॥ প্রফেসর ড. আবু ইউসুফ মোঃ আব্দুল্লাহ ॥
’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-র নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ’৫৭-র স্বায়ত্তশাসন দাবি, ’৬২ ও ’৬৯-এর গণআন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের মুক্তি সংগ্রাম। দীর্ঘ নয় মাসের এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ভেতর দিয়ে, বহু ত্যাগ-তিতীক্ষা, বহু নারীর সম্ভ্রম আর শহীদদের অমূল্য জীবনের বিনিময়ে অর্জিত এ বিজয়। এ বিজয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালেই তাঁকে গ্রেফতার করা হলেও প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার হৃদয়ে, আবেগে সার্বক্ষণিক উপস্থিতি ছিল এ মহান নেতার। বিজয়ের মাসে স্বশ্রদ্ধ সালাম এই মহান নেতার প্রতি। বিন¤্র শ্রদ্ধা আর গভীর কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করছি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।
স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর আমাদের অর্জনগুলো পর্যবেক্ষণ করলে মনে হবে অনেক কিছু আমরা অর্জন করেছি, আমরা হয়তো উন্নয়নের অনেক সূচক পাব। ব্যবসা-বাণিজ্যে, প্রযুক্তিতে, কৃষিতে, সামাজিক অন্যান্য ক্ষেত্রে আমাদের কিছু অর্জন আছে। কিন্তু সেটা যে কাঙ্খিত মানের নয় সেটাও সবাই নিঃসংকোচে স্বীকার করতে বাধ্য হবেন। আজকে যদি একটি পরিসংখ্যান জানতে চাওয়া হয় যে, কৃষিতে কত শতাংশ শিক্ষিত জনশক্তি নিয়োজিত আছে? ব্যবসা-বাণিজ্যে শিক্ষিত শ্রেণির অবস্থান কোথায়? দেশের কত শতাংশ মানুষের কাছে প্রযুক্তি শিক্ষা পৌছানো গেছে? উত্তরে অনেক ক্ষেত্রেই সংখ্যাটি খুব উল্লেখযোগ্য হবে না। একটি দেশের কৃষি ব্যবস্থায় যখন শিক্ষিত লোকদের অংশগ্রহণ বাড়বে তখন সেখানে প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটবে, সমবায়মূখী উৎপাদন বাড়বে। কৃষিব্যবস্থার উন্নয়ন হবে। ক্ষুদ্রশিল্পে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য প্রশিক্ষিত মেধার প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষা ছাড়া এই খাতের উন্নয়ন সম্ভব নয়। স্বাস্থ্যখাতের দূরাবস্থা দূর হবে যদি দেশের জনশক্তির সংখ্যার অনুপাতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, নার্স, মেডিকেল এসিস্টেন্ট, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট প্রস্তুত করা যায়, যদি এই সকল স্বাস্থ্য-স্বজনকে বিশে^র মানের সাথে তাল মিলিয়ে দক্ষ করা যায়। অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈশ্বিক কৌশল আয়ত্তে আনতে শিক্ষিত লোকের বিকল্প নেই। এভাবে সকল ক্ষেত্রেই যদি শিক্ষিত জনশক্তির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায় তাহলে সামগ্রিকভাবে দেশ সমৃদ্ধতার দিকে অগ্রসর হবে।
দেশের প্রাইমারি, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক সেক্টরের শিক্ষার মানের উন্নয়ন প্রশংসনীয়। উচ্চশিক্ষায় সরকারি ও বেসরকারি সেক্টরেও আমাদের অর্জণ রয়েছে। কিন্তু উচ্চশিক্ষায় উল্লেখ করার মত অনেক সেক্টর আছে যেখানে আমরা কাঙ্খিত ভূমিকা রাখতে পারিনি। আমাদের দেশের তরুন মেধাবীরা উচ্চশিক্ষার জন্য এখনো বিদেশ গমন করে থাকে।
আমার দৃষ্টিতে এদেশের শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে গমন করার কারনে বিপুল পরিমাণ মেধা এবং অর্থ সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে। আমি টঘঊঝঈঙ-এর ২০১৪ সালের একটি সমীক্ষার কিছু অংশ তুলে ধরতে চাই; যেখানে বৃটেন, আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া ও কানাডা-তে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা হচ্ছে ১৫০৩৪ জন। সমীক্ষা অনুযায়ী, এ পাঁচটি দেশে পড়তে যাওয়া ১৫০৩৪ জন শিক্ষার্থীর গ্রাজুয়েশন এবং পোস্ট-গ্রাজুয়েশন কোর্স সম্পন্ন করতে ৬ বছরে খরচ হবে প্রায় ২৪০,১৪,১০,০৯৮ আমেরিকান ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ প্রায় ১৯২১১,২৮,০৭,৮৪৮ টাকা অর্থাৎ যা কি না প্রায় ১৯২ বিলিয়ন টাকার সমান। যদি ধরা যায় এদের মধ্যে মাত্র এক তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থীর অভিভাবক তাদের সন্তানদের পড়ালেখার খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য বিদেশ ভ্রমণ করবেন, তাতেও প্রায় খরচ রয়েছে ২১০ কোটি টাকা। উল্লেখ্য যে, উক্ত সমীক্ষার বাদ বাকী দেশে পড়তে যাওয়া প্রায় ৮১৫১ জন শিক্ষার্থীর সম্ভাব্য খরচ এখানে ধরা হয়নি।
