সাবেক অর্থমন্ত্রী এম এ মুহিত সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে ক্যাম্পাস পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে সাবেক মন্ত্রী ও সাকো ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড-এর প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আবুল হোসেন বলেন-
এম এ মুহিত ছিলেন ইতিহাস প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব। তাঁর বহুমাত্রিক কর্মজীবন দেশের ইতিহাসের এক সোনালী অধ্যায়। তাঁর কোনো কাজে ভুল হলে, কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তিনি তাঁর ভুল স্বীকার করতেন। পদ্মা সেতুর বিষয়ে আমার প্রতি ভুল ধারণার জন্য পরবর্তীতে তিনি লজ্জিত হয়েছেন, ক্ষমা চেয়েছেন।
তাঁর মৃত্যুতে আমরা গভীর শোকাহত।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের মৃত্যুতে আমি গভীর শোক প্রকাশ করছি। তিনি ইতিহাস প্রসিদ্ধ ব্যক্তি ছিলেন। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের অধিকারী ছিলেন। তাঁর বহুমাত্রিক কর্মজীবন দেশের ইতিহাসের এক সোনালী অধ্যায়। তিনি ছিলেন সদা হাস্যোজ্জল, কর্মযোগী ও জ্ঞানী মানুষ। তাঁর কথা বলার স্পষ্টতা, সরলতা ও সাহসিকতা ছিল সর্বমহলে প্রশংসিত। তিনি ছিলেন দেশের একজন কৃতিসন্তান। বড় মাপের মানুষ। একজন ভালো মানুষ। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশ একজন দেশসেরা রতœকে হারালো।
দেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি দেশের অর্থনৈতিক পুর্নগঠনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার “উন্নয়ন ভিশন” বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি একজন সোজাসাপটা কথা বলার মানুষ ছিলেন। কোন কাজে ভুল হলে, কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তিনি খোলাখুলিভাবে ভুল স্বীকার করতেন এবং সরাসরি ‘সরি’ বলতেন।
আমি ২০০৯ সালে যোগাযোগমন্ত্রী হই। মন্ত্রীত্বের প্রথম দিন থেকেই আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র নির্দেশ এবং আমার দায়িত্ববোধ থেকে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করি। পদ্মা সেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল, কর্ণফুলি টানেলসহ নানা মেগা প্রকল্প গ্রহণ করি। বিশেষ করে, প্রথম দিন থেকে মেগা প্রকল্প হিসেবে ‘পদ্মা সেতু নির্মাণে’ সর্বাধিক গুরুত্ব দেই। দুই বছরের মধ্যে পদ্মা সেতুর প্রস্তুতিমূলক কাজ সমাপ্ত করি। বঙ্গবন্ধু সেতু অর্থাৎ যমুনা সেতুর ক্ষেত্রে এ পর্যায়ে কাজ করতে ১০ বছর সময় লেগেছে। টেন্ডার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে আসি। ঋণদাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক, জাইকা, এডিবি ও আইডিবি’র সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করি। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতু চালুর টার্গেট নিয়ে কাজ শুরু করি। যাতে ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পদ্মা সেতু নির্মাণের এ সাফল্য জনগণের কাছে তুলে ধরতে পারে।
হঠাৎ লক্ষ্য করি, প্রস্তুতি কাজের চূড়ান্ত পর্যায়ে দেশি ও আন্তর্জাতিক একটি চক্র পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে ধীরগতির প্রক্রিয়া শুরু করে। বিশ্বব্যাংক থেকে নিয়োগকৃত প্রকল্প সমন্বয়কারী পাকিস্তানী বংশোদ্ভুত এক বিহারী কর্মকর্তা এ প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হন। এই কর্মকর্তার নিয়োগের বিষয়টি আমি অর্থমন্ত্রীকে জানিয়েছিলাম এবং তাঁকে বাংলাদেশে পদ্মা সেতুর কার্যক্রমে প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর হিসাবে গ্রহণ না করার জন্য বলেছিলাম। কিন্তু অর্থমন্ত্রী আমার কথা শুনেননি। এ পর্যায়ে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশস্থ তৎকালীন কান্ট্রি ডিরেক্টর এবং স্থানীয় প্রতিনিধিরা আমাকে কাজ শ্লো করার পরামর্শ দেয়। উল্লেখ্য, তৎকালীন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশস্থ কান্ট্রি ডিরেক্টর বিশ্বব্যাংকের তদবিরকৃত ঠিকাদারকে প্রি-কোয়ালিফাইড হিসেবে নির্বাচন করাতে না পেরে, দরপত্র দাখিলের যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হওয়ার পর থেকে অন্য সূরে কথা বলা শুরু করেন। তিনি পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে ধীর পদক্ষেপ নিতে আমাকে বারবার অনুরোধ করে। তিনি পরবর্তী সরকারের মেয়াদে পদ্মা সেতু এগিয়ে নেয়ার কথা বলেন। কিন্তু আমি সাহসিকতা ও সততার সাথে দায়িত্বপালনে, পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে অগ্রসর হই। এক্ষেত্রে তারা নানা কারণ উপস্থাপন করে। আমি যখন তাদের কথায় সাড়া না দেই- তখন তারা পদ্মা সেতু প্রস্তুতি প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির কথা বলা শুরু করে।
