শিক্ষকতা একটা মহান পেশা। দুনিয়াতে আর এমন একটি পেশা নেই যা সম্মানের দিক থেকে শিক্ষকতা পেশার সমান। শিক্ষকরা সোনার মানুষ গড়ার কারিগর। একটি দেশ, জাতি ও সমাজ তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যে বিশ্বাস, মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, দক্ষতা ও নৈতিকতা বোধ নিয়ে গড়ে তুলতে চান সেই কাজটা সম্পূর্ণ করেন সম্মানিত শিক্ষকগণ। শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার ও জাতীয় উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। শিক্ষার গুণগত উন্নয়ন ব্যতিরেকে জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের প্রধান মাপকাঠি হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষার অধিকার পরিপূর্ণভাবে অর্জিত হলে জনসাধারণের অন্যান্য অধিকার আদায়ের পথ সুগম হবে। অথচ স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও আমাদের সংবিধানে শিক্ষা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হয়নি। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও শিক্ষাকে মৌলিক নীতিমালা হিসেবে নেয়া হয়েছে। এগুলো সরকারকে রাষ্ট্র পরিচালনার দিক নির্দেশনা দেয়। শিক্ষা মৌলিক অধিকার না হওয়ার কারণে মৌলিক নীতিমালা লংঘনের দায়ে রাষ্ট্র বা সরকারকে আইনত বাধ্য করা যায় না বা তার বিরুদ্ধে মামলা করা যায় না। মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ অর্থাৎ হেফাজত করার দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের, যা সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে এবং এই মৌলিক অধিকার ক্ষুণœ হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ১০২(১) বিধান মোতাবেক সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে মামলা করতে পারবে।
আইনগত অধিকার না থাকায় বেসরকারি শিক্ষকরা তাদের ন্যায্য প্রাপ্য পে-স্কেলে অন্তর্ভুক্তির জন্য রাষ্ট্রের করুণার ওপর নির্ভর করতে হয়। এটি একেবারেই অনভিপ্রেত। বেসরকারি শিক্ষকদের অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারি উদ্যোগ এবং পর্যাপ্ত সমর্থন না থাকায় তারা সর্বদাই বঞ্চিত হয়। উদাহরণ স্বরূপ দেখা যায়, বেসরকারি শিক্ষকরা বাড়িভাড়া পান ৫০০ টাকা। বাড়ি ভাড়াতো দূরের কথা, এ টাকায় বাড়ির বারান্দাও পাওয়া সম্ভব নয়। চিকিৎসা ভাতা পান ৩০০ টাকা। তা নিন্তাতই অপ্রতুল এবং উৎসব ভাতা পান স্ব স্ব স্কেলের ২৫ ভাগ। বেসরকারি স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকরা কোনো শিক্ষা ভাতা, টিফিন ভাতা ও পাহাড়িয়া ভাতা পান না। পুরো চাকরি জীবনে মাত্র একটি ইনক্রিমেন্ট পেয়ে থাকেন। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের পদোন্নতির কোনো সুবিধি ব্যবস্থা নেই। যেমন বেসরকারি কলেজে এমন অনেক মেধাবী শিক্ষক/শিক্ষিকা আছেন যাদের এসএসসি থেকে অনার্স ও মাস্টার্স পর্যন্ত অনেক বিষয়ে প্রথম শ্রেণি প্রাপ্ত এবং তাদের অনেকেই আবার এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রির অধিকারী হয়েও পদোন্নতিতে অনুপাত থাকার কারণে সহকারী অধ্যাপক হতে পারেন না। তাদের এত উচ্চ মানের ডিগ্রি থাকার পরও ট্রেজেডিটা হলো তাদেরকে পুরো চাকরি জীবনে প্রভাষক হিসাবে জীবন কাটিয়ে দিতে হয়। বেসরকারি কলেজে পদোন্নতির কোনো সুব্যবস্থা না থাকায় মেধাবী শিক্ষার্থীরা এখন এই সম্মানিত পেশায় আসতে চরম অনীহা প্রকাশ করেন। পৃথিবীর কোনো উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে এমন তুঘলকী প্রথা আছে বলে আমাদের জানা নেই। দেশের মেধাবীদেরকে এই পেশায় আনার জন্য শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ দীর্ঘদিন থেকে শিক্ষকদের সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বেতন স্কেল দেয়ার ঘোষণা দিয়ে আসছেন কিন্তু তাঁর এই ঘোষণা ঘোষণা হিসাবেই থাকলো আলোর মুখ দেখলো না। কিন্তু শিক্ষা ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়ন করার মাধ্যমে শিক্ষার গুণগত মানে অগ্রগামী ভূমিকা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে শিক্ষকদের বেতন ভাতাসহ অন্যান্য ভাতা আমাদের দেশ থেকে কয়েকগুণ বেশি। