স্কুলের
নিজস্ব উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের কোচিং করানোর ফলে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষাসহ
সব পরীক্ষাতেই শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক ভালো ফলাফল করছে। এছাড়া আগের চেয়ে
শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। মানের উন্নয়ন ঘটেছে গ্রাম
পর্যায়ের স্কুলগুলোতে।
সুশাসনের
জন্য প্রচারাভিযান (সুপ্র) এর উদ্যোগে বরিশালে সরকারি ‘প্রাথমিক শিক্ষা’
পরিস্থিতি বিষয়ক সামাজিক এক জরিপের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
সম্প্রতি
বরিশালে উপজেলা পর্যায়ে ২টি স্কুল ও ইউনিয়ন পর্যায়ের ২টি স্কুলসহ মোট ৪টি
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওপর এ জরিপ চালানো হয়। ২০১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে
শুরু হয় জরিপের প্রথম পর্ব। ৪ ডিসেম্বর ওই জরিপের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
এরপর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দ্বিতীয় ধাপে ফলোআপ মনিটরিং সম্পন্ন হয়।
প্রথম
পর্যায়ে পরিচালিত ওই জরিপের প্রতিবেদনে বিভিন্ন বিষয়ে সুপারিশ করা হয়। এর
মধ্যে অন্যতম ছিল শিক্ষকদের সংখ্যা এবং গুণগতমান বৃদ্ধি, সবার জন্য বৃত্তির
ব্যবস্থা করা, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটিকে শক্তিশালী ও সক্রিয় করা,
মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার, চাহিদা ও সময়োপযোগী বিদ্যালয় অবকাঠামো নির্মাণ,
শিক্ষা উপকরণের ব্যয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্রয়সীমার মধ্যে রাখা, ঝরেপড়া
শিক্ষার্থী রোধ, প্রতিবন্ধী শিশুর শিক্ষা নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ, আধুনিক
পদ্ধতিতে শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, বাজেটের সঠিক বরাদ্দ ও বাস্তবায়ন
নিশ্চিত করা।
সুপ্র’র গবেষণা
প্রতিবেদন অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা কর্মীরা কাজ করেন। এ
বিষয়বস্তুগুলো হলো, প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত ও সংখ্যাগত অবস্থা, শিক্ষা
সমাপনী, উপবৃত্তি, মিড-ডে মিল, বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ,
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, ম্যানেজিং কমিটির ভূমিকা,
জনবল, স্কুল পর্যায়ে সরকারের বাজেট বরাদ্দ, স্কুল পর্যায়ে বরাদ্দকৃত
বাজেটের সঠিক বাস্তবায়ন ও প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালনা কাঠামো।
সুপ্র
সূত্র জানায়, জরিপের জন্য বরিশালের কিশোর মজলিস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,
গৌরনদীর বাটাজোর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শরিফাবাদ সরকারি প্রাথমিক
বিদ্যালয় ও পশ্চিম শরিফাবাদ সরকারি প্রাথমিক বাছাই করা হয়।
এসব
স্কুলের প্রতিটি থেকে ৫ জন ছাত্র, ৫ জন ছাত্রী, ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও
১ জন সদস্য, অভিভাবক ৫ জন, স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং ১ জন নারী ও ১ জন
পুরুষ শিক্ষকসহ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, উপজেলা শিক্ষা অফিসার, সহকারী
উপজেলা শিক্ষা অফিসারের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। দ্বিতীয় ধাপে ফলোআপ মনিটরিংয়ে
জেলার ৪০ জন শিক্ষার্থীর সাক্ষাৎকার নেয়া হয়, এরমধ্যে ৯৫ ভাগ ছাত্রী। দুই
ধাপে এসব শিক্ষার্থী মতামতের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয় প্রতিবেদন।
প্রকাশিত
প্রতিবেদন অনুযায়ী বছরের শুরুতে বই বিতরণে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। শতকরা
৯৫ ভাগ শিক্ষার্থী জানুয়ারি মাসেই বই পেয়েছে। তবে ৫ ভাগ শিক্ষার্থীর বই
পেতে কিছু অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে।
শতকরা
৭৮ ভাগ শিক্ষার্থী নোটবই কিনেছে। এদের মধ্যে ৬০ ভাগ শিক্ষার্থী নোটবই
শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে ও ভালো ফলাফলে সহায়ক বলে মনে করে। তবে ১২ ভাগ
শিক্ষার্থীর মতে নোটবই কিনতে শিক্ষকরাই তাদের উৎসাহ দিয়েছেন। শতকরা ৪৫ ভাগ
শিক্ষার্থী কোচিং সেন্টারে পড়ে, এদের মধ্যে ৩৮ ভাগই কোচিং করে নিজ স্কুলে।
বেশিরভাগ শিক্ষকই ক্লাসে মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না। এসব স্কুলের শতকরা ৮২
জন শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পায়। আর শতকরা প্রায় ৭১ ভাগ শিক্ষার্থীর বাড়ি থেকে
স্কুলের দূরত্ব ২ কিলোমিটারের মধ্যে।
স্কুলে
শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেয়া হয় কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে ৩০ ভাগ শিক্ষার্থী
বলেছে, স্কুলে তাদের শাস্তি দেয়া হয়। স্কুলগুলোতে শতভাগ নিরাপদ পানির
ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া ৫৭ দশমিক ৫ ভাগ স্কুলে টয়লেট এবং ৭৫ ভাগ স্কুলে ছেলে
ও মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা রয়েছে। আর শতকরা ৫০ ভাগ স্কুলে
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্যও ব্যবস্থা রয়েছে। নিরীক্ষায় মোট ১২ জন
শিক্ষকের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। এদের মধ্যে ৭ জনের শিক্ষাগত যোগ্যতা
স্নাতকোত্তর। শতভাগ শিক্ষক বলেছেন তারা ক্লাসের আগে পাঠ পরিকল্পনা করেন এবং
তা সংরক্ষণ করেন।
প্রতিবেদনে
বলা হয়, সব শিক্ষক শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করেন। ৫৮ ভাগ শিক্ষক ৪টির বেশি
ক্লাস নেন। ৬৭ ভাগ শিক্ষক বলেছেন তারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষার্থীদের
প্রতি অধিক মনোযোগ দেন।
সব
শিক্ষক স্কুলের বাইরে কোচিং করান। এদের মধ্যে ৮৩ ভাগ মনে করেন কোচিং
শিক্ষার্থীদের জন্য ভালো। জরিপে উঠে এসেছে, ৬৭ ভাগ অভিভাবক তাদের সন্তানদের
জন্য নোটবই কিনে দেন, কারণ এটি পড়াশুনা ও ভালো ফলাফলের জন্য প্রয়োজন। ৩৩
ভাগ বলেছেন শিক্ষকরা তাদের নোটবই কিনতে উৎসাহিত করেন।
স্কুল
ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতিসহ সদস্যদের মধ্যে শতভাগ উত্তরদাতা বলেছেন,
তাদের স্কুলে যথেষ্ট শিক্ষক নেই। ১২ দশমিক ৫ ভাগ বলেছেন তাদের গড়ে ৪ জন
শিক্ষক প্রয়োজন। ৮৭ দশমিক ৫ ভাগ বলেছেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে বই বিতরণে কোনো
অভিযোগ নেই। শিক্ষকরা সময়মতো ও নিয়মিত স্কুলে আসেন। ৬২ দশমিক ৫ ভাগ বলেছেন
শিক্ষকরা কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িত।
স্কুল
ব্যবস্থাপনা কমিটির মতে উপবৃত্তি শিক্ষার মনোন্নয়নে ভূমিকা রাখে। তাদের ৭৫
ভাগের মত স্কুলে ফিডিং কার্যক্রম নেই। অপরদিকে শতকরা ৭৫ ভাগের মতে
দরিদ্রতা শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার মূল কারণ। এদিকে, প্রথম ধাপের জরিপ শেষে
কর্ম-পরিকল্পনার ফলোআপ মনিটরিং করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিলো কর্মপরিকল্পনা
অনুযায়ী অগ্রগতি চিহ্নিত করা।
শিক্ষক,
অভিভাবক ও ম্যানেজিং কমিটির দেয়া তথ্যে জানা যায়, গত বছরের চেয়ে এ বছরে
আরও সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে বই বিতরণ করা হয়েছে। তবে বইয়ের ছাপা ও
অনেকক্ষেত্রে এলোমেলো পাওয়া গেছে। এছাড়া ৫ম শ্রেণির কিছু বই দেরিতে পাওয়া
গেছে।
ফলোআপ মনিটরিংয়ে উঠে আসে,
স্কুলে প্রধান শিক্ষক না থাকা ও শিক্ষক সংকটের বিষয়টি। শিক্ষার উপকরণ ও
শিক্ষার মান বৃদ্ধির কথাও বলা হয়। এছাড়াও প্রয়োজনে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ
প্রদান, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটিকে আরো সক্রিয় করে তোলা, অভিভাবকদের
সঙ্গে নিয়মিত পড়াশুনার বিষয়ে যোগযোগ রাখার বিষয়গুলোও তুলে ধরা হয়েছে। আর
যেসব শিক্ষার্থী ভালো ফলাফল করছে তাদের পুরস্কৃত করার কথা উঠে আসে।
ফলোআপ মনিটরিং অনুযায়ী কোচিং করানোর ফলে সমাপনীসহ সব পরীক্ষার শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করছে।