স্থানীয় এজেন্ট দিয়ে ভুয়া অভিযোগ তোলে। স্থানীয় পত্রিকার মাধ্যমে ভুয়া অভিযোগের ভিত্তি করে দুর্নীতির সন্দেহ পোষণ করে সরকারকে, আমাকে সম্পৃক্ত করে নানা প্রচারণার আশ্রয় নেয়। এ দিয়েই ষড়যন্ত্রের প্রথম সূত্রপাত। অসত্য ও ভিত্তিহীন অভিযোগের ভিত্তিতে কতিপয় পত্রিকায় অসত্য, মনগড়া রিপোর্ট করে, যোগাযোগমন্ত্রীর অফিস সংস্কার নিয়ে, নতুন গাড়ি ক্রয় নিয়ে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রেরণের একটি সারসংক্ষেপের খসড়া বিকৃত এবং আমার ও আমার ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর সুপার ইম্পোজ করে কয়েকটি চিঠির মাধ্যমে অসত্য সংবাদ প্রকাশ করে। এসব পত্রিকা উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাকে সমালোচিত করেছে। পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে স্বার্থান্বেষী অভিযোগকারীদের অসত্য অভিযোগে মনগড়া তথ্য মিশিয়ে আমাকে জড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। অফিস সংস্কার, গাড়ি ক্রয় ও পদ্মা সেতু নিয়ে কার্টুন ছাপানো হয়েছে। অনেক উপসম্পাদকীয় ও সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে। টকশোতে অলোচনা হয়েছে। অথচ এসব অভিযোগের সাথে আমার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাকে বিতর্কিত করার জন্য এসব অসত্য খবর প্রকাশ করা হয়। আমি এসব অনাহুত ও ভিত্তিহীন অসত্য খবরের প্রতি গুরুত্ব দেইনি। কারণ, আমার সততা, স্বচ্ছতা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার প্রতি অগাধ বিশ্বাস ছিল। এই বিশ্বাসের জোরে আমি পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাই।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমি পদ্মা সেতুর কাজ টার্গেট অনুযায়ী সমাপ্ত করতে, ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে চালু করতে বদ্ধপরিকর ছিলাম। আমাদের লক্ষ্য ছিল পরবর্তী নির্বাচনে এটা সরকারের সাফল্য হিসেবে জনগণের কাছে তুলে ধরা। পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রস্তুতি পর্যায়ে যে কোন অনিয়ম হয়নি, দুর্নীতি হয়নি- তা আজ দিবালোকের মতো সত্য। অথচ এই পদ্মা সেতু নিয়ে সংগঠিত ও পরিকল্পিত দেশি ও বিদেশী ষড়যন্ত্রের কারণে পদ্মা সেতু নির্মাণ ৯ বছর বিলম্বিত হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করতে হয়েছে। আর আমাকে বিনাদোষে ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয়েছে, পদত্যাগ করতে হয়েছে। দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত আমার সুনাম বিনষ্ট হয়েছে। দেশের ক্ষতি হয়েছে। পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়েছে। বিলম্বের কারণে পদ্মা সেতুর অর্থ ব্যয় বেড়েছে। পদ্মা সেতু নিয়ে যারা আড়ালে-আবডালে ষড়যন্ত্র করেছে, সে সব রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা, স্বনামখ্যাত ব্যক্তিরা ষড়যন্ত্র করেছে, তারাই এ অতিরিক্ত ব্যয় ও বিলম্বের জন্য দায়ী।
বিশ্বব্যাংকের নির্লজ্জ হম্বিতম্বি এবং পদ্মা সেতুর নির্মাণের স্বার্থে এবং পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য এ সময় আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছিলাম- সেতু বিভাগকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মশিউর রহমানকে সেতু বিভাগের দায়িত্ব দিতে। এর আগে সেতু বিভাগ রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের অধীন ছিল। এ বিষয়টি আমি প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভীকেও জানিয়েছিলাম। এ সময় গওহর রিজভীর বাসায় বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমান ছিলেন। তাঁর উপস্থিতিতে আমি বলি, যোগাযোগ মন্ত্রণালয় আঁকড়িয়ে থাকতে আমি আগ্রহী নই। আমি চাই, পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হোক- প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার ও দেশের মানুষের আকাক্সক্ষা পূরণ হোক। গওহর রিজভী বিষয়টি ইতিবাচক ভেবে প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলবেন বলে জানালেন। পরে আমাকে আইসিটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু এরপরও বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে ফিরে আসেনি।
যথাসময় অর্থাৎ ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতু চালুর টার্গেট করে আমি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কাজ শুরু করি। আমি বিভিন্ন দেশে বড় বড় অবকাঠামো পরিদর্শন ও অভিজ্ঞতার আলোকে অবকাঠামো সম্পর্কিত শিক্ষা এবং এ বিষয়ে টেকনিক্যাল জ্ঞান অর্জন করেছিলাম। পদ্মা সেতুর প্রস্তুতি কাজ করতে গিয়ে আমি দেখেছি, জাপানি গৃহীত ডিজাইন। আমি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেনি, লেখাপড়া করেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনুসন্ধানী মন এবং জানার আগ্রহ নিয়ে আমি বিশ্বের বড় বড় সেতু এলাকা পরিদর্শন করেছি। এমনকি আমি নর্থ আমেরিকার সেনটিনিয়াল পানামা ব্রিজ একবার পরিদর্শন করেছি। এটি প্যান-আমেরিকান হাইওয়ে ক্যারিয়ার হিসেবে প্রতিস্থাপনের জন্য নির্মিত হয়েছিল। যা ২০০৪ সালে চালু করা হয়। আমি চীনের হুয়েই প্রদেশের য়িলিং জেলার স্যান্ডোপিং শহরে (Sandouping, Yilling, Hubei) পৃথিবীর সর্ববৃহৎ থ্রি গরজেস প্রকল্প (Three gorges project) কয়েকবার পরিদর্শন করেছি BFA’র (Boao Forum for Asia) সদস্য হিসেবে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য, বোয়া ফোরামের বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে আমেরিকার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট সিনিয়র জর্জ বুশ-এর সঙ্গে একবার এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একবার। তখন শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেত্রী ছিলেন।
