আজকের অর্থনীতির যে সোনালী দিন আমরা অতিক্রম করছি, এতে জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিতের বড়রকম অবদান রয়েছে।
স্যারের সাথে সরাসরি ১০ বছরের অধিক সময় কাজ করেছি। এসময়টাতে স্যারকে দেখেছি খুব নিবিড়ভাবে। স্যার চলে গিয়েছেন, স্যারকে হারিয়ে বাংলাদেশ একজন সূর্যসন্তানকে হারালো। তিনি ছিলেন বহুগুণে গুণান্বিত, অত্যন্ত স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন, প্রতিভাধর এক বিরল ব্যক্তিত্ব। অতীতের সকল ঘটনাবলী দিন, তারিখ উল্লেখ করে নামগুলোসহ মনে রেখে সুন্দরভাবে বলতে পারতেন। এরকম বিরল অসীম প্রতিভাধর ব্যক্তি আমি খুব কমই দেখেছি। তিনি শুধু স্মৃতিশক্তিধরই ছিলেননা, অত্যন্ত মেধাবীও ছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়াদকালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সরাসরি মন্ত্রী হিসেবে তিনি দীর্ঘ ১০ বছর জড়িত ছিলেন।
আজকের অর্থনীতির যে সোনালী দিন আমরা অতিক্রম করছি, এতে জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিতের বড়রকম অবদান রয়েছে। তিনি একজন হৃদয়বান ব্যক্তি ছিলেন, জ্ঞানী প্রতিভাবান ছিলেন। তাঁকে দেখেছি যে কোন বিষয়ে অন্যের মতামত খুব মনযোগ দিয়ে শুনতে। সেগুলো খুব আগ্রহ সহকারে শুনতেন, মানুষকে বলতে দিতেন এবং একমত না হলেও তা তিনি শুনতেন। অনেক সময় প্রত্যেকটি বিষয়ে সূক্ষভাবে তিনি নিজেও জানতে চাইতেন। তাঁর এই গুণটি ছিল অপূর্ব। তিনি খুবই স্নেহপ্রবণ ও হৃদয়বান মানুষ।
এমএ মুহিত যেভাবে মানুষকে শ্রদ্ধা করতে, সন্মান করতেন; আমি মনে করি এটিও একটি বিরল নজির। তাঁর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে যেই বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছে তা হলো, তিনি সবসময় শোনার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। যে কোন সহযোগিতা চাইলে যদি তা যুক্তিযুক্ত পূর্ণ হতো, তাহলে তাতে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যেতেন। তার এই বিশেষ গুণাবলী অন্য সকলের মাঝে সাধারণত আমি দেখতে পাইনা।
২০১৮ সনের নির্বাচনী ইশতেহার রূপকল্প ২০২১ প্রণয়নে জনাব এ এম এ মুহিতের বিরাট অবদান ছিল। পরবর্তীকালে যে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাগুলো আমরা করি সেগুলো প্রণয়নেও স্যার সরাসরি দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। ব্যাষ্টিক অর্থনীতি ও সামষ্টিক অর্থনীতির উপর যে গুরুত্ব দিতে হবে, বিশেষ করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র বিমোচন, বৈষম্য কমিয়ে আনা; এই বিষয়গুলো ব্যাপারে স্যার যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তিনি বুঝতে পারতেন এগুলোর উপর গুরুত্ব না দিলে অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়া যাবেনা, দেশকে সমৃদ্ধ করা যাবে না।
বিশেষ করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এবং গ্রামকে গুরুত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে সাবেক অর্থমন্ত্রীর বিশেষ নজর ছিল। তিনি মনে করতেন, গ্রামকে এবং শহরকে সংযুক্ত করতে হবে। এ সংযুক্তির লক্ষ্যে তিনি সড়ক ও নৌ যোগাযোগসহ সমগ্র যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার উপর বিশেষ গুরুত্বারূপ করেছিলেন। তার ফলও ইতোমধ্যে আমরা পেয়েছি। বর্তমানে বাংলাদেশের যে বিস্ময়কর উন্নতি, গ্রামে-গঞ্জে যে বিদ্যুতায়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে অবকাঠামোগত যে বিস্তৃতি; এগুলো সবই স্যারের প্রণোদনায়, ইচ্ছায় এবং সরাসরি নির্দেশনায় এগুলো আমরা গ্রহণ করেছি।
