অফুরন্ত আলোর ঝর্ণাধারায় উৎসারিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একদিন পরই সগৌরবে পদার্পণ করবে ছিয়ানব্বই বছরে। ১৯২১ সালের পহেলা জুলাই অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক চেতনা বিকাশের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে যাত্রা শুরু করা এই বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানার্জনের তীর্থভূমি, মুক্তচিন্তার পাদপীঠ এবং গণতন্ত্রের সূতিকাগার হিসেবে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে পার করল পঁচানব্বইটি বছর। এর প্রতিটি ধুলিকণা এক একটি অপরাজেয় সংগ্রামী ইতিহাসের সাক্ষী। বাঙালী জাতির ইতিহাস আর এই বিশ্ববিদ্যালয় যেন একই সূত্রে গাঁথা। বাঙালীর মুক্তির সংগ্রামের প্রতিটি অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র্র করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন আর চেতনার নাম। এর প্রমাণ অতীতের সোনালী ইতিহাস। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে এ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল নেতৃত্বের অগ্রভাগে। এখান থেকেই আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছিল সারাদেশে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ভূমিকা অগ্রগণ্য। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা পালন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সেজন্য এ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল পাক-হানাদার বাহিনীর প্রধান লক্ষ্য। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত থেকে শুরু করে স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক ও বিভিন্ন পদমর্যাদার অসংখ্য কর্মকতা-কর্মচারী পাকবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হয়েছিলেন। এখানকার অকুতোভয় ছাত্র-শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন দেশমাতৃকাকে রক্ষা করবেন বলে। প্রাণপণে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে, জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন অকাতরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর নির্মম নির্যাতন ও হত্যাকান্ড সত্ত্বেও তারা দমে না গিয়ে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সম্মুখ সমরে হানাদার বধ করেছেন। ছিনিয়ে এনেছেন বাংলার স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। এভাবেই দেশের আশা-ভরসার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে আপন ভূমিকায় সর্বদাই সমুজ্জ্বল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত পৃথিবীতে আর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে বিশ্ববিদ্যালয় তার জাতিকে একটি পতাকা উপহার দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস কেবল একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস নয়, এর ইতিহাস এই বাংলার মানুষের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক বিবর্তনের ইতিহাস, পরাধীনতার শিকল ভেঙ্গে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনার ইতিহাস। তাই বাঙালী জাতির ইতিহাস থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে কোনোভাবেই পৃথক করা যায় না।
‘সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ ও মানবিক চেতনা বিকাশে উচ্চশিক্ষা’ এই প্রতিপাদ্যকে ধারণ করে ১ জুলাই পালিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। ‘দেশের প্রয়োজনে সর্বদা কান্ডারির ভূমিকায় অবতীর্ণ’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবারের প্রতিপাদ্যটির মাধ্যমে আবারও সেটাই প্রমাণ করল। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটেছে। আমাদের দেশেও স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুদের মদদে জঙ্গিবাদ বিস্তারের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। অশুভ শক্তির এসব অপচেষ্টা রুদ্ধ করার প্রয়াসেই এবারের প্রতিপাদ্যটি নির্ধারণ করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুরু থেকেই একটি ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সামাজিক সংহতি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিকশিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা পাকিস্তানীদের চাপিয়ে দেয়া সাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল সেই বাষট্টিতে। এখন যখন দেশকে পাকিস্তানী ভাবধারায় বিশ্বাসী, ধর্মের ধ্বজাধারী ধর্ম ব্যবসায়ীরা দেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে, জঙ্গি তৎপরতার মধ্য দিয়ে দেশকে তিমিরাচ্ছন্ন মধ্যযুগীয় বর্বরতাকালীন সময়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অতীতের মতোই কান্ডারির আসনে সমাসীন হয়েছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ এবং মানবিক চেতনার বিকাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকতা-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার প্রত্যয় নিয়ে আজ নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালন করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে ভারতীয় উপমহাদেশে ১৮৫৭ সালে সর্বপ্রথম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে উপমহাদেশে আধুনিক উচ্চশিক্ষার নতুন যুগের সূচনা ঘটেছিল। কিন্তু পূর্ব বাংলার মানুষ ছিল সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত। পশ্চিমবঙ্গে যেখানে দশটি কলেজ ছিল, সেখানে জনসংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলায় ছিল মাত্র নয়টি কলেজ। এমনকি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হওয়ার পর থেকেই ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য দাবি উঠতে থাকে। ব্যারিস্টার খান সাহেবজাদা আফতাব আহমেদ, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী, নবাব সলিমুল্লাহ, স্যার সৈয়দ শামসুল হোদাসহ আরও অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ব্রিটিশ সরকারকে চাপ দিতে থাকে। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হলে ব্রিটিশ সরকার নেতাদের দাবির প্রেক্ষিতে নাথান ও স্যাডলার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ১৯২১ সালের পহেলা জুলাই ঢাকার রমনা এলাকায় ছয় শ’ একর জমিতে তিনটি অনুষদ, বারোটি বিভাগ, ষাটজন শিক্ষক, আট শ’ সাতচল্লিশজন শিক্ষার্থী এবং তিনটি আবাসিক হল নিয়ে তার শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে।
এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল আলোকিত মানুষ তৈরি করা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরুর পর থেকেই পূর্ব বাংলার আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন আসতে থাকে। মুক্তবুদ্ধি চর্চায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিরামহীনভাবে কাজ করে যাচ্ছে সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই। এই বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেছেন একদল প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, যাঁরা জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটাতে সহায়তা করেছেন। সেই ধারাবাহিকতার ফল মহান মুক্তিযুুদ্ধ এবং বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো আজকের বাংলাদেশ। প্রথম উপাচার্য ফিলিপ জে হার্টগ চেয়েছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়কে সমগ্র ভারতবর্ষের মধ্যে একটি মডেল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করতে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বিদ্যাচর্চার খ্যাতিতে বিশ্ববিদ্যালয়টি উপমহাদেশের একটি শ্রেষ্ঠ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েও ছিল। প্রতিষ্ঠাকালীন থেকেই এ বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা এবং রাজনীতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রদান ও চর্চার ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে আসছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনালগ্ন থেকে অদ্যাবধি জ্ঞানের আলো নিয়ে নিজে আলোকিত হয়েছেন, দেশ ও দেশের মানুষকে আলোকিত করেছেন হাজারো মনীষী, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞানী, সাংবাদিক, কূটনীতিক, শিল্পী, সাহিত্যিক, শিল্পপতিসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মশালবাহী কেউ না কেউ। এ দেশের অধিকাংশ রথী-মহারথী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক একটা আলোকছটা। র্সর্বাগ্রে বলতে হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। জনমানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এজন্য তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। মুচলেকা দিলে তিনি বহিষ্কার হতেন না। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর তাঁর প্রতিবাদী চেতনা আরও শানিত হয়েছিল। সেই শানিত প্রতিবাদী চেতনার কারণে তিনি মুচলেকা দেননি। পড়ালেখা অসমাপ্ত রেখেই দেশের মানুষের কল্যাণে ঝাঁপিয়ে পড়েন রাজনীতিতে। ২০১০ সালের ১৪ আগস্ট দীর্ঘ প্রায় একষট্টি বছর পর তাঁর ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে জাতির পিতার আগমনের কথা ছিল। তাঁর আগমন এই বিশ্ববিদ্যালয়কে আরও মহিমান্বিত করে তুলত নির্ঘাত। আমরাও সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু নরপিশাচরা সেদিন জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করে। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশ অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপিত হয় দুই স্বৈরশাসক জিয়া ও এরশাদের হাত ধরে। এই দুই স্বৈরশাসক নিজেদের রাজনীতির স্বার্থে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতিকে কলুষিত করার নোংরা খেলায় মেতে উঠেছিল। অনেকেই তাদের প্রলোভনের ফাঁদে ধরা দেয়। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ই বিদ্যাচর্চার পরিবর্তে লেজুড়পনা আর তাঁবেদারিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত ঊনচল্লিশটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। পাটের জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কারসহ নানা উল্লেখযোগ্য গবেষণা এখান থেকে করা হলেও তা কাক্সিক্ষত মাত্রায় নয়। এর অন্যতম কারণ অর্থের সঙ্কট। গবেষণা খুবই ব্যয়বহুল; বিশেষত বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণা। বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার ব্যয় বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে প্রদান করা জাতীয় বাজেটের চেয়েও অনেক বেশি। সীমিত বাজেট গবেষণার উন্নয়নের ক্ষেত্রে অন্তরায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সমাজ এবং সভ্যতা বিনির্মাণের পথ দেখাবে, সমাজের বিদ্যমান সমস্যা নিয়ে গবেষণা করবে, সমাধানের পথ বের করবে সেটাই সমগ্র জাতির কাম্য এবং সেজন্য প্রয়োজন বাজেটে গবেষণা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন অবকাঠামোগত উন্নয়নের জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এটা আরও প্রসারিত করা প্রয়োজন। অবকাঠামোগত দুর্বলতার মধ্যে প্রথমেই আসে আবাসিক সমস্যার কথা। প্রায় চল্লিশ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশকেই আবাসিক সুবিধা দেয়া যাচ্ছে না। যারা আবাসিক সুবিধা পাচ্ছে তারাও বাধ্য হচ্ছে মানবেতর জীবনযাপনে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ একান্ত জরুরি। আরেকটি সমস্যার কথা আমি বলতে চাই। সেটা হচ্ছে জাতির বিবেক হিসেবে বিবেচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে আর্থিক দুর্নীতি, যৌন হয়রানির মতো জঘন্য অন্যায়-অনিয়মের অভিযোগ ওঠে, যা পুরো জাতির জন্যই অপমানজনক। অনেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতিকে নেতিবাচক হিসেবে দেখে থাকেন। এর কারণ রাজনীতিকে ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিকীকরণ। ছাত্ররা যখন রাজনৈতিক আদর্শকে ছাপিয়ে ব্যক্তিক স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়, তখনই ছাত্র রাজনীতি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। ছাত্রদের সেই রাজনীতির ধারায় ফিরে যেতে হবে। এজন্য দরকার ডাকসু নির্বাচন। সাধারণ ছাত্রসমাজ মেধাবীদেরই পছন্দ করে এটা অতীতেও প্রমাণিত। এ দেশের জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে ডাকসু নেতৃত্বের বিকাশ ঘটাতে সহায়তা করে থাকে।
জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন। এ কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ রকম নিম্নমুখী প্রবণতা তিনি মেনে নিতে পারেননি। তাই তিনি সর্বদাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য, অতীত ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার জন্য নানারকম পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন কিংবা পদক্ষেপ নেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়ে চলছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও সেই মোতাবেক চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের একটি বিষয়ের জন্য অবশ্যই সাধুবাদ প্রাপ্য। তা হলো সেশনজটের মারাত্মক সমস্যা থেকে শিক্ষার্থীদের পরিত্রাণ দেয়া। একটা সময় শিক্ষার্থীদের সেশনজটের কারণে আট থেকে দশ বছর ক্যাম্পাসে থাকতে হতো। এখন শিক্ষার্থীরা যথাসময়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করতে পারে। ফলে তাদের কাছ থেকে আর হারিয়ে যাচ্ছে না যৌবনের মূল্যবান সময়।
এ দেশের মহান স্বাধীনতাকেই ধারণ করে আসছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং আজকের সরকার। সকল প্রগতিশীল আন্দোলন ও মহান স্বাধীনতা যুদ্ধকে হৃদয়ে ধারণ করে আজকের প্রশাসন আগামী প্রজন্মের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। একাত্তরে আমরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে লাখো শহীদের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতার লাল সূূর্যটাকে ছিনিয়ে এনেছিলাম। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই সিনেট ও সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা ‘বিজয় একাত্তর’ হল নামকরণে সুরম্য একটি আবাসিক হল নির্মাণ করেছি। আবার স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য, যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর সেই ৭ মার্চের নির্দেশনাকে স্মৃতিতে রাখার জন্যই রোকেয়া হলের অভ্যন্তরে এক হাজার শয্যাবিশিষ্ট ৭ মার্চ ভবন এবং প্রগতিশীল রাজনীতি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথনির্দেশক কবি সুফিয়া কামাল নামে হল নির্মাণ করা হয়েছে। বিগত দুটি সিনেট অধিবেশনে প্রস্তাব করেছি স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল স্নোগান ‘জয় বাংলা’ নামে আরেকটি ছাত্রাবাস করার, এর মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীনতার মহান স্থপতির প্রতিই শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছে।
কথায় বলে লেখাপড়া করা ব্যতীত কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দা দিয়ে হাঁটলেও অনেক জ্ঞান লাভ করা যায়। এটা কথার কথা। তবে এর মধ্য দিয়ে জ্ঞানচর্চায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব কতখানি সেই বিষয়টিই প্রকাশ পায়। শুধু জ্ঞানচর্চায়ই নয়, মুক্তিবুদ্ধি চর্চার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রগতিশীল চেতনার বিকাশ ঘটাতেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস তুলনাহীন, যা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের পেশাগত দক্ষতা সৃষ্টিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই সর্বোচ্চ পর্যায়গুলোতে অবস্থান করে শক্ত হাতে দেশের হাল ধরে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। সবচেয়ে বড় কথা, এই বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করেছিল শিক্ষার্থীদের মাঝে যে মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশের উদ্দেশ্য নিয়ে, তা এখনও করে চলছে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে। পাকিস্তানের পরাজিত শত্রুরা দেশে যে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বিস্তারের প্রয়াস চালাচ্ছে, তা রুখে দিতে অতীতের মতোই মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে বুকে ধারণ করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে এগিয়ে আসতে হবে, কান্ডারির আসনে সমাসীন হয়ে দেশকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের কবল থেকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সারাদেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে যেভাবে বিবেচিত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে, সেই ঐতিহ্য রক্ষা করতে হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে।
-লেখকঃ সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সাবেক সাধারণ সম্পাদক