চীনে সিঙ্গেল ডেকার নির্মিত বিশ্বের দীর্ঘতম সেতু ড্যানইয়ং কুলসান মহাসেতু (Danyang-Kunshan Grand Bridge), বেইজিং-এর তিয়ানজিং গ্র্যান্ড ব্রিজ (Tianjin Grand Bridge), উইনান উইহে গ্র্যান্ড ব্রিজ (Wuhan Yangtze grand Bridge), বেইজিং গ্র্যান্ড ব্রিজ (Beijing Grand Bridge), বেইজিং তিয়ানজিং ব্রিজ (Beijing Tianjin Bridge), হ্যাংজো বে ব্রিজ (Hangzhou Bay Bridge) ও রান ইয়াং ব্রিজ (Runyang Bridge) আমি পরিদর্শন করেছি। হ্যাং জো বে ব্রিজ কানেকটিং নিংবো (Hangzhou Bay Bridge Connecting Shanghai-Ningbo) ৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুর নির্মাণ পর্যায় থেকে কয়েকবার পরিদর্শন করেছি। ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ সাংহাই সি ব্রিজ কানেকটিং ডিপ-সি পোর্ট (Shanghai East Sea Bridge) আমি পরিদর্শন করেছি।
এছাড়া, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার অনেক উল্লেখযোগ্য ডবল ডেকার ব্রিজ যেমন, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ডবল ডেকার সেতু চীনের ইয়াংসিগাং (Yangsigang), সাংহাই-এর মিনপু ব্রিজ (Minpu Bridge), জিয়াংজু প্রদেশের ওউসেনজ্যাশন ব্রিজ (Wufengshan Bridge) এবং টেনসিংজো ব্রিজ (Tianxingzhan Bridge) এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে বেনপো ব্রিজ (Banpo Bridge) পরিদর্শন করি। আমি ভারতের মোম্বাইতে সি-বে ব্রিজ অবলোকন করেছি। বিভিন্ন সময়ে এসব থেকে যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছি, তার আলোকে কারিগরি কমিটিকে পদ্মা সেতুর ডিজাইনে কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে ডাবল ডেকার সেতু নির্মাণের জন্য অনুরোধ করেছিলাম। আমি আরো প্রস্তাব রেখেছিলাম, স্ট্রাকচারাল ডিজাইন এমনভাবে করতে হবে- যাতে করে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলেও ব্রিজের তেমন কোনো ক্ষতি না হয়। এক্ষেত্রে জাপানি বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিতে অনুরোধ করি। কারণ, জাপানিরা ভূমিকম্প সহনীয় ডিজাইন এক্সপার্ট।
উল্লেখ্য, অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য আমি হংকং-এর ঝুহাই মাকাও ব্রিজ (Hongkong-Zhuhai-Macou Bridge) যেটি সমুদ্র পৃষ্ঠে ১৬ কিলোমিটার এবং সমুদ্র ভূ-গর্ভস্থ ৩৯ কিলোমিটার অর্থাৎ ৫৫ কিলোমিটার সেতু নির্মাণকালীন সময়ে একাধিকবার পরিদর্শন করেছি এবং নির্মাণ শেষেও আমি এটি প্রত্যক্ষ করেছি। বর্তমানে পদ্মা সেতুতে ‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং’ এর সক্ষমতা হচ্ছে ১০ হাজার টন, যা পৃথিবীর কোন সেতুতে নেই। ৯ মাত্রার ভূমিকম্পেও সেতু টিকে থাকার সক্ষমতা রয়েছে।
আমি তখন লব্দ অভিজ্ঞতার আলোকে কারিগরি কমিটির প্রধান অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীকে বলেছিলাম, পাইলিং করতে গিয়ে যদি শক্ত মাটি পাওয়া না যায়, নরম মাটি স্তর আসে তাহলে কনক্রিট গ্রাউটিং পদ্ধতিতে কেমিক্যাল ব্যবহার করে ফাউন্ডেশন দেয়ার বিধান রাখতে অর্থাৎ নরম মাটি এলে তা কেমিক্যাল দিয়ে কংক্রিট এ রূপান্তর করা সম্ভব। আমি এক্ষেত্রে চায়নার উদাহরণ দেখিয়েছি। আমি এক্ষেত্রে Three Gorges Dam project on Yangtze River, Xiaolangdi Project on yellow River, Baoshan Steel Inc., Shanghai, Metro line, Shanghai, Shanghai Plaza Project, Shanghai Out – Huangpur Tunnel, Shanghai – Honk Kong New World Plaza, Xiang’an Subsea Tunnel, Xiamen এবং Wicheng Road, Wuxi, China’য় আমার দেখা ও জানার অভিজ্ঞতার কথা তাঁকে বলেছি। আমি আরো বলেছি, পাইলিং করতে গিয়ে মাটির গভীরে গ্যাস পাওয়া গেলেও ফাউন্ডেশন করা সম্ভব- এ বিষয়টি আমি চায়নার একটি টিভি চ্যানেলে স্ববিস্তারে দেখেছি।
পাইলিং করতে গিয়ে যদি নরম মাটি পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে কি করণীয় সে বিষয়ে সিউল থেকে দেশে ফেরার পথে হংকং-এ পদ্মা সেতুর ডিজাইন কনসালটেন্ট Maunsell AECOM-এর সাথে আমার এক বৈঠক হয়। তারা চাইনিজ বংশোদ্ভূত বিশ্বখ্যাত এক আমেরিকান ডিজাইনারকে পদ্মা সেতুর ডিজাইন করার দায়িত্ব দিয়েছিল। এ বৈঠকে তারা আমাকে ধারণা দিয়েছিল যে, যেহেতু পদ্মা নদী উত্তাল ও বিভীষিকাময়, রিভার বেড দ্রæত পরিবর্তনশীল, সেজন্য এতে সেতু তৈরির জন্য আলাদা ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন হতে পারে। হঠাৎ নদীর তলদেশের মাটি সরে যাওয়া, পলিমাটির স্তর পাওয়া এবং হঠাৎ চর জেগে ওঠা- পদ্মার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাই সেতু নির্মাণে স্টিলের পাইল স্ক্রিনে বিশেষ ধরনের কেমিক্যাল সংমিশ্রণে কংক্রিট গ্রাউন্টিং পদ্ধতি অবলম্বন করতে হতে পারে। তারা আমাকে এ ধরনের ইঙ্গিত দিয়েছিল। বস্তুত, এ ধরনের মতামত বা এ ধরনের পরিস্থিতি উদ্ভব হতে পারে- এ বিষয় জাপানি কনসালটেন্টের ডিজাইনে কোনো ইঙ্গিত ছিল না।
