॥ মোঃ মনিরুজ্জামান ॥
উপ-পরিচালক, ক্যাম্পাস সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্র
ক্যাম্পাস’র জ্ঞানমেলা সিরিজে প্রকাশিত ২০টি বইয়ের মধ্যে অসাধারণ ব্যতিক্রমী একটি বই হচ্ছে সর্বক্ষেত্রে অবিরাম সাফল্যের বিশেষ মানুষ হতে ১০ দিগ্দর্শন। বইটি অধ্যয়ন-অনুশীল ও চর্চার মাধ্যমে যেকোনো পাঠকের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে ইতিবাচক চিন্তা-চেতনার উন্মেষ ঘটা অনিবার্য।
বইটি লিখেছেন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক ও ক্যাম্পাস সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্র এর মহাসচিব, আমাদের শ্রদ্ধেয় ড. এম হেলাল স্যার। হতাশ মনে আশার সঞ্চার এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও ন্যায়ভিত্তিক বিশ্ব প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত ড. হেলাল স্যার একজন স্পষ্টভাষী, নির্ভীক সাংবাদিক ও সমাজ সংগঠক; মানবতা-সততা-ন্যায়বিচার এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমৃদ্ধি সম্পর্কে যাঁর রয়েছে ব্যতিক্রমী চিন্তা-চেতনা, অসাধারণ জ্ঞান ও দূরদৃষ্টি।
ব্যক্তি, সমাজ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়নমূলক বিভিন্ন বিষয়ের ওপর তিনি নিয়মিত কলাম লেখেন। জীবনধর্মী তাঁর এ সকল কলাম গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয় ক্যাম্পাস’র জ্ঞানমেলা সিরিজে। এসব বই অধ্যয়ন, অনুশীলন ও চর্চার মাধ্যমে স্বশিক্ষিত, চিন্তাশীল, সুস্থ ও সমৃদ্ধ জীবনলাভ করতে পারে যে কেউই। উন্নততর বিশেষ মানুষ হবার জন্য তথা আধুনিক, চিন্তাশীল ও সমৃদ্ধ জাতি গড়ে তোলার জন্য এ বইগুলোকে বিজ্ঞানসম্মত ও সহজ-সরল গাইড বললেও অত্যুক্তি হবে না।
ড. এম হেলাল স্যারের মৌলিক লেখার সেইরূপ একটি বিশেষ বই হচ্ছে ১০ দিগ্দর্শন। এ বইয়ে উল্লেখিত প্রতিটি দর্শনই স্যার ছোট ছোট উদাহরণের মাধ্যমে অত্যন্ত সহজ ও সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেছেন। এক বসাতেই পড়ে শেষ করার মতো ছোট্ট এ বইয়ে উপস্থাপিত স্যারের দর্শনগুলোর মাধ্যমে শুধু আমি নই, যারাই অধ্যয়ন করেছেন তারাই উপকৃত হয়েছেন বলে অনেকেই তাদের প্রতিক্রিয়া ও লেখায় জানিয়েছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস- ভবিষ্যতেও যারা এ বইটি সংগ্রহ করে পড়বেন, তারাও অবশ্যই উপকৃত হবেন। এ ১০টি দিগ্দর্শন চর্চার মাধ্যমে আমার অর্জনও কম নয়। অর্জনের দশকথা এখানে তুলে ধরছি।
সহজ-সরল ও স্বাভাবিক থাকা তথা ন্যাচারাল হওয়া
দ্রুতগতির যানবাহনের জন্য যেমনি সোজা রাস্তা দরকার, তেমনি মানুষের চিন্তাশক্তির বিকাশ ও স্রষ্টার আনুকূল্যের জন্য সরল মন দরকার। কারণ গভীর ও দূরের লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছাতে আঁকা-বাঁকা পথ তথা দ্বিধান্বিত চিন্তা-চেতনা বা মন-মানসিকতা বিরাট প্রতিবন্ধক। দূরবর্তী গন্তব্যে পৌঁছার জন্য গাড়িকে যেমনি সোজা রাস্তায় তেজী গতিতে চলতে হয়, মানবজীবনেও লক্ষ্য অর্জন বা লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য তেমনি সরল চিন্তা ও সরল বিশ্বাস অত্যাবশ্যক।