ড. শামসুল আলম বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জনাব এম এ মুহিতকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখতেন। সেসময়ে অর্থমন্ত্রী কিছু বললে তিনি খুব সহজে তা ধারণ করতেন এবং মেনে নিতেন। অর্থমন্ত্রীর প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল। এই শ্রদ্ধার মূল কারণ ছিল তাঁর প্রতিভা, মেধা ও জনগণের প্রতি তাঁর ভালোবাসা এবং স্পষ্টবাদীতা। এগুলো প্রধানমন্ত্রীকে আকর্ষণ করেছে বলে আমার বিশ্বাস। তিনি দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিতে গেলে অনেক সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলতেন, আপনি চাইলে বসে বক্তব্য দিতে পারেন। সংসদেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এমএ মুহিত সাহেবকে অনেক শ্রদ্ধা, সন্মান দেখাতেন। এটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বদান্যতার এক বিশেষ দৃষ্টান্ত এবং মুহিত সাহেবের জন্য ছিল এক বিরাট পাওয়া।
শুরুর দিকে পদ্মা সেতু করতে পারাটা আমাদের জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ ছিল। অনেক বড় আঘাত আমাদের উপর এসেছে। বিষয়টি অর্থনৈতিক হলেও এর রাজনৈতিক দিকও ছিল। একটা সময় পদ্মা সেতু বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে যায়। এক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সহযোগিতা করা, শক্তি যোগানো, প্রেরণা দেয়া, আশ্বাস দেয়ার মধ্য দিয়ে এমএ মুহিত অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছেন বলে আমি মনে করি।
পদ্মা সেতু বন্ধের ষড়যন্ত্রে কানাডিয়ান কোম্পানী কর্তৃক সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেনকে মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, কানাডিয়ান কোর্টের অনুসন্ধানে আসলে কিছুই বেরিয়ে আসেনি। এটি ছিল সম্পূর্ণ ভুল, বিভ্রান্তিকর ও প্ররোচনামূলক যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি অপূর্ব বিজয় বলে প্রতীয়মান। বিশেষ করে এই ধরণের আন্তর্জাতিক একটি সংস্থা বাংলাদেশকে এভাবে বিভ্রান্তিতে ফেলবে, যা ছিল অকল্পনীয় বিষয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজনীতিতে সবসময়ই চ্যালেঞ্জ নিয়ে থাকেন, কিন্তু অর্থনীতির ক্ষেত্রে স্বঅর্থায়নে পদ্মা সেতু করার যে সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছিলেন, তা ছিল বিরাট এক চ্যালেঞ্জ এবং সেক্ষেত্রে প্রেরণা ও কৌশল যোগাতে এমএ মুহিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বড় সহযোগী ও সহকর্মী। এসময়টাতে তিনি এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন।
পদ্মা সেতু ও আবুল হোসেনকে নিয়ে এরূপ চক্রান্ত সম্পর্কে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও ক্যাম্পাস পত্রিকার সাক্ষাৎকারেও অনেক সময় বলতেন, পদ্মাসেতু নিয়ে অনেক বড় ভুল বুঝাবুঝি হয়ে গেছে, তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেনকে এতদবিষয়ে ক্ষতিপূরণ দেয়া উচিৎ। এই প্রসঙ্গে ড. শামসুল আলমের মতামত জানতে চাইলে তিনি জানান, এটি মুহিত স্যার প্রথম থেকেই বলে এসেছেন; সৈয়দ আবুল হোসেন এসবের সাথে জড়িত নয়। সেটি প্রমাণিতও হয়েছে তিনি দোষী নন। শুধু সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনই নয়, আমাদের কিছু আমলাও এতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। এনবিআর এর সাবেক চেয়ারম্যানকে এই অভিযোগে জেলেও যেতে হয়েছিল। কাউকে কাউকে গ্রেফতার করা, কাউকে পদত্যাগে বাধ্য করার মাধ্যমে বিশ্বব্যাংকে এজাতীয় কর্মকান্ড থেকে বিরত রাখার জন্য সরকার যথেষ্ট চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু এতেও বিশ্বব্যাংক তা থেকে দমেনি। তবে সত্যের জয় একসময়ে যে হয়েই থাকে, তা আবারও প্রমাণিত হলো। কানাডিয়ানরা প্রমাণ করলো এর কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই।
আগামী জুন ২০২২ ইন শা আল্লাহ সেই স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন হতে যাচ্ছে যা হবে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও কূটনীতির ক্ষেত্রে চরম বিজয়। বাঙ্গালীরা বিশেষত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে কথায় নয়, কাজে বিশ্বাস করেন তা স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মানের মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হলো।