কারিগরি কমিটিকে আমার অর্জিত সেতু সম্পর্কিত টেকিনিক্যাল জ্ঞান এবং আমার এসব চিন্তাভাবনা শেয়ার করি। আমি ফাউন্ডেশন ডিজাইন, চুক্তিমূল্যে কোন ভেরিয়েশন না রেখে লামসাম (Lum-Sum) রাখা, পাইলিং করতে গিয়ে যদি শক্ত মাটি, শক্ত বালি বা পাথরের স্তর না পাওয়া যায়, তাহলে শর্ত মোতাবেক ৬টির পরিবর্তে ৮টি পাইল বসিয়ে একই ব্যয়ে স্টিল পাইল স্ক্রিনে কেমিক্যাল দিয়ে কংক্রিট গ্রাউন্টিং পদ্ধতি ব্যবহার, ব্রিজটি আরো ৫ ফুট উঁচু এবং পদ্মা সেতুর মধ্যভাগে কয়েকটি স্পানে এক্সট্রা ডোজ ক্যাবল স্ট্রেইট করাসহ নানা টেকনিক্যাল বিষয়ে গুরুত্ব দেয়ার জন্য কনসালটেন্ট-এর সাথে কথা বলি। কারিগরি কমিটি প্রধান জামিলুর রেজা চৌধুরীকেও বিষয়টি অবহিত করি এবং এ বিষয়গুলো পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে তাঁকেও অনুরোধ জানাই। কিন্তু জামিলুর রেজা চৌধুরী আমার কথা গুরুত্ব দেননি। এ বিষয়ে আমি অর্থমন্ত্রীকে অবহিত করলে তিনি আমার কথার উপর গুরুত্ব না দিয়ে জামিলুর রেজা চৌধুরীর কথার উপর গুরুত্ব দেন। অথচ বুয়েটের কতিপয় আওয়ামী লীগ পন্থী প্রকৌশলীগণ ভিন্ন মতাদর্শের লোক হওয়ার কারণে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে কারিগরি কমিটিতে নেয়ার বিষয়ে আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত তাকে পদ্মা সেতুতে সম্পৃক্ত করেন। উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাংক যখন পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অসত্য ও ভিত্তিহীন অভিযোগ তোলে ও নির্মাণ বিলম্বিত করার ষড়যন্ত্র শুরু করে- তখন জামিলুর রেজা চৌধুরী সরকার এবং আমার পক্ষে একটি কথাও বলেননি। তিনি নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করেন।
আমার আশঙ্কা অনুযায়ী পদ্মা সেতুর নির্মাণ পর্যায়ে দেখা গেল একাধিক পিলারের মাটির তলদেশে শক্ত মাটি নেই, তরল মাটি যা পাইলিং-এর উপযুক্ত নয়। এ ক্ষেত্রে কি করণীয় সে ব্যাপারে কোরিয়ান সুপারভিশন কনসালটেন্ট তখন পর্যন্ত ছিল অনভিজ্ঞ। এ সময় পদ্মা সেতু নির্মাণে বর্তমান ঠিকাদার ৬টির পরিবর্তে ৮টি পাইলের প্রস্তাব করেছিলো বলে আমি শুনেছি। কিন্তু বর্তমান কোরিয়ান সুপারভিশন কনসালটেন্ট সে পথে না গিয়ে গবেষণার নামে সময়ক্ষেপণ করেছে প্রায় দুই বছর। শেষ পর্যন্ত Maunsell AECOM-এর ডিজাইনার আমাকে যে ইঙ্গিত দিয়েছিল সে ধারণাই কনসালটেন্টের পরামর্শে গৃহীত হয়েছে। তবে ৬টা পাইলের পরিবর্তে ৭টা পাইল বসিয়ে স্টিল পাইল স্ক্রিনে কেমিক্যাল দিয়ে কংক্রিট গ্রাউন্টিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। শুরুতেই বর্তমান চায়না ঠিকাদারদের পরামর্শ গ্রহণ করলে অনাকাক্সিক্ষত অবস্থার সৃষ্টি হতো না, সময়ক্ষেপণ হতো না। এছাড়া, এই পদ্মা সেতুর খুঁটির নিচে সর্বোচ্চ ১২২ মিটার গভীরে স্টিলের পাইল বসানো হয়েছে। বিশ্বে এখনো পর্যন্ত কোনো সেতুর জন্য এত গভীরে পাইলিং-এর প্রয়োজন হয়নি। নদীশাসনের জন্য ১১০ কোটি মার্কিন ডলারের চুক্তি হয়েছে। এর আগে বিশ্বে নদীশাসনে এককভাবে এত বড় দরপত্র আর কখনো হয়নি।
উল্লেখ্য, একজন বিডারকে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে বাদ দিয়ে পদ্মা সেতুর ঠিকাদার আমার রেখে যাওয়া প্রি-কোয়ালিফাইড বিডারদের মধ্যে থেকে নির্বাচন করা হলো। কিন্তু সুপারভিশন কনসালটেন্ট নিয়োগে নতুনভাবে প্রি-কোয়ালিফিকেশন আহবান করা হলো। অথচ এসএনসি-লাভালিনকে বাদ দিয়ে অন্যদের মধ্য থেকে সুপারভিশন কনসালটেন্ট নির্বাচন করা সমীচীন ছিল। নতুনভাবে প্রি-কোয়ালিফিকেশন দরপত্র আহবানের ফলে কোরিয়ার মতো তুলনামূলকভাবে অনভিজ্ঞ সুপারভিশন কনসালটেন্ট নিয়োগ পেল। যদি নতুন প্রি-কোয়ালিফাইড টেন্ডার আহবান না করে পূর্বের দ্বিতীয় সর্বনি¤œ প্রি-কোয়ালিফাইড বিডার Maunsell AECOM’কে নির্বাচন করা হতো, তা হলে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। এক্ষেত্রে ঠিকাদার নিয়োগে এক নীতি এবং সুপারভিশন কনসালটেন্ট নিয়োগের ক্ষেত্রে অন্য নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে সময়ক্ষেপণের মাত্রা আরো বেড়ে গেল এবং নির্মাণ ব্যয়ও বাড়লো।
অনেক গবেষণা ও কালক্ষেপণ করে স্টিল পাইলে ‘স্ক্রিন গ্রাউটিং’ পদ্ধতিতে কেমিক্যাল ব্যবহার করে কনক্রিট গ্রাউটিং ফাউন্ডেশন দেয়া হয়েছে যা Maunsell AECOM-এর আমাকে দেয়া আগের মৌখিক পরামর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। গবেষণার নামে দুই বছর শুধু সময় ক্ষেপণই হলো না, নির্মাণ ব্যয়ও বাড়লো।