স্যারের উল্লেখিত এই সহজ-সরল উদাহরণটি আমার জীবনকে সহজ-সরল ও স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক করেছে।
যুক্তিভিত্তিক ও ন্যায়ভিত্তিক আচার-আচরণ করা
মানুষের কোনো আচরণই অযৌক্তিক বা অবৈজ্ঞানিক হওয়ার কথা নয়। যুক্তির বাইরে কোনো আচরণ থাকলে সেটি অসদাচরণ বলে পরিগণ্য। সেই অসদাচরণ তথা অন্যের সাথে অযৌক্তিক ও অন্যায় আচরণের ফলে মনোজগতের স্থিরতার পরিবর্তে উত্থিত হয় অস্থিরতার কম্পন। এ কম্পন অত্যন্ত মৃদু হলেও পরিণাম এতই ক্ষতিকর, যা শরীরবৃত্তে ভূমিকম্পের চেয়েও মারাত্মক। এরফলে নানারকম শারীরিক ও মানসিক রোগ তৈরি হতে থাকে।
এরূপ নানা যুক্তি দিয়ে স্যারের লেখা এই দর্শনটি চর্চায় যুক্তিভিত্তিক ও ন্যায়ভিত্তিক আচার-আচরণের ফলে আল্লাহর রহমতে গত ১০ বছরে অসুস্থতাজনিত কোনো ছুটি নিতে হয়নি আমাকে।
ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতার চর্চা
এ পয়েন্টে স্যার লিখেছেন- অন্যের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন ও কৃতজ্ঞতার মানসিকতা পোষণ নিজের সহজতা, উদারতা ও সুস্থতার জন্যই প্রয়োজন।
নিজের সুস্থতা কে না চায়! আমিও এত সহজে সুস্থ থাকার এ দর্শন থেকে দূরে থাকতে পারিনি। তাইতো মনের অজান্তেই মনোবীণায় ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতার ঘণ্টা এমনিতেই বেজে ওঠে। মানুষের জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ সহায়ক এরূপ ১০টি দিগ্দর্শন এত সহজ-সরল ও সুন্দরভাবে তুলে ধরার জন্য আমার এ লেখার মাধ্যমে স্যারকে অসংখ্য ধন্যবান ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তাঁর অনুজ সহকর্মী হিসেবে আমি নিজকেও ধন্য মনে করছি।
ক্ষমাশীল ও ধৈর্যশীল হওয়া
মানুষের মহৎ গুণাবলীর অন্যতম হচ্ছে ‘ক্ষমা’। অন্যকে ক্ষমা করা কেবল মহত্বের লক্ষ্যণই নয়; আপন অন্তর্জ্বালা ও দুঃখ-কষ্ট কাটিয়ে রোগমুক্ত, সুস্থ ও ব্যালেন্সড লাইফের প্রধান নিয়ামক ও শক্তি হচ্ছে ক্ষমা। ক্ষমা চাইতে পারা এবং ক্ষমা করতে পারা -দু’টোই সহজ-সরল ও উদার মনের পরিচায়ক, যা বড় মাপের মানুষদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
এ দর্শনের বিভিন্ন লেখনীতে স্যারের বড়ত্বেরও বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। যার কিছুটা ধারণ ও লালনের ফলে আমার যেকোনো ভুলের জন্য এমনিতেই নিজ মুখে ঝড়ৎৎু চলে আসে।
সময়, সুযোগ ও স্থানের সদ্ব্যবহার
এ পয়েন্টে স্যার লিখেছেন- ঞরসব ্ ঞরফব ধিরঃ ভড়ৎ হড়হব. যে সময় চলে যায়, তা আর ফিরে আসে না। এটিই সময়ের নিষ্ঠুর নিয়ম; এটি ঘূর্ণমান ও বেরসিক ঘড়ির কাঁটার বিরামহীন ধেয়ে চলা। সময়কে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তবে সময়ের সঠিক ও যথার্থ ব্যবহারের মাধ্যমে নিজকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কার্যসূচি সম্পাদনের কলাকৌশল অবলম্বন করা যায়।
সময়ের গুরুত্ব সম্পর্কে আমি ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি। স্কুল-জীবনে কোনো এক ক্লাসের বার্ষিক পরীক্ষায় সময়ের গুরুত্ব সম্পর্কে বিশাল এক রচনাও লিখেছিলাম। তারপরও সময়, সুযোগ ও স্থানের সদ্ব্যবহার -এই দর্শনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ড. হেলাল স্যার এত সুন্দরভাবে করেছেন যে, আমার স্কুল-জীবনের সেই পড়া কর্মজীবনে বাস্তবায়ন করতে অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে। তাইতো সময়ের কাজ সময়ে শেষ করার ফলে আমার তেমন পেন্ডিং থাকে না।
আত্মঅনুসন্ধান ও আত্মউপলব্ধি
জীবন চলার পথে খেয়ালের বশে বা অচৈতন্যে, অনভিজ্ঞতা বা অজ্ঞানতায় মানুষ ভুল-ত্রুটি করবে, অন্যায় করবে -এটি অপ্রত্যাশিত হলেও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সচেতন মুহূর্তে সেই অন্যায় বা ভুল-ত্রুটির বিষয়ে আত্মউপলব্ধি আসা জরুরি, যা মনুষ্যত্বের তথা মানবিক গুণাবলীর পরিচায়ক। আর যার মধ্যে এ আত্মউপলব্ধির প্রবণতা দেখা যায় না, তাকে মনুষ্যত্ববিবর্জিত বলেই ধরে নেয়া যায়।
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ দর্শন চর্চায় আমাকে প্রতিমুহূর্তে স্মরণ করিয়ে দেয় যে- আমি মানুষ, মান+হুঁশ; মনুষ্যত্ববিবর্জিত হবার কোনো সুযোগ আমার নেই।
সততার লালন ও চর্চা
সততা হচ্ছে মানব চরিত্রের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, আকর্ষণীয় ও সুকঠিন বিষয়। সততা মানুষের স্থায়ী ও অপরূপ সৌন্দর্য, যা না থাকলে অন্যের কাছে তার আকর্ষণ ও কদর চিরন্তন হয় না। বলতে গেলে মানুষের সকল আচার-আচরণ দু’ভাগে বিভক্ত- সৎ এবং অসৎ অর্থাৎ সততা ও অসততা।
এরূপ ছোট ছোট কথা, বাস্তব জীবনধর্মী উদাহরণ দিয়ে শ্রদ্ধেয় হেলাল স্যার এই দর্শনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। স্যারের লেখা এ দর্শনটি পড়ার সময়ে আমার বাল্যকালে পড়া দু’টি কথা মনে পড়ে যায়- সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ; সততার ফল অত্যন্ত মিষ্ট, অসততার ফল খুবই তিক্ত। তাই স্বর্গবাসে মিষ্ট ফল উপভোগের লোভ সামলাতে না পেরে সততার লালন ও চর্চার চেষ্টা অবিরত করে যাচ্ছি।
দায়িত্বশীল হওয়া এবং দেনা ও দায়মুক্ত থাকা
এই পয়েন্টে স্যার লিখেছেন- সুস্থ ও সবল মননের পূর্বশর্ত হচ্ছে অন্যের সকল পাওনা পরিশোধ এবং নিজের ওপর অর্পিত সকল দায়-দায়িত্ব পালন করা। এই দায়িত্ব পালনকে সংক্ষিপ্তরূপে বা সংকীর্ণমনে দেখলে চলবে না। আমাদেরকে যেমনি পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন করতে হবে, তেমনি সচেতন সুনাগরিক হিসেবে সমাজ, দেশ ও জাতির প্রতি দায়িত্ব পালন এবং স্রষ্টা ও সৃষ্টির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দায়িত্বও পালন করতে হবে।
