দেশবরেণ্য শিক্ষক নেতা, কৃতি ও কীর্তিতে অনন্য প্রফেসর ড. এএসএম মাকসুদ কামালকে সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) পদে নিয়োগ দিয়েছে সরকার।
ঢাবির আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন এবং দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের এ প্রথিতযশা অধ্যাপককে উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) পদে নিয়োগ দিয়ে আদেশ জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ।
ওই আদেশে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলরের অনুমোদনক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ, ১৯৭৩-এর ১৩ (১) ধারা অনুযায়ী উপ-উপাচার্য পদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমেদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় এই শূন্য পদে চার বছরের জন্য আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন এবং দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামালকে নিয়োগ দেওয়া হলো।
উপ-উপাচার্য হিসেবে তিনি বর্তমান পদের সমপরিমাণ বেতন-ভাতা পাবেন এবং বিধি অনুযায়ী পদসংশ্লিষ্ট অন্যান্য সুবিধা ভোগ করবেন। উপ-উপাচার্য হিসেবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবিধি ও আইন দ্বারা নির্ধারিত ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব পালন করবেন।
প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তিতে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে প্রফেসর ড. মাকসুদ কামাল বলেন- এদেশের সবচাইতে ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে আমি আনন্দিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া, শিক্ষার মান বৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়কে অগ্রসর ভূমিকায় দেখার জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীবান্ধব গবেষণামুখী পরিবেশ গড়ে তোলার চেষ্টা করব। ইদানিং যে কথাগুলো উঠছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা হয় না, শিক্ষার মান নিচে নেমে গেছে -এ বিষয়গুলোতে যাতে পরিবর্তন আনা যায়, সে বিষয়গুলো সমাধানের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে সকলকে সাথে নিয়ে।
করোনা দুর্যোগে ঢাবি শিক্ষার্থীদের অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রাজ্ঞ এ শিক্ষাবিদ বলেন- জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে সকল বিভাগ অনলাইন ক্লাসরুম শুরু করেছে। অনুষদসমূহ বিভাগগুলোর সাথে আলোচনা করে কোনো সাহায্য-সহযোগিতা শিক্ষক শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন রয়েছে কিনা, এবিষয়ে রিপোর্ট প্রণয়ন করে শীঘ্রই আমার বরাবর পাঠাবে। ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে অনেকেই হয়ত অনলাইন ক্লাসরুমে অংশ নিতে পারছে না। অনলাইন এডুকেশনকে যাতে সার্বজনীন করা যায়, সেজন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে যতটুকু সহযোগিতা করা প্রয়োজন তা আমরা দেখব এবং ভিসি, ট্রেজারার, ডিনসহ প্রশাসনের অন্যান্যদের সাথে আলোচনা করে ম্যাক্সিমাম ছাত্র-শিক্ষকদের একটা ইনক্লুসিভ ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করব।
আইসিটি মিনিস্ট্রি ও টেলিকমিউনিকেশন মিনিস্ট্রি আমাদের সুপারিশ অনুযায়ী ইতোমধ্যেই ফোন অপারেটরদের সাথে কথা বলেছে; সুষ্ঠু ও সহজলভ্য ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে যাতে আমরা অনলাইন এডুকেশন কার্যক্রমকে অব্যাহত রাখতে পারি। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাথে ক্যাম্পাসের যে বন্ধন, লকডাউনের কারণে সাড়ে তিন মাস ধরে সেই যোগসূত্রতা নেই। তাই সেই যোগসূত্র স্থাপন করা, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার মধ্যে রাখা, তারা যেন সতেজ থাকে, তাদের মধ্যে যেন উদ্দীপনা থাকে, ক্যাম্পাসে ফিরে আসার পর তারা যেন পূর্ণ উদ্যমে একাডেমিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারে -এধরনের মনোবল প্রতিষ্ঠা করাই মূল লক্ষ্য থাকবে অনলাইন এডুকেশনের।
