করোনার প্রাদুর্ভাবে বড় সংকটে পড়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এই সময়টায় একদিকে শিক্ষার্থী ভর্তি কমে গেছে; অন্যদিকে বিদ্যমান শিক্ষার্থীরা নিয়মিত টিউশন ফি পরিশোধ না করায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয় কমে গেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে অনেক প্রতিষ্ঠান জনবল কমাচ্ছে। আবার কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কমাচ্ছে। এমনকি একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নিজস্ব ফিক্সড ডিপোজিট-এফডিআর ভাঙতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কাছে অনুমতি চেয়েছে।
জানা যায়, ঢাকা মহানগরীতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন পেতে পাঁচ কোটি টাকার এফডিআর করতে হয়। আর জেলা পর্যায়ে তিন কোটি এবং মফস্বল বা উপজেলা পর্যায়ে দেড় কোটি টাকার এফডিআর থাকতে হয়। করোনাজনিত সংকটে পড়ে এসব এফডিআর ভাঙতে চাইছে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়। রাজশাহীর বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, রাজধানীর বনানীতে অবস্থিত একটি বিশ্ববিদ্যালয় এরই মধ্যে এ ব্যাপারে ইউজিসিতে আবেদনও করেছে।
করোনার মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুরু হয় ‘সামার’ সেমিস্টার। এই সময়টায় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তেমন কোনো সমস্যায় পড়তে না হলেও ছোট ও মাঝারি মানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তি ব্যাপকভাবে কমেছে। যেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গত বছরের সামার সেমিস্টারে গড়ে ৪০০ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল, সেখানে এবার দুইশ’র কম শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। আর যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে কমবেশি ২০০ শিক্ষার্থী ভর্তি হতো, সেখানে ভর্তি হয়েছে একশ’র কম। রাজধানীর সোবহানবাগের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছরের সামার সেমিস্টারে এক হাজার ৬০০ শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও এবার হয়েছে মাত্র ৪৫০ জন। আগামী অক্টোবর থেকে ‘ফল’ সেমিস্টার শুরু হবে। কিন্তু এখনো যেহেতু এইচএসসি পরীক্ষাই গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি, তাই আসন্ন সেমিস্টার নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দুশ্চিন্তা বাড়ছে।
তবে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি (আইইউবিএটি), ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) মতো বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে করোনার মধ্যেও শিক্ষার্থী ভর্থির সংখ্যা গত বছরের চেয়ে খুব বেশি হেরফের হয়নি।
আইইউবিএটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুর রব বলেন, করোনার মধ্যেও আমরা ভালো অবস্থানেই আছি। সামার সেমিস্টারে গত বছরের কাছাকাছিই শিক্ষার্থী পেয়েছিলাম। তবে নতুন এবং ভাড়া বাড়িতে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় চলছে, তারা বেশি সমস্যায় আছে। এইচএসসি পরীক্ষা না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থী কিন্তু কমতেই থাকবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে যদি এইচএসসি পরীক্ষা গ্রহণের সুযোগ থাকে, তাহলে সেই ব্যাপারটা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিবেচনা করা উচিত।
এ ব্যাপারে জানাতে চাইলে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, এফডিআরের টাকা তুলে নেয়ার জন্য দু-একটি বিশ্ববিদ্যালয় যোগাযোগ করেছে। তবে আমরা জানি না, এই ধরনের কোনো সুযোগ আছে কি না? আবেদন পেলে আমরা আইনি দিক পর্যালোচনা করব। এরপর তা মন্ত্রণালয়ে পাঠাব।
বর্তমানে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০৬। এর মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে ৯৬টির। করোনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় রয়েছে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কারণ শিক্ষার্থী থাকুক আর না-ই থাকুক, তাদের মাস শেষে বড় অঙ্কের ভবন ভাড়া পরিশোধ করতে হয়। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নানা ধরনের সংকটে পড়েছে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের অনেকেই নিয়মিত টিউশন ফি পরিশোধ করছে না। ফলে যা আয় হয়, তা দিয়ে ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই স্বল্পসংখ্যক জনবল কমালেও রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী ও ধানমন্ডিতে ক্যাম্পাস থাকা একটি বিশ্ববিদ্যালয় বড় ধরনের জনবল কমিয়েছে।
বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেন, আমরা নতুন প্রায় ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য সংগ্রহ করেছি। সেখানে সামার সেমিস্টারে গত বছরের তুলনায় প্রায় ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী ভর্তি কমেছে। এখন সমস্যায় পড়ে কেউ কেউ তাদের এফডিআর ভাঙার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। ব্যাপারটি ইউজিসি বা মন্ত্রণালয়ের ভেবে দেখা উচিত। তবে আমরা এই সংকটময় মুহূর্তে সরকারের কাছে প্রণোদনা হিসেবে সুদবিহীন ঋণ চেয়েছিলাম; কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি। আমরা যদি ঋণ পাই, তাহলে কারো এফডিআর ভাঙার প্রয়োজন পড়বে না।
দেশে করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে গত ১৭ মার্চ থেকে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। বন্ধের মেয়াদ আগামী ৩ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়িয়েছে সরকার। শুরুর দিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধই ছিল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত মে মাস থেকে অনলাইনে ক্লাস, মূল্যায়ন, ভর্তিসহ সব শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর অনুমতি দেয় সরকার। আর জুলাই থেকে অনলাইনে শুরু হয় সামার সেমিস্টারের ক্লাস।