এই দর্শন চর্চার অভিজ্ঞতায় আমি বলবো যে- আমার কর্ম ও জীবন পরিসর খুব বেশি বিস্তৃত না হলেও আমি দেনা ও দায়মুক্ত নির্ভেজাল সাদামাটা জীবনযাপন করছি। আর দায়িত্বশীল হওয়ার বিষয়ে বলতে চাই- স্যারের লেখা ১০ দিগ্দর্শন বইটি পড়ার পর থেকে আমার মনে হচ্ছিলো, এই বইটির ওপর কিছু কথা লিখা আমার দায়িত্ব; সেই দায়িত্ব পালনের প্রয়াসেই এই লেখাটি লিখেছি।
গণতন্ত্রের অনুশীলন এবং অন্যের অধিকারের প্রতি সচেতন থাকা
নিজের অধিকার সচেতনতার পাশাপাশি অন্যের অধিকারের প্রতি সদাসচেতন এবং সদাজাগ্রত থাকা সুশিক্ষা ও সভ্যতার পরিচায়ক। অন্যের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের স্বার্থত্যাগ এমনকি আত্মবলিদানেও পিছপা হন না মানবাতাবাদী আধুনিক মানুষরা। তিনিই আধুনিক ও যুক্তিবাদী মানুষ, যিনি নিজের মতের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শনের পাশাপাশি প্রতিপক্ষের অভিমতের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল থাকেন। শিক্ষা, সভ্যতা ও জ্ঞানের আলোর এ স্তরে পৌঁছার চেতনা বা সৌভাগ্য হয় খুব কম মানুষেরই।
সব ‘বেশি’ ভালো না, আবার সব ‘কম’ খারাপ না। তাই এ লেখনির মাধ্যমে স্যারকে আশ্বস্ত করে বলছি- স্যারের এ দর্শন চর্চার মাধ্যমে গণতন্ত্রমনা এবং অন্যের অধিকারের প্রতি সচেতন থাকা সেই সৌভাগ্যবান খুব কম মানুষের কাতারেই আমি থাকতে চাই।
নীতি-আদর্শ ও ধর্মকর্ম পালন
ন্যায়-নীতি ও আদর্শ রক্ষা এবং ধর্মকর্ম পালন উন্নততর মানুষের বৈশিষ্ট্য। ন্যায় ও বিজ্ঞানের দর্শনে নীতি ও আদর্শের চর্চা মানুষকে উৎকর্ষের দিকে নিয়ে যায়; যেকোনো ক্ষেত্রে সফল হওয়ার পথকে সুগম করে তোলে। তাছাড়া নৈতিক চরিত্র গঠনেও ধর্মকর্মের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সর্বশেষ এ দর্শন স্মরণে স্যারের প্রতি অন্তরের অন্তস্থল থেকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এবং মহান রাব্বুল আলামিন দয়াময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি- তিনি যেন আমাকে নীতি-আদর্শ ও ধর্মকর্ম পালনে পরিপূর্ণ করে তারপর এ পৃথিবী থেকে তাঁর কাছে নিয়ে নেন।
শেষ কথা
এবারে পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলে এ লেখা শেষ করতে চাচ্ছি। উপরে উল্লেখিত ১০টি দিগ্দর্শন চর্চায় আমার অর্জন-অভিজ্ঞতার কথা খুবই স্বল্পপরিসরে আপনাদের সাথে শেয়ার করেছি। যদি ভালো লেগে থাকে, আপনারাও বইটি সংগ্রহ করে পড়ে নিতে পারেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস- আপনাদেরও অঢেল উপকার হবে ইনশাআল্লাহ। মাত্র ৩০ টাকায় বইটি সংগ্রহ করতে যোগাযোগ করুন- ক্যাম্পাস অফিস, ৩৩ তোপখানা রোড, ১৩ তলা, ঢাকা ১০০০।
ফোনঃ ৯৫৫০০৫৫, ৯৫৬০২২৫, ৯৫১৫০৯৯
(মতামত লেখকের নিজস্ব)