔষধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও পণ্য কেনাকাটা।
এবার প্রস্তাবিত অর্থ কীভাবে খরচ করবে সরকার? দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের কী ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান খান শুধু স্বাস্থ্যখাতে চলমান কিছু কর্মকা-ের কথাই উল্লেখ করেন। তিনি জানান, হৃদরোগ, কিডনি ও ক্যান্সারের চিকিৎসা ব্যবস্থা বাড়ানোর জন্য বিভাগীয় শহরগুলোতে ১০০ শয্যা বিশিষ্ট ক্যান্সার হাসপাতাল তৈরি করা হবে।
বিদ্যমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে এবং সকল জেলা সদর হাসপাতালে নেফ্রোলজি ইউনিট ও ডায়ালিসিস কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা এবং স্বাস্থ্য বিষয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা বাড়ানোর কথাও বলেন তিনি।
কিন্তু স্বাস্থ্যখাতে রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা সেবা, রোগ প্রতিরোধ, অবকাঠামো উন্নয়ন, জনবল বাড়ানো, সুশাসন নিশ্চিত করা এই সকল দিক ঢেলে সাজানোর জন্য ব্যাপক মাত্রার এবং টেকসই সংস্কার বিষয়ে কোনো পথ-নির্দেশনা নেই।