এ প্রসংগে আমি শুধু একটি কথাই বলতে চাই, প্রতি বছর দেশের হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী উচ্চ শিক্ষার্জনের জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। সাথে যাচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থাৎ শত শত বিলিয়ন টাকা। এটি একটি জাতির জন্য বিশালাকার ক্ষতি। যেমনি ভাবে এ ক্ষতি অর্থ সম্পদের তেমনি ভাবে এ ক্ষতি মেধার। দেশ ও জাতি বঞ্চিত হচ্ছে শাণিত মেধার ব্যক্তিদের সেবা থেকে। এ উভয় প্রকার ক্ষতির মেয়াদ যদি আরো দীর্ঘায়িত হয় এবং এটিকে যদি সহনীয় মাত্রায় কমিয়ে আনা না যায়, তাহলে জাতি হিসেবে আমাদেরকে পিছিয়ে পড়তে হবে এবং এর জন্য এ জাতিকে এক সময় চরম মূল্য দিতে হবে।
আধুনিকায়নের এ যুগে বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা আমরা কেনো হারাবো? আমরা কি পারি না ১৫-২০ বছর ব্যাপী মেগা পরিকল্পনা নিয়ে এ দেশে বিশ্বমানের ৪/৫টি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে? আমরা কি পারি না ব্রিটেন, আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া এবং কানাডার মতো দেশের ৪/৫টি বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের মডেল এদেশে স্থাপন করতে? আমাদের জমি রয়েছে, মানব সম্পদ রয়েছে, প্রাকৃতিক অনুকূল পরিবেশ রয়েছে, বিশ্বমানের শিক্ষকও রয়েছে... তাহলে আমরা পারছিনা কেনো? আমাদেরকে পারতেই হবে, দেশের মেধা ও অর্থ সম্পদ দেশেই রাখতে হবে এবং দেশকে গড়তে হবে। প্রয়োজন শুধু সাহসী সিদ্ধান্তের।
স্মরণ রাখতে হবে, স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে স্বাধীনতা অর্জনের স্পৃহা জন্মেছিল একটি স্বকীয় জাতি গঠনের তীব্র বাসনা থেকে। স্বপ্ন ছিল বিশ্বের বুকে সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়ানোর। অবশেষে শোষকের বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়। স্বাধীনতা অর্জনের ৪৬ বছর পার হয়েছে। আমরা কতটুকু সমৃদ্ধতা অর্জন করেছি তা বিচার বিশ্লেষনের দাবী রাখে। কেননা যে স্বপ্নে ৩০ লক্ষ জীবন বিশর্জন দিতে হয়, যে স্বপ্ন দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত ছিনিয়ে নেয়, যে স্বপ্ন মানুষের স্বাভাবিক সামাজিক জীবন যাপনকে তছনছ করে দিয়ে জীবন বাঁচাতে শত শত মাইল পায়ে হেটে পাশ্ববর্তী দেশে রিফিউজির জীবন যাপনে বাধ্য করে, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের ব্যর্থতা মেনে নেওয়া অপরাধ।
বাংলাশের চেয়ে পিছিয়ে থেকেও উন্নয়নের সোপান বেয়ে অনেক উপরে উঠে গেছে বেশ কিছু দেশ। মালয়েশিয়া এর অন্যতম। মালয়েশিয়ার ইর্ষনীয় সাফল্য অর্জনের পিছনে শিক্ষার আধুনিকীকরণ, শিক্ষায় বিনিয়োগ এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ ও শিক্ষায় দেশপ্রেমই মূখ্য ভূমিকা পালন করেছে। কাজেই দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধতা অর্জনে দেশের উচ্চশিক্ষার মানের দিকে নজর দেওয়ার বিকল্প আমাদের হাতে কিছু নেই।
একই সাথে যে জনগোষ্ঠীকে আমরা শিক্ষিত ও দক্ষ করে গড়ে তুলছি তাদের মধ্যে যেন দেশপ্রেম এর ঘাটতি না থাকে সেদিকটাও নিশ্চিত করতে হবে।
মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করেছেন। কিন্তু এই স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে বর্তমান সময়ের তরুণ প্রজন্মকে। স্বাধীনতার পর থেকেই এ দেশের সার্বভৌমত্ব নস্যাৎ করার জন্য ছিল হাজারো অপচেষ্টা। যা বর্তমান সময়েও অব্যাহত রয়েছে। তরুণ প্রজন্মকে তাই শপথ নিতে হবে, মহান মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ যেন বৃথা না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নতুন মুক্তিসংগ্রামের সেনানী হয়ে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করতে হবে। আমরা স্বপ্ন দেখি আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ সমৃদ্ধতায় বিশে^র প্রথম সারির দেশগুলোর সাথে এক কাতারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। সবাইকে মহান বিজয়ের শুভেচ্ছা।
লেখক- প্রফেসর, আইবিএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, উপাচার্য, নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজি খুলনা; চেয়ারম্যান, নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ ট্রাস্ট