এছাড়া শিক্ষার্থীদের পাঠক্রমের যেটুকু অবশিষ্ট আছে, সেটা অনলাইনে শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ারও চেষ্টা থাকবে। এরপর যেটুকু বাকি থাকবে, তা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর হয়ত সাপ্তাহিক ছুটি কমিয়ে, কিংবা বাৎসরিক ছুটি সংকুচিত করে এবং ক্লাসের সংখ্যা বাড়িয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষতিপূরণ করার ব্যপারে এরইমধ্যে সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমাদের এখনকার লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীরা যাতে সুস্থ থাকে, বাসায় যাতে সবকিছু সুষ্ঠুভাবে মেইনটেইন করে চলে, ক্লাসের মাধ্যমে সে বার্তা পৌছে দেয়া।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবছর পূর্তি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা প্রসঙ্গে কর্মযোগী ব্যক্তিত্ব ড. মাকসুদ কামাল বলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৯তম জন্মদিবস ইতোমধ্যে আমরা উদযাপন করেছি, ১০০তম জন্মদিবসের দিকে আমরা যাচ্ছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০বছর উদযাপনকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এ সংক্রান্ত কমিটির সদস্য-সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি আমি। শতবর্ষকে লক্ষ্য রেখে মল চত্ত্বরে একটি দৃষ্টিনন্দন মনুমেন্ট করা হবে। শতবর্ষ ল্যান্ডমার্ক পরিকল্পনার ডিজাইন করা হয়েছে, স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে এবং যে স্থানে হবে তাকে কেন্দ্র করে একটি মাস্টারপ্ল্যান ও ল্যান্ডস্কেপ প্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছে।
পাশাপাশি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও গবেষণা কার্যক্রম বাড়ানোর জন্য আমাদের ব্যাপক পরিকল্পনা রয়েছে। পরিকল্পনার মধ্যে শিক্ষকদেরকে প্রয়োজনীয় গবেষণার বরাদ্দ প্রদান করার ব্যাপারটিও রয়েছে। মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি, সেটি অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। শিক্ষকগণ যাতে মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণাগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারে এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন জার্নালগুলোতে প্রকাশনা করতে পারে -সেদিকে গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়েরই উন্নতি হবে, বিশেষ করে গবেষণা সংক্রান্ত।
এছাড়া, আমাদের যে জার্নালগুলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়, বিশেষ করে ফ্যাকাল্টির যে জার্নালগুলো, সে জার্নালগুলোর মান বাড়ানোর দিকে নজর দেয়া হবে ও সেগুলোর অনলাইন সংস্করণের ব্যবস্থা করা হবে -যাতে করে ভবিষ্যতে জার্নালগুলোর ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর আমরা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো থেকে পেতে পারি।
আরেকটা বিষয় হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য পূর্বাচলে রাজউক থেকে আমরা একটা বরাদ্দ পেয়েছিলাম। আর্থিক বিষয়ে সমাধান না হলেও শতবর্ষকে সামনে রেখে সেখানকার জন্যও একটি পরিকল্পনায় আমরা যাচ্ছি। গবেষণার সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য আমাদের একটি মেডিকেল ফ্যাকাল্টি সংযুক্ত হসপিটাল সেখানে করার পরিকল্পনা রয়েছে। হয়ত সময় লাগবে, কিন্তু আমরা পরিকল্পনা করে এগিয়ে রয়েছি। আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারপ্ল্যান ছিল না, এখন সেটি প্রণীত হতে যাচ্ছে। মাস্টারপ্ল্যানের ফলে যত্রতত্র দালানকোঠা না করে বিশ্ববিদ্যালয়কে দৃষ্টিনন্দন করা যাবে বাস্তবজ্ঞানের মধ্য দিয়ে।