দেশীয় অর্থে পদ্মা সেতুর প্রস্তুতি, জমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পূর্ত কাজে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়। এই ব্যয়ে কোন সংস্থা বা দেশীয় পত্রিকাগুলো কোন অভিযোগ তুলতে পারেনি বা তুলেনি। বরং পদ্মা সেতুর প্রত্যাশিত দাতাসংস্থাগুলো এসব কাজের সুষ্ঠুতা ও অগ্রগতির ভূয়সী প্রশংসা করেছে। পরবর্তীতে নানা কল্পিত ও ভুয়া অভিযোগ এনে পদ্মা সেতু নির্মাণ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করেছে। যেখানে পদ্মা সেতু নির্মাণে কোনো অর্থ ছাড় হয়নি, কোনো ঠিকাদার নিয়োগ হয়নি- সেখানে বিশ্বব্যাংক ও দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হয়েছে, দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে, কীভাবে বলে। এর মানে ষড়যন্ত্রকারীরা ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ সরকার যাতে পদ্মা সেতু নির্মাণ শেষ করতে না পারে এবং পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের ‘বিজয় নিশান’ যাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে না ওড়ে- সেই ব্যবস্থাই পাকাপোক্ত করেছিল।
কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে? সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে নিজস্ব অর্থায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন। পদ্মা সেতু নির্মাণের পরবর্তী ইতিহাস দেশবাসী ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের জানা। পদ্মা সেতুতে সরকার এবং যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে আমার যে কোন অনিয়ম ছিল না, কোন দুর্নীতি ছিল না এবং পদ্মা সেতুতে যে কোন দুর্নীতি হয়নি তা দুদকের তদন্ত ও কানাডার আদালতের রায়ে প্রমাণিত হয়েছে। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের সাহসী পদক্ষেপ এবং সততা বিশ্বব্যাংককে নতুনভাবে বাংলাদেশের বিষয়ে চিন্তা করার পথ দেখিয়েছে। পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দাতারা ঋণচুক্তি স্বাক্ষরের পরেও সরে যাওয়ায় মানীয় প্রধানমন্ত্রী সাহসিকতার সাথে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন- নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করবেন। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের প্রীতির কারণে অর্থমন্ত্রী ধীরগতিতে অগ্রসর হন। এমনকি বিশ্বব্যাংকের সাথে দেন-দরবার করে কালক্ষেপণ করেন। এই কালক্ষেপণ করাটিও সমীচীন ছিল না।
অন্যদিকে মালয়েশিয়াকে দিয়ে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে যে অযৌক্তিক প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল- সেটাও ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত। এসব বিষয় নিয়ে অযথা সময় নষ্ট করা হয়। এটাও যথাযথ হয়নি। কিছুটা বিলম্ব হলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করে। এটা বাংলাদেশের সক্ষমতার নতুন পদচারণা। এতে করে বিশ্বে দেশের ভাবমুর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। নজির সৃষ্টি হয়েছে। আল্লাহর শুকরিয়া, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র জনকল্যাণমুখী ও যাদুকরি নেতৃত্ব এবং সাহস ও ব্যক্তিত্বের অনুশীলনে তিনি পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে তাঁর অঙ্গীকার বিলম্ব হলেও পূরণ করেছেন। এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।
বিশ্বব্যাংক এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের অন্তরায় ছিল। দেশের ভেতরে কতিপয় ব্যক্তি ও কতিপয় জাতীয় দৈনিকের প্রতিদিনকার অসত্য খবর- এ ষড়যন্ত্রের হাতকে শক্তি যোগায়। কথায় আছে, “অপরিচিত লোক বা বাইরের লোক অপেক্ষা দেশের ভেতরকার শত্রæ অধিক ভয়ংকর”। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সুশীল সমাজ পরিচয়ে, জ্ঞানী ব্যক্তির পরিচয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণের পথে বাধা ছিল। তাদের সেসময়কার কথাবার্তা- পদ্মা সেতু নির্মাণের অনুকূলে ছিল না। অর্থ দাঁড়ায়, তারা চায়নি পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের হাত ধরে বাস্তবায়িত হোক। তাদের লবিং-এ-ই পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক সরে দাঁড়ায়।
গত ১৮ মে, ২০২২ এ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে “দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস” উপলক্ষে আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ উপকমিটির আয়োজিত অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চ্যুয়াল মিটিং-এ যুক্ত হন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ অনুষ্ঠানে বলেন, আজ পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন অবয়বে দাঁড়িয়ে আছে। অচিরেই যান চালাচলে পদ্মা সেতু খুলে দেয়া হবে। কিন্তু এ পদ্মা সেতু নির্মাণে দেশীয় আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র সক্রিয় ছিল। যার কারণে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়েছে। সে সময় কতিপয় রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজ বিশ্বব্যাংক দ্বারা অর্থায়ন স্থগিত করেছে। এ অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণের সফলতা প্রসঙ্গে বলেন- “সে সময় বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছিল- জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু বানাচ্ছে, ওটায় চড়া যাবে না। চড়লে ভেঙ্গে পড়বে। আবার তার সাথে কিছু দোসরাও ছিল। তাদের এখন কি করা উচিত। পদ্মা সেতুতে নিয়ে গিয়ে ওখান থেকে টুস করে পদ্মাতে ফেলে দেয়া উচিত”। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও উল্লেখ করেন, “এক ব্যক্তি একটি ব্যাংকের এমডি পদের জন্য পদ্মা সেতুর মতো সেতুর টাকা বন্ধ করেছে, তাকে পদ্মা নদীতে দুইটা চুবানি দিয়ে সেতুতে তোলা উচিত। তাতে যদি শিক্ষা হয়”। প্রধানমন্ত্রীর এ হিউমার এবং সহজ, সরল ও সত্য কথা বলাকে কেউ কেউ নেতিবাচক বিশেষণে ভূষিত করেছে। এটা কারো কাছ থেকে প্রত্যাশিত ছিল না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এসব বক্তব্য মূলত সত্যের প্রতিফলন। কষ্ট ও দুঃখের প্রতিচ্ছবি। সহজ ভাষায় তিনি জনগণের দুঃখ ও বেদনাকে তাঁর বক্তব্যে তুলে ধরেছেন। আমরা জানি, তিনি বাবা-মা ও ভাইদের হারিয়ে হাজারো কষ্ট বুকে চেপে রেখে এদেশের মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করছেন। দেশের উন্নয়নে কাজ করছেন। দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন। বিদ্যুৎ, শিক্ষা, যোগাযোগ ও সামাজিক খাতের উন্নয়নে ব্যাপক কাজ করেছেন। পদ্মা সেতুকে নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করে বিশ্বে বাংলাদেশের সক্ষমতা তুলে ধরেছেন। শেখ হাসিনার সততা ও সাহসের সোনালী ফসল পদ্মা সেতু। বাংলাদেশের সামর্থের স্মারক পদ্মা সেতু। তাই পদ্মা সেতু চালুর প্রাক্কালে পদ্মা সেতুর বাস্তবায়নের তীব্র বাধাগুলো সম্পর্কে বলতে গিয়ে এসব কথা তিনি Humourly, খোলাখুলি বলেছেন। এসব বক্তব্যকে কারো অশালীন বলা এবং কাউকে হত্যার হুমকি হিসেবে দেখা- রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত বলার কোন যৌক্তিতা নেই। এটা রাজনৈতিকভাবে নেয়াও কাম্য নয়। পদ্মা সেতুর বাস্তবতার দৃষ্টিতে এটা দেখা উচিত। উল্লেখ্য, পরবর্তী দুই সরকারে আওয়ামী লীগ সরকার না আসলে- পদ্মা সেতু নির্মিত হতো না। দেশের মানুষের কাছে ‘স্বপ্নের পদ্মা সেতু’ অধরা থেকে যেতো।
যোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করে আমি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মোতাবেক মন্ত্রীত্বের প্রথম দিন থেকে আন্তরিকভাবে কাজ শুরু করি। প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করি। সেতু কার্যক্রমের প্রতি পদক্ষেপে বিশ্বব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে দুই বছরে পদ্মা সেতুর প্রস্তুতি কাজ প্রায় শেষ করি। ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন কাজ শেষ পর্যায়ে নিয়ে আসি। কোন ক্ষেত্রেই কোন অস্বচ্ছতা ছিল না। আমি শত ভাগ সততা ও নিষ্টার প্রয়োগে দায়িত্ব পালন করি। কিন্তু বিশ্বব্যাংক এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীরা হঠাৎ করে মরণকামড় শুরু করে। অহেতুক অসত্য কল্পিত অভিযোগে আমাকে দোষী করে, আমাকে সম্পৃক্ত করে পদ্মা সেতুর দুর্নীতির গল্প ফেদে বসে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে এ দুর্নীতির অভিযোগের গল্প শুনতে হয়। সরকারকে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে, প্রধানমন্ত্রীর পরিবারকে অবর্ণনীয় ঝামেলা মোকাবিলা করতে হয়। ষড়যন্ত্রকারীদের অসত্য খবরে স্ফুলিঙ্গ ছড়ায় কতিপয় জাতীয় পত্রিকার খবর এবং নিশিরাতে টকশো’র কুশিলবরা। তারা প্রভাবিত হয়ে অসত্যকে সত্য বানানোর চেষ্টা চালায়। পদ্মায় বহু পানি গড়িয়ে যায়। বিশ্বব্যাংক ঋণ দেয়া থেকে সরে দাঁড়ায়। ষড়যন্ত্রকারীরা দেশের ক্ষতি করে- আনন্দ উৎসব করে।
এ সময় আমার কষ্টের জন্য, আমার সামাজিক হেনস্থার জন্য আমি এদের কাউকে গালাগালি বা মন্দ কথা বলিনি। সত্য তথ্য দিয়ে সত্য ঘটনা জানানোর চেষ্টা করেছি। আমার ভালো কথাবার্তা, কার্যকলাপ, পিতার শেখানো পারিবারিক শিষ্টাচার, ব্যবহার, কাজের সততা এবং ইন্ট্রিগ্রিটি’র মাধ্যমে আসল অবস্থা বুঝানোর চেষ্টা করেছি। শেষ পর্যন্ত দুদকের তদন্ত এবং কানাডার আদালতের রায় ষড়যন্ত্রকারীদের আনন্দে- পানি ঢেলে দেয়। তাঁরা সত্য উপলব্দি করে। কিন্তু তাঁরা সত্য কথা বলে না। আর তাই আজ প্রধানমন্ত্রীর খোলামেলা সত্য কথা- তাদের গ্রহণ করতে কষ্ট হচ্ছে। তাই সমালোচনা করছে। অথচ ষড়যন্ত্র না হলে, বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন থেকে সরে না গেলে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতু চালু হতো। পদ্মা সেতু নির্মাণ ৯ বছর বিলম্বিত হতো না। এখন দেখা যায়, অনেকে পদ্মা সেতুর ব্যয় বৃদ্ধির জন্য সমালোচনা করেন। ভারতের সেতু নির্মাণের সাথে পদ্মা সেতুর ব্যয়ের তুলনা করেন। পদ্মা নদীর মতো উত্তাল নদী, যে নদীর প্রকৃতি, নদীর ফাউন্ডেশন ও ভয়াবহ মাটির অবস্থান, সেই নদীর উপর সেতু নির্মাণ প্রাক্কলিত ব্যয়ে হয় না- এর ব্যয় বৃদ্ধি স্বাভাবিকতায় পড়ে। এর সাথে রেল লাইন নতুন করে যুক্ত হয়েছে। তাই সবাইকে অনুরোধ রাখবো- আপনারা সমালোচনার জন্য সমালোচনা না করে বাস্তবতাকে মেনে নিন।
বিশ্বব্যাংকের অসত্য ও ভিত্তিহীন অভিযোগ এবং দেশীয় পত্র-পত্রিকার ভুয়া অভিযোগে সরকারের মন্ত্রিসভার কতিপয় প্রভাবশালী সদস্য সে সময় প্রভাবিত হয়ে পড়ে। এমনকি বিশ্বব্যাংকে যারা কাজ করেছে তারা সকলেই বিশ্বব্যাংকের পক্ষ নেয়। এর মধ্যে সে সময়কার অর্থমন্ত্রী এম এ মুহিত ছিলেন অন্যতম।
বিশ্বব্যাংক চতুরতার সাথে এমনভাবে শর্ত জুড়ে দেয় যে, আমি যদি পদত্যাগ করি বা আমাকে অন্য মন্ত্রণালয়ে পরিবর্তন করে দেয়া হয়- তাহলে বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে ফিরে আসবে। যখন আমাকে অন্য মন্ত্রণালয়ে সরিয়ে দেয়া হয়, তখন বিশ্বব্যাংক গো ধরে আমাকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিতে হবে। আমি মন্ত্রিসভা থেকে সরে গেলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন অব্যাহত রাখবে। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী এমএ মুহিত এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলেছিলেন বলে শুনেছি। অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের আশ্বাসে প্রভাবিত হয়ে আমাকে পদত্যাগ করাতে বিভিন্ন জায়গায় দৌড়ঝাপ করেন। পরিস্থিতি অনুভব করে আমি পদ্মা সেতু নির্মাণের স্বার্থে, নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে, জাতীয় স্বার্থে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করি। এ হেন অবস্থায় বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন স্থগিত ঘোষণা করে। এর অর্থ দাঁড়ায়, পদ্মা সেতু এবং সরকার ও আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ ছিল ভুয়া এবং উদ্দেশ্যমূলক।
আমি মনে করি, বিশ্বব্যাংকের ইতিহাসে এ ধরনের ঋণচুক্তি বাতিল ছিল বড় ধরনের ভুল সিদ্ধান্ত। লজ্জাজনক সিদ্ধান্ত। যেখানে ঋণের অর্থ ছাড় হয়নি, ঠিকাদার নিয়োগ হয়নি, কনসালটেন্ট নিয়োগ হয়নি- সেখানে দুর্নীতির আশংকা বা দুর্নীতি সংগঠিত হয় কীভাবে। অথচ এই অসত্য ও অনুমেয় দুর্নীতি তদন্তে বিশ্বব্যাংক তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেল নিয়োগ করে লুইস মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বে। ওকাম্পো বাংলাদেশে এসে যুক্তি বা উপাত্ত ছাড়া বাংলাদেশের দুর্নীতি নিয়ে লম্পজম্প করলেন। কারণ ছাড়া, যুক্তি ছাড়া, প্রমাণ ছাড়া আমাকে, উপদেষ্টা মশিউর রহমান ও সচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়াকে গ্রেফতারের চেষ্টা করেন -যা ছিল অমার্জনীয় অপরাধ। পরবর্তীতে আমি শুনেছি, অর্থমন্ত্রীর বাসায় বিশ্বব্যাংক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের এক বৈঠক হয়। এ সময় ড. গওহর রিজভী, দুদক চেয়ারম্যান ও দুদকের কমিশনারগণ উপস্থিত ছিলেন।
এ বৈঠকে বিশ্বব্যাংক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রধান ওকাম্পো বিশ্বব্যাংকের রেফারেল তালিকার ভিত্তিতে আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে বলেন এবং গ্রেফতার করতে বলেন। আমি শুনেছি, এ সময় দুদকের কমিশনার জনাব সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বলেন, আমি দীর্ঘসময় বিচারক ছিলাম। বিশ্বব্যাংকের রেফারেল তালিকার ভিত্তিতে প্রমাণ ছাড়া কারো বিরুদ্ধে মামলা করা যায় না। গ্রেফতার করা যায় না। এ সময় অর্থমন্ত্রী ও গওহর রিজভী তাদের কথার তেমন জোরালো আপত্তি জানাননি। বিশ্বব্যাংক ও বিশ্বব্যাংকের ইনট্রিগ্রিটি নিয়ে কেউ কোন কথা বলেননি। বাংলাদেশের প্রতি যে এটা অবিচার করা- তাও উল্লেখ করেননি। পরবর্তীতে বিশ্বব্যাংকের চাপে সচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়াকে গ্রেফতার করা হয়।
মূলত বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রধান লুইস মোরেনো ওকাম্পোর নেতিবাচক রিপোর্টে বাংলাদেশের স্বপ্নের পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংক সরে যায়। অথচ ওকাম্পো আজ বিশ্বের বড় দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত। ওকাম্পোর দুর্নীতির চল্লিশ হাজার নথি ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। ওকাম্পোর নেতিবাচক রিপোর্ট পদ্মা সেতু নিয়ে বাংলাদেশকে বিতর্কিত ও সমালোচিত করেছে। তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে আমার সততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এই দুর্নীতিবাজ ওকাম্পোর পরামর্শেই বিশ্বব্যাংক গেøাবাল সার্চ করে আমার সম্পর্কে কোন অনিয়ম পায়নি। বিশ্বব্যাংক আজ পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করতে না পেরে বিশ্বব্যাপী লজ্জিত। আমার কাছে অনুতপ্ত। সেই উদ্ধতবাদী ওকাম্পো আজ বিশ্বব্যাপী নিন্দিত ও বিতর্কিত। তার সাথে বাংলাদেশের দুইজন বিশিষ্ট ব্যক্তি বৈঠক করে তার অপচেষ্টার সাথী হয়েছিলেন। আল্লাহ সর্বশক্তিমান। আজ সত্য প্রকাশিত হয়েছে। আমি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছি।
