॥ রাইসা হেলাল ॥
দ্বাদশ শ্রেণি, ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজ
গত পহেলা এপ্রিল থেকে ২০১৫ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। আমিও একজন পরীক্ষার্থী। ভিকারুননিসা নূন কলেজের ছাত্রী হওয়ায় আমার সিট পড়েছে হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজে। কলেজ সেন্টারটি আমাদের বাসার সন্নিকটে। বাসা থেকে যেতে ১০/১২ মিনিট সময় লাগে। গাড়ি দিয়ে গেলে ৫-৭ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছানো যায়। তবুও প্রথম পরীক্ষার দিন ঘন্টাখানেক সময় হাতে নিয়েই বের হয়েছিলাম পরীক্ষা হলের উদ্দেশ্যে।
বাসা থেকে বের হয়ে কাকরাইল মোড় যেতেই যানজটের যে অবস্থা দেখলাম, তাতে বুঝতে আর বাকি রইল না যেÑ আর বেশি দূর গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে না। তখন আমি আর মা হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে থাকতেই গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। আমার মতো আরও অনেক পরীক্ষার্থীই যানবাহন থেকে নেমে গেল। হেঁটে যেতেও বেশ বেগ পেতে হলো। একেতো সংকীর্ণ ফুটপাথ, তাও আবার হকারদের দখলে। তার ওপর রাস্তায় এত গাড়ি-রিকশার জ্যাম লেগে গেছে, কোনো কিছুই নড়ছে না। পরীক্ষার হলে ঢুকতেও কম বেগ পেতে হলো না। পরীক্ষার্থী, তাদের অভিভাবক, পথচারী, নিরাপত্তাকর্মী, যানবাহন সব মিলিয়ে কলেজের সামনে এক ভজঘট অবস্থা। অনেক ভিড় ঠেলে ধাক্কাধাক্কি করে তবেই কলেজের ভেতর প্রবেশ করলাম।
পরীক্ষা শেষেও একই অবস্থা; রাস্তার অর্ধেকতো পরীক্ষার্থীদের অভিভাবকদের দিয়েই ভরে গেছে। অন্যদেরও চলাচলের উপায় নেই। ভিড়ের মধ্যে অভিভাবকদের খুঁজে পাওয়া দায়। রিকশা-গাড়ি সব জ্যামে আটকে আছে। প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে গাড়ি রেখে, তারপর মা হেঁটে আমাকে নিতে আসেন। ছোট ভাইকে কোলে নিয়ে দুপুর রোদে হেঁটে এসে উনিতো একেবারে গলদঘর্ম। আমি ভাবছিলাম, পরীক্ষার সাথে সম্পৃক্ত নয় এমন ব্যক্তিও অহেতুক এই বিশৃঙ্খল জ্যামে পড়ে নিশ্চয়ই পরীক্ষার্থীদেরই অভিসম্পাত করছে। পরে জানতে পারলাম, এইচএসসি পরীক্ষার জন্য পুরো ঢাকা শহরেই নাকি যানজট মারাত্মক রূপ ধারণ করেছিল।
প্রথম দু’পরীক্ষা এভাবেই বিশৃঙ্খল অবস্থায় দিলাম। তৃতীয় পরীক্ষার দিন বাসা থেকে বের হয়ে দেখি, যানজটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৃষ্টি। সেতো আরও ভয়াবহ অবস্থা! যানজট গেল আরও বেড়ে, তার সঙ্গে কাদা আর রাস্তায় জমা পানি। গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে যাওয়ারও উপায় নেই। তাও অনেক কষ্টে ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে কিছুদূর পর্যন্ত গেলাম। গাড়িগুলো এমনভাবে জ্যামে আটকে আছে যে, দু’টো গাড়ির মাঝখান দিয়েও যাবার উপায় নেই। ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে, কখনও পানি এড়িয়ে, কখনও পানিতে জুতা ভিজিয়ে এগুতে থাকলাম। কিন্তু ঠিক কলেজ গেইটের দরজা থেকে ৫/৬ মিটার পর্যন্ত জায়গায় হাঁটুপানি। যাব কী করে! তখন রিকশাওয়ালাগণ এগিয়ে এলেন। পাশাপাশি রিকশা দাঁড় করিয়ে ব্রিজ তৈরি করে ফেললেন। সেই রিকশার ব্রিজে উঠে রাস্তা পার হয়ে তবেই পরীক্ষার হলে পৌঁছলাম। সেদিন এতই জ্যাম ছিল যেÑ অনেকেরই আসতে দেরি হয়ে গেল, কয়েকজনতো পরীক্ষা শুরু হওয়ার ১০-২০ মিনিট পর হলে ঢুকল! বৃষ্টি আর কাদায় প্রত্যেকের যে অবস্থা হয়েছিল, তা আর বলার নয়। সেদিন বাসায় ফিরে অনেক পরীক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়ে।
এভাবে আরো ৭/৮ দিন বিভিন্ন পুলসেরাত পার হয়ে যেতে হবে আমাদেরকে পরীক্ষার হলে। কাগজে-কলমে পরীক্ষা দেয়ার পাশাপাশি সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও অনাচার সহ্য করার পরীক্ষাও দিয়ে যেতে হচ্ছে।
এ অবস্থায় ভাবছিÑ উপরে বর্ণিত এ দুর্ভোগগুলোকে আমরা কি ‘নিয়তি’ বলে মেনে নিয়েছি! এসব কিছুর জন্য মূলত দায়ী কে বা কারা, তা বড়রা ভালো জানেন। তবে শৃঙ্খলার অভাবও কম লক্ষণীয় নয়। এইচএসসি পরীক্ষার সিট যেসব কলেজে পড়েছে, সেই কলেজগুলোর সামনে কঠোর আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন ছিল। কলেজ সংলগ্ন রাস্তাগুলোতে ব্যারিকেড দিয়ে বিকল্প যাতায়াত ব্যবস্থা করা কঠিন ছিল না। পরীক্ষা শুরুর ১ ঘন্টা আগে থেকেই পরিকল্পিতভাবে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা যেত। এজন্য প্রয়োজন ছিল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর আরও সদস্য মোতায়েন। বৃষ্টির দিনগুলোতে পানি জমে যাওয়া রাস্তায় ইট দিয়ে বা বালির বস্তা দিয়ে যাতায়াতের পথ বানিয়ে দেয়া যেত, যেন পরীক্ষার্থীরা সহজেই রাস্তা পারাপার হতে পারে। সম্ভাব্য যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় যথাযথ পূর্বপ্রস্তুতি নেয়া দরকার ছিল। এছাড়াও রাস্তা ভাঙা হওয়ায়, বৃষ্টিতে জলজট সৃষ্টি হয়ে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। তাই রাস্তাঘাট সংস্কার করা খুব জরুরি; না হলে প্রতিবছরই আমাদের মতো পরীক্ষার্থীসহ সকল মানুষ ভোগান্তিতে পড়বে।
আমরা একটি সুষ্ঠু, সুন্দর পরিবেশে পরীক্ষা দিতে চাই। যানজট বা জলজটের কারণে যেন আর একজন পরীক্ষার্থীরও পরীক্ষার হলে পৌঁছাতে দেরি না হয়, আমরা সেটিই চাই। তাই এরূপ বড় পাবলিক পরীক্ষার বাস্তবতাগুলো মাথায় রেখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ পূর্বপ্রস্তুতি নেবেন, সবিনয়ে সেই অনুরোধ রইল।
লেখকের ওয়েবঃ www.raisa.helal.net.bd
ই-মেইলঃ nazneen7ahmed@yahoo.com