আরেকটি প্রক্রিয়ার দিকে আমরা যাচ্ছি। সেটি হচ্ছে- বিদেশি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা এখানে কমে গিয়েছে, তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করার প্রক্রিয়া চলমান আছে। বিশেষ করে বিভিন্ন বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব ভালো শিক্ষক আছেন, তাদের জন্য কিছু বৃত্তির ব্যবস্থা করা হবে -যাতে করে তারা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে লেখাপড়া করাতে উৎসাহিত হোন। আমাদের দেশের প্রথিতযশা শিক্ষক যারা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষকতা করান, বা উন্নত দেশের নাগরিক যারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন, তাদের আমাদের দেশে অনারারি ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে এনে শিক্ষা কার্যক্রমে যাতে আরো গতি সঞ্চার করা যায়, গবেষণা কার্যক্রমকে সতেজ করা যায় -সেটিরও পরিকল্পনা করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত র্যাংকিংয়ে যাতে একটা সম্মানজনক অবস্থানে আনতে পারি, সেজন্যে আমরা এরকম বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়েছি। গবেষণা ল্যাবগুলোকে আমরা আধুনিক ও সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করছি। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফরমেশন টেকনোলজির অবকাঠামো উন্নয়ন আমাদের শতবর্ষ পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে। উন্নত গবেষণার জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরকে ল্যাবমুখী করার পরিকল্পনা করেছি। গবেষণার প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ কেনার জন্য ইতোমধ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আধুনিক গবেষণা না হলে শিক্ষকেরা পাবলিকেশন করতে পারবে না, সাইটেশন হবে না; ফলে বিশ্ববিদ্যালয় ভালো র্যাংকিং এ যাবে না।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ বছর পূর্তিকে সামনে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাসহ যাবতীয় উন্নয়নের জন্য আমরা একটা এনডওমেন্ট ফান্ড গ্রহণ করার পরিকল্পনা করেছি। আমাদের এলামনাই এসোসিয়েশনের যারা আছেন, তাদের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে কিভাবে এটিকে চূড়ান্ত করা যায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এবিষয়ে অত্যন্ত আগ্রহী। শতবর্ষকে সামনে রেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের টিএসসিকে আরো দৃষ্টিনন্দন, আরো ব্যবহার উপযোগী এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করার ব্যাপারে বিভিন্ন পর্যায়ে বলেছেন। সেই সুযোগটিও আমার নেয়ার চেষ্টা করছি।
পাশাপাশি আমাদের শিক্ষার্থীরা বিশ্বায়নের এ যুগে, নওলেজ ইকোনমির যুগে যাতে বিশ্বমানের শিক্ষার্থী হয়ে বহিঃবিশ্বের যেকোনো স্থানে চাকরির অনুসন্ধান করতে পারেন, চাকরি পেতে পারেন, চাকরি করার যোগ্যতা অর্জন করেন -সেলক্ষ্যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমরা যে পরিকল্পনাগুলো নিয়েছি, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হয়তঃ আরো ৫-১০ বছর সময় লাগবে বা হয়তঃ আরো কম সময় লাগবে। পরিকল্পনা হাতে থাকলে এবং তা গ্রহণযোগ্য পরিকল্পনা হলে, যখন যিনি দায়িত্বে আসুন না কেন, তিনি সেটি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসবেন। আগে পরিকল্পনায় কিছু ঘাটতি ছিল, সেই ঘাটতি পূরণে আমরা বর্তমান পরিকল্পনাগুলো করেছি এবং এরকম আরো পরিকল্পনা করা দরকার। শীঘ্রই এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আমরা অগ্রণী হবো।
মোদ্দা কথা- বিশ্ববিদ্যালয় হলো জ্ঞান পরিচর্যার জায়গা, জ্ঞান সৃজনের জায়গা এবং সিনিয়র-জুনিয়র স্কলারের মধ্যে জ্ঞান আদান-প্রদান এবং মুক্ত চিন্তা ও মুক্ত বুদ্ধি পরিচর্যার জায়গা। বিশ্ববিদ্যালয়কে যদি আমরা সেদিকে নিয়ে যেতে পারি, ১০০ বছর পূর্তিকে সামনে রেখে এ অঙ্গীকারটি শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা করতে পারি, তাহলে আমাদের শিক্ষার্থীরা হয়ে উঠবে বৈশ্বিকমানের শিক্ষার্থী। বিশ্বের যেকোনো দেশে তাদের বিচরণ হবে স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ। চাকরি পাওয়া থেকে শুরু করে যেকোনো মেধার চর্চায় তারা উন্নত বিশ্বের শিক্ষার্থীদের সমতুল্য হবে -এটি আমাদের প্রত্যাশা। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবাইকে সমান্তরালে এগিয়ে আসতে হবে। শতবর্ষের এ অঙ্গীকারটি আমাদের নেয়া উচিত দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে এবং ভালোবাসার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে।