জ্ঞানভিত্তিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ এবং আলোকিত জাতি গঠনে নিবেদিত শিক্ষা ও যুব উন্নয়নমূলক পত্রিকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গনের ত্রুটি-বিচ্যুতি, সমস্যা ও সম্ভাবনা উদঘাটন করে সরকার ও নীতি-নির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণের মাধ্যমে আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাঙ্গন প্রতিষ্ঠা ক্যাম্পাস পত্রিকার উদ্দেশ্য।
ক্যাম্পাস পত্রিকায় `জেলা প্রশাসকের দৃষ্টিতে শিক্ষাঙ্গন` কলামে শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গনের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট প্রশাসকদের অভিজ্ঞতা ও মতামত তুলে ধরা হয়। বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার উন্নয়নভিত্তিক কার্যক্রম অন্যান্য ব্যক্তি বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুকরণীয়রূপে কার্যকর হতে পারে, যা সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য হতে পারে কল্যাণকর।
প্রিয় পাঠক, জেলা প্রশাসকের দৃষ্টিতে শিক্ষাঙ্গন কলামে উপস্থাপনের নিমিত্তে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার প্রতিনিধি মুখোমুখি হন দেশের শ্রেষ্ঠ জেলা প্রশাসক নির্বাচিত হওয়া ঢাকার জেলা প্রশাসক মোঃ শহীদুল ইসলামের সাথে। তাঁদের কথোপকথনের উল্লেখযোগ্য অংশ এখানে তুলে ধরা হলো।
বি ক্যাঃ একজন দক্ষ ও ডায়নামিক জেলা প্রশাসক হিসেবে দেশের শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গন সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন ও পরামর্শ বলবেন কী?
মোঃ শহীদুল ইসলামঃ শিক্ষাক্ষেত্রে একজন শিক্ষক এবং একজন শিক্ষার্থী একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। একজন শিক্ষক যতক্ষণ ক্লাসে পড়ান, ততক্ষণ তিনি শিক্ষক। অর্থাৎ ৭/৮ ঘন্টা ধরে যতক্ষণ তিনি পাঠদান করেন, ততক্ষণই শুধু তিনি শিক্ষক; এর বাইরে ২৪ ঘন্টার বাকি সময় তিনি ছাত্র। যদি তিনি নিজে ভালোভাবে পড়াশোনা না করেন, না বোঝেন, না জানেন, না শিখেন, তাহলে তিনি ক্লাসে শিক্ষার্থীদের কী শেখাবেন? ইংরেজিতে প্রবাদ আছে, `A good teacher must be a good student earlier`. ভালো শিক্ষককে আগে অবশ্যই ভালো ছাত্র হতে হবে। আগে শিক্ষক ভালো ছাত্র হলে পরে তিনি অবশ্যই ভালো শিক্ষকে পরিণত হবেন।
বি ক্যাঃ আপনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক কেমন ছিলো?
শহীদুল ইসলামঃ আমাদের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক খুবই ভালো ছিল। আমরা স্যারদের স্নেহময় ইন্টিমেসি পেয়েছি। তাঁরা শুধু আমাদের শিক্ষকই ছিলেন না, একইসঙ্গে তাঁরা ছিলেন আমাদের ফ্রেন্ড, ফিলোসফার এন্ড গাইড। তাঁরা প্যারেন্টাল সুপারভিশন, লাভ এন্ড এফেকশন দিয়ে আমাদের পড়াশোনা করিয়েছেন। আমাদের সুবিধা অসুবিধার দিকে সজাগ দৃষ্টি রেখেছেন।
সুযোগ পেলে আমাদের খবরাখবর ও কুশলাদি জানতে চেয়েছেন। মোট কথা, তাঁরা শুধু শিক্ষক নয়, অভিভাবক হিসেবেও আমাদের দিকে সজাগ দৃষ্টি রেখেছেন। আমাদের সময় শিক্ষকরা পাঠদানের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সজাগ ও স্নেহশীল ছিলেন। এখনকার মতো কমার্শিয়াল চিন্তার প্রাধান্য মনোভাব আমাদের সময়কার শিক্ষকদের মনে ছিলো না। তারা আমাদের আন্তরিকভাবেই স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন। আমরাও তাদের শ্রদ্ধা করতাম। সবমিলিয়ে আমাদের সময় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক সত্যিকার অর্থেই ছিলো অত্যন্ত সুমধুর।
বি ক্যাঃ বর্তমান সময়ের শিক্ষার ও তখনকার শিক্ষার পরিবেশের মধ্যে কী পার্থক্য ছিলো বলে আপনি মনে করেন?
শহীদুল ইসলামঃ বর্তমান সময়ের সাথে তখনকার শিক্ষার পরিবেশের মধ্যে বেশ পার্থক্য। সামাজিক পরিস্থিতির কারণে এই পার্থক্য তৈরি হয়েছে। তবে সরকার এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর চেষ্টা রয়েছে শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল কাজই হওয়া উচিত শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা, যাতে শিক্ষার্থীরা সেখানে পড়াশোনার উপযুক্ত পরিবেশ পায়, মন দিয়ে পড়াশোনা করতে পারে। প্রতিকূল পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে যেনো তাদের কোনোভাবেই মোকাবিলা করতে না হয়।
বি ক্যাঃ উচ্চশিক্ষা শেষে আমাদের দেশের শিক্ষিত যুবসমাজ বেকার হয়ে পড়ছে। এই সমস্যা সমাধানে কী উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
শহীদুল ইসলামঃ আমরা আসলে লেখাপড়া করি ভালো একটা চাকরি পাব, এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। ফলে লেখাপড়া শেষ করে আমরা চাকরি না পেয়ে বেকার হয়ে যাই। আমাদের এই কনসেপশনটাই আসলে ভুল। শুধুমাত্র চাকরির জন্যই লেখাপড়া করা উচিত নয়। ভালো মানুষ হওয়ার জন্য লেখাপড়া করা উচিত। আত্মউন্নয়ন তথা মনুষ্যত্বের উৎকর্ষ সাধন শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য। কেউ যদি সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ভাল মানুষ হতে পারে, তাহলে কর্মজীবনে চাকরি বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা পাওয়া তার জন্য কোনো কঠিন কাজ নয়।
বি ক্যাঃ বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে বলে আপনি মনে করেন?
শহীদুল ইসলামঃ আমি মনে করি, বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় অবশ্যই ব্যাপক পরিবর্তন হওয়া উচিত। সভ্যতার সেই আদিযুগ থেকে এখন পর্যন্ত, আইসিটি আমাদের সামনে যে সুযোগ তুলে ধরেছে, আগে কখনো বিজ্ঞান আমাদের সামনে এই সুযোগ আনতে পারেনি। এখন আমরা এক ক্লিকেই সারা বিশ্বের সবজায়গায় কমিউনিকেট করতে পারি। এই সুযোগ আইসিটি ছাড়া বিজ্ঞানের আর কোনো আবিষ্কার আগে আমাদের দিতে পারেনি। এখন একজন ছাত্র ঘরে বসে গুগলে সার্চ করে ইংল্যান্ড, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ইত্যাদি সবদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সবকিছুই জানতে পারে। ইন্টারন্যাশনাল লাইব্রেরির সকল বইপত্র, জার্নাল ইত্যাদি সে ঘরে বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে পড়তে পারে। এই সুযোগ আগে কখনো ছিলো না। এখন লেখাপড়াটা সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে, শুধু স্কুল বা প্রাতিষ্ঠানিক গন্ডিতে আর সীমাবদ্ধ নেই। আইসিটি`র মাধ্যমে এখন শিক্ষার্থীরা যেকোনো জায়গা থেকেই পড়তে পারে এবং এটা আইসিটির সবচেয়ে বড় অবদান। আইসিটির এই সুবিধা আমাদের ব্যবহার করা উচিত এবং লুফে নেওয়া উচিত। আমরা দেখছি যে, করোনার কারণে স্কুল-কলেজ ইত্যাদি প্রাতিষ্ঠানিক সবকিছুই বন্ধ হয়ে গেছে। এখন এই করোনাকালীন সময়ে ফিজিক্যালি ক্লাস করতে না পারলেও আইসিটি`র মাধ্যমে আমাদের শিক্ষার্থীরা যার যার অবস্থান থেকে ক্লাস করতে পারছে। আইসিটি`র আরও ব্যাপক ইনফ্রাস্ট্রাকচার আমরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ও বেসরকারি উদ্যোগে সারা দেশে বিস্তার করতে পারি, স্টাব্লিশ করতে পারি `যাতে দেশের মানুষ আইসিটিকে বিকল্প হিসেবে, সাপোর্টিভ হিসেবে, কমপ্লিমেন্ট হিসেবে এর সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যেতে পারে।
বি ক্যাঃ শিক্ষাক্ষেত্রে ছাত্র-রাজনীতি বা শিক্ষক-রাজনীতি কতটুকু যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন?
শহীদুল ইসলামঃ শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র-রাজনীতির প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি মনে করি। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতি না থাকলে ছাত্ররা রাজনীতি শিখবে কোথায়? নেতৃত্ব তৈরি হবে কিভাবে? ছাত্র যখন আত্মবোধ থেকে শিখতে শুরু করে, তখন রাজনীতি তার শিক্ষার সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। এজন্য উচ্চ শিক্ষায় রাজনীতির আবশ্যকতা রয়েছে। তবে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতির সাথে যে অপসংস্কৃতি বিরাজমান, তার অপসারণ হওয়া উচিত।
শিক্ষক রাজনীতির বিষয়টি একেবারে ভিন্ন। শিক্ষকদের রাজনীতিতে জড়ালে শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষা প্রদানের সুযোগ সংকোচিত হয়, শিক্ষা বাধাগ্রস্থ হয়। শিক্ষকরা সরাসরি রাজনীতিতে না জড়িয়ে ছাত্র-রাজনীতির অনুঘটক ও অভিভাবক হিসেবে কাজ করতে পারেন।
বি ক্যাঃ ছাত্র-যুবকদের উদ্দেশ্যে আপনার মূল্যবান পরামর্শ বলবেন কী?
শহীদুল ইসলামঃ আমি ছাত্র-যুবকদের উদ্দেশ্যে একটা কথাই বলবো তাহলো, তাদের খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করতে হবে। যদি তারা পড়াশোনায় মনযোগ দিতে না পারে, তাহলে তাদের সবকিছুই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। তাদের লিসনিং, হিয়ারিং, রাইটিং, মেডিটেশন ইত্যাদি বিভিন্ন ধাপ ব্যবহার করে পড়াশোনায় মনযোগ দিতে হবে। পড়াশোনায় মনযোগের কোনো বিকল্প নেই। যে ছাত্র পড়াশোনায় যত বেশি মনযোগ দেবে, সে তত বেশি ভালো ছাত্র হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু ছাত্রদের ক্ষেত্রেই নয়, একজন মানুষ জীবনে কোনো কাজ করার ক্ষেত্রে যত বেশি মনযোগ দেবে, মন বসাতে পারবে, সে তত বেশি সফল হবে। সুতরাং মনযোগ সহকারে পড়াশোনা করা ছাত্র-যুবকদের এক নম্বর কাজ হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। পড়াশোনার প্রতি ডিভোশন তৈরি করতে হবে। আর ছাত্র-যুবকরা যদি পড়াশোনার প্রতি ডিভোশন তৈরি করতে পারে, নিজের মনের মধ্যে পড়াশোনার একটি জগৎ তৈরি করতে পারে, তাহলে ছাত্রজীবনে সফলতা এবং সফল কর্মজীবনের দ্বার তাদের সামনে খুলে যাবে।
বি ক্যাঃ সুদীর্ঘ ৩৯ বছর তথা ৩ যুগেরও বেশি সময় ধরে প্রকাশিত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকা শিক্ষা উন্নয়নে কী ভূমিকা রাখতে পারে, সে বিষয়ে আপনার মূল্যবান পরামর্শ জানাবেন কী?
শহীদুল ইসলামঃ সুদীর্ঘ ৩৯ বছর তথা ৩ যুগেরও বেশি সময় ধরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকা প্রকাশিত হয়ে আসছে। শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ তৈরি এবং ছাত্রদের ভবিষ্যৎ সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ক্যাম্পাস সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে থাকে। দেশের ছাত্র, শিক্ষক ও শিক্ষাঙ্গনে এর অবদান উজ্জ্বল।
শিক্ষা মানুষের আচরণগত পরিবর্তন করে। শিক্ষা ছাড়া মানুষের গুণগত পরিবর্তন সাধন করা সম্ভব নয়। আমরা অনেক কিছু পড়ি, অনেক কিছু জানি, অনেক কিছু শিখি; কিন্তু সেগুলো আমরা বাস্তবায়ন করি না আমাদের জীবনে। কারণ, আমরা তা ইনটেক করতে পারি না, আত্মস্থ করতে পারি না। ফলে আমাদের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসে না। আমরা যা জানি বা শিখি, সবার আগে সেটার প্রতিফলনের মাধ্যমে নিজেকে পরিবর্তন করা উচিত। আর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকা ছাত্রযুবকদের এই পরিবর্তন করার লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। তাই আমি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকার যুগ যুগ ধরে অব্যাহত প্রকাশনাকে স্বাগত জানাই এবং এর উত্তরোত্তর সাফল্য ও সমৃদ্ধি কামনা করি।