॥ মোস্তফা মামুন ॥
কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র বা ছাত্রীর সঙ্গে দেখা হলে শুরুতেই জানতে চাই, ‘হলে থাকো?’
সত্যি বললে, আরো অনেকের মতো আমারও মনে হয়, হলে না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটা পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠে না। এখনকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কতটা শেখায় আর কতটা ভোলায় সেই নিয়ে প্রশ্ন আছে। হলের রাজনৈতিক চেহারার কারণে ছাত্রদের জীবন সব সময় খুব আরামদায়কও হয়তো নয়। তবু এতগুলো তরুণের একসঙ্গে থাকা জীবনের এক চঞ্চল প্রবাহ তৈরি করে। একীভূত থাকা, ত্যাগ করা, অন্যের লড়াই থেকে শেখা -সব মিলিয়ে হলজীবনই আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রদের প্রকৃত অর্থে সমৃদ্ধ করে। তৈরি করে দেয় আগামীর লড়াইয়ের জন্য।
হলজীবনের একটা গল্প বলি শুরুতে। ঈদের ঠিক আগে আগে, সবার বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি। ট্রেন-বাস-লঞ্চের খোঁজ চলছে। পাশের রুমের একজনকে দেখা গেল সেই আলোচনায় খুব উৎসাহী না। নিজের সাধারণ নিয়মেই ডাইনিংয়ে যাচ্ছে, খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে। জিজ্ঞেস করায় এক রুমমেট বলল, ‘ওর তো বাড়িঘর নেই।’
‘বাড়িঘর নেই মানে?’
‘না হলে কি সারা বছর হলে থাকে?’
‘ঈদে বাড়ি যায় না?’
‘না। ঈদেও হলে থাকে।’
ঈদেও হলে থাকে -রুমমেটের কাছে যদিও এটা তাচ্ছিল্যের বিষয়, কিন্তু আমি এর উল্টো পিঠের করুণ ছবিটাই দেখলাম বেশি করে। একটি ছাত্র কতটা বাধ্য হলে ঈদের সময়ও হলে থাকে। হয়তো কেউ নেই। বাবা মারা গেছেন। ভাইদের আলাদা সংসার। কিংবা হয়তো অনেক দূরে থাকে, যাতায়াতে ভাড়া খরচের চেয়ে বরং সেই টাকায় গরিব মা-বাবার ঈদটা একটু ভালো হবে চিন্তা করে নিজের আনন্দটাকে কোরবানি দিয়েছে। তখন অত পরিচয় ছিল না বলে ওকে জিজ্ঞেস করিনি। পরে জেনেছি, আমার দ্বিতীয় ভাবনার সঙ্গে অনেকটা মিলে যায়। টিউশনি করত। ছাত্রের সামনে পরীক্ষা। এই সময় ছুটিতে গেলে পুরো বেতন পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা। সেই বেতন আবার বাবার চিকিৎসার জন্য খুব দরকার।
এই দুঃখ জেনে হলের প্রতি কৃতজ্ঞতাটাও বেড়ে গেল। কী সুন্দর ব্যবস্থা! হল বা বিশ্ববিদ্যালয় তার একেবারে তুচ্ছ ছাত্রদের কথাও ভেবে দেখে। না হলে ঈদে হল বন্ধ তো রাখাই উচিত। কারো আপত্তির কিছু ছিল না। যেমন- এর আগে সামরিক সরকার বিরোধী আন্দোলনের সময়ও যখন হল বন্ধ করা হতো, তখনো আপত্তির সুযোগ ছিল না। আপত্তির সুযোগ নেই, করোনার সময় হল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েও। কিন্তু আপত্তি আছে হল বন্ধ করাকে এমন প্রায় চিরস্থায়ী করা নিয়ে, যা এমনই বিবেচনাহীন সিদ্ধান্ত, যাতে ছাত্রদের তালা পর্যন্ত ভাঙতে হলো। ওরা ঠিক করছে, না ভুল করছে -এই বিতর্কে না গিয়ে বলি, আমাদের চেয়ারের এ পাশে যাঁরা বসেন, তাঁরা দরদ দিয়ে উল্টো পাশের মানুষগুলোকে দেখেন না। সমস্যার একমুখী সমাধানের চিন্তা যে নতুন সমস্যার জন্ম দেয়, সেটা নিয়ে ভাবি না বলেই আমাদের পুরো ব্যবস্থা অমানবিক রূপ নেয়।
মরিয়া ছাত্রদের মুখগুলো দেখে বুঝতে পারি কতটা বাধ্য হয়ে ওরা রাস্তায়। বাড়ি বা পরিবারের সঙ্গে থাকা সবার কাছেই আনন্দের। ছুটিও ছাত্রদের জন্য মন্দ ব্যাপার নয়। তবু ওদের ঢাকায় থাকতে হয়। কারণ কেউ হয়তো পড়ার পাশাপাশি ছোটখাটো কোনো কাজ করে। এখন সব যখন চলছে, তখন সেই প্রতিষ্ঠানও খোলা। থাকছে আরামবাগ-ফকিরাপুলের জীর্ণ কোনো মেসে। যা আয় হচ্ছে প্রায় তা-ই হয়তো ব্যয়। তাই হল খোলার দাবি করার সময় করোনা-স্বাস্থ্যবিধির কথা ওদের মাথায় আর খুব থাকে না।
আগস্ট মাসে পরিচিত এক ছাত্র ফিরে এলো ঢাকায়। হলে বা ঢাকায় থেকে যারা খুব অভ্যস্ত, ওদের পক্ষে টানা গ্রামে থাকা সম্ভব না। তাছাড়া ওর একটা টিউশনি ছিল। সেখানে অনলাইনে পড়াচ্ছিল। কিন্তু প্রত্যন্ত জায়গা থেকে সব সময় ইন্টারনেট পাওয়া যায় না। চাকরি বাঁচাতে ঢাকায়। হল বন্ধ। এই সময় আত্মীয়-স্বজনের বাসায়ও থাকার প্রত্যাশা করা যায় না। অগত্যা একটা মেসে উঠল নিম্ন আয়ের কিছু মানুষের সঙ্গে, জীবনের প্রয়োজন যাদের করোনা নিয়ে ভাবার খুব সুযোগ দেয় না। হাসতে হাসতে বলল, ‘করোনার ভয়ে হল বন্ধ; কিন্তু এখন যেখানে থাকছি সেখানে অবস্থা হলের চেয়েও খারাপ।’
‘হলের চেয়েও খারাপ বলতে?’
‘হলে রুমে থাকি ছয়জন, এখানে সে রকম জায়গায় এখন ১০ জন।’
‘বলো কী! তাহলে তো স্বাস্থ্যবিধি...’
‘এদের সঙ্গে থেকে থেকে একটা লাভ হয়েছে। এখন আমারও মনে হয়, করোনা আসলে বড়লোকের অসুখ।’
‘তাই নাকি?’
‘এই মানুষগুলো কত জায়গায় ঘোরে, কত মানুষের সঙ্গে মেশে; কিন্তু দিব্যি তো বেঁচেবর্তে আছে। এ নিয়ে বরং এখন হাসাহাসিই করে।’
সেও হাসতে থাকল। এটা হাসির বিষয় নয়। জানি। ঘনিষ্ঠ মানুষকে হারিয়েছে। পরিচিতদের ভোগান্তি ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছি, তবু অবাক হই এই শ্রেণির তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার শক্তি দেখে। করোনা শুরুর পর আমরা বুয়া-ড্রাইভারকে প্রায় তাড়িয়ে দিয়েছি। পরে দেখা গেছে নিজে আক্রান্ত হওয়ার পর সেই ড্রাইভারকেই ডাকতে হয়েছে, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এবং সে এসেছেও। আপনি এখন করোনা রোগী, আসব না-এমন ভয় বা অভিমানে যদি এই শ্রেণি পিছিয়ে থাকত, তাহলে কিন্তু অনেকের ঘর হাসপাতাল হয়ে যেত। আমরা সতর্ক। কিন্তু সতর্কতার সঙ্গে বাস্তবতা আর মানবিকতারও যোগাযোগ থাকা দরকার। না হলে সেটাই বরং একরকমের অসতর্কতা।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রুমগুলো সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। কোথাও কোথাও চার রুমের সিটে আট-দশ জন থাকে। স্বাস্থ্যবিধি মানা অনেক কঠিন। কিন্তু পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ওরা যেসব জায়গায় থাকছে, সেটা তো বরং আরো ঝুঁকির। সেই দিকটা দেখে, স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে হল খোলার একটা চিন্তা এখনই করা উচিত।
শুরু করেছিলাম হলজীবনের একটি গল্প দিয়ে। শেষও করি গল্পে। প্রথম দিন হলে উঠে রুমমেটদের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি। প্রথম একজন পরিচিত হয়ে নাম বললেন, বুলবুল। তখনকার সময়ে বুলবুল নাম তরুণদের মধ্যে খুব স্বাভাবিক। পরের জনের নাম জানা গেল রাজ্জাক। এরপর যখন আরেকজন নাম বললেন জসিম, তখন স্তম্ভিত। বাংলা সিনেমার নায়কের নামধারী সব লোক কি হলে উঠে বসে আছে নাকি! যা হোক, চতুর্থজনের নাম পল্টু। এবার নিশ্চিত হলাম, বঙ্গবন্ধু হলেই উঠেছি। এফডিসির কোনো ফ্লোরে নয়। কিন্তু ঘটনা এখানে শেষ নয়। শুরু। রাতে খুব সুঠাম দেহের, লম্বা চুলের একজন মানুষ এলেন। আর দেখলাম সবার তুমুল উত্তেজনা। সারা দিন কী কী করেছেন শুনতে চান। তিনি শোনাতে শুরু করলেন, ‘নায়িকার সঙ্গে আজ সিকোয়েন্স ছিল না। ডিরেক্টর স্যার বলেছেন, কাল হবে।’
সবাই হতাশ। আমি তখন যেন কিছু ধরতে পারছি। এই মানুষটি মাস্টার্স দিয়ে হলে রেজাল্টের অপেক্ষা করছেন। মাঝে মিলে গেছে সিনেমায় দ্বিতীয় নায়ক হওয়ার সুযোগ। ভাগ্যপরীক্ষায় নেমে গেছেন রুপালি পর্দায়। সারা দিন শুটিং শেষে রাতে এসে শোনান গল্প। তাতে নায়িকাকে নিয়ে তিনি কী করলেন না করলেন তাই নিয়ে রুমমেটদের তুমুল কৌতূহল।
কেউ কেউ এভাবে সিনেমা-নাটকে নেমে যেতে পারে। নাম সিনেমার নায়কসুলভও হতে পারে কারো কারো। কিন্তু হলে সিনেমার নায়করা থাকে না; থাকে সংগ্রাম করতে থাকা মানুষরা, খুব সাধারণ পরিবারের সন্তানরা।
আর সাধারণদের দুঃখের কথা আমরা অসাধারণরা সাধারণত বুঝতে পারি না।
-লেখকঃ সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক