এবছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রায় ১৩ লক্ষ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছে। তারা দেশের একটি বিশেষ সময়ে বিশেষ মুহুর্তে পেট্রোলবোমা ও কথিত লাগাতার অবরোধের মধ্যেও অনেক কষ্ট-শিষ্ট সহ্য করে দীর্ঘদিনে তাদের কাঙ্খিত পরীক্ষা সমাপ্ত করতে পেরেছিল। তারপরও বর্তমান সরকারের সফল, দক্ষ ও আন্তরিকতাপূর্ণ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সুবাদে পূর্ব ঘোষিত ৬০ দিনের মধ্যেই উক্ত পরীক্ষার ফলাফল শিক্ষার্থী ও অভিবাবকদের হাতে তুলে দিতে পেরেছেন।
শিক্ষার অগ্রগতির সাথে সাথে দেশে চলমান ডিজিটাল ব্যবস্থা এবারের উচ্চমাধ্যমিক কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রেও কাজে লাগানোর অংশ হিসাবে শিক্ষামন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে যাচাই-বাছাই, সম্ভাব্যতা ও বাস্তবায়ন বিষয়ে রিপোর্ট প্রদানসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর আবু বকর সিদ্দিককে প্রধান করে একটি উপ-কমিটি গঠন করে দেয়া হয়। উক্ত উপ-কমিটির সুপারিশ এবং মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী সভায় সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে অনলাইন ও মোবাইল এসএমএস পদ্ধতিতে প্রথমে ৩০০ আসনের বেশি এমন কলেজগুলোকে এর আওতায় আনার সিদ্ধান্ত হয়েছিলো বলে জানা যায়। ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের সফটওয়ার ও এসকল কারিগরি বিষয়ে অগাধ অভিজ্ঞতা ও জনবল না থাকায় তা সমন্বয়ের জন্য বুয়েটের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অত্যন্ত দক্ষ ও মেধাবী প্রযুক্তিবিদ প্রফেসর ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রথমে সংশ্লিষ্ট সকলের ধারণা ছিল যে, শুধু ঢাকা বোর্ডের সর্বোচ্চ ৩ লক্ষ শিক্ষার্থী হয়তো এ প্রক্রিয়ায় আবেদন করতে পারেন। পরে শিক্ষাসচিব মহোদয়ের আগ্রহে সারাদেশের প্রায় ১২ লক্ষের মতো আবেদনকারী এ প্রক্রিয়ায় ভর্তির জন্য আবেদন করেছিলেন। সবই ঠিক ছিলো, কিন্তু বিপত্তি হলো ফলাফল প্রকাশ করা সংক্রান্ত সময় নিয়ে। যদি ফলাফল প্রকাশের সময়টা তাড়াহুড়ো না করে কয়েকদিন বেশি সময় নেয়া যেত তাহলে শিক্ষার্থী ও অভিবাবকদের মধ্যে উৎকণ্ঠা ও হয়রানির বিষয়টি এতোটা পাত্তা পেত না। যাহোক, যা হওয়ার তাতো হয়েছেই। তবে এবিষয়ে আমি বিভিন্ন রেফারেন্সে একটু অলোকপাত করতে চাই। সর্বশেষ যেভাবে এ বিষয়টির ফয়সালা হতে চলেছে তা হলো- প্রথম তালিকায় যারা স্থান পায়নি কিংবা স্থান পেয়েও বিভিন্ন কারণে ভর্তি হতে পারেনি প্রতি ক্ষেত্রেই দ্বিতীয়, তৃতীয় এমনকি চতুর্থ মেধাতালিকা পর্যন্ত দেয়া হয়েছে যাতে সর্বশেষ শিক্ষার্থীটাও কোনভাবে ভর্তি প্রক্রিয়া থেকে বাদ না পড়ে। সেজন্য দফায় দফায় সময় বাড়িয়ে বাড়িয়ে একবারে ২৫-২৬ জুলাই পর্যন্ত অর্থাৎ পুরো মাসই ভর্তি প্রক্রিয়া চলেছে। শুধু তাই নয়, সচিব মহোদয় এমন প্রস্তাবও দিয়েছেন যে, যারা একাদশে টাকার জন্য ভর্তি হতে দ্বিধান্বিত রয়েছে তারা আবেদন করলে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ তহবিল থেকেও ভর্তির টাকা পেতে পারেন।
ডিজিটাল এ ভর্তি প্রক্রিয়াটা নিয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। আর হওয়ারই কথা, কারণ মাধ্যমিক পাস করার পরে শিক্ষার্থীরা তাদের জীবনের লক্ষ্য স্থির করার জন্য কলেজ নির্ধারণ অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অথচ ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভর্তির কাজটি সহজ-সুন্দর ও সাবলিলভাবে সম্পন্ন করার জন্য যারা এটি পরিকল্পনা করেছিলেন তাঁরা হচ্ছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, শিক্ষাসচিব মোঃ নজরুল ইসলাম খান, সাথে রয়েছেন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর আবু বকর সিদ্দিক ও সকল শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যানবৃন্দসহ তদসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ। শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় সম্পর্কে আমরা সকলেই কমবেশি অবগত রয়েছি যে, তিনি কি ধরনের লোক। তিনি ৭০ বছর বয়সি (গত ৫ জুলাই ২০১৫ তাঁর ৭১তম জন্মদিন ছিল) অত্যন্ত অভিজ্ঞ ও নিবেদিতপ্রাণ একজন সফল রাজনীতিক যিনি ছাত্র রাজনীতি থেকেই তাঁর কর্মের জন্য সর্বদা প্রশংসিত হয়ে আসছেন। তিনি শেখ হাসিনার সরকারের পরপর তিনবারের (অন্তর্বর্তীকালীন সরকারসহ) সফল শিক্ষামন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার আগের মেয়াদের (১৯৯৬-২০০১) আওয়ামীলীগের ঐকমত্যের সরকারের আমলেও তিনি শিক্ষামন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। যার ফলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে রয়েছে তাঁর অগাধ ও সুস্পষ্ট ধারণা। অন্যদিকে বর্তমান শিক্ষাসচিব মোঃ নজরুল ইসলাম খান একজন দক্ষ সরকারি আমলা যিনি ডিজিটাল বাংলাদেশের কনসেপ্টের সাথে শুরু থেকেই জড়িত রয়েছেন। সরকারি পর্যায়ে একসেস টু ইনফরমেশন (এ টু আই) প্রকল্পের তিনি একজন অগ্রদূত। বেসরকারি পর্যায়ে যেমন- মোস্তফা জব্বার, জাকারিয়া স্বপনসহ আরো অনেকে কম্পিউটার প্রযুক্তিকে ছড়িয়ে দিতে অগ্রদূত হিসাবে কাজ করেছেন, আবার প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বুয়েটর প্রফেসর ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, প্রফেসর ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মোঃ আব্দুল মোত্তালিব প্রমুখ অগ্রদূত হিসাবে কাজ করেছেন, ঠিক তেমনি সরকারি পর্যায়ে মোঃ নজরুল ইসলাম খান। শিক্ষামন্ত্রণালয়ে আসার আগে দীর্ঘদিন তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলেন। এখন অবশ্য সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতায় তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত সকল কিছু সমন্বয় করছেন বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র, প্রধানমন্ত্রী তনয়, বিশিষ্ট কম্পিউটার বিজ্ঞানী, প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। এতক্ষণ শিক্ষামন্ত্রী এবং সচিব সম্পর্কে একটু আলোকপাত করলাম এইজন্য যে, তাঁরা দুজনেই তাঁদের স্ব-স্ব জায়গায় প্রতিভায় উজ্জল। তাঁরা দুজনেই প্রধানমন্ত্রীর খুবই আস্থাভাজন এবং তাঁদের দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত। সেজন্য একাদশে ডিজিটাল ভর্তি বিষয়ে তাঁরা যা করেছেন দেশ-জাতি সকলের ভালোর জন্যই যে করেছিলেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ সিদ্ধান্তটি তাঁরা তাঁদের ব্যক্তিগত লাভের জন্য নেননি। তাঁরা সেটি করেছিলেন দেশ ও জাতির বৃহত্তর স¦ার্থের জন্যই। যেটুকু সমস্যা হয়েছে তা শুধুই ভুল বোঝাবুঝি এবং ইনফরমেশন গ্যাপ। অথচ বিষয়টিকে যেভাবে নেগেটিভ হিসাবে বিভিন্নভাবে প্রচার করা হয়েছে তা মোটেও ঠিক হয়নি বলে আমার মনে হয়েছে।
দুয়েকটি পত্রিকা অবশ্য এটিকে নিয়ে একেবারে নেগেটিভ হেডলাইন করেছেন এবং মন্ত্রী-সচিবের বিরোধের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছেন। অথচ এ বিষয়ে তাঁরা দুজনেই তাঁেদর অবস্থান পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন। শেষপর্যন্ত সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, কোনো কোনো বিষয়ে কখনো কখনো কারো কারো সাথে ভুল বোঝাবুঝি, দ্বিমত, মতপার্থক্য ইত্যাদি থাকতেই পারে, এ বিষয়ে তিনি উদাহরণ হিসাবে নিজেদের পরিবারের সকল সদস্যের মধ্যে বিভিন্ন ছোটখাটো বিষয়ে মতপার্থক্যের কথা উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীতে অবশ্য শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে ভুল বোঝাবুঝির বিষয়ে পরামর্শ করে কাউকেই হেয় প্রতিপন্ন না করে মন্ত্রণালয়ের গতিশীলতার জন্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। সেগুলিও কেউ কেউ বিরোধ উস্কে দেয়ার জন্য অবশ্য বাঁকাভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছে। অথচ দেখুন ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সময়ের ব্যবধানে এ বিষয়টি কত সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে নেয়া যায় সমাধানের পথে। সেজন্য সাময়িক সময়ের বিরক্তি ও বিড়ম্বনার পাঠ চুকিয়ে এখন অভিভাবকেরা স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত একটি অনুরোধ সকলের প্রতি থাকবে, এ বিষয়ে তাঁদের দুজনের মতপার্থক্যের বিষয়টি যেমন করে সামনে নিয়ে আসা হয়েছিল, তাঁরা যখন পরবর্তীতে নিশ্চয়ই মিলেমিশে ভালোভাবে কাজ করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাক্ষেত্রকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য পূর্বের ন্যায় যদি স্বত:স্ফুর্তভাবে কাজ করে যান, তাহলে সেটিও মিডিয়াতে পজিটিভভাবে ফলাও করে প্রচার পাওয়ার যোগ্য।
-লেখকঃ ড. মোঃ হুমায়ুন কবীর, ডেপুটি রেজিস্ট্রার, কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়