পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়েছেন ড. শামসুল আলম। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বঙ্গভবনে তাঁকে শপথ বাক্য পাঠ করান। তাঁর শপথের মধ্য দিয়ে প্রতিমন্ত্রীর সংখ্যা দাঁড়ালো ২০ জনে। সংসদ সদস্য না হওয়ায় তিনি মন্ত্রিসভায় জায়গা পাচ্ছেন টেকনোক্র্যাট হিসেবে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. শামসুল আলম ৩৫ বছরের অধ্যাপনা শেষে ২০০৯ সালের ১ জুলাই পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। সিনিয়র সচিব পদে দীর্ঘ এক যুগ চুক্তিভিত্তিক দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর কৃষি অর্থনীতিবীদ ড. শামসুল আলম বলেন, আমি আমার কর্মজীবনে স্বচ্ছতার প্রমাণ দিতে পেরেছি। কোনো অবৈধ সুবিধা নিইনি। দেশটাই আমরা কাছে বড়। স্বচ্ছ ভাবমূর্তি ছিল বলেই আজ আমি এই জায়গায় আসতে পেরেছি। পরিকল্পনা কমিশনে আমার পুনর্জন্ম হয়েছে। এটি অপূর্ব পাওনা।
সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দেয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
ড. শামসুল আলম বলেন, দীর্ঘ ১২ বছর এই চত্ত্বরে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। এখন নতুন দায়িত্ব পালন শুরু করলাম। প্রধানমন্ত্রী আমার ওপর যে আস্থা ও বিশ্বাস রেখেছেন, তা যেন রক্ষা করতে পারি সেজন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। টিম ওয়ার্কের মাধ্যমে পরিকল্পনামন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেই উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে চাই।
ড. শামসুল আলম আরও বলেন, ২০০৯ সালে থেকে এখন পর্যন্ত সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের ১১৪টি প্রকাশনা হয়েছে। অথচ ১৯৭২ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রকাশনা হয়েছে মাত্র ১৪টি। আমার হাতে যতগুলো পরিকল্পনা হয়েছে সবগুলোই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। সবার প্রশংসাই পেয়েছি। বিসিএস পরীক্ষায় পাশ করার পর আমাকে শিল্প মন্ত্রণালয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু আমি যাইনি। কারণ পরীক্ষার ফল প্রকাশ হতেই দেড় বছর দেরি হয়েছিল। ওই সময়ের মধ্যে আমি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম। তাই সেখান থেকে আর বের হতে পারিনি। জিইডিতে দায়িত্ব নেয়ার সময় কোনো পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ছিল না। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-এর পরামর্শে সে সময় পিআরএসপি ছিল। হঠাৎ করে পরিকল্পনা থেকে বেরিয়ে আসাটা তখন ছিল সংবিধানের লঙ্ঘন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর আবারও পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ফিরে আসা হয়েছিল।
ড. শামসুল আলম ১৯৫১ সালের ১ জানুয়ারি চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে ১৯৬৫ সালে কৃষি অর্থনীতিতে স্নাতক ও ১৯৭৩ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৮৩ সালে ব্যাংককের থাম্মাসাট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ও ১৯৯১ সালে ইংল্যান্ডের নিউ ক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
ড. শামসুল কর্মজীবনে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন। তিনি ৪ বছর তিন মাস জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচীতে ২০০২ থেকে ডিসেম্বর ২০০৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশি কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করেন। ২০০৮ সালে তিনি জার্মানির হুমবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয়, বেলজিয়ামের ঘেণ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং অধ্যাপক এবং নেদারল্যান্ডের ওয়াগিনেঞ্জেন ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড রিচার্সে ইরসমাস মুন্ডুস স্কলার হিসেবে কাজ করেন। এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাকাল্টি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
২০০৯ সালের ১ জুলাই প্রেষণ ছুটিতে সরকার তাঁকে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে। ২০১৫ সালে কমিশনের সদস্য থাকাবস্থায় তাঁকে জ্যেষ্ঠ সচিব করা হয়। ২০১৬ সালে অধ্যাপনা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কমিশন সদস্য হিসেবে তাঁর মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর কয়েকবার তাঁর মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ২০ জুন পুনরায় সরকার তাঁকে তিন বছরের জন্য নিয়োগ প্রদান করে। শামসুল আলম ৩০ জুন ২০২১ সাল সিনিয়র সচিব থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
পরিকল্পনা কমিশনে দায়িত্ব পালনের সময় তিনি ‘বাংলাদেশের প্রথম প্রেক্ষিত পরিকল্পনা’ (২০১০-২০২১) ও ‘ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা’ (২০১১-২০১৫) প্রণয়ন করেন। তিনি ‘বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন কৌশলপত্র’ (২০১১-২০২১) ও ‘সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র’ (২০১৫-২০২৫) নীতিমালা প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি বাংলাদেশে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জন বিষয়ক বেশ কিছু প্রতিবেদন, অধ্যয়ন ও গবষণা গ্রন্থ সরাসরি তত্ত্বাবধান ও সম্পাদনা করেন।
শামসুল অর্থনীতি বিষয়ক ১২টি গ্রন্থ রচনা করেন যার মধ্যে গবেষণা ও পাঠ্যপুস্তক অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও তিনি ১৮টি গ্রন্থ সম্পাদনা করেন ও তার ৪৮টি গবেষণা প্রতিবেদন বিভিন্ন সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে।
২০১৮ সালে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকনোমিক মডেলিং তাকে ইকনোমিস্ট অব ইনফ্লুয়েন্স পুরস্কারে ভূষিত করে। এছাড়াও একই বছর তিনি বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি স্বর্ণপদক, বাংলাদেশ শিক্ষা পর্যবেক্ষণ সোসাইটি কর্তৃক ‘নজরুল ইসলাম স্মৃতি পদক’ লাভ করেন। ২০২০ সালে অর্থনীতিতে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদক প্রদান করে।