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আর. এম দেবনাথ তার এক নিবন্ধে লিখেন, একজন হাই স্কুলের শিক্ষক তাঁকে জানালেন নির্দিষ্ট ডিগ্রি নিয়ে হাইস্কুলে একজন শিক্ষক এখন যোগদান করলেই ২০-২৫ হাজার ভারতীয় রূপি পান, যা চাকরিতে যোগদান করলে বাংলাদেশের একজন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষকও পান না। তাই এই স্বাধীন দেশের একজন শিক্ষক যখন তার জন্য নির্ধারিত সম্মানীর মাধ্যমে পরিবারের ভরণ পোষণ ব্যবস্থা না পেয়ে হতাশায় আত্মহত্যা করেন। কিংবা এই মহান পেশা ছেড়ে দিয়ে জীবন জীবিকার তাগিদে অন্য কোনো অসম্মানের পেশায় জড়িয়ে যান। তখন স্বাধীন জাতি হিসাবে আমাদের লজ্জিত হওয়ার কথা। এই জন্য অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহী করতে তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অবশ্যই সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তবেই দেশে দক্ষ মানব সম্পদ তৈরি হবে এবং যোগ্য সু-নাগরিক প্রত্যাশা করা যায়।
কোনো জাতি যদি শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয় তাহলে সে জাতির পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে না। প্রায় ৩ দশকের যুদ্ধে বিধ্বস্ত ভিয়েতনাম শিক্ষা খাতে জিডিপি’র ৬.৬ শতাংশ বিনিয়োগ করে প্রতিযোগিতায় বিশ্বে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সেখানে আমাদের বিনিয়োগ দক্ষিণ এশিয়ার সর্বনিম্ন মাত্র ২.২ শতাংশ, জিডিপি’র অন্তত ৬ শতাংশ ও জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করলে আমরা সার্কভুক্ত দেশের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবো। ইউনেস্কোর হিসাব অনুসারে শিক্ষাখাতের ব্যয় ৬.৬% হওয়া উচিত। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শিক্ষাখাতে বাজেটের ২১ শতাংশ বরাদ্দ থাকত। এখন তা কমিয়ে ১১ শতাংশে নামানো হয়েছে। ২০১৪-১৫ সালের বাজেটে মোট বাজেটের ১১.৬৬ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে শিক্ষাখাতে। এই বরাদ্দ শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়-এ দুই মন্ত্রণালয়ে বন্টন করা হয়েছে, যদিও মোট পরিমাপের দিক থেকে শিক্ষা বাজেট বেড়েছে, কিন্তু শতাংশ হিসাবে শিক্ষা বাজেটে বরাদ্দের হার গত ৫ অর্থ বছরে ক্রমাগত কমেছে। গত ২৬ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে চট্টগ্রাম মহানগরের একটি স্কুল পরিদর্শনে গিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নিজেই বলেন, আমি যখন দায়িত্ব নিই তখন শিক্ষা বাজেট ছিল শতকরা ১৪ ভাগ। পরের বছরে তা কমে হয় ১৩ ভাগ এখন সেটা ১১ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, সারাবিশ্বে যখন শিক্ষা বাজেট বাড়ছে আমাদের তখন ক্রমেই কমতে শুরু করেছে। অথচ দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য শিক্ষাকেই সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেয়া উচিত ছিল। কারণ শিক্ষা একমাত্র দেশকে পশ্চাৎপদতা থেকে মুক্ত করতে পারে।
শিক্ষামন্ত্রী নিজেই প্রায়ই বলেন আমরা শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন দিতে পারি না। তাহলে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে, কিভাবে শিক্ষার গুণগত মান তৈরি হবে? ভারত ও নেপালে শিক্ষা খাতে মোট দেশজ সম্পদের ৪%এর বেশি, ভুটানে ৫%, মালয়েশিয়ায় ৮%, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১০%, সিঙ্গাপুরে ১২%, ব্রাজিল এবং চিলিতে ৪% এর মত। শিক্ষা খাতে ব্যয় সঠিকভাবে ব্যয়িত হলে তা দেশের উৎপাদনশীল কর্মকান্ডকে গতিশীল করে এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় দক্ষ মানব সম্পদের কেবল যোগান দেয় না বরং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সঠিক মাত্রার মানব সম্পদ তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।
বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে, দক্ষ ও সফল শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের অক্লান্ত পরিশ্রমে বর্তমান সরকার সমাজের সকল স্তর ও চিন্তার মানুষের মতামত গ্রহণ করে জাতির প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি, আকাংখা ও লক্ষ্যের প্রতিফলন ঘটিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ সালে প্রণয়ন করেছেন। কিন্তু একই সরকার কেন তা দ্রুত বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে পারছে না তা অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে এটি বাস্তবায়ন করতে হলে শিক্ষাখাতে অধিকতর বাজেট বরাদ্দ দেয়া আবশ্যক হয়ে পড়েছে। জাতীয় শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্টের আহবায়ক অধ্যক্ষ আসাদুল হক বলেন, ১৯৯১, ১৯৯৭, ২০০৫ ও ২০০৯ সালে জাতীয় বেতন স্কেল প্রবর্তনের সময় সরকারি শিক্ষক কর্মচারীদের সঙ্গে একই দিনে বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীরা বেতন স্কেল এবং বিশ শতাংশ মহার্ঘভাতা পেয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় আমাদের প্রত্যাশা এবারও একই সময়ে বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীদের নতুন বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। স্কেলের সঙ্গেই পূর্ণাঙ্গ বার্ষিক প্রবৃদ্ধি, সরকারি শিক্ষক কর্মচারীদের মতো চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ভাতা এবং সম্মানজনক বাড়ি ভাড়া প্রদানের ঘোষণা প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর নিকট বেসরকারি শিক্ষক সমাজ প্রতীক্ষার প্রহর গুণছে। আমরা আশা করি বর্তমান সরকারের ভিশন-২০২১ বাস্তবায়ন ও ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হলে শিক্ষক সমাজের ন্যায্য পাওনা সুনিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে দেশে জ্ঞান-বিজ্ঞান,তথ্য প্রযুক্তি ও ভাষাগতভাবে দক্ষ মানব সম্পদ সৃষ্টি করতে হবে। আর এ গুরুত্বপূর্ণ কাজটি বাস্তবায়িত করবেন মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকেরা। তাই এই পাঁচ লাখ বেসরকারি এমপিওভূক্ত শিক্ষককে অভূক্ত রেখে কখনোই সরকারের এই মহৎ উদ্দেশ্য সফল হবে না। বেসরকারি শিক্ষকদের নতুন বেতন স্কেলে অন্তর্ভূক্ত না করলে তাঁরা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়বে, রাষ্ট্র এবং সমাজে সকল পেশার মানুষের নিকট হেয় প্রতিপন্ন হবে, তার ফলস্বরূপ তারা ক্লাসে ঠিকমত মনোযোগ দিয়ে পাঠদান করতে পারবে না। এমনিতেই বিরোধী দলের লাগাতার হরতাল অবরোধে শিক্ষার যে বারোটা বেজেছে তার ওপর দেশের ৯৮ শতাংশ শিক্ষাদানকারী বেসরকারি শিক্ষক সমাজকে নতুন বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্ত না করলে তা মরার ওপর খাড়ার ঘায়ের মত হবে। শিক্ষকরা স্কুল, কলেজে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে তাদের ন্যায্য অধিকারের জন্য রাস্তায় নেমে আসবে এবং বর্তমান সরকারের এই অযৌক্তিক ও হটকারী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে প্রবল জন প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। তা এ জাতির জন্য কখনোই সুখকর হবে না। আমরা বেসরকারি শিক্ষক সমাজ চাই না, সরকার কোনো অদৃশ্য শক্তির ইঙ্গিতে এমন কোনো হটকারী সিদ্ধান্ত যেন না নেয়? তাহলে সরকারকে পুরো বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। আমরা চাই সরকারের শুভ বুদ্ধির উদয় ঘটবে এবং নতুন অর্থ বছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ অবশ্যই বাড়াতে হবে।
-লেখকঃ আজিজুর রহমান আযম,
কলেজ শিক্ষক ও কলামিস্ট