ওকাম্পোর রিপোর্টে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের আশংকায় বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন থেকে সরে যায়। ঠুনকো অজুহাতে বিশ্বব্যাংকের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হয়নি। পদ্মা সেতুর স্বার্থে আমি পদত্যাগ করার পরও বিশ্বব্যাংক ঋণ দিতে এগিয়ে আসেনি। এটা প্রমাণ করে- বিশ্বব্যাংক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে পদ্মা সেতুতে ঋণ দেয়নি। প্রস্তুতিপর্বে দুনীতির ষড়যন্ত্রের আশংকা ছিল অমূলক, ভিত্তিহীন, কাল্পনিক, বায়বীয় এবং উদ্দেশ্যমূলক। পরবর্তীতে পদ্মা সেতুর দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্তদের বাংলাদেশের আদালত নির্দোষ বলে রায় দেয়। কানাডার আদালতে একই অভিযোগের মামলায় প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে রায় দেয়, গালগল্প বলে রায় দেয়। আমি কোন অন্যায় ও অসত্যের সঙ্গে কখনো আপোষ করিনি। বিশ্বব্যাংকের গেøাবাল সার্চ ও দুদকের নিবিড় তদন্ত আমার সম্পর্কে কোন অনিয়ম খুঁজে পায়নি- যা তার প্রমাণ।
পদ্মা সেতুর কোন প্লান ছিল না। চূড়ান্ত ডিজাইন ছিল না। অর্থের সংস্থান ছিল না। কোন দাতা সংস্থার কমিটমেন্ট ছিল না। দু’বছরে প্রস্তুতিকাজ সম্পন্ন করে ঠিকাদার নিয়োগও চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে এসেছিলাম। সেই ঠিকাদারই এখন পদ্মা সেতু তৈরি করছে। পদ্মা সেতুর কাজ যেভাবে আমি এগিয়ে নিয়েছিলাম- তাতে সরকারের প্রথম মেয়াদে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতু চালু হতো। বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের প্রস্তুতি কাজ করতে যেখানে ১০ বছর লেগেছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পদ্মা সেতুর সে পর্যায়ের কাজ আমি দু’বছরে শেষ করেছি। বিশ্বব্যাংক ও দেশীয় স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্রে ২০১৩ সালে পদ্মা সেতুর চালু হওয়া বন্ধ করেছে। বাংলাদেশের অব্যাহত উন্নয়নে এটি একটি বিরাট বাধা হিসেবে চিহ্নিত থাকবে।
পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংক সরে গেলে অর্থমন্ত্রী এম এ মুহিত বিশ্বব্যাংকের চতুরতা, পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংকের বিলম্বের কারণ এবং তাদের ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরেছিলেন। আমার প্রতি তিনি যে ভুল আচরণ করেছেন তা তিনি উপলব্দি করেন। আমি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করলে তিনিই একমাত্র মন্ত্রিসভার সদস্য যিনি আমাকে সাত্ত¡না দেয়ার জন্য, নিজের ভুল কার্যক্রমের স্বীকারের জন্য আমার গুলশানস্থ বাসায় গিয়েছিলেন। মন্ত্রিসভার অন্য কোন সদস্য তখন আমার বাসায় যাননি বা টেলিফোন করেও সহমর্মিতা দেখাননি। পদ্মা সেতুতে কোন দুর্নীতি হয়নি। কোন দুর্নীতির ষড়যন্ত্রও হয়নি। অথচ আমি পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়ায় কোন অনিয়মের প্রশ্রয় দেইনি। আমি নির্দোষ- এ সত্য উপলব্দি করে অর্থমন্ত্রী আমার বাসায় গিয়ে উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। পরবর্তীতে যখনই তাঁর সাথে দেখা হয়েছে, তিনি নিজের ভুল স্বীকার করতেন এবং আমার প্রতি অবিচারের বিষয় তুলে নিজের ভুলের প্রসঙ্গ টেনে আনতেন। বর্ষসেরা করদাতা হিসেবে এনবিআর আমার হাতে পুরস্কার তুলে দিয়ে তিনি আমার সততার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
সর্বশেষ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস আমাকে শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদানের জন্য দেশের যুগশ্রেষ্ঠ শিক্ষা-উদ্যোক্তা হিসেবে স্বর্ণপদক ও সম্মাননা প্রদান করে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ছিলেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। প্রধান অতিথির ভাষণে অর্থমন্ত্রী বলেন, “পদ্মা সেতু নিয়ে নানা ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে অসত্য ও ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে যে অন্যায় করা হয়েছে, তজ্জন্য আমি সবার পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা চাচ্ছি। সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রতি আমিও ব্যক্তিগতভাবে অন্যায় করেছি। তাঁকে আমি ভুল বুঝেছি। সত্যিকারভাবে পদ্মা সেতুর কার্যক্রমে তাঁর কোন অনিয়ম ছিল না। আমি বিশ্বব্যাংকের কথা শুনে ব্যক্তিগতভাবে আবুল হোসেনের সততার প্রতি অবিচার করেছি। আমি লজ্জিত এবং দুঃখিত”। আক্ষরিক অর্থে এ অনুষ্ঠানে সুধী সমাবেশে আমার কাছে তিনি ক্ষমা চেয়েছেন। এ ক্ষমা বা দুঃখপ্রকাশ তাঁর উত্তম চরিত্রের পরিচয়ই বহন করে।
আজ এ মহান ব্যক্তি, দেশের অন্যতম অর্থনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং উদার মনের ব্যক্তিত্ব এম এ মুহিত আমাদের মাঝে নেই। আমি তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করি। মহান আল্লাহ দেশের এই কৃতিসন্তান এম এ মুহিতকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন।