গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্তের পর ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। সম্প্রতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের এক বছর পার হচ্ছে। যদিও আগামী ৩০ মার্চ থেকে স্কুল-কলেজ খোলার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। তবে সম্প্রতি আবার করোনার সংক্রমণ বাড়তে থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। দুশ্চিন্তায় রয়েছেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা।
করোনার মধ্যেও গত বছরের জুন-জুলাই থেকে অফিস, গার্মেন্ট, কলকারখানাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান এক ধরনের স্বাভাবিকতার ভেতর দিয়ে চলছে। শুধু বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতে ল-ভ- হয়ে গেছে শিক্ষাসূচি। প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় পাঁচ কোটি শিক্ষার্থী। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিতে দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অর্থনীতিতে ক্ষতি হলে বেশি কাজ করে বা নতুন বিনিয়োগ করে তা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। কিন্তু শিক্ষায় ক্ষতি হলে তা সহজেই পোষানো সম্ভব নয়। এমনকি একটি জাতিকে সারা জীবন এই ক্ষতি বয়ে বেড়াতে হয়। ফলে করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে শিক্ষায়।
করোনার জন্য গত বছরের উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি), জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। যেহেতু স্কুলই খোলা যায়নি, তাই বার্ষিক পরীক্ষাসহ কোনো পরীক্ষাই নেওয়া হয়নি। তবে সব শিক্ষার্থীকে ঠিকই পরবর্তী শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়েছে। এছাড়া জেএসসি ও এসএসসির ফলের ভিত্তিতে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হয়েছে। এতে অনেকটাই অসম্পূর্ণ শিক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীরা একটি বছর পার করেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
শুধু গত শিক্ষাবর্ষই নয়, করোনায় চলতি শিক্ষাবর্ষও হুমকির মুখে পড়েছে। সরকার এরই মধ্যে চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য ৬০ কর্মদিবসের সিলেবাস এবং এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য ৮০ কর্মদিবসের সিলেবাস প্রকাশ করেছে। এত সংক্ষিপ্ত সিলেবাস প্রকাশের পরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে না পারায় তা শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষাপঞ্জি অনুসারে, গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। আর আগামী ১ এপ্রিল থেকে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ দুই পাবলিক পরীক্ষাই কবে নাগাদ নেওয়া সম্ভব হবে, তা বলতে পারছেন না কেউ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, করোনায় সবচেয়ে বড় ক্ষতিতে যে শিক্ষাব্যবস্থাই, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আমার মত হচ্ছে, না পড়িয়ে একজন শিক্ষার্থীকে কোনো অবস্থাতেই ওপরের ক্লাসে ওঠানো যাবে না। আমার প্রস্তাব, শিক্ষাবর্ষের সময় বাড়িয়ে শিক্ষার্থীদের কিছুটা হলেও শিখিয়ে পরবর্তী শ্রেণিতে উন্নীত করা।
স্কুল-কলেজের সঙ্গে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ হয়ে যায়। মে মাস থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যায়গুলোতে অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা ও জুলাই মাস থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস শুরু হয়। কিন্তু সব শিক্ষার্থীর কাছে প্রয়োজনীয় ডিভাইস না থাকা, দুর্বল ও ধীরগতির ইন্টারনেট এবং ইন্টারনেটের উচ্চদামের কারণে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর পক্ষেই অনলাইন ক্লাস করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে দরিদ্র পরিবার ও মফস্বলের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে পড়ছে। একই সঙ্গে অনেক পরীক্ষা আটকে থাকায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বড় ধরনের সেশনজট তৈরি হয়েছে। গ্রাম-শহর ও ধনী-দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, আমি মনে করি, অর্থনীতির ক্ষতি সরকার মোকাবেলা করতে পেরেছে। কিন্তু শিক্ষায় বড় ক্ষতি হয়ে গেছে, যদিও এতে কারো হাত নেই। শিক্ষার ক্ষতি সঙ্গে সঙ্গেই বোঝা যায় না। তাই হয়তো এখনই আমরা বুঝতে পারছি না। তবে পশ্চিমা বিশ্ব ভার্চুয়াল লেখাপড়ায় বেশ এগিয়ে, সেজন্য তাদের ক্ষতি কিছুটা কম। আমাদের অনলাইন শিক্ষাও আরো জোরদার করতে হবে।
জানা যায়, ২০১৯ সালে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৭.৯ শতাংশ আর মাধ্যমিকে এই হার ছিল ৩৭.৬২ শতাংশ। ঝরে পড়ার পেছনে অন্যতম কারণ দারিদ্র্য ও বাল্যবিয়ে। বিশেষ করে শহরের বস্তিবাসী এবং চর ও হাওর অঞ্চলের শিশুরাই বেশি ঝরে পড়ে। করোনার কারণে এসব পরিবারে দারিদ্র্য আগের চেয়ে বেড়েছে। ফলে ঝরে পড়ার হারও অনেক বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।